তৈমুর খান
দারিদ্র্যই যাঁর অহংকার, চাষার ছেলে হওয়াই যাঁর গর্ব এবং বেকারত্বই যাঁর ভূষণ—সেই কবি রুদ্রপতি। গ্রাম্যতার আজন্ম লালিত পরিবেশে কবিতায় এক অসাধারণ মিথ সৃষ্টি করেছেন। কবিতা যদি আত্মবাদী চেতনায় নিগূঢ় ব্রহ্মানন্দকে ধরার প্রয়াস হয় তবে তা ব্যর্থতা, শূন্যতা এমনকী আত্মহত্যারও চূড়ান্ত রূপান্তর। যে কারণে কবি আশ্রিত হতে চান শব্দে, স্বপ্নে, তাঁর সৃষ্টিতে। অর্থাৎ যাবতীয় পার্থিব ক্লেদ থেকে গ্লানিমুক্ত এক অলৌকিক ধারা সংগীতের নিক্কণ শ্রবণে কবি তৃপ্ত হন। শেলী যাকে বলেছেন—’Invites to love with her kisses divine……… কবি যখন পার্থিবের চাওয়া-পাওয়ায় ক্লান্ত, বিবর্ণ—তখন নিজেকে তাঁর অবহেলা আত্মধিক্কার থেকে তুলে হতাশার নির্বাপিত চান। এই কারণেই শেলি আবার বলেছেন-‘I gasp. I faint, till they wake again’ রুদ্র পতির কবিতায়ও এই রূপান্তর ঘটেছে। জীবনচর্চিত বাণীকেই তিনি কবিতায় ধরেছেন। ছক বাঁধা চিরাচরিত রীতিতে ভালো ছেলের মতো তিনি উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়ে শহুরে বিলাসবহুল জীবন কাটাতে চাননি কেমেস্ট্রি অনার্স পড়া অসমাপ্ত রেখেই হাতে তুলে নিয়েছেন কবিতা লেখার খাতা-কলম। এসব নেহাৎই হাস্যকর বলে মনে হবে উজ্জ্বল কেরিয়ার ছেড়ে একটা অবহেলিত অন্ধকার জগতে প্রবেশ। কিন্তু প্রকৃত কাব্যরসিকেরাই জানেন যাঁর হৃদয়ে কাব্যরসের অবস্থিতি সেখানে রসায়নবিদ্যার শুষ্ক গাণিতিক সূত্রগুলি কত অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং রুদ্রের কাছে কবিতা-ই হয়ে উঠল মনচষা কৃষকের ক্ষেত্রভূমির ফসল। এখানেই তাঁর জীবনের নিরূপিত ব্রহ্মানন্দের অবগাহন এবং সৃষ্টি দর্শনে চরম সন্ধিকাল। মাত্র পাঁচটি কাব্যে কবি তুলে ধরলেন তাঁর সমীহ যাপনগুলি—
১) প্রান্তিক চাষা (১৯৯৩)
২) লেদ অথবা অসংপৃক্ত হাইড্রোকার্বন (১৯৯৩)
৩) এ বছর শ্রাবণ ভালো (২০০৪)
৪) বেকারের কবিতা (২০০৪)
৫) গুচ্ছমূল (২০০৫)
পাঁচটি কাব্যেই কবির কৈশোর যৌবনের গ্রাম্যজীবনের নানা স্পন্দন, বিদ্রোহ, অভিমান, প্রেম এবং প্রাত্যহিক মুকুলিত হয়ে উঠেছে। শব্দের নিবিড় সংশ্লেষে এক নিরক্ষীয় বলয়ের ভেতর তাঁর ভৌগোলিক অবস্থানকে জৈবসত্তায় রূপ দিয়েছেন। মননজীবী কবির কাছে এইসব কাব্যের কবিতাগুলি এক একটি মুহূর্ত খণ্ডের সমষ্টি লাভ করেছে। কয়েকটি শিরোনামের ভেতর পর্যায় ক্রমিকভাবে হাঁটলে কবিকে পরিক্রমা করা যাবে।
১
আমি সেই অববাহিকার প্রাচীন চাষী
সভ্যতার আদিচেতনার স্তর থেকে রুদ্র চিরকালীন এক কবিতার কাছে আমাদের টেনে নিয়ে যান, যে প্রবৃত্তিমুখীন চেতনায় মিশে থাকে আদিম অভিমান, জৈব তাড়নার যাবতীয় শর্ত। প্রথম আগুন জ্বালানো, আগুনে মাংস ঝলসানো, নারী-পুরুষের টান, ঘর বাঁধা, সন্তান-সন্ততির জন্ম দেওয়া এবং জীবিকার জন্য আদিম বৃত্তি কৃষি ও পশুপালনকেই গ্রহণ করা সবই রুদ্রের কবিতায় অমোঘ দিশারী। শহরের আলোকিত জীবন থেকে বহুদূরে গ্রামের প্রান্তিক চাষা হয়ে দু-বেলা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের স্বপ্নে বিভোর থেকে, মেঘ ও মাটির সঙ্গে জীবনের সূত্র রচনা করে, নোনা স্ত্রীর পাশে শুয়ে, চাঁদ ও নক্ষত্র দেখে, মৌসুমি বাতাসের অপেক্ষা করে, গরুর গাড়িতে চড়ে অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ করে, তালপাতা কেটে পুকুরের জলে দিয়ে গুগলি-শামুক তুলে, সাপ ভর্তি নদী-নালা- জলাশয়ের ভেতর ঘর বেঁধে কবি জীবন কাটিয়ে দিতে চান। শরৎ-আশ্বিন-মাঘ সংক্রান্তি একে একে সবই আসে কবির জীবনে। ফসল ভালো হলে বউকে শাড়ি কিনে দেন। ফসল খুব ভালো হলে বউকে ধান ফুলের মতো কানের দুল পর্যন্ত দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। গ্রাম্যজীবনের এক অনাচ্ছিত প্রশ্রয়, ব্যাকলুতা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপট রচনা করেন। সেখানে ঋতুর পর্যায়ক্রমিক প্রভাব পড়ে। খরা, বর্ষা, শীত, হেমন্ত, শরৎ, বসন্ত সব ঋতুই মানুষের জীবনে স্বাক্ষর রাখে। পলাশ, মহুল, শাল, শিমুল সমস্ত গাছগুলিই তাদের পত্র-পল্লবে পুষ্পে আনে বিভিন্ন সওগাত। আবার আঞ্চলিক নানা উৎসবও এই সূত্রে পালিত হয়। বিশেষ করে কৃষক পরিবারে সংক্রান্তি, নবান্ন, লক্ষ্মীপূজা, বাহাপরব প্রভৃতি। লোকজীবনের সঙ্গে এক আনন্দের সূত্রপাত ঘটে। সাপ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য যেমন মনসা পূজা, তেমনি বৃষ্টি হওয়ার জন্য গ্রাম ঠাকুরকে পূজা করা অথবা নাচনির সিন্দুর পাহাড়ে নাচাও উৎসবের মধ্যেই পড়ে। এসবেই ঘটে লোকায়ত ভাবনার প্রকাশ। কৃষক জীবনের নানা টানাপোড়েনের সংসার, ধারদেনা, অভাব-অভিযোগ থাকেই। কখনো হালের গরুও বিক্রি করতে হয়। কিন্তু গরুর চোখের জলও কবির চোখ এড়ায় না। আবার ফাঁকা মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রাঘাতে কৃষকের মৃত্যু একটা সংসারকে পথে বসিয়ে দেয়। সেই ঘরের নাবালক ছেলেকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। মাঠে নামতে হয় কাজ করতে। বাজ পড়াকে ভয় পেলে চলে না। কখনো সর্পাঘাতেও মৃত্যু আসতে পারে। তবু জীবনযুদ্ধকে এড়িয়ে গেলে হয় না। খড়ের অথবা টালির চাল, বাঁশের জঙ্গলের পাশে মাটির ঘরে, কেরোসিনের টিমটিমে প্রদীপ জ্বেলে এই চাষীকেই বসতে হয় কবিতা লিখতে। শব্দ খুঁজতে হয় নিজেরই জীবনবোধের ভেতর থেকে। অর্থাৎ কৃষিকাজের সঙ্গে কবিতা লেখারও, বীজ বোনার সঙ্গে শব্দ খোঁজারও, স্বপ্ন দেখার সঙ্গে ভালো ফসল ফলারও আকাঙ্ক্ষা একই দ্রাঘিমায় মিলিত হয়।
আদি সভ্যতার চিরন্তন পথিক রুদ্র এ ভাবেই প্রতিটি পর্ব লিখে চলেন। লোকজীবনের নানা সংস্কার থেকে কখনো মুক্ত হতে চান না। রসায়নবিদ্যাকে এখানে আনতে চান না। মানবীয় সুকুমার সম্পর্কগুলিকে স্পর্শ করেন। তাই যে খড় গরুকে খেতে দেন, সেই খড়েই বিছানা পাতেন। যে জীবন বাউরির ষাঁড় এনে গাভী আবাদ করেন, সেই জীবন বাউরিকে এক বোতল দেশী মদের দামও দেন, চারগণ্ডা খড় দেন; এই খড়ে শুয়েই মিলিত হন তাঁর মানুষীর সঙ্গে— সুতরাং পশু এবং মানুষের জৈব প্রবৃত্তির কোনও তফাত নেই। বকনা বাছুর হলে যেমন বাড়ির লোক খুশি হয়, তেমনি ছেলে-শিশু হলেও খুশি হয়—এও লক্ষ করেন। ভোটের তালিকায় পদবীকে মান্যতা দেওয়া হয় এটাও কবির চোখ এড়ায় না। সেখানে জীবন বাউরির নাম লেখা হয় ‘বাউরি জীবন’, কিংবা ‘বাউরি পবন’। ক্ষেতমজুর নিঃস্ব অসহায় মানুষগুলির জীবিকার সঙ্গে কৃষি সভ্যতার যে অবিচ্ছেদ্য সংযোগ সেটি দেখিয়েছেন কাব্যগুলির অধিকাংশ কবিতাতেই। গাই-গরুও যেমন কাছের, তেমনি ফসল মাঠ বৃষ্টি-মেঘও খুব কাছের, সেই সঙ্গে চাষী বউও। সকলের পারস্পরিক ভালবাসার মাধ্যমেই এই মহাবৃত্ত রচনা। গ্রামদেশ আকীর্ণ করে আছে এই লোকজীবনের সম্পর্ক। তাই কবিও লিখেছেন—
“শাঁখা ও চুড়ির শব্দে গৃহস্থের সুর
সমস্ত অমঙ্গলের বিরুদ্ধে শাঁখ বাজে
প্রদীপ জ্বলে ওঠে।”
(গ্রামদেশ: প্রান্তিক চাষা),
গৃহস্থের পরিপূর্ণতা এনে দেয় গৃহস্থের বউ, শাঁখা-সিঁদুর, শঙ্খধ্বনি, তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বালানো। ফসল ভালো হলে এসবের সঙ্গেই কৃষকবাড়িতে সুখ ফিরে আসে। আবহমানকালের সভ্যতায় কবি দেখেছেন নদীমাতৃক জীবনের প্রতিচ্ছবি। নারী এবং জমি একই রূপের দুই পিঠ। যখনই অন্নের সংস্থান হয়েছে, যখনই সুখের মুখ দেখেছেন তখনই নারীর কোমল হাসির স্নিগ্ধ রেখাটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। চাষ করা আর সন্তান জন্মানোর প্রক্রিয়ার কোনও তফাত নেই। কবি সভ্যতার খবর দিয়ে বলেছেন—
“বাতাসে জলের গন্ধ ভেসে আসে, জল-শব্দ বীজগুলি আলোকিত করে
এইখানে সূর্য ওঠে। নদী তীরে
মানুষের প্রাচীন বসতি।”
(মেঘে মেঘে: এ বছর শ্রাবণ ভালো)
যাযাবর বৃত্তি থেকে কৃষি সভ্যতায় উত্তরণ ঘটার পরই গোষ্ঠীতন্ত্র তথা দাম্পত্য জীবনের সূত্রপাত ঘটে। তখনই নারী-পুরুষের আসঙ্গ লিপ্সা জেগে ওঠে, কাছাকাছি আসতে চায় ‘শিহরিত দুইটি শরীর’। বুকের ভেতর মাদল বেজে ওঠে। নদী জল—শরীরের টান, আর পলিতে সবুজ ফসল। নারীকে চুম্বন করেই যেন নদী জেগে ওঠে। নদী চিরদিনই কালের প্রতীক আর সমুদ্র সেই কালের পরিমাপে আবদ্ধ। টি.এস.এলিয়ট ‘ড্রাই স্যালভেজেস’ নদীর বর্ণনায় সে কথা বলেছেন—’The river is within us, the sea is all about us.’ নদী সভ্যতায় রুদ্র পতিও এই ভাবনায় চালিত হয়েছেন। আমাদের জন্মান্তর পর্বের ভেতর যুগ যুগ ধরে নদী ভালবাসার মধ্যে দিয়ে সভ্যতার অগ্রসরতা লক্ষ করেছেন। যেহেতু আমরা নিষ্কাম কর্মের অভ্যাসে বিশ্বাসী নই, সেহেতু আমাদের প্রার্থনার মধ্যেও সন্তানকে দুধভাতে রাখার আদর্শ ধ্বনিত হয়েছে। উত্তর প্রজন্মের জন্য আমাদের আকুলতা, পরিশ্রম, চাষাবাদ এবং ঘর বাঁধা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মেনে নিয়ে জীবনবোধের আকরিক থেকে ইস্পাত খুঁজে আনা। এই ব্যত্যয় থেকেই রুদ্র পার্থিব ঈশ্বরের কাছেও মাথা নোয়ান—
“চাষ আমার ধর্ম এবং জীবিকা
অথচ এমন তো হবার ছিল না;
কেন আজো মন উসখুশ করে, ঈশ্বরকে প্রণাম
করার বিনিময়ে
বলি মেঘ দাও, বৃষ্টি দা;ও নিষ্কাম চাওয়া নেই প্রণাম করার বিনিময়ে এই মন চেয়ে বসে মেঘ
আরো প্রণাম করি সরকারকে বলি—ভোট দেবো
অনুরোধ ধান ও আলুর দাম ফেলে দিও না, দিও না;”
(আত্মদহন: গুচ্ছমূল)
একজন কৃষকের এই আন্তরিক প্রার্থনা কতখানি জীবন্ত তা গ্রামবাংলার প্রতিটি মানুষ জানে। প্রতিবছরই ফসলের দাম না-পাওয়া কৃষক কিংবা প্লাবনে ফসল নষ্ট কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয়। পানচাষীর আত্মহনন ফি বছরই ঘটে। কখনো বৃষ্টির অভাবে কৃষকের চাষাবাদ হয় না। আকাশের বৃষ্টিনির্ভর বলেই প্রাকৃতিক বিশ্বাসে পরোক্ষে কৃষকেরা ঈশ্বর নির্ভর হয়ে পড়েন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ দাম্পত্য জীবনেও ফাটলের সৃষ্টি করে। বর্ষার শান্তি বারিধারা এলেই সব প্রশমিত হয়। শাক দিয়ে মাড়-ভাত খাওয়া চাষার জীবন সজনে গাছের কাটা ডাল পুঁতে বর্ষাকালে, গোবর দিয়ে উঠোন নিকোয় চাষার বউ, ঝরা পাতা আর মরা কাঠ দিয়ে ভাত রান্না করে। বর্ষা এলেই উর্বর মাটি সন্তান ধারণের নারীর মতো হয়ে যায়। বাতাসের শব্দ-তরঙ্গে বৃষ্টির আভাস পান কবি। সব মিলিয়েই কবির জীবনরসায়ন। ধান, গম, আলু, সরষে, তিল-তিসি ফসলের সঙ্গে সঙ্গে কবির দাম্পত্যজীবনের ছবি আর মাঝখানে কবিতার চাষ যেন ত্রিবেণী সঙ্গমে পৌঁছে দেয়। কাব্যের নাম যখন ‘গুচ্ছমূল’ তখন বুঝে নিই সমস্ত ফসলের কথাই কবি বলছেন। বিশেষ করে ধান, গম, আনাজপাতি সমস্তই—কেন-না, এরা বর্ষজীবী ফসল। একবার ফল দান করেই মারা যায়। কবির জীবনক্ষেত্রও সেই গুচ্ছমূলেরই আধার। যেখানে চলমান স্বপ্নের বাস্তবায়নে রূপরেখাটি কবিতায় প্রকাশ লাভ করে। কৃষক ও কবি একই সত্তার অধিকারী কলম ও লাঙল একই যন্ত্রের দ্বিমুখী প্রজ্ঞাপাত—একটি কর্মপ্রজ্ঞা, অপরটি ভাষাপ্রজ্ঞা। দুটিই জীবনের মূল বিধেয়কে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। সুতরাং রুদ্র কবি বলেই কর্মপ্রজ্ঞাকে ভাষায় বিস্তৃতি দেন। কবিতাকে প্রাণ থেকে তুলে, মাটি থেকে তুলে, স্বপ্ন-বাস্তবের সংযোগরেখায় অনন্তকালের অনুভূতিতে পর্যবসিত করেন।
২
শরীরের টানে নৌকা ভেসে যায়
শরীরই মনের আধার। শরীরকে ঘিরেই মন পল্লবিত, আবর্তিত। কামনা, আগুন যেমন অর্ন্তদাহ আনে, তেমনি নারীভাবনাকেও উজ্জীবিত করে। ভালবাসার আবহাওয়া সংবাদ ঋতুপর্যায়ের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দেয়। তখন রাতজাগা, বিভ্রম বসন্তের পলাশ-শিমুলের রাঙানো পথে ‘রাত্রিব্যাপী শরীরে লবণ চলাচল বাড়িয়ে দেয়’। গোপন প্রণয় বেড়ে চলে। তখন শুকনো নদীতেও জলের তরঙ্গ, সব যুবতীই তন্বী রাধার মতো অভিমান কাঁখের কলস ভাঙে। মাদল বাজানো রাতের মায়ায় দীঘল চোখের হরিণীরা এগিয়ে যায়। বুকে ঢির ঢির শব্দ। দারিদ্র্যরেখার ভেতরেও অমোঘ অথচ বিপন্ন এক ইস্তেহার, লেদের মেশিনেও করাতকলেরও যন্ত্রধ্বনি প্রেমেই কার্বন উগরে দেয়। ঝুমুর, ছৌনাচ, টুসুগান, ভাদুগান, সিঁদুর পাহাড়ে কোমর দোলানো নাচ, অ্যামিনো অ্যাসিডে অভিষিক্ত ধারাবাহিকভাবে প্রেমের শীর্ষমুখ জেগে ওঠে। জীবনের রক্তের দাগ, যন্ত্রণা, স্তব্ধতার মধ্যেও হারমোনিয়ামের সুর ঘোরে। এক আদিম অথচ আশ্চর্য প্রেমের বোধের কাছে আত্মবীক্ষণের মর্মর গ্রহণকে কবি রূপ দিয়েছেন। সভ্যতা, দারিদ্র্য, শ্রেণি সংগ্রাম, বিভেদ-বিপন্নতা নিয়ে এলেও বয়ঃসন্ধির মোহময়তা, নিঃসঙ্গতা, ভোগ ও যৌনতা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেনি। সেখানেই থেকে গেছে রহস্যের চরম ক্ষরণ যাতে দৈনন্দিনের জীবিকায় উদ্বেল নার্সিসাস ধরা দিয়েছে—
“আয়নায় মুখ দেখে চমকে উঠেছ তুমি, এ্যাতো ক্ষত দাগ!
শুকনো নদীর পাশে গ্রামদেশ কুপির আলোতে প্রায় ম্লান;
বাঁশি বাজাতে গিয়ে রক্ত….
কিছুটা পরাগ”
(আলো-অন্ধকার: লেদ অথবা অসংপৃক্ত হাইড্রোকার্বন)
এই ক্ষতচিহ্ন দেখে নদী চমকে ওঠে।
সবই ‘যৌনতার দাগ; অসংপৃক্ত জৈব যোগে ঘোরে আর্তনাদ’…আমরা জানি নারী ও নদী দুই-ই সৃষ্টির প্রতীক যোনি ও পলিসম্ভূতা। জীবন আর জীবনের রসদের আধার। সুতরাং কবির কাছে নারীও নদীতে রূপান্তরিত। দুই-ই প্রেমের ভালবাসার দাবি নিয়ে উপস্থিত। সেই কারণেই মেয়েদের হোস্টেলে নদীবাস করে, আবার মেয়েরাও কতবার নদী হয়ে যায়। যন্ত্রণার তিল তিল সঞ্চয়ে নদীকেই প্রার্থনা করেন। বিরহে, চাষী জীবনের দুর্ভিক্ষে, নিঃসঙ্গতায় নদীকেই ডাকেন। নদীপ্রেম সভ্যতার, নদীপ্রেম পুরুষের, নদীপ্রেম কবিরও। ‘রক্তের ভেতর মৃত নদীরা’ সহসা বৈশাখে জেগে ওঠে। খরা যখন নিত্যদহনে জীবনকে নিংড়ে নেয়, তখন কবি অনুভব করেন—
“প্রণয় মুদ্রায় নত নারী…তবু ফেরা, মৃত নদীপাশে
আমি যাকে ভালবাসি তার উঠোনে এসে
গুটি কয়েক কবিতা এ বছর শূন্য হাতে যাই;”
(খরা: প্রান্তিক চাষা)
মরা নদীকে বুকে শুইয়ে রেখে লেখেন কবি মেয়ে হোস্টেলের কবিতা। কখনো ভুলতে পারেন না চাষী জীবনের পড়ে থাকা লাঙল কাঁধে জীবনচাষা, ঝুমুরওয়ালির গান শোনা, বর্ষার দিনে ভিজে যাওয়া, দারিদ্র্যের টানে হু হু কেঁপে ওঠার কথা। এক্সচেঞ্জের কার্ড, সার্টিফিকেট সব হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে, বেকারত্বের আর্তনাদে হতাশায় ডুবে যেতে, ছাঁটাই শ্রমিকের দলে মিশে যেতে, ফুটো ফুসফুস কাশি ও রক্তের দাগে প্লাবিত হতে হতে কবি লিখতে পারেন—
“ফুটো ফুসফুস, কাশি ওঠে, রক্তদাগে প্লাবিত যাত্রাপথ
তবু, কবি ভাসিয়ে দিয়েছে নৌকা
চন্দ্র ওঠা রাত আর মানতরত সেই মেয়েকে দেখেছি।”
(স্বপ্নের নৌকাগুলি: বেকারের কবিতা)
সেই মেয়ের টানেই ‘আই.টি.আই থেকে লেখা’ চিঠি কবি পোস্টবাক্সে ফেলেন। মেয়েটিকে বোঝান তাঁর যন্ত্রণায় কাঁপা গ্রামের কথা। ফাগুন মাস, লণ্ঠনের আলো, রাতের আকাশ, শ্রমিকের শুকনো মুখ, শাঁখের আওয়াজ, চিতিসাপ, কালো সাপ সমস্ত বোঝান। আর ডাকবাক্সে খোঁজ করেন তার যদি চিঠি আসে। তা হলে তাঁর প্রতীক্ষা সার্থক হবে। শ্রাবণের সম্ভাবনা গাঢ়তর হবে। এভাবেই গ্রামজীবন তথা কৃষকজীবনের আর্তি ও আরতি নিয়ে কবি অপেক্ষা করেন ও আশা করেন—
“এ বছর শ্রাবণ; করজোড়ে বর্ষণের আকুলতা প্রতিটি রেখায় যেন নদী পাই
প্রতিটি বিন্দুতে জলাশয়; বহুদিন নৌকা বাইনি, বহুদিন ঘাটে লাগেনি তরী।”
(এ বছর শ্রাবণ ভালো)
নদী-নৌকা, নারী-পুরুষ, চাষী-কবি এক-একটি রূপকের ভেতর মানুষের জৈবিক প্রবৃত্তিগুলি নিহিত হয়েছে। চর্যাপদের শবর-শবরীর মতো প্রণয়লীলায় এও এক শিকার কাহিনি। আবহমানকালের সেই স্রোতস্বিনী নদীকেই নারী মর্যাদায় তুলে ধরেছেন। বৃষ্টিফোঁটাগুলি যেমন স্রোতে হয় নদী, তেমনি কিশোরী মেয়েটি হয়ে ওঠে নারী। নদীকে বাঁধ দিয়ে যেমন উর্বর মাটি অথবা সেচসিক্ত মাটিতে পরিণত করা হয়, তেমনি নারীকেও বিবাহের শিকল পরিয়ে করা হয় গৃহিণী। দুইয়েরই ভালবাসা সভ্যতা ও মানব জীবনের ধারক ও বাহক। এই চিরন্তন কথাটিও কবি বলেন—
“একটি মেয়ে ক্রমাগত নারী হয়ে উঠছে
সমস্ত হরমোন রক্তের ভেতরে জড়ো হয়ে
তাকে সন্তান লালন পালনে উৎসাহ জোগায় নদী জাগে, জেগে ওঠে ঘর গেরস্থলি।”
(বিস্তার: গুচ্ছমূল)
এখানেই নারী ও নদীর বিস্তার। শরীরের টানে
কামনার জন্ম হলেও সভ্যতার কাছে এর ব্যাপ্তির আবেদন ভোলার নয়। রুদ্র এখানেই ব্যক্তি থেকে নৈর্ব্যক্তিকে পৌঁছে গেছেন। কবিতাকে সাময়িক ও সীমানার ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
৩
পাগল করা খিদে এলো। ভাদ্রমাস হাহাকার তোলে
দারিদ্র্যরেখার নীচে বসবাস করে কবি বুঝে গেছেন জীবন নির্বাহ কত কঠিন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ফুল্লরা সুন্দরী নারীবেশিনী দেবী অন্নপূর্ণার কাছে যেভাবে বারোমাস্যা গেয়েছিলেন, কবিও ভাদ্র-আশ্বিন, বৈশাখ-আষাঢ়ের জীবিকার হালচাল শুনিয়েছেন। মুকুন্দরামকে জন্মভূমি দামুন্যা ত্যাগ করে যাওয়ার পথে শালুক পোড়া খেতে হয়েছিল; আর এই কবিকে এতদিন পরও খিদে সহ্য করে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে। বন্ধ কারখানার শ্রমিক হয়ে দিনের পর দিন অনাহার জীবনযাপন করতে হয়েছে। অন্ধ জ্যাঠা এবং অন্ধ পিসিকে নিয়ে দুঃখের সংসারে শাক-মাড়-ভাত খেয়ে কখনো দিনপাত করতে হয়েছে। উনুনের ওপর বিছানা পেতে শুতে হয়েছে, হালের গরু বিক্রি করতে হয়েছে। কতদিন উনুন জ্বলেনি। চোখের জল পড়ে শুকিয়ে গেছে। এসবইতো কবিতা। জীবনকে খুঁড়ে তোলা প্রতিটি কবিতায়। সারাদেশই কবির চোখের সামনে ভেসে উঠেছে—
“একটি ভারতবর্ষের মানচিত্র আঁকতে গেলে যতগুলি রেখা ব্যবহৃত হয়, জেনো তার
সবগুলি কালো কৃষ্ণের…
ছাঁটাই শ্রমিকের
এবং দারিদ্র্যসীমার নীচে অবনত গ্রামগুলির রক্ত উগরে আসা”
(মানচিত্র আঁকতে গেলে: বেকারের কবিতা) ভারতবর্ষের গ্রামগুলি যে অন্ধকারে দারিদ্র্যে পূর্ণ, হাসপাতালগুলি ওষুধ-শূন্য, কর্মহীন হাজার হাজার বেকারে ভর্তি, কালিমাখা লেদের শ্রমিক বৃত্তি গ্রহণ অথবা প্রান্তিক চাষা হয়ে গাই-গরু, ছাগল-ভেড়া ও হাঁস- মুরগি পোষা সবই চলতে থাকে। পুরুলিয়ার রুক্ষ মাটির সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমী সৎ জীবনযাপনের কথাই রুদ্র বরাবর বলেছেন। কখনো ক্ষোভ অভিমান জন্মালেও প্রতিবাদের চরম হাতিয়ার তুলে নেবার বাসনা প্রকাশ করেছেন, তেমনি ফসলে বিষ দিয়ে পোকাদেরও মারতে চাননি, গরুর চোখে জল দেখে গরু বিক্রি করতে পারেননি। ষাঁড় পোষা, গাই পোষা যে কত উপকারী গ্রামের মানুষের তাও বলতে ভোলেননি। প্রাণী ও মানুষের সঙ্গে যে কী স্নেহের সম্পর্ক এবং দরিদ্র মানুষের কাছে অর্থনৈতিক আয়ের কারণ সেটাও বলেছেন। ক্ষেতমজুরদের সারাদিন
জীবিকার জন্য পরিশ্রম, বিকেলে খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নামা যে বিনোদন এটাও জীবনের দাবি। আবার দারিদ্র্যের কারণে, পেটের ভাতের জন্য নারীকে শরীর বিক্রি করতে হয়েছে:
“দারিদ্র্যরেখা শেকল হয়ে গিয়ে দু’পায়ে বেঁধেছে তাকে,
পা ফাঁক মেয়েটি ঈষৎ নীল; ভাত ভালোবাসে।”
(শেকল শেকল: বেকারের কবিতা)
দারিদ্র্য মানুষকে বহু নীচে নামিয়ে দিয়েছে। ঝুমুর গাওয়া শিল্পীজীবনেও মিশে গেছে দারিদ্র্য। কণ্ঠে যে সুর উঠেছে তাও দারিদ্র্যের সুর। অন্ধকারের পর অন্ধকার কবি দেখেছেন। বৈশাখের দুরন্ত সেই দারিদ্র্য রেখা—
“ঝুমুরে ডুবেছে পা। এই উষ্ণবলয়ে রাত্রিকাল অনাহার, দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে ওই সূর ওঠে রাত্রির তরঙ্গে আরো তরঙ্গ যুক্ত হয়”
(বৈশাখ: এ বছর শ্রাবণ ভালো)
এও যেন বারোমাস্যারই রূপান্তর। পলাশ ফুটেছে, কিশোরী শরীরে এসেছে প্রথম ঋতু। স্পন্দনের রাত, চাঁদ জ্বেলে দিয়েছে আগুন; তবু দুর্ভিক্ষে পীড়নে হাহাকারে কলরোল উঠেছে। চোখে অশ্রু, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা নিয়ে মাদল বাজিয়েছে কৃষক, কখনো ধেনোমদ খেয়ে নেচো ভাদুগান, টুসুগান যেন জীবিকার জন্য তারা গেয়ে বেড়িয়েছে। দারিদ্র্য বুকে চেপেই ফসল, প্রেম এবং কবিতা খুঁজেছেন কবিও। দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা বুনেছেন কবিতার শব্দে। দারিদ্র্য নিয়েই সংসার পেতেছেন। ঝুলে যাওয়া স্তন দেখে বুঝেছেন কবির নারী জননী হয়েছে। বাঁশের খুঁটি, খড়ের চাল, উঠোনে দু-চারটে ফুলগাছ আর তারের উপর টাঙানো কাপড়, কেরোসিন স্টোভ, কয়লার উনান নিয়েই কবির জীবন আর এই নিয়েই বাংলা ভাষার সাধনা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে বন্দনা। ঝাপটে ধরে দুই গালে চুমু খাওয়া, জাত-সম্প্রদায় ভুলে যাওয়া মানুষ, শুধু মানুষ হওয়ার সাধনা। সুতরাং দারিদ্র্যের উত্তরণে কৃষক জীবনের গরিমায় কবিতা ভাবনার প্রাবল্যে জীবনের নগ্নসমীহকে ছুঁতে পারেন কবি আর তখনই লিখতে পারেন ‘আনন্দ’—
“লিখি ধামা ভরা চাল, বাটা ভারা পান
লিখি মাঠ ভরা ধান আর গাছ ভরা আম
গাই ভর্তি গোয়াল আর মাছ ভর্তি দিঘি
দূর থেকে আরো দূরে আমাদের সুখ
বেঁচে থাকুক আমাদের সন্তান দুধেভাতে
বেঁচে থাকুক আমাদের সন্তান মাছেভাতে”
(গুচ্ছ মূল)
৪
রাত্রি ছিঁড়ে উঠে এসো পবিত্র সকাল
রুদ্র পতি গ্রাম উঠে যেতে দেখেছেন শহরে। ভাতমুখী গ্রামগুলি নিঃসঙ্গ অভাবে জীর্ণতায় পীড়িত ম্লান হয়ে পড়েছে। এসব দেখতে দেখতে এক কল্যাণ ও প্রার্থনার কাছে আমাদের নিয়ে গেছেন—
“প্রদীপের নীচে এসো আলো
প্রণয়ের ভেতর দাও শিল্পবোধ;
বাঁশের সাঁকোটি পার হয়ে এখনো কষ্ট ঘোচাই।”
(পায়ে পায়ে এই জন্ম: এ বছর শ্রাবণ ভালো)
সমস্ত অর্থনীতির মূল উৎস গ্রামেই নিহিত, কিন্তু চিরকাল গ্রামের মানুষই অন্ধকারে বঞ্চনায় ডুবে থাকে। বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে কাদা পায়ে ঘর ঢোকে। এই কষ্টের পরিবর্তন চাওয়া তো একজন কবির কাম্য। যৌন চেতনা যেমন সত্য, তেমনি গ্রাম্যজীবনে নানা সংস্কারই জীবনকে সুস্থ ও বিশ্বাসী এবং নির্ভর করে তোলে। তাই বজ্রপাত ও খরিশসাপ দেখে মন্ত্রজপ এবং ঈশ্বরকে স্মরণ করেন কবি। বিজ্ঞান পড়েও সপ্তর্ষিমণ্ডলকে সাত ভাইয়ের মায়ের শব-যাত্রা গমন ভাবেন। বৃষ্টির জন্য গ্রামদেবতার কাছে মানত করেন, মনসাকে সন্তুষ্ট করতে সাপ মারেন না। পোয়াতি মেয়েকে লোহার অভাব দূর করতে হালের ফলা চাটতে বলেন। গ্রামে এসবই রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে এবং জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এতদসত্ত্বেও রুদ্র কখনো কখনো উদাসী বাউল হয়ে যান। প্রেমিক সত্তাটিকে গোপন করতে পারেন না—
“এমন ফাল্গুন দিন
পলাশের রাঙা দাগে এ জনম কবিতার অক্ষরে ফুটে ওঠে।”
(দিগন্তে: এ বছর শ্রাবণ ভালো)
কবিতার অক্ষরেই জীবন ফুটে উঠেছে। প্রেম, নারী, সহজিয়া ভাবনা ও কবির নিজেকে জানানোর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—
“চাষাবাদ করেছি মাটি ঘেঁটে
ভালোবাসা ছাড়া আর অন্য কোনো
বুঝবার ক্ষমতা হয়নি আমার;”
(ফের, চাষার কবিতা: গুচ্ছমূল)
এই ভালবাসাইতো চাষাকে কবি-তে পরিণত করেছে। সহজ সরল আত্মবিশ্বাসের কবিতা লিখিয়েছে। আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। দুঃখ জর্জর দারিদ্র্য জীবনের ক্লান্ত, অবসাদ কবিকে পথভ্রষ্ট করে দিতে পারেনি। আগাগোড়া সেই কারণেই আলোর প্রার্থনা—
‘রাত্রি ছিঁড়ে উঠে এসো পবিত্র সকাল’। পবিত্র সকালের প্রার্থনা আজ আমাদের প্রত্যেকেরই।