আবু বকর সিদ্দিক
শুরুর কথা
রুমি পড়ার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে, বিশেষত যখন আমি ‘দ্য সোল অফ রুমি’ (আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু অনূদিত), ‘ফরটি রুলস অফ লাভ’ (শাহেদ জামান অনূদিত) পড়েছিলাম-আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি কখন কোন্ বইটি পড়া দরকার তা অনেক ক্ষেত্রে সময়ই ঠিক করে দেয়! ওই সময় রুমি ও তাঁর গুরু শামসের প্রশান্ত বাণী আমাকে গভীর প্রশান্তি দিয়েছিল (এবং হয়তো ওই সময় এটা আমার জন্যে প্রয়োজনও ছিল!)। টানা প্রায় ৬ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে আমি যখন হাঁপিয়ে উঠেছি, যখন অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় আমার রীতিমতো অরুচি ধরতে যাচ্ছে, ঠিক সে-সময় উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করা জন্যে (পিএইচডি) ছুটি নিই; অর্থাৎ, আবারও সেই একই ব্যাপার! এবার আমি ক্লাসরুমে পড়াবো না, তবে গবেষণার জন্যে পড়বো।
ছুটির পর আমি ভাবছিলাম, আমাকে কিছু সৃজনশীল সাহিত্য পাঠ করতে হবে এবং তা অবশ্যই আমার গবেষণা-সংক্রান্ত পড়ার বাইরে। শুরুতে আমি শহীদ ইকবালের ‘কিরণরেখার পত্রপুট’ পড়ি, এটি এ-বছরই (২০২৪) অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এই বই আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে-নিয়ে যায় শৈশব ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়গুলোর কাছে। এরপর রমযানের শুরুর দিকে হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ পড়তে শুরু করি। হাসানের আগুন পাখি অনেক আগে পড়লেও এটি কোনো কারণে পাঠ করা হয়নি। এ-উপন্যাসে ধর্ষণের ধারাবাহিক বর্ণনা আমার মধ্যে বিবমিষা জাগিয়ে তোলে, মন খারাপ করে দেয়! আমি তখন খুঁজছিলাম এমন এক বই যা আমাকে প্রশান্তি দেবে, প্রেষণা জোগাবে এবং গবেষণা-সংক্রান্ত পড়াশোনার রুচিকেও সতেজ করবে; ঠিক তখনই আমার চোখ পড়ে খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ডের’ ওপর-যে বইটি বেশ কিছুদিন ধরে আমার পড়ার টেবিলেই রাখা ছিল। অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আমাকে বইটি বেশ আগেই পাঠিয়েছিলেন। এমনকি আমি পড়াও শুরু করেছিলাম, কিন্তু অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততার জন্যে পড়ায় ছেদ পড়ে। এ-বছর রমযানের মাঝামাঝি সময়ে আমি জেদ করলাম, বইটা আমাকে শেষ করতেই হবে (৫৭৫ পৃষ্ঠার বই একটানা পড়ে শেষ করা জন্যে অবশ্যই জেদ দরকার!); আর পাঠক হিসেবে আমি কচ্ছপের মতো! যাহোক, রোজার ইদের পরদিন বইটি পড়া শেষ হয়। তবে বই নিয়ে লিখতে আলসেমি করেছি (যা অবশ্য আমার মজ্জাগত অভ্যাস!)।
বই প্রসঙ্গে
বিখ্যাত ভারতীয় লেখক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার খাজা আহমদ আব্বাস তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেন ৬১-তম জন্মদিনে (৭ জুন, ১৯৭৫)। ওই সময়ের হিসেবে তা অনেক পরেই। কারণ, ওই সময় ভারতের মানুষের গড় আয়ু খুব বেশি ছিল না (লেখক নিজেই বলেছেন, পঞ্চাশ বছর আগে, অর্থাৎ, ১৯২৫ সালে একজন ভারতীয়ের গড় আয়ু ছিল ছাব্বিশ বছর!)। খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনীর মূল নাম ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড : অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ইন অটোবায়োগ্রাফি’। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু বইটি ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড’ নাম দিয়ে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনূদিত বইটি ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাতৃভাষা প্রকাশ’ প্রকাশ করে। অনূদিত বইয়ে ৪৯টি পরিচ্ছেদ রয়েছে (এগুলোকে অন্যকোনো নামে ডাকা যায় কিনা আমি বুঝতে পারছি না!)। প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম রয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদটি (যার শিরোনাম ‘বার্থ সার্টিফিকেটবিহীন এক ব্যক্তির বক্তব্য’) পুরো বইয়ের ভূমিকার মতো-সেখানে লেখক পাঠককে জানাচ্ছেন, ৬১ বছর বয়সে এসে তিনি তাঁর জীবনের উপাখ্যান লিখতে শুরু করেছেন। জানাচ্ছেন তাঁর বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার কথা, কেনো তিনি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছেন কেবল তার কৈফিয়তই দেননি-বরং এ-পেশার মাহাত্ম্যও দৃষ্টান্ত সহকারে পেশ করেছেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া তার জন্যে কতটা সংগ্রামের ছিল তা শুরুর দিকের অনুচ্ছেদগুলো (৯, ১০, ১১, ১২, ১৩ নম্বর প্রভৃতি) পড়লে অনুধাবন করা যায়। একজন সফল চলচ্চিত্রকার (চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার ও পরিচালক) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্পও তিনি জানিয়েছেন। আত্মজীবনীতে একক ব্যক্তি হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছেন জওহরলাল নেহরু (১২, ২১, ২৮, ৩১ ও ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদসমূহ এ-ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করা যায়)।
বইয়ের শুরুতে ‘অনুবাদকের কথা’ অংশে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু সংক্ষেপে খাজা আহমদ আব্বাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন। এটা পড়েই লেখকের বহুর্মুখী প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আত্মজীবনীর ভূমিকা লিখেছেন অসাধারণ ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব অমিতাভ বচ্চন। খাজা আহমদ আব্বাসের হাত ধরেই তাঁর সাত হিন্দুস্তানি চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল। আত্মজীবনীর ‘ভূমিকা’য় তিনি খাজা আহমদ আব্বাসকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন এবং আবেগপূর্ণ ভাষায় তাঁর অনুভূতিও প্রকাশ করেছেন। বইয়ের ‘অনুবাদকের কথা’ ও ‘ভূমিকা’ অংশ দুটো অনূদিত মূল বই পাঠে পাঠককে আগ্রহী করে তোলে।
কেন আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু?
১. খাজা আহমদ আব্বাসের আত্মজীবনীর উল্লেখযোগ্য দিক হল বর্ণনাভঙ্গি ও উপস্থানশৈলীর ব্যতিক্রমধর্মিতা। লেখক গতানুগতিক ধারাকে অনুসরণ করেননি (সাধারণত, আত্মজীবনীতে লেখকেরা নিজের ছেলেবেলা, পড়াশোনা, বিবাহিত জীবন, কর্মজীবন-প্রভৃতি অধ্যায় বিভাজনের মধ্য দিয়ে নিজের জীবনালেখ্য তুলে ধরেন)। লেখক নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন ছোটোগল্পের স্টাইলে। বইয়ের ৪৯টি পরিচ্ছেদ যেন আলাদা আলাদা গল্প। আবার সবগুলো মিলে একটা পূর্ণাঙ্গ আখ্যান। ছোটোগল্পকার হিসেবে খাজা আহমদ আব্বাস খ্যাতিমান ছিলেন।
আত্মজীবনীতে গল্পকার আব্বাসের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন-৩ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘ইব্রাহিমের একটি পুত্র ছিল’), ৪ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘পানিপথে তিনটি কবর’), ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘শীতের রাতে শীতল ঘাম’), ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘আমার জন্যে চেরি ফোটেনি’), ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘মৃত্যুর মাঝে জীবন’), ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘বিয়ের স্বাদ’), ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘তিন পায়ে দৌড়’), ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘আমি একা হাঁটবো), ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘নগরী এবং স্বপ্ন’), ৪৬ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘জীবনের জন্য যুদ্ধ’) ও ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘খাঁটির ভূখণ্ডে’) প্রভৃতি অনুচ্ছেদগুলোকে আলাদা গল্প হিসেবেও পাঠ করা যায়! অপরদিকে, আই অ্যাম নট আইল্যান্ডকে উপন্যাস হিসেবেও পাঠ করা যায়। ঔপন্যাসিক হিসেবেও খাজা আহমদ আব্বাস পরিচিত ছিলেন। বিশেষত, ইনকিলাব (১৯৫৮) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড যেন একটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। জীবনের কতগুলো দারুণ গল্প বা ছোটো ছোটো আখ্যানের সঙ্গে এতে যুক্ত হয়েছে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন।
এমনকি আত্মজীবনীটা শেষও হয়েছে উপন্যাসের মেজাজে। এ-জন্যেই আমার মত হচ্ছে, আত্মজীবনীর প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদ যেমন আলাদা গল্পের মতো, তেমনি সবগুলো পরিচ্ছেদ মিলে একটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস হয়ে ওঠে। লেখকের বর্ণনাভঙ্গিতে চিত্রনাট্যধর্মী গদ্যের মেজাজও রয়েছে। এটা নিয়ে অবশ্য আলাদাভাবে কথা বলা প্রয়োজন।
২. লেখক নিজের কোনো ছবি আত্মজীবনীতে যুক্ত করেননি। এটা অবশ্যই ব্যতিক্রম। ছবি না-থাকার অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন-দেশভাগের সময় পানিপথে তার ‘বার্থ সার্টিফিকেট’সহ গুরুত্বপূর্ণ ছবি ও কাগজপত্র হারিয়ে গিয়েছিল (১ নম্বর পরিচ্ছেদ)। তবে, আমার মনে হয়েছে, লেখক ইচ্ছে করেই তার বইয়ে ছবির ব্যবহার করেননি। তবে, তিনি যেভাবে লিখেছেন, পড়ে মনে হয়েছে বর্ণিত ঘটনাবলি যেন চোখের সামনেই ঘটছে। এর কারণ হিসেবে তার সিনেম্যাটিক গদ্যের ভূমিকা রয়েছে। লেখক একজন চিত্রনাট্যকার। বহু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাই তাঁর গদ্য অনেকটা চিত্রনাট্যধর্মী। খাজা আহমদ আব্বাসের গদ্য পড়তে গিয়ে আমার বাংলাদেশের একজন লেখকের নাম মাথায় এসেছে-তিনি জহির রায়হান। জহির রায়হনের কথাসাহিত্যও অনেকটা চিত্রনাট্যধর্মী। তাঁর ছোটোগল্প (‘অপরাধ’, ‘পোস্টার’, ‘কয়েকটি সংলাপ’ ও ‘একুশের গল্প’) কিংবা উপন্যাস হাজার বছর ধরে (১৯৬৪) ও আরেক ফাল্গুন (১৬৯) যে কেউ পড়লে আমার কথার সত্যতা যাচাই করতে পারবেন। দুজনই সফল চলচ্চিত্রকার। তাই, দুজনের গদ্যের মধ্যে মিলটা যে আসলে কোথায় তা আর না-বললেও চলে! খাজা আহমদ আব্বাসের গদ্য কেবল চিত্রনাট্যধর্মীই নয়, তাঁর গদ্য সরস এবং তাতে রসিকতাবোধও ভালোভাবেই আছে-২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘বিয়ের স্বাদ’) ও ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘খাঁটির ভূখণ্ডে’) দুটোকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যায়।
৩. ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড’ কেবল আত্মজীবনী নয়, এটি ভ্রমণ আখ্যানও। খাজা আহমদ আব্বাস বুঝতে পেরেছিলেন, আরো একটা বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবী প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে। তাই, দ্রুতই তিনি পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দেখার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি দুবছর আগে থেকেই (১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে) অতিরিক্ত পরিশ্রম করে টাকা জমাতে শুরু করেন। লেখক বিশ্বভ্রমণের উদ্দেশ্যে টাকা উপার্জনের নিমিত্তে নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন এবং চলচ্চিত্র সমালোচনা থেকেও টাকা আয় করেন। প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে আসার পর তিনি ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। সতেরো শত রুপি দিয়ে জাহাজের ‘রাউন্ড-দ্যা ওয়ার্ল্ড’-এর একটি টিকেট কেনেন। টিকেট কেনার পর ব্যাংকে তাঁর ২০০০ রুপি অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে সে টাকা তিনি আর ফেরত পাননি। তবে, লেখক দমে যাবার মানুষ নন। বাবার কাছ থেকে তিনি ভ্রমণ-খরচ বাবদ দুই হাজার রুপি নিয়েছেন। তাঁর ভ্রমণ শুরু হল। শুরুতে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, হংহং, সাংহাই, চীন ও জাপান দেখেছেন। জাপানে চেরি ফুল দেখতে পারেননি বলে আফসোস করেছেন। এরপর গিয়েছেন আমেরিকা। ইউরোপে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। লেখক সাহস করে ইউরোপেও গিয়েছেন। প্রথমে গিয়েছেন প্যারিসে। প্যারিস তাঁকে মুগ্ধ করেছে। লন্ডন শহরও তাঁর ভালো লেগেছে। তবে, মিলান (ইতালি) দেখে তার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, ইতালিকে মনে হয়েছে ‘ফ্যাসিবাদের নকল দাঁত’ (পৃ. ১৮৫)। ইউরোপে লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সান্নিধ্য পেয়েছেন (জাহাজে অবস্থানকালে)। সান্নিধ্য পেয়েছেন জওহরলাল নেহরুরও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের অবস্থানের ব্যাপারে লেখক নেহরুকে বলেছেন-‘[…] আমাদের যদি স্বাধীনতার আগাম নিশ্চয়তা দেওয়া না হয়, তাহলে ঔপনিবেশিক জনগণ কোনো যুদ্ধ অথবা শান্তির অংশে পরিণত হবে না’ (পৃ. ১৯৪)। জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘পোকিপসি কনফারেন্সে’ লেখক সাংবাদিক হিসেবে নিজের উল্লিখিত মত দিয়েছেন। নেহরু লেখকের মতকে সমর্থন দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদের নগ্নরূপকে আরো ভালো করে দেখা জন্যে লেখক ইউরোপের বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ায় গিয়েছেন। হিটলারের ‘ড্র্যাং নাখ ওস্টেন’কে (গাড়ি পূর্বদিকে চালাও) লেখক ‘একটি উচ্চভিলাসী ভূ-রাজনৈতিক চাল’ বলে অভিহিত করেছেন (পৃ. ১৯৯)। এটা তিন বছরের মধ্যে প্রায় সত্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর লেখক গিয়েছেন ইস্তাম্বুলে (তুরস্ক)। আধুনিক তুরস্কে আতাতুর্কের প্রভাব দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন। সেখান থেকে পরে গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে (ইরাক)। সাংবাদিক, লেখক ও চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে খাজা আহমদ আব্বাস আরো কয়েকটি দেশে অতিথি হিসেবে ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে চীন ও সোভিয়েত রাশিয়া অন্যতম। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে লেখক চীন ভ্রমণ করেন। তিনি চীনের বিপ্লবের দ্বিতীয় বার্ষিক উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেখানে গিয়েছেন। লেখক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চীনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। চীনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিপ্লবী নেতার সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সান-ইয়াৎ-সেনও রয়েছেন। লেখকের বর্ণনায় চীনের বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে লেখক জানাচ্ছেন, ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চীন ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী ছিল। চীন-ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হয় ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এরপর লেখক ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে অতিথি হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ার বিভিন্ন শহর পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর কাছে ‘মস্কো’কে মনে হয়েছে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও শিল্প বিষয়ক রাজধানী’ আর ‘লেলিনগ্রাদ’ হচ্ছে দেশটির ‘শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ (পৃ. ৪০৯)। তাছাড়া ‘লেলিনগ্রাদ’কে তার কাছে প্রকৃত অর্থেই ‘একটি ফিনিক্স নগরী’ মনে হয়েছে (পৃ. ৪০৮)। লেখক স্ট্যালিনের জন্মস্থান জর্জিয়ায়ও গিয়েছেন। রাশিয়ায় অবস্থানকালে মস্কোর ‘ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত রাইটার্স’-এর পক্ষ থেকে লেখককে বলা হয়, পাকিস্তানের উর্দু ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর তিনটি ছোটোগল্প রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ-জন্যে তাঁকে কয়েক হাজার রুবল সম্মানিও দেওয়া হয়। যাহোক, ভ্রমণ-আখ্যান হিসেবেও বইটি পাঠ করা আমার কাছে আনন্দদায়ক মনে হয়েছে।
৪. চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রে বইটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বইয়ে ভারতীয় সিনেমা নিয়ে যেমন আলাপ আছে, তেমনি রয়েছে বিশ্বের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বদের নিয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। আত্মজীবনীর অনেকগুলো অনুচ্ছেদে (২৩, ২৯, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫) চলচ্চিত্র নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। লেখক ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে (‘ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র সমালোচক’) কীভাবে একজন ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার বৃত্তান্ত পেশ করেছেন। তাছাড়া এ-অনুচ্ছেদে লেখক হিসেবে তাঁর মনোজগত ও লেখার মেজাজ সম্পর্কেও অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রকার হিসেবে খাজা আহমদ আব্বাস অনেকগুলো ব্যবসাসফল বা হিট ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন। নিজে পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন অনেক চলচ্চিত্র। এ-ক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি নির্মাণ করেছেন ধরতি কি লাল (১৯৪৬), পরদেশি (১৯৫৭), শেহের আউর সপনা (১৯৬৩), সাত হিন্দুস্তানি (১৯৬৯), দো বুন্দ পানি (১৯৭২) প্রভৃতি বিখ্যাত ভারতীয় সিনেমা। ধরতি কি লাল (মাটির সন্তান) সিনেমায় ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে কলকাতা শহরের ক্ষুধার্ত ও উদ্বাস্তু মানুষের জীবনবাস্তবতা জীবন্ত হয়ে ওঠেছে। এটা ভারতের প্রথম সামাজিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত কোনো সিনেমা। শেহের আউর সপনা (নগরী এবং স্বপ্ন) সিনেমার জন্যে ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মাননা (‘গোল্ড মেডেল’) পেয়েছেন। সাত হিন্দুস্তানি ও দো বুন্দ পানি (দু ফোটা পানি) চলচ্চিত্রের জন্যও পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সাত হিন্দুস্তানি সিনেমার মধ্য দিয়েই চলচ্চিত্র জগতে অভিষেক হয় বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের। তবে, দো বুন্দ পানি জাতীয় পুরস্কার পেলেও এটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। এছাড়া খাজা আহমদ আব্বাস অনেকগুলো সফল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন-ধরতি কি লাল (একই সঙ্গে পরিচালনাও করেছেন), নীচা নগর (১৯৪৬), নয়া সংসার (১৯৪১), সাত হিন্দুস্তানি (একই সঙ্গে পরিচালনাও করেছেন), আওয়ারা (১৯৫১), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), মেরা নাম জোকার (১৯৭০), ববি (১৯৭৩) ও হেনা (১৯৯১) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বিদেশি চলচ্চিত্র নিয়েও লেখক সংক্ষেপে আলাপ করেছেন। যেমন-কানাডিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক নরম্যান ফ্রেডারিক জুয়িসনের দ্য রাশিয়ানস আর কামিং, দ্য রাশিয়ানস আর কামিং, পোলিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা রোমান পোলানাস্কির কুল ডে স্যাক, তরুণ জার্মান পরিচালকের শোনসেইট ফুর ফুচসে। তাছাড়া লেখক রুশ চলচ্চিত্রকার আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রের অনুরক্ত ছিলেন। খাজা আহমদ আব্বাস ভারতীয় সিনেমাকে সুদূর সোভিয়েত রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। আত্মজীবনীর ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘লাল তারকার দেশে’) মারফত জানা যায়, তিনি ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘সোভেক্সপোর্ট ফিল্মে’র অতিথি হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়া ভ্রমণ করেন। লেখকের সঙ্গে ছিলেন ওই সময়ের তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া তাঁর নির্মিত ও পরিচালিত আওয়ারা সিনেমার নায়ক রাজকাপুরসহ আরো অনেকে। যাত্রাপথে লেখকের দেখা হয়েছিল চার্লি চ্যাপলিনেরর সঙ্গে। আওয়ারা সিনেমা ভারতে হিট (ব্যবসাসফল) হয়েছিল। আওয়ারার পরিচালক (লেখক) এ-সিনেমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলেছেন, ‘[…] অপরাধীরা জন্মগত অপরাধী নয়, বরং সামাজিক অবিচার অপরাধী সৃষ্টি করে এবং এর মধ্যে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে রোমান্স, কৌতুক এবং মন মাতানো সংগীত’ (পৃ. ৪০৭)। ওই সময়ে সোভিয়েত রাশিয়াতেও আওয়ারা সিনেমা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বিশেষত, এ-সিনেমার আওয়ারা গানটি সেখানে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। লেখকের ভাষায়, ‘[…] উজবেক ছেলেরা হিন্দিতে গান গাইছে ‘আওয়ারা হুঁ’ অথবা রুশ ভাষায় ডাবিং করা ‘ব্রোদাগিয়া’ (ইৎড়ফধমুধ) সেই ভূখণ্ডে প্রেইরির আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে হোটেল ও রেস্টুরেন্টে সকল ব্যান্ড ও অর্কেস্ট্রা এই ছায়াছবির গানের সুর বাজাতে শুরু করেছিল’ (পৃ. ৪০০)। লেখক সোভিয়েত রাশিয়ার এক ছাত্রের কাছে ‘আওয়ারা’ সিনেমা জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ জানতে চান। জবাবে ছাত্রটি বলে-‘[…] যুদ্ধের পরিবর্তে আমরা পর্দায় প্রেম দেখতে চাই, আমরা বাধাহীনভাবে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেখতে চাই, আমরা চাই কেউ আমাদের মুখে হাসি আনুক। সেজন্যে আমরা ‘আওয়ারা’র ব্যাপারে পাগল’ (পৃ. ৪০৮)। সত্যিকার অর্থে, ওই সময় সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষ যুদ্ধকেন্দ্রিক ও অক্টোবর বিপ্লব দ্বারা উদ্বুদ্ধ সিনেমা দেখে বিরক্ত হয়ে ওঠেছিল। আওয়ারা সেখানে ছিল একেবারে ভিন্ন ঘরানার সিনেমা। মস্কো থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে কয়কশ রাশিয়ান নাগরিক বিমানবন্দরে এসে হাজির হয়। তাদের সবার চোখ অশ্রুসিক্ত ছিল। আর সেটা ছিল লেখক ও তাঁর ভ্রমণসঙ্গীদের জন্যে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যাহোক, বইটি চলচ্চিত্রপ্রেমী পাঠক ও সমালোচকের কাছে যে আলাদা গুরুত্ব পাবে-এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
৫. লেখক নিজের পেশা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারো কথা না-শুনে নিজের সম্ভাবনা উপলব্ধি করেছেন এবং নিজের হৃদয়ের কথা শুনেছেন। বইয়ের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ (‘লাইব্রেরি ও ভালোবাসা’) মারফত জানা যায়-সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা থেকেই লেখক ইন্টারমিডিয়েটে ইংরেজি, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যা পড়েছেন। পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়াকে ওই সময়ে তিনি দৈনন্দিন রুটিনে পরিণত করেছেন। তাছাড়া তার চোখে ছিল সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। তিনি জানতেন তার মন অতি সংবেদশীল। এ-কারণে, তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়েও পড়েননি। লেখকের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদদাতা হিসেবে। ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে (‘সাংবাদিকতায় প্রথম পাঠ’) লেখক শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসেবে ন্যাশনাল কল পত্রিকায় কাজ শুরুর বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ-পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন জে. এন সাহনি। লেখক ন্যাশনাল কল পত্রিকায় অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং সাংবাদিক জে. এন সাহনির কাছে সংবাদ লেখার বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন। এরপর লেখক অন্য সহপাঠীদের সহযোগিতায় (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায়) আলীগড় ওপিনিয়ন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। আলীগড় ওপিনিয়ন ছিল ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা। এ-পত্রিকা প্রকাশে লেখক অনেক বাঁধারও সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কারও করতে চেয়েছিল (১১ নম্বর অনুচ্ছেদ/ ‘ভাইস-চ্যান্সেলরের সঙ্গে নাশতা’)। খাজা আহমদ আব্বাস সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে যেকোনো ঝুকি নিতে রাজি ছিলেন। এর প্রমাণ মেলে বইয়ের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে (‘বোম্বে এবং সমাজতন্ত্রের সাহসী আবহ’)। সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে লেখক বোম্বে গিয়েছেন এবং সেখানে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি (বিনা বেতনে) দ্য বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় কাজ করেছেন। কারণটা লেখক নিজেই বলেছেন, ‘দ্য বোম্বে ক্রনিকল’ ছিল একমাত্র জাতীয়তাবাদী দৈনিক। আমার জন্য তা-ই ছিল, অথবা কিছুই ছিল না। ‘দ্য বোম্বে ক্রনিকল’ এর সঙ্গে আমাকে অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়তে হয়েছিল। আমি ছিলাম কাজ করার বালক, যাকে ছাড়া সম্পাদক পত্রিকা চালাতে সক্ষম হবেন না’ (১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ/ ‘বিজয়ের জন্য একটি নগরী’, পৃ. ১৪১)। লেখক নিজের একাগ্রতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বোম্বে নগরীকে জয় করেছেন-দ্য বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় ৫০ রুপি বেতনে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। এভাবে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় ঠিকে গেছেন। কলাম লেখক হিসেবেও নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি দ্য বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় ‘লাস্ট পেজ’ শিরোনামে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ব্লিটজ-এ যোগাদান করলেও একই শিরোনামে তাঁর কলাম লেখা অব্যাহত ছিল। ‘অনুবাদকের কথা’ অংশে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু জানাচ্ছেন, ‘লাস্ট পেজ’ নামের সাপ্তাহিক কলামটি খাজা আহমদ আব্বাস ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব লিখেছেন। এই শিরোনামে লেখাকে ভারতের দীর্ঘ সময় ধরে লেখা কলাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাহোক, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সৎ সাহস ও সততা থাকা দরকার। লেখকের জীবনী পাঠে সেটা উপলব্ধি করা যায়। এ-জন্যে যারা সৎ ও সাহসী সাংবাদিক হতে চান, কলামিস্ট হতে চান, তাদের কাছেও বইটির আবেদন ফুরিয়ে যাবে না!
৬. লেখক অনেক রাজনৈতিক ঘটনাকে কেবল বইয়ে বর্ণনা করেননি, সেসব ঘটনার বিষয়েও নিজের অনুভূতি ও মতামতও প্রকাশ করেছেন। লেখক কৈশরে ভগত সিংয়ের ফাঁসি (১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ) কার্যকর হওয়ার খবর পত্রিকা মারফত পেয়েছেন। এ-খবর পড়ে লেখক অঝোরে কেঁদেছিলেন। এমনকি সেই কান্না তাঁর শৈশবকে মুছে দিয়েছিল! (৮ নম্বর অনুচ্ছেদ, ‘আমি আমার অশ্রু বিসর্জন দিয়েছি’)। ‘স্বদেশি আন্দোলন’ থেকে শুরু করে ‘ভারতভাগ’, ‘ভারত-পাকিস্তান’ সম্পর্ক, ‘চীন-ভারত’ সম্পর্ক ও কাশ্মীর নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেছেন। ভারতভাগ (১৯৪৭) তাঁকে চরম আহত করেছিল। আত্মজীবনীর ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদে (‘কে ভারতকে হত্যা করেছে?’) তিনি আবেগময় ভাষায় ভারতের বিভাজন নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তিনি ভারত বিভাজনের নেপথ্যে কে বা কারা?-এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। লেখক ভারতভাগের জন্যে ব্রিটিশদের বিভাজন নীতি, উগ্র হিন্দুত্ববাদ, কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার পাকিস্তানপন্থী নীতি ও সাম্প্রদায়িতাকে প্রধানত দায়ী করেছেন। এছাড়াও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভারতের স্বাধীনতা উদ্যাপন (১৫ আগস্ট), লেখকের পরিবারের পানিপথে আটকে পড়া ও জওহরলাল নেহরুর সহযোগিতায় তাদেরকে নিরাপদে দিল্লীতে ফিরিয়ে আনা-প্রভৃতি ঘটনাবলিও তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে। রাজনৈতিক ঘটনা ব্যক্তির মনস্তত্ত্বকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে এবং খাজা আহমদ আব্বাসের লেখায় তা প্রতিফলিতও হয়েছে।
৭. লেখকের জীবনদর্শনও বইটিতে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষ করে পেশাগত জীবন ও আদর্শের ক্ষেত্রে তাঁর আপোসহীন মনোভাব তিনি আমৃত্যু ধরে রেখেছেন। তাঁর লেখা কলাম (প্রবন্ধ) পাঠে, চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এবং কথাসাহিত্য পাঠে মানবিক জীবনদর্শনই প্রাধান্য পেয়েছে। এই আত্মজীবনীর শেষে যেমন বলেছেন-‘এখানে আমি মানবতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং মানবতা আমার সঙ্গে যুক্ত। মোহাম্মদ ও রাম, গান্ধী ও গ্যেটে, শেক্সপিয়র ও শেলি, লেনিন ও জওহরলাল নেহরু, তারা সবাই আমার অংশ ছিলেন এবং আমি তাদের অংশ ছিলাম’ (পৃ. ৫৭৫)। তবে তিনি নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। লেখক কমিউনিস্ট আদর্শকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু নিজেকে ‘কমিউনিস্ট’ মনে করেননি (পৃ. ৩৫৬-৩৬৫)। বইয়ের ৩৩ নম্বর পরিচ্ছেদে (‘কমিউনিজম এবং আমি’) লেখক কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করেছেন, যেখানে লেখকের নিজের রাজনৈতিক আদর্শও অপ্রকাশিত থাকেনি। লেখক নিজেকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি চান শ্রমজীবী মানুষের ‘সাংস্কৃতিক জাগরণ’। ভারতীয় কমিউনিস্টরা চায় শ্রমজীবী মানুষের রক্তে সার্বিক মুক্তি। এখানেই ভারতীয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য লক্ষণীয়-
কমিউনিস্টরা সমগ্র শ্রমজীবী গোষ্ঠীকে বিদ্যমান পার্টি লাইন অনুযায়ী উগ্র ও আক্রমণাত্মক করে তুলতে চায়, আর আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইকবালের কবিতা, প্রেমচান্দ, ইসমত চুগতাই ও কৃষেণ চন্দরের গদ্য, কবির ও আলী সরদার জাফরির (যাকে আমি এখনো সাধু কবিরের আধুনিক অবতার হিসেবে শ্রদ্ধা করি) মতো মানবতাবাদী দর্শন নিয়ে তাদের উগ্রতা ও আগ্রমণাত্মক মনোভাবকে প্রশমিত করতে চাই। (পৃ. ৩৬২)
সুতরাং, লেখক নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কোনো পার্টির কাছে বন্ধক রাখতে চাননি বলে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি। নিজের আদর্শের সঙ্গে কখনো আপোসও করেননি।
অনুবাদ প্রসঙ্গে
অনুবাদক হিসেবে ইতোমধ্যে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু খ্যাতি পেয়েছেন। তাঁর অনূদিত বেশ কয়েকটি বই আমার পড়া হয়েছে। সে-অভিজ্ঞতা থেকে বলছি তাঁর অনুবাদ সহজ ও প্রাঞ্জল। মূল পাঠেরও (ঞবীঃ) অনুগামী। আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে তিনি ভাবানুবাদকে বেশি প্রাধান্য দেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর বেশিরভাগ অনুবাদ ইংরেজি থেকে বাংলায়। অ্যাই নট অ্যান আইল্যান্ডও তাই। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর সহজাত অনুবাদকের মেজাজ বজায় রেখেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে হয়নি তা কিন্তু নয়! মনে হয়েছে, কিছু জায়গায় তিনি আক্ষরিক অনুবাদকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং সেখানে বাক্যের অর্থ কিছুটা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠেছে। আমি যেহেতু মূল ইংরেজি বইটি (টেক্সট) পড়িনি তাই এ-ক্ষেত্রে মন্তব্য করাটা অনেকটা অনুচিত হবে বলে মনে করি। তবে, অনুবাদের কিছু অংশ ভালো করে পড়লে বোঝা যায় (যেখানে মনে হতে পারে আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়েছে)-যেসব বাক্যের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তা মূলত বাক্য গঠনের জটিলতা ও শব্দের ভুল প্রয়োগের জন্যে; এ-ক্ষেত্রে অনুবাদকের চেয়ে ‘প্রুফ রিডার’ বা প্রকাশনীর দায়ই বেশি। কয়েকটি জায়গা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে-
১. ‘আমি কোবেতে প্রথম ফ্যাসিবাদ-সমর্থক ভারতীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, যাদের ব্রিটিশ বিরোধিতা তাদেরকে বাধ্য করেছি ফ্যাসিবাদী প্রোপাগ্রান্ডার (বানান?) প্রতি ঝুঁকে পড়তে’ (১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, পৃ. ১৬৫)।
২. ‘[…] আমাকে বহনকারী ট্রেনটি লস অ্যাঞ্জেলেস রেলস্টেশনে করলে বিপরীত দিক থেকে আরেকটি ট্রেন এসে পৌঁছে’ (১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, পৃ. ১৭০)।
৩. ‘[…] আমি ভারতে বিরুদ্ধে ভারতবিরোধী ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘ইন্ডিয়া স্পিকস’ এর মতো নোংরা প্রচারণা চালাচ্ছি’ (৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদ, পৃ. ২৬০)।
৪. ‘[…] আমি পিছলে সিমেন্টের ফ্লোরের ওপর পড়ে যাই এবং আমার পুরো শরীরের আমার বাম হাতের ওপর’ (৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদ, পৃ. ৫৬৮)।
উল্লিখিত বাক্যসমূহের ভুল অনুবাদজনিত নয়, বরং এ-ক্ষেত্রে প্রুফ রিডারের অসচেতনতাকে অনেকাংশে দায়ী করা যায়। তবে, এগুলো বড় ধরনের কোনো ভুল নয়; আর ৫৭৮ পৃষ্ঠার বইয়ে এ-রকম ভুল থাকাও অস্বাভাবিক নয়!
মুদ্রিত (অনূদিত) বইয়ের সমালোচনা কিংবা মুদ্রণজনিত সমস্যা প্রসঙ্গে
বইয়ে বানানজনিত কিছু ভুল রয়েছে এবং সেগুলো অসাবধানতা বশত হয়েছে। যেমন-‘চিহ্নিত চিহ্নিত’ (পৃ. ১৫০, শুদ্ধ : চিহ্নিত), ‘আমর’ (পৃ. ২২৯, শুদ্ধ : আমরা), ‘নাশতার’ (পৃ. ২৯৪, শুদ্ধ : নাশতা)। কয়েকটি স্থানে বিরামচিহ্নের ভুলপ্রয়োগও আছে (পৃ. ৪১৪)। বানান ও বিরামচিহ্নজনিত ভুলের দায়ও প্রকাশনীর ওপরেই বর্তায়। এর বাইরে, বইয়ে মুদ্রণজনিত বেশকিছু সমস্যাও রয়েছে এবং তা গুরুতর! মুদ্রণজনিত বেশকিছু সমস্যা বইটির সৌন্দর্য ম্লান করে দিয়েছে। যেমন-বইয়ের অনেক জায়গায় পৃষ্ঠা সংখ্যার ধারাবাহিকতা নেই! (২২৪ থেকে ২৪১ নম্বর পর্যন্ত পৃষ্ঠা সংখ্যার ধারাবাহিকতা নেই)। এমন একটা বইয়ের ক্ষেত্রে এ-ধরনের ভুল মেনে নেওয়া কঠিনই বটে! এ-ধরনের ভুল পাঠককে চরম বিরক্তিরও উদ্রেক করে। আশা করি, ভবিষ্যতে ‘মাতৃভাষা প্রকাশ’ এসব ভুলের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে।
শেষ কথা
‘কোনো কিছু ঠিকঠাক বোঝার সবচেয়ে আদর্শ উপায় হচ্ছে, সেটা নিয়ে লিখতে বসা। লিখতে শুরু করলেই একটু একটু করে সবকিছু পরিষ্কার হতে থাকে। অনেক কিছু কলমে চলে আসে, যা মাথায় আসে না’ (হারুকি মুরাকামি/ নরওয়েজিয়ান উড, পৃ. ১৩)। লেখার গুরুত্বের বিষয়ে মুরাকামি যা বলেছেন তা স্বীকার করেও বলা যায়-যে বই পাঠে গভীর অনুভূতির সৃষ্টি হয় না, তা নিয়ে লেখার আগ্রহও তৈরি হয় না। কিছু বই পাঠে আমরা জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করি, নতুন জীবনবোধও তৈরি হয়; তখন আরো বেশি জানা ও বোঝার জন্যে পঠিত বই নিয়ে লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আসলে, বেশি জানা ও বোঝার আগ্রহ থেকেই আমি আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। আমি কী লিখেছি বা তার মধ্যে কী আছে তা নিয়ে আমি ভাবিনি; কেবল এটাই উপলব্ধি করেছি, লেখার মধ্য দিয়ে আমি পঠিত বইয়ের মধ্যে আরো নিমগ্ন হতে পেরেছি এবং বেশি শিখতে পেরেছি!
যেকোনো আত্মজীবনী থেকেই অনেককিছু শেখা যায়। আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ডও এ-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। বই থেকে দু-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। সাত (৭) নম্বর অনুচ্ছেদে (‘ভাইজান’) লেখক জানাচ্ছেন-কৈশর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও কর্মজীবনে যে মানুষটি তাকে বেশি প্রভাবিত করেছেন তিনি হচ্ছেন ‘ভাইজান’ (লেখকের জ্যাঠাতো ভাই)। এ-অনুচ্ছেদে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। বিশেষত, ভাইজানের অনেক কথাই অনুসরণীয়। যেমন, ভাইজান বলেছেন, ‘কাউকে গুরুত্ব সহকারে না নিয়েও গুরুতর মানসিকতা সম্পন্ন হওয়া সম্ভব’ (পৃ. ৬৮)। কিংবা শিক্ষা নিয়ে ভাইজানের বক্তব্য-‘পাণ্ডিত্যের ভান করা ছাড়া জ্ঞান অন্বেষণ করা, পৃষ্ঠপোষকতা বা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা পোষণ না করে মানুষের সেবা করা, কারো ক্ষতি না করে রসিকতা উপভোগ করা, অন্যদের সঙ্গে হাসা এবং অন্যকে লক্ষ্য না করে হাসা’ (পৃ. ৬৮)। এই বই পাঠে আমার বেশকিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধিও হয়েছে। তবে এসব নিয়ে লিখিনি। কারণ, মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি কিংবা উপলব্ধি তো আসলে ‘ব্যক্তিগত’-ই!
খাজা আহমদ আব্বাসের আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান হয়ে থাকেনি, এটা হয়ে ওঠেছে একটা সময়ের উপাখ্যান। তাঁর জীবনীপাঠে একটা সময়ের চিত্র যেন আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। ওই সময়ের ভারত ও বহির্ভারতের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রেও আত্মজীবনীর মূল্য রয়েছে। লেখক হিসেবে এখানে তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন। লেখকের মধ্যে ভারতীয় মনোভাব প্রবলভাবে লক্ষণীয় হলেও চেষ্টা করেছেন আন্তর্জাতিক হয়ে উঠার। অবশ্য, তাঁর গল্প, উপন্যাস বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়া কিংবা তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র দেশের (ভারতের) বাইরে জনপ্রিয়তা পাওয়া লেখকের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রমাণ করে। সবশেষে বলি, আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড বইয়ের আবেদন অনেকের কাছেই থাকবে। বিশেষভাবে ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, কলাম লেখক, চলচ্চিত্রকার ও ভ্রমণ-আখ্যান পড়ুয়া পাঠকের কাছে বইটি অনেক কারণেই ভালো লাগবে। সাধারণ পাঠক জ্ঞানের বিচিত্র ভুবনে ডুব দেওয়ার জন্যে হলেও ‘আই অ্যাম নট অ্যান আইল্যান্ড’ হাতে নিতে পারেন; এতে যে তিনি আশাহত হবে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
(১৬ জুন ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ)
মনোজ্ঞ আলোচনা । সবদিক নিয়ে ।
ধন্যবাদ জানবেন।