মোস্তাক আহমাদ দীন
কয়েক মাস ধরে যে-রাস্তা দিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছি তা সাধারণ এক রাস্তা বটে, কিন্তু একটা জায়গার পর থেকে টানা দু-তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বাঁপাশে একটা রেললাইন চোখে পড়ে। ব্রাঞ্চ রেললাইন। রেলগাড়ি মাঝে মাঝে যায়, সিলেট থেকে খাজাঞ্চি হয়ে ছাতক পর্যন্ত–তবে অধিকাংশই মালবাহী, এবং তাও কয়েকটি বগির সমষ্টিমাত্র। একটি জায়গায় গিয়ে আমাদের গাড়িটি রেললাইনের ওপর দিয়ে ডানপাশ থেকে বাঁপাশে যায়, ফিরতিপথে বাঁপাশ থেকে আবার ডানপাশে ফেরে, কিন্তু এই কয় মাসের মধ্যে ওই রেলগাড়ির জন্য আমাদের গাড়িটিকে থামাতে হয়নি কখনো–এমনই নির্বাধ, নিরুপদ্রব পাশফেরা। যদিও এখানে এমন নিষেধবার্তা রয়েছে যে : ‘এই রেললাইনের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষেধ’, তবু, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই যার-যার মতো করে রাস্তা পার হচ্ছে; বোঝা যায়, কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না রেললাইনটিকে, কারণ এ কোনো মেইন রেরলাইন নয়–ব্রাঞ্চ রেললাইন :
আমি আছি মরচে-ধরা ব্রাঞ্চ রেললাইন
আছি আর কয়টা দিন
জানোই তো সরকার পরিত্যক্ত রেললাইন তুলে দেয়
প্রশাসন মুছে দেয় স্মৃতি
কিন্তু মানুষের মন কি পেরেছে?
সরকার মাসুদের ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ নামক এই কবিতাটি এতদিন আমার এতটা প্রিয় ছিল না, কিন্তু কয়েক দিন ধরে পঙক্তি ক-টি মনের ভেতর গুঞ্জন তুলছে। এই মনেপড়ার কারণটি অবশ্যই বাস্তব–প্রাত্যহিক যাতায়াতের ফল–কিন্তু একথা যে-কোনো পাঠকই বলবেন যে, কবিতাটি তার এই পাঁচটি পঙক্তির মধ্যে এর বাস্তব ভূচিত্র ছাড়াও ধারণ করে আছে আরও দুই প্রকার অর্থের ব্যঞ্জনা। একটি এর অধ্যাত্ম অর্থ : ‘আছি আর কয়টা দিন’; অন্যটি মানুষী : ‘কিন্তু মানুষের মন কি পেরেছে?’ তবে দীর্ঘদিন ধরে সরকার মাসুদের কবিতা পড়ে আমার যা মনে হয়েছে, তাঁর কবিতা মূলত অধ্যাত্মভাবী নয়। তা হলে কি মানুষী? পৃথিবীর অধিকাংশ কবিতা তো আসলে তা-ই। ব্রাঞ্চ রেললাইনরূপী মানুষটি স্বেচ্ছায় কোথাও চলে গেলে বা সরকার বাহাদুর তাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে তুলে নিয়ে গেলে কী হবে জানি না, কিন্তু এখন তো আমাদের ‘মন’ তাঁকে, তাঁর কবিতাকে, কোনোভাবেই ভুলতে পারছে না। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ-এ প্রকাশিত ‘গৃহবধূদের জন্য লেখা কবিতা’ শিরোনামক ‘আদা’, ‘রসুন’ ও ‘পেয়াজ’ নামে সরকার মাসুদের তিনটি কবিতার কথা। এখানে এই ইলশেগুঁড়িদিনে ‘আদা’ কবিতাটি পড়বার লোভ কোনোভাবেই সামলাতে পারছি না :
কে বলেছে আদা ছাড়া মাংসের স্বাদ হয়!
এই নামজাদা মসলার ঘ্রাণ
না থাকলেই আমিষের অপমান
শুক্রবারের মধ্যাহ্নভোজে খাদ্যরসিকের প্লেটে
মুরগি-মুরগি গন্ধ কার ভালো লাগে?
সেজন্যেই কি পাঠশালায় শিশুতোষ শ্লেটে
ড্রয়িং আপা আদার ছবি এঁকে দেয়?
বর্ষাদিনে সর্দিলাগা লোকের চায়ের কাপে
আদা মেঘলা চিন্তার জট খুলে আনে
রাতজাগা টেবিলে প্রুফের তাড়া একগাদা
তাছাড়া আদা, কাঁকড়ার মতো এলোমেলো,
পাকা গৃহিনীর রান্নাঘরে টুকরিতে পড়ে থাকে
আদা জনরুচির উত্তরণে খুশি মনে মনে
আদার ব্যাপারী আজ জাহাজেরও খবর রাখে।
একেকটি কবিতার কবি-তা বা কবি-ত্ব একেক জায়গায় একেকরকম, এই কবিতায় ‘নামজাদা মসলা’, ‘আমিষের অপমান’, ‘আদা মেঘলা চিন্তার জট খুলে আনে’, ‘আদা, কাঁকড়ার মতো এলোমেলো’ এবং ‘আদা জনরুচির উত্তরণে খুশি মনে মনে’–আদার এই প্রাণবান, সক্রিয় [এবং এর অন্তরালবর্তী কৌতুকী/মজাদার] রূপটিই আমার কাছে কবিতা। বাকি দুটি কবিতা আরো উপাদেয়, উত্তেজকও বটে : ‘মধ্যবিত্তের ঝুরি ঝুরি খাদ্যাভ্যাসের/পানাপুকুরে রসুনগুলো পাতিহাঁসের/মতো পাছা উঁচিয়ে ডুবে থাকে’; ‘পেঁয়াজ’ কবিতায় আছে এরকম কিছু পঙক্তিও : ‘কি সংসারী কি ঘরছাড়া মহাযোগী/যেই হোক সে যতদূর যেখানেই যাবে/পেঁয়াজ আছে, পেঁয়াজ একদিন কেঁদেছিল/উৎসববাড়ির বটিতে, এই বোধ তাকে কাঁদাবে।’
এই কবিতা দুটি ছাড়াও সরকার মাসুদের আরও বহু কবিতা এখনো আমাদের যৌথপাঠের অপেক্ষায়। আমার জানা মতে, তাঁর কবিতাবই চলতি বাজারে পাওয়া যায় না, আমি অন্তত খুঁজে পাই না; তাঁর কোনো বই এখন পর্যন্ত–যাকে বলে সুমুদ্রণ–তার স্পর্শ পেয়েছে বলেছে বলেও জানি না। তাই বলে ‘মানুষের ‘মন’ কি তাঁর কবিতা ভুলতে পারছে? আজ কবিতার পাশাপাশি মনে পড়ছে প্রায় একযুগ আগে তাঁর সঙ্গে দেখা-হওয়ার একটি স্মৃতি। কোনো এক ফেব্রুয়ারিতে মেলা যখন ভেঙে যাচ্ছে তখন বাংলা একাডেমি-চত্বরে তাঁর সঙ্গে দেখা; আলাপের ফাঁকে ফাঁকে কেন জানি–হয়ত কোনো বায়বীয় কারণেই–মাঝে মাঝে হেসে উঠছিলেন মাসুদ, আর জিজ্ঞেস করছিলেন তাঁর বন্ধু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কথা। কিশওয়ার কি আর এমনি এমনি তাঁকে উৎসর্গিত একটি কবিতায় লিখেছিলেন : ‘সিদ্ধিরগঞ্জে যাবো/সিদ্ধির দেশের লোক/খোঁজে/সমস্ত আলোক আছে/লক্ষ্যে অলক্ষ্যে ঐ লোকে।’ কিশওয়ার যাঁর খোঁজ করছেন, সেই লোক তাঁর খোঁজ করবে না তো কে করবে? মনে পড়ে কিশওয়ার তখন লড়াই করছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে এবং সেই অবস্থায় নানা গল্পে তিনি মাঝে মাঝে আমাদের কাছে তাঁর বন্ধু সরকার মাসুদের কথা বলতেন।
২
এরপর কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার যখন আমাদের রেখে চলে যান তখন তাঁকে নিয়ে এখানে-সেখানে ক-দিন বেশ লেখালেখি হয়, এরপর সকলেই চুপচাপ। আমরাও যে তার নানা পঙক্তি মাথায় নিয়ে ঘুরেছি, এখনো ঘুরছি, তবু তো তাঁর সম্পর্কে প্রায় নীরবই রয়ে গেলাম, কিন্তু লক্ষ করি সরকার মাসুদ এরই মধ্যে তাঁকে নিয়ে একাধিক গদ্য লিখেছেন। কিশওয়ার যখন চলে যান, তখনো চল্লিশ পেরোইনি, নৌকা তখন উজানে বইছে, আর আজ নৌকা ভাটিমুখী হয়েছে বলেই হয়ত কিছুটা কিশওয়ারমুখী। একা বসলে মাঝে মাঝে কিশওয়ারের ভূত এসে ঘাড়ে চাপে এবং নিজেকে কিছুটা অপরাধী মনে হয়। একবার একটি ছোটোকাগজের আলোচনাকালে তাঁর ছন্দজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম, বলেছিলাম অন্ত্যমিলের প্রতি তাঁর অহেতু অনুরাগ আর ছন্দ-ঔদাস্যের মধ্যকার বিরোধের কথা, অথচ সেই কাগজেই ছাপা হয়েছিল তাঁর একটি কবিতার এরকম কয়েকটি পঙক্তি :
ক্ষয়ে যেতে যেতে আকাশে তাকালে
আকাশ করুণা করে
মানুষের মতো, মানুষ করে না,
ভাগ্যতারা বিরূপ তারকার
শেষ দীর্ঘশ্বাস শোনে
মৃত্যুর ধ্বনিতে।
মৃত্যুর আড়ালে সমাজ-মানুষের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অবহেলার বিষয়টি স্তবকটিতে স্পষ্ট, অন্যত্র ‘ভালোবাসেনি’ কবিতায়ও তো লিখেছেন, কেউ তাকে ভালোবেসে তাঁর বুক-ঠোঁট-চোখ স্পর্শ করেনি, বরং যুগের কিরিচ দিয়ে হৃদয় রক্তাক্ত করেছে। এ-কারণেই হয়ত তাঁর কবিতায় মৃত্যু আর অবদমনের এত এত চিহ্ন। এ-ক্ষেত্রে, হয়ত সমাজ-বঞ্চনার কারণেই, তিনি তাঁর অন্য বন্ধু শোয়েব শাদাবের সগোত্র এবং দু-জনের লেখায়ই রয়েছে যুগপৎ দমিতভাব ও অধ্যাত্মভাবের নানা উদাহরণ। দুজনেই দেখেছেন অমানুষী সঙ্গমদৃশ্য : ‘কুকুর লেহন করে কুকুরীর যোনী/পুরুষ আরশোলা উপগত/সঙ্গিনীর পেলব শরীরে’ লিখেছিলেন কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, আর শোয়েব শাদাব : ‘সংগমে মজে মত্ত কুকুর-কুক্কুরী/যেখানে সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে/লড়াই লড়াই এক দ্রৌপদী পাঁচ পাণ্ডব।’ স্তবকদ্বয়ের পর থেকে দুটি কবিতাই ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গেছে–তা যাক, আমাদের কথা হচ্ছে, একই রকমের দৃশ্য তো আর দু-জন কবি এমনি এমনি দেখেননি, এর ভেতরে অবশ্যই সমাজব্যাপারের রুদ্ধ-বদ্ধ পরিস্থিতি জড়িত। আশির দশকের কবিদের এমন [সম]ভাব-বিষয়ে সমাজবিশ্লেষকেরা কখনো ভেবে দেখবেন হয়ত, আশা করি এ-ও ভেবে দেখবেন কিশওয়ার তাঁর তিন বন্ধু শাদাব, নোমান, মঞ্জু এবং নিজেকে উৎসগির্ত একটি কবিতায় কেন এমনটি বলবেন :
মদিরা নয়ন বানে আমোদিত
আমরা চারজন।
তার যৌন গন্ধময় ঘ্রাণের আক্রোশে
এই তরল যৌবন খাই সুপক্ক ফলের মতো
নিজেরাই নিজেদের সেজদারত
প্রেমিক-ঘাতক হই প্রজ্ঞার ছুরিতে।
এই দ্বন্দ্ব-বিরোধকে বিশ্লেষণ করা খুব সহজ কাজ নয়, এর জন্য সমাজব্যাপারের তলদেশে যেতে হবে। তবে সত্য হলো, এতকিছুর পরেও কিশওয়ারের কবিতায় শেষপর্যন্ত অধ্যাত্মভাবটাই প্রবল, এবং তাঁর দ্বিতীয় বই ‘সংঘর্ষ : আলো অন্ধকার’-এর অনেক কবিতাই এর তূরীয় নজির, যা পড়ে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমরা যারপরনাই আলোড়িত। আলোড়িত, কেননা তখন আমরা কেউ কেউ মনসুর হাল্লাজের নাম শুনেছি বটে, কিন্তু তখনো তাঁর দর্শন ও কবিতার কিছুই পড়ে উঠতে পারিনি। তখনো জানতাম না কেন মৃত্যুদণ্ডের আগে আগে মৃত্যু অবধারিত জেনেও মনসুর হাল্লাজ হাসতে হাসতে একসময় কেঁদে ফেলবেন, কেন তাঁকে পাঁচ শো চাবুক মারা হবে এবং শেষ করে ফেলা হবে এবং কেনই-বা তাঁকে দেখে কান্নায় ফেটে পড়বেন ভক্ত-বন্ধু সুফিরা; হাল্লাজের আমিই সত্য এবং তিনিই সব, আমিই সব এবং তিনিই সত্য প্রভৃতি একাকারত্বের কথাও কি জানতাম? জানলে হয়ত এতটা আচ্ছন্ন হতাম না এই কবিতায় :
আমাকে হত্যা করো
প্রভুর আদেশ।
…
আমাকে হত্যা করে
প্রত্যাদেশে
প্রভুকে হত্যা করো
আমার আদেশে,
আমি-প্রভু
প্রভু-আমি
প্রেমের আলাপ।
আমরা এখন সাবালক হয়ে উঠছি, মনসুর হাল্লাজ পড়ছি, পড়ছি রুমি-হাফিজ-আত্তারও; তবে এখন যেমন দুই যুগ আগের ঘটনায় আলোড়িত হই, আরও দুই যুগ পরেও এখনকার ঘটনায় আলোড়িত হব কি না জানি না, কারণ নাবালকত্বের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাচ্ছে কবিতাক্ষেত্রের নাবালত্বও। আমাদের ক্ষেত্র এখন উর্বর ও উদার, এখন এখানে নামহীন সংখ্যাময় সব ইরিফসল, বেশি ফলনের আশায় যার-যার মতো করেও নির্বিচার রোপন করে যাচ্ছি বীজ, এত এত জন্মব্যাপারের মধ্যে আমরা কি আর তাকাতে পারব শোয়েব শাদাবের মৃত্যুচিত্র-আঁকা কবিতাগুলোর দিকে?
৩
গাণ্ডীব থেকে প্রকাশিত শোয়েব শাদাবের একমাত্র বই ‘অশেষ প্রস্তরযুগ’ যখন কোথাও পাওয়া যেত না, তখন তাঁর কথা–বিশেষত তাঁর বইটির কথা–খুব শোনা যেত। উৎপলকুমার বসু কবিতাসংগ্রহ-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন, তাঁর ‘সামান্য কবিখ্যাতি’র অন্যতম কারণ নাকি তাঁর বইগুলোর ‘দুষ্প্রাপ্যতা’। কৌতুক করে বলুন বা যে-কারণেই বলুন, কথাটি তাঁর নিজের ক্ষেত্রে সত্য না হলেও, শোয়েব শাদাবের ক্ষেত্রেই যেন সত্য হলো। নাহলে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে উলুখড় থেকে শোয়েব শাদাবের কবিতাসংগ্রহ বইটি যখন প্রকাশিত হয়, যেখানে পূর্বপ্রকাশিত ‘অশেষ প্রস্তরযুগ’ ছাড়াও সেই সময়কালে প্রস্তুতকৃত প্রকৃতি ও রঙতুলি এবং অশেষ প্রস্তরযুগ-এর দ্বিতীয় পর্ব এবং শিরোনামহীন অনেক কবিতা থাকার পরও আমরা কি সেই কবিতাগুলোর কাঙ্খিত/যথাযোগ্য মনোযোগ দিতে পেরেছি? আমরা তো এখন সকলেই নানা দিকে, নানা মাধ্যমে সক্রিয় ও তৎপর, একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে হয়ত মনে পড়বে শাদাবের মৃত্যুদগ্ধ পঙক্তিগুলো : ‘বুক যেন চিতাকাঠ, রাত্রিদিন জ্বলে আর জ্বলে/চোখের বরফ ঢেলে করবো শীতল কতো আর/আকাশ সেও তো কেঁদে কেঁদে নিঃশেষে নির্জল’; মনে পড়বে তাঁর ধ্বংস, মৃত্যু আর পরাজয়ের প্রত্নপাললিক কবিতাগুলো :
কোথায় নকশাময় চিত্রিত শহর
রৌদ্রের বন্দর
তা কি সেই অমালোক সমুদ্রের পাড়ে?
সূর্যদেবতার শক্তি ছিলো তোমার বাহুতে
রোমশ শরীরে
আজ নিঃশেষ
আজ পরাজয়।
তাই বলে একথা মনে করবার কারণ নেই যে শাদাবের কবিতামাত্রই মৃত্যু, বিনাশ আর পরাজয়ের কবিতা। একটু এগিয়ে আমরা যদি ঢুকে পড়ি প্রকৃতি ও রঙতুলি বইয়ে, তাহলে দেখব অন্য এক শোয়েব শাদাবকে, আমরা শুনতে পাব কোনো হারেমের কান্নার আওয়াজ :
আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা সেখানে নাচতো।
ঘুঙুরের শব্দে অসীম বৃষ্টি ঝরাতো
আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা।
কিংবা চাবুকের সপাং সপাং আঘাতে
নগ্ন শরীর থেকে
রক্তের লাল নীল ঝরনা বহাতো
আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা।
আর প্রতিরাত অন্ধ খোজার সঙ্গে সঙ্গমে মিলতো
আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা।
আর, অশেষ প্রস্তরযুগ-এর দ্বিতীয় পর্বে পৌঁছে মনে হবে তাঁর কবিতা দমিত-দগ্ধ মৃত্যু-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাইছে–শান্ত হতে চাইছে, দেবীও মৃত্যু-মন্থন থেকে জাগিয়ে তুলছেন তার অস্তিত্ব, আর পাইনের ডাল থেকে রাশি রাশি তুষারকণা ঝরে পড়ছে তাঁর আত্মায়। নিশ্চয়ই শাদাব ও কিশওয়ার–এই দুই কবির আত্মা এখন কোথাও-না-কোথাও শান্তি পাচ্ছে, আমরা তাদের নিয়ে লিখি আর নাই লিখি, বন্ধু সরকার মাসুদ অন্তত মাঝে মাঝে তাঁদেরকে নিয়ে দু-চার লাইন লিখবেন এই আশা তো করাই যায়।
সরকার মাসুদ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এবং শোয়েব শাদাব— তিনজনই সুপরিচিত কবি। এই তিন কবিকে নিয়ে অর্থাৎ তাদের কবিতা নিয়ে মোস্তাক আহমাদ দীন খুবই মনোগ্রাহী ও গরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন ‘‘ তিনজন কবি” শিরোনাম দিয়ে । সাধারণত কবিরাই কবিতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো আলোচনা করে থাকেন। মোস্তাক আহমাদ দীনের এই সংক্ষিপ্ত অবয়বের আলোচনাটিও পড়েও তেমনটি মনে হলো।