মধুসংহার
কত আজব জিনিস যে হয় দুনিয়ায়- মাঝে মাঝে তা প্রক্রিয়া করলে রীতিমত তাজ্জব লাগে। আমাদের বয়স বাড়লে ডিমেনশিয়া হয়- ভুলে যাই আগের কথা, কিছুতেই স্মৃতির কুয়ার কাছে গিয়ে বালতি হাতে আর দাঁড়াতে পারি না; কুয়ার তলায় ভুবনপুরে মন খারাপ করে জমে থাকা জল থেকে তুলে আনতে পারি না ময়ূরের পাখার মত কাঁপতে থাকা জল- এ কী আশীর্বাদ নয় আমাদের জন্য? ডিমেনশিয়া না থাকলে চলে যাবার সময় স্মৃতির আঁটা থেকে নিজেদের খুলে নিতে কতই না পেরেশান হতে হতো আমাদের। দুনিয়া, প্রকৃতি এক বিস্ময়কর কবিরাজ- কত ঝাড়ফুঁক, টোটকার বিধিব্যবস্থা করে রেখেছে সে, তা না হলে যাবার বেলায় কেবলই ফিরে ফিরে তাকাতে হতো আমাদের, আর বুক ভেঙে কান্না আসতো দেখে যে যার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজহাঁস হয়ে উঠছি কেবল- কোথাও দিঘির জলে আশপাশে সে নেই আজ- সে যে দিব্যি চলে গ্যাছে, ভুলে গ্যাছে আমায় দূর কোন আলো ঠিকরানো অন্ধকারে!
বসন্তবাহার
নিসর্গে বসন্ত আসতে আচমকা বৃষ্টির ছাঁট লাগে
অভিজ্ঞানে স্ফূরণ আনতে চোখের জল পড়ে ভাগে।
কে কড়া নাড়ে, এতোটা বেপরোয়া দিব্যি অচেনা?
হুড়কো খুলে দেখি রাষ্ট্র নামের নির্নিমেষ এক সেনা।
রাত্রির পাটে দেখাই জামার নিচে জ্বলে ধূলার জমাট
ভিক্ষু শমন হিমালয় থেকে ডেকেছে সন্ন্যাসীর হাট।
নদী পরিপূর্ণ গঙ্গা পার্বতীর নীল পায়ে পায়ে ঘোরে
বিসমিল্লাহ খান সানাই বাজায় মেঘমল্লার সম্ভারে।
পিচঢালা পথের আবাহনে তার ঝরকা কাটা সঙ্কটে
কালের মন্দিরা সময়ের নির্বিকারে বসন্ত হয়ে ফোটে।
হাতের তালুতে জমেছে দেখো ইতিহাসের শুচিবাই
অন্তরালের ঘরে এসো বধূ গো বলো না যাই, যাই।
বাংলাদেশ হয়ে ফুটি
বয়স বাড়ে ধীরে, মায়া কিংখাবের অজানায়
পরে নিই ধূসরের সাদা ধানের কুড়া ও ক্ষমায়,
কথার গুটিবসন্ত হাতে ফিরে যাই একা নিরবধি
আমি প্রতিদিন এক নতমুখ বাংলাদেশ হয়ে ফুটি।
বাংলার অগণিত বিল ময়ালের পয়ার আমার
ফাটাফাটা কাদা কর্দমের শরীরে ওঠে প্রতিবার।
নদীর অন্তরে ঝিনুকের দাগকাটা নীরবতায় বাঁধি
মুখ বুজে পাতালের নীলে বাংলা ভাষা হয়ে কাঁদি।
হেমন্ত কী বর্ষায় আদিবাসী অন্তর নিত্য আমাকে
ডাহুকের মায়া রক্তে রুয়ে নিঙরে নিঙরে ডাকে
মায়ারাত্রির সুই-সুতোয় বোনা দিগন্ত পানে চাহি
মৃত্যুর গোলাপজল ছিটিয়ে অপার ঘূর্ণি হয়ে বহি।
মাধবী শস্যের ছায়ারা একা হাওয়া ভাঙার দুপুরে
ঘোলা চোখে কেবলি আকুল শিশুরা খেলা করে
ইশকুলের হঠাৎ কাঁপা ঘন্টাধ্বনির মুখে যে ছুটি
আমি প্রতিদিন এক নতমুখ বাংলাদেশ হয়ে ফুটি।।
জিভ কাটার সঞ্চারি
কাঁচালঙ্কা মেশানো একটি মধুশ্রী গ্রুপে
তুমি আছো দেখে আমিও যুক্ত হলাম।
জানি নতুন এক আঁটি দুঃখ নিতে
তোমার তেমন সমস্যা হবে না।
চুল খোলা রেখে যেই তুমি
ঝাউবন মাড়িয়ে হেঁটে যাও
বাতাস তোমাকে দিব্যি সই ও দোপাট্টা বলে ডাকে
আমি দেখি তুমি বাতাসকে ফিরে
যেতে বলো না, তুমি বলো না যে-
বাতাস তুমি ধাড়ি কাক,
ধূলা ভেঙে ভেঙে আর ডেকো না।
সেই ভরসায় আমিও নিজেকে
তোমার সাথে এক সমিতির সভ্য করে নিয়েছি
আমার এ জিভ কাটার সঞ্চারি তোমার পায়ের
ঘুঙুরের পাশে রাখামাত্র
তুমি বললে- সিন্দুকের উপর মুখ রেখে
একবাটি দুধ দিয়ে মুখ ধুয়ে এসো যাও-
কাঁটার দাগগুলো দেখা যাক।।
মধুচূর্ণা
আমরা তোমার হৃদপথে শরিক, প্রত্যাখ্যানে হাজির
তুমি জীবনে খাড়া দুপুরের সমান নির্ঘুম চুমুক।
সে একসময় এসেছিল আমাদের জীবনে
সব তরুণ হয়ে উঠেছিল পতঙ্গের নজির।
আগুনে হাত রাখা-ই প্রকৃত ফুলে হাত রাখা- এই
আজব বিদ্যা আমরা শিখেছিলাম গেরিলা ইয়াকুবের কাছে।
আমার কাজের মধ্যেই অকস্মাৎ নার্গিস ফোন করে,
ফোনের ওপাশে ওকে খুব বিচলিত লাগে;
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে- ইয়াকুব স্যার মারা গ্যাছে,
বলেই গলার স্বর কান্নার নিচু গ্রামে আটকে যায়।
আমরা কম্পনরেখায় যে অঞ্চল থেকে আসি
ওখানে বিল আর ছানিপড়া চোখের বড় মিল পড়ে।
আমরা যে দুধগ্রাম থেকে আসি ওখানে নিজেরই
ঘূর্ণাবর্তে আলোর চিক্কন রেখা ভাঙা নক্ষত্রের মধুচূর্ণে পাষাণ।
পা
তিনপথের মোড়ে শিশুপাড়ায় দেখা রেইনট্রির গাছ
হঠাৎ একদিন কবন্ধ প্রেমিক হয়ে পড়েছিল।
আমাদের যা কিছু দুধ ও লেবেনচোশ মাখা শৈশব
তার সবই বুঝি শুয়েছিল ছায়াগাছের জ্যোৎস্নায়,
আমাদের যা কিছু দূর মেলার পুতুল, টিনের শাবাস
অনাহারী চালে ঝমঝম বৃষ্টি, দিগন্তের দুয়ার পেরিয়ে
আরও দূর কোন রঙের নৈঃশব্দ্য ছাতিম গাছ
ওখানে হিয়ার মূলে হাত জোড় করে বসেছিলাম।
আজ কী করে যে কুঠার বসেছে আমাদেরই পায়ে
পড়ে গ্যাছি ঢালুর পাড়ে কবন্ধ প্রেমিক রেইনট্রির গাছ-
জ্যোৎস্নার ছেঁড়া ধূলা ও পালক উড়ে উড়ে নামে
মাথার উপর রাত্রির ইতিহাসে পোড়া বিচলিত হাত।
তিমিরার্তি ফুরাবার আগে দুপুর হেলে পড়ার মুখে
আমরা যে বালুভাত খেলা এতোগুলো রঙিন কবুতর
শুক সারি ছোট ছোট নুড়িপাথরের বুদবুদ এসো তোমরা
চলো হাত লাগাই জোরকদম কুঠারের সামনে বাড়িয়ে ধরি
আমাদেরই উদ্বাস্তু একজোড়া ঘরকুনো বিবাগী পা
উড়ে যাই দূর জবাফুলের মোড় কবন্ধ রেইনট্রির গাছ।।
উইপিং উইলো
টাওয়ারের ভিতরেই উড়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের লাটিম
খেলার পোশাকে ছেলেরা মেয়েরা দলে দলে আলাদা,
দল বেঁধে লাফায়, হল্লা করে বেনামি প্রমাদ একসাথে।
পাকা সড়কের হাতের নিচে নিস্তরঙ্গ শুয়ে আছে পুকুর
মাথা উঁচু আকাশের ডাকঘরের ঠিকানায় অট্টালিকা
স্প্রিংফিল্ড শপিং মলের নীল কোণায় হুকার দোকান।
মোটেলের পাশে গাড়ি ধোয় আমিগো মেহিকান ছেলেরা
কাস্টোমার চলে যাবার পর জলের ধারায় বলে কুলেরো,
কিছুদিন পরেই কুলেরোর বদলে বলবে নিগা এসহোল!
ফুটবল খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছে যে উৎফুল্ল যুবারা
একবারের জন্যও দেখে উঠছে না- একান্ত পরিপাটি
উইলো গাছটি মোড়ের দখিনেই একাকী কাঁদছে বড়!
আলিসা কারসন
মনে করার চেষ্টা করছি, মাঝেমধ্যেই যেমন তা করি
জন্মের আগে আমি যে শূন্য পিঞ্জরায় পাখি ছিলাম
আমাদের সংসার কেমন ছিল, কেমনই বা ছিল
আমার অন্য ভাইবোনেরা, পুতুল ঘুড্ডি, তাদেরও কী
ক্লান্ত লাগলে দিগন্তের এ-মাথা ও-মাথা উড়ে যেতে
ইচ্ছে করতো, আমাদের মা-বাবা কী স্নেহের নাম করে
ঝাউগাছের শোঁশোঁ হয়ে কাঁদতো রাতের সিন্দুকে?
জানি যে একটা বয়সে সব মানুষ হাওয়া হয়ে যায়
যেখানে পাহাড়ের মাথা নুয়ে এসে ভিক্ষু হয়ে বসে
মানুষ হাওয়া ওখানে পূর্বজন্মের মাকড়জালি পাতে
ধানদূর্বা ধুলাবালি আঙুলের মাথায় সোনামুখি সুইয়ের
নাম করে রক্তবিন্দু আঁকে আর বলে- দেখো, দেখো
ছানিপড়া চোখের ইজেলে আমার নকশিকাঁথাটি দেখো।
বুঝি না- আমরা যে বোঝে অবোঝে গ্যালাক্সির বুকে
কারো না কারো মৃতদেহবাহী একলা খাটিয়ার উপর
নিজের ভবিতব্য গুনে গুনে ভাসমান বাগান বানাই।
আলিসা কারসন উড়ে যাবে অতিদূর মার্সের খোঁজে
সে আর ফিরে আসবে না, তিনি আমাদের পাড়ায়
আর কোনদিন ফিরে আসবেন না- সবার পক্ষ থেকে
আলিসা কারসন হবেন বিজ্ঞান ও মায়ার ঊর্ধ্বালোক।
ছোট এই মেয়েটি কী তবে আদিঅন্তহীনে ঘন্টার ধ্বনি
ঈশ্বরের অধিক কালের ফোঁটা দেখা অদেখার সিম্ফনি।
বদরুজ্জামান আলমগীর : কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর।
নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
জালালউদ্দিন রুমির কবিতা, মসনবি : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ।
প্রকাশিতব্য কবিতাগ্রন্থ : মরিয়মফুল দুনিয়া।
প্রকাশিতব্য সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা : পানপাত্রে নক্ষত্র কুচি। ভাষান্তরিত আন্তর্জাতিক কবিতা : দরজা খুলেই দেখি জেব্রাক্রসিং।
Upcoming English poetry book : Dhaka stars on Philly Sky.
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
নাটক : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পুণ্যাহ। আবের পাঙখা লৈয়া। জুজুবুড়ি। চন্দ্রপুরাণ। পানিবালা। বাঘ। পরীগাঁও। প্রত্ন প্রতিমা। ইলেকশন বাজারজাতকরণ কোম্পানি লিমিটেড। এক যে আছেন দুই হুজুর। পিঁয়াজ কাটার ইতিহাস। ডুফি কীর্তন। নুনমধু টিপসই। পানিফল সংবেদ।
জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা : নিজগ্রাম সরিষাপুর, মামাবাড়ি জ্ঞানপুর, সরারচর হাই ইস্কুল, বাজিতপুর কলেজ, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান নিবাস- ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।