spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধকাজী নজরুল ইসলামের "কৃষকের ঈদ" : সত্য-সমাজ ও বিপ্লবের চেতনা

লিখেছেন : এ কে আজাদ

কাজী নজরুল ইসলামের “কৃষকের ঈদ” : সত্য-সমাজ ও বিপ্লবের চেতনা


এ কে আজাদ

জীবনে যাদের হররোজ্ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিঁদ
মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক রত্নের নাম, যিনি ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে ইসলামী গান এবং কবিতায় তার অবদান অনস্বীকার্য। প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে নজরুল ছিলেন অদ্বিতীয়। এমনকি এখনও তার মত কোন কবি ইসলামী কবিতা বা গান রচনা করতে পারেননি। মুসলমানদের ঈমান, ইসলাম, আকিদা, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, কুরবানী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা ও গান আজও মুসলমানদের পাথেয় হয়ে আছে। তার কবিতা ও গানে ইসলামের কোরআন ও হাদিসের মর্মবাণী এবং বিপ্লবী চেতনা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত। কাজী নজরুলের হামদ ও নাত ছাড়া যেন মুসলমানদের সংস্কৃতি অসমাপ্ত। বিশেষ করে ঈদুল ফিতরে কাজী নজরুল ইসলামের সেই ঐতিহাসিক গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” না হলে যেন ঈদ অসম্পূর্ণই থেকে যায়; মনে হয় ঈদ আসেনি। এই গানটার ভিতরে মহান আল্লাহ পাকের রাজত্বের ঘোষণা আছে, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের কথা আছে, যাকাত তথা ইসলামী অর্থনীতির কথা আছে, আছে গরিব দুঃখী মানুষের অধিকারের কথা। ঠিক তেমনি অধিকার বঞ্চিত মানুষের জয়গান, মানুষের দাবী এবং ধনিক ও বণিক শ্রেণীর এবং সমাজের জ্ঞানীগুণী আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব কর্তব্য বর্ণিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের “কৃষকের ঈদ” কবিতায়। এই কবিতাটি যেন মুসলমানদের ঈমান, ইসলাম এবং বিপ্লবী চেতনায় বিশেষভাবে উদ্ভাসিত।

কাজী নজরুল ইসলাম পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের সম্যক জ্ঞান রাখতেন। তিনি জানতেন পবিত্র কোরআন শরীফে সূরা যারিয়াত এর ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে– “তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে”। সুরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে– “আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থ দান যারা করে, তারাই সত্যপরায়ন এবং মুত্তাকী। সুরা হাশরের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে– “যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই যেন ঐশ্বর্য আবর্তন না করে।”

১৯৩৭ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঈদ সম্মেলনে প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম ঈদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন– “সকল ঐশ্বর্য সকল বিভূতি আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিতে হবে। ধনীর দৌলতে এবং জ্ঞানীর জ্ঞান-ভান্ডারে সকল মানুষের সমান অধিকার রয়েছে– এই নীতি শিকার করি। ইসলাম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছে। আজ জগতের রাজনীতির বিপ্লবী আন্দোলনগুলির ইতিহাস যদি আলোচনা করে দেখা যায় তবে বেশ বোঝা যায় যে সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রবাদের উৎস মূল ইসলামেই নিহিত রয়েছে। আমার ক্ষুধার অন্নে তোমার অধিকার না থাকতে পারে কিন্তু আমার উদ্বৃত্ত অর্থে তোমার নিশ্চয়ই দাবি আছে– এ শিক্ষাই ইসলামের।” জগতের আর কোন ধর্ম এত বড় শিক্ষা মানুষের জন্য নিয়ে আসেনি। ঈদের শিক্ষার ইহাই সত্যিকারের অর্থ। কাজী নজরুল ইসলামের সে দিনের সেই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই ঈদ বিষয়ক তার কবিতা এবং গানে।

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৫ এবং ৬ ই এপ্রিল কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জুবিলী উৎসবে কাজী নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠানের সভাপতি রূপে তাঁর জীবনের শেষ প্রদত্ত অভিভাষণে প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন– “হিন্দু মুসলমানের দিন-রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনের এক দিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব, অন্য দিকে লোভি অসুরের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য এই ভেদ জ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম।” উল্লেখ্য তাঁর এই অভিভাষণ “যদি আর বাঁশি না বাজে” শিরোনামে সর্বত্রই পরিচিতি লাভ করেছে। অসংখ্য কবিতা এবং গানের মাঝে “কৃষকের ঈদ” কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; যেখানে মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, সম্পদশালীদের সম্পদে গরীবের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেই সাথে এই কবিতাটি মুসলমানদের ঈমান ইসলাম এবং বিপ্লবের চেতনা হিসেবে জনগণের কাছে নন্দিত হয়েছে। কবিতাটির শুরুতেই বলা হয়েছে–

বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন্ মরুর গোরস্থানে!

চমৎকারভাবে শুরু করা এই কবিতায় ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলালকে আহ্বান করে কবি বলেছেন– কোথায় লুকিয়ে আছেন তিনি? তিনি যেন লুকিয়ে আছেন লজ্জায়? কিসের লজ্জা? কেন লজ্জা? এই ব্যাখ্যা কবিতার পরবর্তী চরণগুলোতে পাওয়া যায়। তবে প্রাথমিকভাবে এখানে এটুকু বোঝা যায় যে– হযরত বেলাল (রাঃ) এখন আর জীবিত নেই, তিনি এখন মক্কা-মদিনার সেই মরুভূমির কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। কবি নজরুল মনে করছেন এ যেন লজ্জায় লুকিয়ে আছেন হযরত বেলাল (রাঃ)। কিসের লজ্জা? লজ্জার কারণ এই যে, ইসলামের প্রথম যুগে যখন ঈদ এর প্রবর্তন করা হয় তখন সাধারণ মানুষের ভিতর এর জাঁকজমক অবস্থা ছিল। মানুষের অধিকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু আজকে ধনী গরীবের বৈষম্য এতটাই বেশি হয়ে গেছে যেÑ কেউ কেউ অনেক ধনী হয়ে উঠেছেন; অপরদিকে বেশ কিছু গরিব মানুষ তারা খাবার না পেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে কৃশকায় হয়ে গেছেন। এখানে চমৎকার একটি চিত্রকল্পের অবতারণা করেছেন সমাজ সচেতন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অতীতে গৃহস্থদের গরুগুলো যখন কাজের অনুপযুক্ত হয়ে যেত, তখন কসাইদের কাছে তারা বিক্রি করে দিত। কসাই এই গরুগুলোকে জবাই করে গোস্ত বিক্রি করত। জবাই করার পূর্বে হাটে বাজারে এই গরুগুলোকে যখন নিয়ে যাওয়া হতো, দেখা যেত হাড্ডিসার গরুর কঙ্কাল যেন হেঁটে চলেছে। ঠিক তেমনি ক্ষুধাক্লিষ্ট, অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করা কৃশকায় মানুষগুলো যখন ঈদগাহ্ মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে যায়, মনে হয় যেন মানুষের কঙ্কাল হেঁটে যাচ্ছে। দেখতে পাওয়া যায় বৈষম্যের চিহ্ন। এখন যদি আল্লাহর রাসুল এবং তার সাহাবীরা বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই বৈষম্য দেখে লজ্জা পেতেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত বেলাল (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে তাই তো কবি নজরুল বলেছেন– লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্থানে!

রমজান মাসের রোজার সময় মানুষেরা অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের সাথে ইফতার করে থাকে। কিন্তু আমার দেশের গরিব অসহায় কৃষকেরা ইফতার করে তার চোখের জলে। সারাদিন অনাহার শেষে তাদের ক্ষুধার অন্ন জোটে না। এই অবস্থা দেখে কষ্টে বেলালের আজান হয়তো থেমে যেত– এই ছিল কবির ধারনা। এম মুঠো অন্নের জন্য অভাবের তাড়নায় কৃষক তার নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বন্ধক রাখে। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ঋণ নেয়। সে ঋণ বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। একদদিকে যখন ঋণের ভারে জীবন অতীষ্ঠ, অর্ধাহারে অনাহারে কঙ্কালার দেহের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন পৃথিবীর সন্ধ্যাকাশে উদিত হয় ঈদের চাঁদ। দুঃসহ রাত পাড়ি দিয়ে রমজান মাসের পরে যখন কৃষকেরা ঈদগাহে যায়, তখন পেছনে পড়ে থাকে তাদের অর্থের অভাবে অনাহারী জীবন।

তাদের বুকে ব্যথা আর জ্বালা। তাদের মাথা ঋণের দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঈদের দিন ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়া এ সমস্ত ঋণগ্রস্ত মানুষের ছবি ফুটে উঠেছে কবরি কবিতায়–

থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে
তীর খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির লুটাতে খোদার রাহে।

কাজী নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করেছেন- যে সমস্ত মানুষ ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে ঘুমাতে পারেনি, সেই সমস্ত গরিব কৃষকের ঘরে ঈদ এসেছে কিনা? আমরা যারা ধনী শ্রেণি তারা ঈদে অনেক উৎসব করি। কিন্তু যে সমস্ত লোকেরা প্রতিদিনই অনাহারে থাকে, প্রতিদিনই যাদের কাছে রোজা, সেই সমস্ত এবং না-খেয়ে থেকে যাদের শরীর হাড্ডিসার হয়ে গেছে, যাদের চেহারায় ফুটে উঠেছে কঙ্কালের ছবি, তাদের ঘরে কি ঈদের আনন্দ এসেছে কি না? সেই প্রশ্নই কবির কবিতায়–

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিঁদ
মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

শুধু তাই নয় এ সমস্ত কৃষকের সাথে তাদের বাচ্চারাও না খেয়ে থাকে। বাচ্চাদের মায়ের অর্ধাহার অনাহারের কারণে বাচ্চারা পেট ভরে দুধ খেতে পায় না। কবি নজরুল ইসলাম ঈদের এই বাঁকা চাঁদকে কৃষকের অনাহারে মারা যাওয়া কাফনে আবৃত সেই শিশুর ঠোঁটের সাথে তুলনা করেছেন। একজন শিশু অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে তার শরীর যখন হাড্ডিসার হয়ে যায়, তখন কামানের বা পাঁজরের হাড্ডিগুলোর সাথে কেবল চামড়া লেগে থাকে, এই কৃশকায় হাড্ডিসার দেহের হাড়ের সাথে বাঁকা চাঁদের তুলনা করেছেন কবি। যেন এই বাঁকা চাঁদের ভিতরে সেই পাঁজরের হাড়ের চিহ্ন দেখতে পান কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঈদের নামাজে যখন তাকবীর পড়া হয়, সন্তানহারা বাবার মনে হয় সে যেন তার সন্তানের জানাজার নামাজ পড়ছেন। তার বুকের ভেতরে হু হু করে উঠে অভাব অনটনের কারণে সন্তান হারানোর স্মৃতি। তাই তো লিখেছেন কবি –

একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?
আসমান-জোড়া কাফনের আবরণ যেন টুটে
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে মৃত শিশুর অধর পুটে।
কৃষকের ঈদ! ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার
যত তাকবীর শুনে বুকে তার তত ওঠে হাহাকার!

যিনি ইমাম তার অনেক দায়িত্ব। সমাজের অবহেলিত লাঞ্ছিত মানুষের জন্য তার রয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্য। তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে ঈদগাহ মাঠে বক্তৃতা করেন বা খুতবা প্রদান করেন। কাজী নজরুল ইসলাম মনে করতেন– যে ইমাম একবার এসেছিলেন, যে রসূল (সাঃ) একবার এসেছিলেন, তাঁর সাহাবীরা যখন এসেছিলেন তখন মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘব হয়েছে। কিন্তু এখন যে ইমাম ঈদের মাঠে নামাজ পড়াতে এসেছেন তিনি যেন কেবল ধনীদের ইমাম। তার দ্বারা গরিবদের কোন উপকার হয় না। তার গায়ে থাকে জরীর জামা। আলেম-ওলামাকে বলা হয় ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বা নবীদের ওয়ারিশ। শেষ নবীর পরে আর কোন নবী আসবেন না। সুতরাং আলেম ওলামাদেরকে পালন করতে হবে নবীদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব। কিন্তু আজকে ইমামগণ আলেম-ওলামাগণ তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা এই দুনিয়াতে মানুষের অহংকার থাকবে না, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না বৈষম্য। একজন সম্পদের পাহাড় গড়বে আর অন্যজন না খেয়ে থাকবে এমনটি যনে না হয়। কেউ যেন নিজের গচ্ছিত সম্পদ নিয়ে গর্ব অহংকার না করে। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা হুমাজাহ্র ২ থেকে ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে– “সে ব্যক্তি অর্থ জমা করে এবং তা বার বার গণনা করে এবং সে ধারণা করে যে তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে। কখনো না অবশ্যই হুতামা নামক দোযখে সে নিক্ষিপ্ত হবে।” মুসলিম শরীফের এক হাদীসে আছে– “বিচারের দিন আল্লাহ পাক বলবেন– হে আদম সন্তান! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তুমি তো খাবার দাওনি। আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম তুমি পানি দাওনি, আমি রোগগ্রস্ত ছিলাম তুমি সেবা করনি। তখন মানুষ বলবে– হে প্রভূ, তা কি করে হয়? তোমার তো ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই। তুমি তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তখন আল্লাহ বলবেনÑ আমার অনেক বান্দাহ ক্ষুধার্ত ছিল, তাদেরকে খাবার দিলে আমার খাবার হত। আমার অনেক বান্দাহ তৃষ্ণার্ত ছিল তাদেরকে পানি দিলে আমার পান করা হত। আমার বহু বান্দাহ রোগগ্রস্থ ছিল, তাদেরকে সেবা করলে আমার সেবা হত।” এমনি ভাবে কুরআন এবং হাদিস সবসময়ই দরিদ্র সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলে, তাদের অধিকারের কথা বলে। অভাব দূরীকরণ নিশ্চিত করার কথা বলে। সেখানে এই ইমাম সাহেবের খুতবা শোনে ধনীরা গরিবের পাশে দাঁড়ায় না। গরিবেরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই তো ইমাম সাহেবকে কবি প্রশ্ন করেছেন–

কোথায় ইমাম? কোন্ সে খুৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দ্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে
জরীর পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদগাহে তুমি কি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
নিঙাড়ি’ কোরআন হাদিস ও ফেকা, এই মৃতদের মুখে
অমৃত কখনো দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বল বুকে!

যেহেতু কোরআন হাদিসের আইন বাস্তবায়ন হয়নি, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি, ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, পুঁজির পাহাড় গড়েছে অবিরত; কিন্তু ইমাম সাহেবদের সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ নাই। মুতরাং তিনি ইমাম হন কেমন করে? এমন একটি শাসন ব্যবস্থা চলছে, যে শাসন ব্যবস্থায় তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়, কিন্তু তেল বিহীন মাথায় এক ফোঁটাও তেল দেওয়া হয় না; এই সমাজ ব্যাবস্থা নির্বিঘেœ চলে কিন্তু কোন ইমাম যাকে জাতীয় নেতা বলা হচ্ছে, তিনি এই সমস্ত সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে পারেননি। ধনীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে গরিবদের দিতে পারেন নাই। গরিবদের হক আদায় হয়নি। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাত্র ৩২ বছরের ব্যবধানে সমগ্র মক্কা মদিনায় যাকাত নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ যেই আরবের বুকে ধনী গরিবের ব্যবধান ছিল আকাশ পাতাল, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আদল, ইহসান এবং ইনসাফ। পুঁজিপতিদের নিকট থেকে গরিবের হক আদায় করে দিয়েছে ইসলাম। তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা এনে দিয়েছে, মানুষ মানুষের দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়েছে, মানুষ মানুষের ভালোবাসার সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখনো তো সেই ইসলামই আছে, কিন্তু এখন যেই নেতা আছেন, যে ইমাম আছেন, তার বক্তব্য শুনে সাধারণ মানুষেরা উপকৃত হয় না। ধনীরা গরিবদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসে না, গরিবদের অধিকার রক্ষিত হয় না, মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না, কোরআন হাদিসের করনীয় কি তা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। তাতে বোঝা যায়– এই ইমাম সেই ইমাম নন। তিনি ইসলাম সঠিকভাবে নিজে বুঝতে পারেননি এবং ইসলামের মর্মবাণী কি তা সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেননি। শুধুই তোতা পাখির মত মুখেই পড়েছেন পাক কুরআন এবং রসূলের বাণী। তার অন্তরে ঢোকেনি কুরআন হাদীসের মর্ম। তাইতো নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন–

নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি,
হায় তোতা পাখি শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি?
ফল বহিয়াছ, পাওনি’ক রস, হায়রে ফলের ঝুড়ি!
লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় না’ক নুড়ি!
আল্লাহ্-তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান?
শক্তি পেল না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান!
ইমান! ইমান! বল রাত দিন, ইমান কি এতই সোজা?
ঈমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?
শোন মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পূর্ণ যার ইমান
শক্তিধর সে, টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আসমান!
আল্লাহ্র নাম লইয়াছ শুধু, বোঝনি’ক আল্লারে!
নিজে যে অন্ধ সে কি অন্যেরে আলোকে লইতে পারে?
নিজে যে স্বাধীন হইলো না সে স্বাধীনতা দেবে কাকে?
মধু দেবে সে কি মানুষে যাহার মধু নাই মৌচাকে?

অর্থাৎ যখন একজন মানুষ ঈমানের বলে বলিয়ান হয়, ঈমান গ্রহণ করে মমিন হয়, তখন তার ভেতরে একটা শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। সে শক্তি ন্যায় এর পক্ষে, সততার পক্ষের, সে শক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধের শক্তি! সে শক্তি অসত্যের বিরুদ্ধের শক্তি, সে শক্তি মিথ্যার বিরুদ্ধের শক্তি। কিন্তু এখন আমরা বলছি– আমি ঈমানদার, অথচ আমার চোখের সামনে অন্যায় হচ্ছে, আমি প্রতিবাদ করতে পারছিনা। আমার চোখের সামনে মানুষের সম্ভ্রমহানী হচ্ছে, নিরাপত্তাহানী হচ্ছে, মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা থাকছে না, সে নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না, তাহলে আমরা কিসের ঈমানদার? ঈমান মানেই হচ্ছে শক্তি। সে শক্তি স্বাধীনতার শক্তি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার শক্তি। কিন্তু চোখের সামনে অন্যায় চলে, মানুষের স্বাধীনতা থাকে না, নীতি-নৈতিকতা থাকে না, সেখানে আমরা কি করে নিজেদেরেকে ইমনদার বলে দাবী করি? তাইতো কাজী নজরুলের প্রশ্ন–

কোথা সে শক্তি-সিদ্ধ ইমাম? প্রতি পদাঘাতে যার
আবে জমজম শক্তি-উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন হায় সে শক্তিহীন!
হয়েছে ইমাম, তাহারি খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন!

ইমাম ছিলেন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম, যার পদাঘাতে জমজম সৃষ্টি হয়েছে। ইমাম ছিলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম যিনি নিজের সন্তানকে কুরবানী দেবার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন এবং অগ্নিকুণ্ডে জ্বলবার মত সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এখনকার যেই ইমাম তার কোন শক্তি নেই, তার কোন সিদ্ধি নেই। অন্যায়ের কাছে মাথা বিক্রি করে সে হয়েছে জাতির নেতা। ফলে তার চোখের সামনে শত অনাচার ঘটলেও সে কিছু বলার মত সাহস দেখাতে পারে না। প্রতিবাদ করার মত শক্তি তার নেই। যেহেতু ইমামেরই এই দশা, তখন মুসল্লিদের আর কি হবে? যা হবার তাই হচ্ছে। অনাচারে অবিচারে নিমজ্জিত হচ্ছে গোটা জাতি।

তাই তো কাজী নজরুল ইসলাম আকাক্সক্ষা করেছেন এমন একটি দিনের, যেদিন মানুষের ঈমান হবে শক্তির পরিচায়ক। মানুষের ঈমান হবে সত্যের পরিচায়ক, মানুষের ঈমান হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার শক্তির পরিচয়ক। আর ইমানের বলে বলীয়ান যিনি ইমাম হবেন তিনি তার ইমানী শক্তি দিয়ে, ইমানী জাজবা দিয়ে মানুষের মনে নবজাগরণ সৃষ্টি করবেন। তিনি হবেন সমাজ সংস্কারক। তিনি হবনে বিপ্লবের পথ প্রদর্শক। সেই ইমামের আকাক্সক্ষায় কাজী নজরুল লিখেছেন–

দীন কাঙ্গালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাগিদ
কোথা সে মহান শক্তি-সাধক আনিবে যে পুনঃ ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আসমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি!

এমন একটি সুদিনের কামনা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, যেদিন সমাজের সকল অনাচার মুছে যাবে, সকল অন্যায় সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে, সমাজ থেকে দূরীভূত হবে অবিচার, উৎপাটিত হবে সকল দুর্নীতি; সমাজ হবে একটি স্বর্গরাজ্য। মানুষের মনে কষ্ট থাকবে না, সমাজে দুঃখ থাকবে না, সবার মুখে থাকবে কেবল হাসি। পরিশেষে, এই কবিতার শেষ চরণে এসে মানবতার কবি, মানুষের কবি, সত্যের কবি, ঈমানের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্যঙ্গ করে বলেছেনÑ যেহেতু এই সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, যেহেতু এই সমাজের মানুষের অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা নেই, সেহেতু সমাজ হচ্ছে কবরস্থানের সমান। মুসলমানদের উত্থান ঘটেছিল জুলুম বঞ্চনার চির অবসানের জন্য। কিন্তু আজকে সমাজের যে মুসলমান সেই মুসলমান জুলুমবাজ, সে জুলুম দূর করতে পারে না। কবরস্থানের মৃত মানুষের সামনে অন্যায় অবিচার ঘটলে, পাপ পঙ্কিলতা সংঘটিত হলে, সেই মৃত মানুষ যেমন তার কোন প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিকার করতে পারে না, ঠিক আজকের এই সমাজও যেন তেমনি হয়ে উঠেছে মরা মানুষে ভরা গোরস্থানের মত, যেখানে অন্যায় সংঘটিত হলে, অপরাধ সংঘটিত হলে মানুষেরা তার প্রতিবাদ করতে পারে না। যেখানে অন্যায় চলে, অপরাধ চলে, মিথ্যা চলে, সেখানে রোজাও হয় না, ইফতারও হয় না। এ সবই মেকী। কেননা বুখারী শরীফের এক হাদীসে আছে যে Ñ “যে ব্যক্তি রোজা রাখলো কিন্তু মিথ্যা কথা বলা ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারলো না, তার অনাহারে থাকাতে আল্লাহর কিছু যায় আসে না।” আর রোজাই যদি না হয় তাহলে কিসের ঈদ? আমাদের তো ঈদই হয় না। সুতরাং এমন একজন নেতার দরকার যিনি আসলে সমাজ থেকে সকল প্রকার খারাপ ও অন্যায় কাজ দূরীভূত হবে। আমাদের রোজাগুলো সেদিন সত্যিকারের রোজা হবে। আমাদের সেহরী এবং ইফতার প্রকৃত পূণ্যের হবে। আমাদের ঈদ সেদনি প্রকৃত আনন্দের হবে। তাই তো এই সমাজকে কটাক্ষ করে সুদিনের প্রত্যাশায় মানবতার কবি, মানুষের কবি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বিদ্রোহী কবি, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন–
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে সেই দিন ঈদ হবে।

গ্রন্থ সহায়িকা:
১. নজরুল রচনাবলী: প্রকাশনায় বাংলা একাডেমি।
২. নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা, সম্পাদনায় আবদুল মুকীত চৌধুরী।
৩. তাফসীরে ইবনে কাছীর: প্রকাশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
৪. বুখারী শরীফ: প্রকাশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
৫. নজরুল কাব্য সমীক্ষা: আতাউর রহমান।
৬. নজরুল কাব্য প্রবন্ধে সাম্যবাদ ও সুফি রহস্য: মোস্তাক আহমাদ।
৭. বহুমাত্রিক নজরুল: সম্পাদনায় হাসান হাফিজ।
৮. নজরুল: অর্ন্তজগৎ, আ ন ম আবদুস সোবহান।
৯. নজরুল কবি ও কাব্য: সম্পাদনায় প্রণব চৌধুরী।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ