spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবেপরোয়া আধুনিক কবি শামসের আনোয়ার

লিখেছেন : আবু রাইহান

বেপরোয়া আধুনিক কবি শামসের আনোয়ার

আবু রাইহান

‘শামসেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব টাই ছিল একটা বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্বের মতো। এতটাই উদ্দামতা, সজীবতা দুঃসাহসিকতা ছিল শামসেরের এতটাই আক্রমণাত্মক বিষন্ন আর ক্ষুব্ধ এতটাই আন্তরিক ছিল শামসের এতটাই আন্তরিক যে, প্রকৃত শামসেরকে খুঁজে পাওয়ায় ছিল মুশকিল। খুঁজে অবশ্যই ঠিকই পাওয়া যায় শামসেরকে, তার কবিতায়। শুধুমাত্র তিনটে কবিতার বইতেই, বাংলা সাহিত্যে,শামসের প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। মৃত্যু যদি অকালে না হাতছানি দিত তাকে, বাংলা কবিতা হয়তো আরো একটু বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠত। নতুন শতাব্দীর যারা তরুণ কবি তারা হয়তো অনেকেই জানেন না, কৃত্তিবাস যখন খ্যাতির চূড়ায়, সেই সময়ে প্রথম কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছিল শামসের আনোয়ার। আমাদের সেই তুমুল হৈচৈ এখন প্রায় বিস্মৃত। মা আর প্রেমিকার এক মিশ্রিত বন্ধনে শামসের এক দীর্ঘসময় আচ্ছন্ন ছিল।…সত্তরের সেই মহাসময় আর জীবন ছিল যেমন বেপরোয়া, তার কবিতাও তেমনই। আমাদের ভাষায় এমন সশস্ত্র এক আধুনিক কবি সত্যিই খুঁজে পাওয়া ভার।’–বাংলা ভাষার আধুনিক কবি শামসের আনোয়ার এর মৃত্যুর কয়েক বছর পর প্রকাশিত তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় এই কথাগুলো লিখেছিলেন সত্তরের আর এক বিশিষ্ট কবি ভাস্কর চক্রবর্তী।
কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি শামসের আনোয়ারের কবিতার বিশিষ্টতা হলো এই যে, তিনি এক ধরনের এক্সপ্রেশনিজমকে আমদানি করেছেন তাঁর কবিতায়। যা তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কোনো বাঙালি কবির মধ্যেই ততটা লক্ষিত হয় না। এক্সপ্রেশনিজম বা অভিব্যক্তিবাদ ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্যে একটি বিশেষ আন্দোলন। শিল্পী সাহিত্যিক তাঁদের ভেতরকার জ্বালা-যন্ত্রণা ও নানা ধরনের টানাপোড়েন বহির্বিশ্বের উপর চড়া রঙে চাপিয়েছিলেন। শামসেরও তাই করেছেন, তবে নিজস্ব রীতিতে, নিজস্ব ঘরানায়। শামসেরের অভিব্যক্তিবাদের একটি প্রধান অবলম্বন হলো নারীর যৌন সম্পর্ক–
“…রুদ্ধ ঠোঁট, রুদ্ধ স্তন
রুদ্ধ যোনির মেয়ে, মার্বেল
দিয়ে সাজান চোখের বাঘ…” (নাম-২)
কবি শামসের আনোয়ারকে নিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন– ‘শামসের মানে আমি শুনেছি তরবারি। বিধাতা তাই তার মুখ অমন সুচিন্তিত হত্যা প্রবণতা দিয়ে গড়েছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সোনার মাছি তো এখনও খুন হয়নি, উড়ছে। তার কবিতায় সে নিজেই ঘাতক।
“টমাটোয় থাকে ঘনীভূত বীর্যের খোয়াব, সূর্য ও নারীর শ্রেষ্ঠতা
এনে দেয় যা আমাদের।
টমাটোর পাতায় ধারালো চাবুকের গন্ধ অনুভূতিকে প্রখর করে…”
শামসের আনোয়ারের কাব্যভাষা সমস্ত কবিতাতেই এরকম। মূল কবিতা, তার বেদনা-যন্ত্রণা ভাষা -রহস্য কবির কাছেই থেকে গেছে। শাপগ্রস্ত জননী তাঁর মৃত জাতকদের একটি প্রদর্শনীতে ডেকেছেন যেন আমাদের।’

‘তোমার স্তনে হাত রাখলে মনে হয় যে একটা
ছোট্ট পাখি চেপে ধরেছি মুঠোর ভিতর,
জোরে চেপে ধরলে মরে যাবে–
আঙ্গুলের ডগা বুলিয়ে বুলিয়ে আমি তোমার
স্তনের পালক গুলো খাড়া করে তুলি।’ (স্তন)

কবি জয় গোস্বামী তাঁর এই ‘স্তন’ কবিতার সম্পর্কে বলেছেন, ‘স্তন’ বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে। ‘স্তন’ শব্দটিতে নতুন শক্তি ভরে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ। বাংলা ভাষায় অনেক কবির কবিতায় স্তনের ব্যবহার আছে। সার্থক ও সুন্দর ব্যবহার। কিন্তু শান্ত এই কবিতাটিতে একটি অপ্রত্যাশিত বিভাব এসে দেখা দিয়েছে। তা হল স্নেহ। কাম ই এর বিষয় এবং এর ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা যেহেতু বাড়ছে, তাই উন্মাদনা আসার কথা। কিন্তু সেই উন্মাদনা প্রকাশিত হচ্ছে স্নিগ্ধ শান্ত একটি স্নেহের মধ্য দিয়ে– ‘জোরে চেপে ধরলেই ম’রে যাবে–’ অভিব্যক্তিটির তো তুলনা নেই।’
নিজের কবিতা লেখা সম্পর্কে কবি শামসের আনোয়ার বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা অন্যতম আরও অনেক কাজের মধ্যে একটি কাজ বলে ভাবিনি কখনো। আমার গা- ফুঁড়ে কবিতা নামে একটা অসুখ মাত্র ষোলো বছর বয়সে বেরিয়েছিল। আকাশভর্তি উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজীর মধ্যে একদিন সন্ধ্যায়, নিঃসঙ্গ পিঙ্গলবর্ণের কোনো তারা লক্ষ্য করেছিলাম। উজ্জল তারাগুলিকে মনে হয়েছিল, আমাকে ঘিরে থাকা সুখী সমাজের প্রতিভু। কিন্তু ওই পিঙ্গল– অসুস্থ তারার চেতনা আমার চেতনার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ওই বয়সে। খুব অনায়াসে আমার গা-ফুঁড়ে একটি কবিতার জন্ম হয়েছিল।’ জীবদ্দশায় কবি শামসের আনোয়ারের কেবল তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি হল– ‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’, ‘মূর্খ স্বর্গের গান’ এবং ‘শিকল আমার গায়ের গন্ধে।’
নিজের তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে কবি শামসের আনোয়ার বলেছিলেন, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে আমার শেষ কাব্যগ্রন্থের সামঞ্জস্য রয়েছে। দুটো কাব্যগ্রন্থেই আমার মায়ের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে। আর এসেছে ব্যাধির কথা। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ইত্যাদি নানান ব্যাধি। দুটো কাব্যগ্রন্থেরই মূল সূত্র হচ্ছে প্রচন্ড ডেসপেয়ার। ডেসপেয়ারের সঠিক কোনো বাংলা প্রতিশব্দ আছে মনে হয় না। দুটো গ্রন্থেই ধ্বংস, আত্মহনন এবং মৃত্যু ভাবনা ফিরে এসেছে বারবার।
আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে, শুধু একটিমাত্র কবিতায় আমার মায়ের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রথম ও শেষ গ্রন্থে যেভাবে, সেভাবে নয়। সম্পূর্ণ অন্যভাবে। ওই কবিতার নাম নিশি। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লেখার সময় যে বাড়িতে আমি থাকতাম, সে বাড়িতেই প্রবল পরাক্রমে রাজ্যত্ব করতো আমার মায়ের পোষা তিরিশ থেকে বত্রিশটি বেড়াল।
‘মূর্খ স্বপ্নের গান’ এ আমি ধ্বংস, আত্মহনন এবং মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চেয়েছি গান বা সুরের মাধ্যমে। একমাত্র গান বা সুরই শূন্যতার পরিপূরক হতে পারে। আমার কাছে শূন্যতা মানে হল সময়। কেননা তাকে পরাজিত করা যায় না– সে হচ্ছে ফ্যাসিস্ট, চিরন্তন, পিছিয়ে যাবে বলেই সে এগিয়ে যায়… মুছে দেওয়ার জন্য কিছু নিরর্থক ছবি আঁকে। সুর বা গান কিন্তু এই সময়কেও খন্ডিত করে। তাকে নানান চেহারা দেয়। ইচ্ছেমতন হ্রস্ব বা দীর্ঘ করতে পারে। কবিতা মানের শব্দ। সুর ও গান বিধৃত থাকে শব্দে ও শব্দ জনিত আবহাওয়ায়। ছবি ও স্থাপত্যের জ্যামিতিক বিন্যাসেও গান ও সুর লিপ্ত থাকে। কবিতাতেও থাকে নিজস্ব জ্যামিতিক বিন্যাস এবং অন্তর্নিহিত রঙের টানা কাজ। যে কোনো ভালো কবিতা আমাদের প্রত্যক্ষ ও সরাসরিভাবে নাড়া দেয়। এভাবে প্রতিটি শিল্পই কিছুটা পরিমাণে সময়ের চেহারা পাল্টে দেয়। বিন্দুর জন্য হলেও সময়কে এভাবে ছিন্ন ও কর্তিত করে। ‘মূর্খ স্বপ্নের গান’এও অনুতাপ, ক্ষোভ, আশাহীনতা, লজ্জা, ধ্বংস এবং আত্মহননের চিন্তা অনেক কবিতায় খুব স্পষ্ট। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির কেন্দ্রে যা ঘুরছে, তা গান অথবা সুর। আমার সমস্ত ক্লান্তি, অবক্ষয় ও জড়তাকে মুহূর্তের জন্য হলেও গানের সাহায্যে অতিক্রম করতে চেয়েছে–
“গান আজ সমস্ত সকাল আমাকে ধরে রেখেছে তার চাবুকের নিচে
আমি কথা বলতে পারিনি, নড়তে পারিনি একবারও
কলম তুমি এসো…. ওকে ছুঁড়ে ফেলে দাও দূরে।” (নিলাম)
আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘শিকল আমার গায়ের গন্ধে’ আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’র চূড়ান্ত সম্প্রসারণ। তৃতীয় বইয়ে যতগুলো কবিতা আছে, সবগুলোকে মাত্র একটি কবিতাও বলা যায়। ‘শিকল আমার গায়ের গন্ধে’ কাব্য সংকলনে শুধু প্রথম কবিতায় গানের উল্লেখ আছে– “সমস্ত রেকর্ড বেজে চলেছে আমাদের মুখের বিরুদ্ধে
হাত ও নখের বিরুদ্ধে
তীক্ষ্ণ কালো আঁচড়ে বাজছে নষ্ট শরীর, নষ্ট হয়ে যাওয়া মন–
রেকর্ড থেকে লাফ দিয়ে উঠছে চাবুক এবং খড়গ ও
চাবুকের গান… (শাসন)
‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’ কবিতা বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘তুমি নারী, মা কিংবা প্রেয়সী’ কবিতা লেখার সময়ে আমার মধ্যে নারী জাতির প্রতি প্রবল কোনো বিদ্বেষ ছিল না। ওই কবিতায় আমাদের সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ ছিল বরং। মাকে জড়িয়ে আমি বড় হয়ে উঠেছিলাম। আমার প্রাথমিক জীবন ছিল সম্পূর্ণভাবে মায়ের দ্বারা শাসিত। তাই কিছু অভিযোগ মায়ের বিরুদ্ধে এসে পড়েছে।
“…অথচ যে কিছুতেই পথ-ঘাট মনে রাখতে পারতো না
ভয় পেতো আলো রক্ত ও সমুদ্র,যাকে তোমরা
ঘোড়দৌড়ের পোশাক পরিয়ে অপমান করেছিলে…
আমি তার অতি পবিত্র করুণ মৃতদেহ তোমার পায়ের কাছে রাখি।…”
দেশ সুবর্ণজয়ন্তী কবিতাসংকলনে (১৯৩৩-১৯৮৩)পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরে একশ জন নির্বাচিত বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবিদের প্রতিনিধিমূলক কবিতা প্রকাশ করেছিল। এই সংকলনে কবি শামসের আনোয়ার এর ‘একটি দুঃসাহসিক যুবক’ নামের একটি কবিতা রয়েছে।
‘আমি তোমার শরীরের হত্যাকারী ঘূর্ণি ও চোরাবালির
গভীর ষড়যন্ত্র এড়িয়ে আকাঙ্ক্ষার প্রবালদ্বীপে নেমে যাব
শরীরের সমস্ত নিষ্করুণ মরুভূমি ও পর্বতশৃঙ্গগুলির
দম্ভ জয় করে আমি উঠে যাব বাসনার উগ্রচূড়ায়
আমি অই শরীরের উন্মুখ কাঁটাগুলির ভিতর হতে
ছিঁড়ে নেব উজ্জ্বল ফুলের মতো তোমার প্রগাঢ় হৃৎপিণ্ড।’
‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার জন্ম ১৯৫৩ সালে। কৃত্তিবাসের সম্পাদক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তিবাস সংকলন’ এর দ্বিতীয় খন্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাস পত্রিকা কোন কবি তৈরি করেনি। বরং বলা যায় এই পত্রিকাকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার অনেক প্রধান কবি আত্মপ্রকাশ করেছেন।’ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভূমিকা আরো লিখেছেন, ‘কৃত্তিবাসের এক সংখ্যায় অনেকের লেখা প্রকাশিত হলেও ৮-১০ জনই নিয়মিত লেখক। এঁরাই পত্রিকার প্রধান স্তম্ভ। বলাবাহুল্য এঁরা হলেন-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, উৎপল বসু, শরৎ মুখোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, তারাপদ রায় প্রমূখ। সেই সঙ্গে সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সংযোজন, নতুনদের মধ্যে আকৃষ্ট হয়ে এসেছেন সমধর্মী কবিরা। যেমন দেবারতি মিত্র, ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার। ১৯৬৬ সালে কৃত্তিবাস পত্রিকা কৃত্তিবাস পুরস্কার চালু করে। কৃত্তিবাস পুরস্কারের বিজ্ঞাপনে লেখা হয় ২৫ বছর বা তার কম বয়স যে কবির মৌলিক বাংলা কবিতা আমাদের মতে বছরের শ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে বিবেচিত হবে, এই পুরস্কার তার জন্য। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন, ‘প্রথমবার কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছিলেন কবি শামসের আনোয়ার। শামসের আনোয়ার তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসের ছাত্র! পুরস্কারের মূল্য ছিল ১০০ টাকা। প্রথম বছর কৃত্তিবাস পুরস্কারের ১০০টাকা দিয়েছিলেন সাগরময় ঘোষ। আর শামসের আনোয়ারের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন দীপ্তি ত্রিপাঠী।’
কৃত্তিবাস সংকলনের দ্বিতীয় খন্ডে শামসের আনোয়ারের মোট ৬টি বাছাই কবিতা সংকলিত হয়েছে। ‘স্মৃতি কৈশোরিক’ কবিতায় শামসের আনোয়ারে লিখেছেন–
‘ক্রমশ রক্তিম হয়ে উঠছি এই অপরাধে তুমি চলে গেলে আনুগত্যহীন– আমি
তো বৎসরান্তে আবার আম্রমুকুলের ডেকে উঠবে কোকিল এই ভেবে মোমবাতি
জ্বেলে প্রতীক্ষায় আছি। শিখার মতো আলোকিত হয়ে তুমি আসবে বলেছিলে–
যেন তুমি আমায় দেবে হাসপাতাল যেন তুমি ফিরিয়ে দেবে মায়ের কোল এবং
উষ্ণতা। –বাল্যের বন্ধুরা তো সকলে বালকই থেকে যায়–
শুধু বাঘবন্দির ঘুঁটি হয়ে ওঠে জীবন আর বুকের ভেতর ফুঁসে ওঠে দুরন্ত টার্জান।’

রাত্রির গভীর অনুভব ফুটে ওঠে ‘নিয়ন অরণ্যে’ কবিতায়–

‘অদৃশ্য আঙ্গুল থেকে ঝুলছে অসংখ্য রঙিন বেলুন। স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেতর রাত্রি
নামে মৃদু পায়ে। ধূসর নীল ও বেগনি মেঘের বিকেলে সন্ধ্যা পার হয়ে.–
নিয়নের আলোকরশ্মিতে ক্রমশ জড়িয়ে পড়ে মানুষ ও মানুষীরা।–
রাত্রির অলৌকিক বর্ণচ্ছটায়, রহস্যময়তায়,গভীরতায়, মদালস আলস্যতায়
আমাদের সর্বস্বের বিনিময়ে আমরা পরস্পর নিবিড় আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে কাঁপতে
থাকি থরথর করে রাত্রির শেষ প্রান্তে এসে। এ রাতের যদি শেষ না হতো।’
মা আর প্রেমিকার এক মিশ্রিত বন্ধনে কবি শামসের আনোয়ার দীর্ঘসময় আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁর ‘মা অথবা প্রেমিকা স্মরণে’ নামক কবিতায় দেখি তারই প্রকাশ–

‘তোমার শরীরের পাতায় পাতায় আমি খুঁজেছি তারই রক্তের দাগ
বুকের মধ্যাহ্ন আকাশে যৌবনের দীপ্ত জ্বালা
আমি তোমার সবুজ তলপেট জরায়ু আর হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে
ফিরে পেতে চেয়েছিলাম স্মৃতির ধ্বংসাবশেষ।
কুসুমিত স্তনদুটির কাছে প্রার্থনা ছিল
তোমার মায়ের কৈশোরিক গোলাপের ঘ্রাণ
অই সুড়ঙ্গেতে আছে তাঁর বালিকাবেলার অব্যবহৃত চোরাকুঠুরি
অথচ তুমি কোনদিনই গর্ভধারণের মতো ঘনিষ্ঠ হলে না।’

‘তুমি নারী, মা কিংবা প্রেয়সী’ কবিতায় দেখি একই রকম অনুভব এর চিত্র–

‘দূরে একনিষ্ঠ জিঘাংসায় জ্বলে হ্যারিকেন
যেন বা অন্ধকারে
ওত পেতে আছে দৃপ্ত রোষায়িত স্তন, অথচ তোমার স্তনে
আঘাত ছিল না, কোমলতা ছিল, আশীর্বাদ ছিল
আমি কতদিন তোমার স্তনের মতো দুটি সেবাপরায়ণ
স্তন খুঁজেছি’–

‘ঈর্ষায় রচিত’ কবিতায় ভিন্নতর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব কেমন উদাস ও বিষন্ন করে–

‘অমন নরম বুক, কবিতার উইপোকায় খেয়ে গেছে
কাবা শরীফের মত চুম খাওয়া যায়
অন্য কোন কারণে নয়
নির্জন বৃষ্টির মধ্যে– তুই আমার চেয়েও দুঃখিত লোকের মতো
হেঁটে যেতে পারিস’–
কবিতার শরীর নিয়ে খেলা করা ক্লান্ত কবি ‘স্নায়ু ছাড়া ঘুমের শেষে’ কবিতায় লেখেন–
‘বুকের খুব কাছাকাছি বেজে ওঠে শীতের রাতের গান
ওর তিনটের সময় উঠে আমি তাই পরিশ্রমসাধ্য ছুরি দিয়ে শব্দের শিষ কাটি
নীল আলো জ্বলা টেবিলে শব্দের নরম খোসা স্তুপ হয়ে জমে থাকে’–
কবি শামসের আনোয়ারের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ২০০২ সালে তাঁর প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা একশোর বেশি কিছু কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় শামসের আনোয়ারের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। তাঁর এই শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের কবিতাগুলি নির্বাচন করে দিয়েছিলেন কবি দেবারতি মিত্র। শামসের আনোয়ারের কবিতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘শামসের স্বেচ্ছায় সচেতনে পূর্ববর্তীদের প্রভাব এড়িয়ে নিজের পথ, নিজের কাব্য ভাষা খুঁজতে চেয়েছিলেন। নিজস্ব জীবনযাপন বা চিন্তাধারা সম্বন্ধে তাঁর রাখ ঢাক ছিল না। যতদূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব,ততদূর তিনি নান্দনিক বা সামাজিক সংস্কার না মেনে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় ৱ্যাবো সুলভ একটা টক ঝাল স্বাদ এসেছে। কৃত্তিবাস এর এবং হাংরিদের কেউ কেউ অবশ্য আগেই এ ধরনের কিছু সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে শামসের আলাদা। তাঁর জীবনই তাঁকে আলাদা করে দিয়েছিল। শামসেরের নাগরিক, স্বেচ্ছাচারী, আত্মভুক যন্ত্রণা বাইশ বছর বয়স থেকেই তাঁর সত্তার মধ্যে শিকড় গেড়েছিল–
“….আমার বিছানার পাশে বনলতা সেন নয় কোনো এক জলজ্যান্ত
পাপিয়া বসুর মণ্ডুকের মতো দুই স্তন ওৎ পেতে থাকে
শস্তা তেলের দুর্গন্ধে বিদিশার নেশা খুঁজতে গিয়েই
আমি অপ্রতিভ হেসে ফেলি
পায়ের নিচেই ক্ষুরধার রোদ,আমি বলতে পারি না আহা
বাইরে কি মনোরম বৃষ্টি…
ব্যর্থতা ও গ্লানির ক্ষুধায় হস্তমৈথুনের সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েই
আমি পুনরায় ব্যর্থতা ও গ্লানির নি:সীম তটে ফিরে আসি…”
(এই কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা)

রোমান্টিকতার খোসা ছাড়িয়ে ফেলা বাস্তবতা যুবক-যুবতীর প্রেমহীন দেহমিলনের তেতো যন্ত্রণা এবং পরিশেষে মনোহীন ক্লান্তি ও আচ্ছন্ন বিষাদ শামসেরের কবিতায় এক দারুন চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছে:
“একটা পতঙ্গভুক বৃক্ষের মতো ওর তৃষিত ডালপালাগুলো
আপ্রাণ চেপে ধরে আমার শরীর…
পরিশ্রম হয় ভালোবাসাহীনতার পরিশ্রমে
মেঝে থেকে দেয়াল অব্দি বেঁকে যায়…
আমি ওর ডালপালার জঙ্গলে
একটা মৃত পতঙ্গের মতো আটকে থাকি।” (ভালোবাসাহীনতার কষ্ট)

শুধু ভালবাসাহীন নর-নারীর যৌনাবেগ ও খেলা শেষের তিক্ততা নয়, তার চেয়ে অস্তিত্বমূলের গভীর বিষাদ এবং বিস্তীর্ণ অন্ধকার ছেয়ে আছে শামসেরকে।
মাকে নিয়ে শামসেরের কবিতা গুলি বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। মায়ের সঙ্গে ছেলের এমন সম্পর্ক আমার মনে হয়েছে অভারতীয়। শামসের নিজেকে কখনো ঈডিপাস, কখনো হ্যামলেট, কখনো নষ্টামি দুষ্টামি মেশানো এক বালক যুবক মনে করেন। তাঁর মা ছিলেন বিবাহবিচ্ছিন্না,শামসের তাঁর একমাত্র সন্তান। কিন্তু ছেলের সঙ্গে তাঁর বনে না। মায়ের মা নানি ছিলেন স্নেহের আকর, শামসেরের আশ্রয়স্থল। এইসব জটিল কবিতা বিচিত্র মনোবিকলনের ফল। এরকম কবিতা কস্মিনকালে পড়েছি বলে মনে হয় না।
“…তোমার মা সেদিন স্নেহে পাগলিনী প্রায়
ব্যাকুল বাঘিনীর মতো সাহসে তেজে আমায় স্তন্যপান করিয়েছিলেন
আমার তৃষ্ণার কান্না তাঁর শুকনো বুকের
দুকুল ছাপিয়ে দুধের বান ডেকেছিলো
অফুরন্ত হৃদয় ঝরেছিল দুচোখের পাতা পেয়ে
তোমরা যা পাও নি আমি পেয়েছি সে সবই
আমি তাঁর গর্ভের চোরাকুঠুরিতে ভ্রূণের মত লুকিয়ে বেঁচেছি…”
(মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে)

সত্তরের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশ্রয়ে কৃত্তিবাস পত্রিকায় লিখে এক ঝাঁক প্রতিশ্রুতিমান কবি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার নতুন টাটকা বাতাস বয়ে এনেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শামসের আনোয়ার, দেবারতি মিত্র, ভাস্কর চক্রবর্তী প্রমুখ। শুধু কৃত্তিবাস পত্রিকায় নয় দেশ পত্রিকায়ও এদের কবিতা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল ধারাবাহিকভাবে। বাছাই করা কবি ও কবিতা নিয়ে প্রকাশিত দেশের সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলনেও রয়েছে কবি শামসের আনোয়ারের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। কবি শামসের আনোয়ার নিজে ‘জর্নাল সত্তর’ (জর্নাল,জার্নাল নয় কেন? জীবনানন্দের বিখ্যাত অতিপঠিত কবিতাটি কিন্তু জর্নাল ১৩৪৬,জার্নাল ১৩৪৬ নয়।) নামে একটি বিতর্কিত এবং সাহসী পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ও কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন শামসেরের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’ বেরোনো মাত্র শামসের আনোয়ার আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে বিতর্কিত কবি হয়ে ওঠে। সেই সময়টা আমি আর শামসের খুব কাছাকাছি থাকতাম। দেখেছিলাম এই তীব্র খ্যাতির পাশাপাশি এক অসম্ভব পারিবারিক সন্ত্রাস ও সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়েছিল ওকে।…সেই সময় থেকেই শামসের ভাবতে শুরু করলো কবিতা-ফবিতা কিচ্ছু হচ্ছে না। একদিন বাড়িতে গিয়ে দেখি আমাদের সবার কবিতার বই ও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে মাটিতে, নিজের কবিতার বই তো বটেই। অসম্ভব উত্তেজনায় কাঁপছিল শামসের। বলছিল, কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে অনেক দূরে। সেই শেষ। সেদিন মধ্যরাত অবধি আমরা একসঙ্গে ছিলাম… অথচ কোনো কিছুর মধ্যেই শামসেরকে যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বারবার শামসের বলছিল, ও লিখতে পারছে না আর বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ছিল। ঘুমের মধ্যে থেকে আবার জেগে উঠছিল, আবার বলছিল সেই একই কথা। এর কয়েকদিন পর আমি দেশের বাইরে চলে যাই। ফিরে এসে শুনলাম কি একটা খেয়ে পিজি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে শামসের। মাঝে মাঝে দেখতে যেতাম দেখতাম সেই উদ্দাম কবির ঘুমেরও অনেক গভীরে ঢুকে যাওয়া শরীর। এক মাস ঘুমিয়েই থাকলো শামসের। সেই ঘুম থেকে নিচে নামতে নামতে নামতে, নামতে এক্কেবারে মাটির তলায়…।’

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় কবি বন্ধু আয়ান রশিদ খানের সঙ্গে শামসের আনোয়ার কবি হাফিজের ‘দিওয়ান’ এর বেশ কিছু শের বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন। মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থে কবি শামসের আনোয়ার আধুনিক কবি হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতার পংক্তি তুলে ধরলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

‘বড় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কাছে
বর্ষীয়সী মহিলাদের কাছে সমবেত শিশুদের কাছে
প্রার্থনার দুহাত তুলে নতজানু বলেছিলাম নম্র স্বরে
ইতিহাস পড়া শেষ করে সেবার আমি রামমোহনপুরে গিয়েছিলাম
ভেবেছিলাম পুরনো মন বিকিয়ে দিয়ে নতুন মন কেনা যাবে
তুমি তখন তিনটি বল নিয়ে হৃদয়ের গোপন খেলা খেলেছিলে তিনজন বালকের সাথে
আমি পারিনি লুফে নিতে
ক্লান্তি নিয়ে গিয়েছিলাম– ক্লান্তি নিয়ে ফিরে এলাম’–
(রামমোহনপুরের স্মৃতি)

‘আমার এ ঘর চতুষ্কোণ, অন্ধকার
অনন্ত অন্ধকারে আমি সাঁতার কাটি,হামাগুড়ি দিই
এখানে হঠাৎ কোনো বিশাল ঘন্টা বেজে ওঠে না
অন্ধকারের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ এখানে নেই
অন্ধকার সমুদ্রে আমি অজস্র প্রবাল, সবুজদ্বীপ,মাছ
ও মৎস্য নারীদের খুঁজে পাই
মৎস্য নারীদের মতো আমি আলো দেখি না, তীর দেখি না।’ (ঘর)

‘ইচ্ছার খুঁটিতে বাঁধা আমি তুমি জানো
তোমার দৈহিক ভঙ্গি পরাধীনতার মানে প্রেম।
মূর্খতার গুঁড়ো মেখে নিই প্রত্যহ সন্ধ্যায়
তোমাদের মুখ হতে মূর্খতার গুঁড়ো চেটে খাই–
প্রত্যেক সন্ধ্যায় তুমি শরীরে মেখেছো কেরোসিন
বলছো আগুন হয়ে, খেলা করো তবে
অনুমতি পত্র নেই জেনে তুমি ব্যঙ্গে হাসো
লাইসেন্স দেখে অন্য যুবকের চিতা জ্বেলে দাও
তোমার হৃদয় ভিড়াক্রান্ত নিলামের খোলা কুঠি
জানি প্রাপ্য নাও তুমি অস্তিত্বের দামে’–
(তুমিই আত্মীয় বুক, ছাগল ও কঠিন আধার)

‘কোন দূর লাবণ্যহীন প্রান্তরে একটি বিষন্ন রমণী
স্মৃতির মত চুলগুলি ধীর ও শান্ত ছড়িয়ে থাকে সমস্ত মুখে
অশ্রুপাতের গান গায়–
অশ্রুপাত- অশ্রুপাতের চেয়েও মর্মান্তিক সংগীত আর কিছু নেই
এই পৃথিবীতে’। (মাতৃভূমি ও মায়াবী জ্যোৎস্নায়)

‘কোন বিদর্ভ নগরী আমার স্বপ্নের ভিতর জেগে ওঠে না
ইতিহাসের কোনো অর্থ নেই মূঢ়তা ও ভ্রান্তি ছাড়া
যে নারী আমাকে পথে বসালো তার ক্রুর হাসির ছাপ
লেগে আছে ইতিহাসের পৃষ্ঠায়
আমি জানি মানুষের কোন উত্তরণ ক্লিওর আঁচলে বাধা নেই
এই কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা ছাড়া কোন সত্যের
অপেক্ষা আমি রাখি না
নরম বৃষ্টির মধ্যে একান্ত দুঃখিত লোকের মতন আমি
মাথা নিচু করে হেঁটে যাই’–
(এই কলকাতা আর আমার নিঃসঙ্গ বিছানা)

‘তার স্তন-দুটি ছিল একটি শান্ত, ছোট্ট দ্বীপ–
নদীর হালকা শরীর নিয়ে সে ঘুরে বেড়াতো
নিজেরই স্তনের চারিপাশে
দেহের বালু নিয়ে খেলা করতো আত্মমগ্ন বালিকার মতো
তার উরু দুটি ছিল একটি অকর্ষিত পশ্চাদ-ভূমি
অনন্ত শৈশব এবং সারল্যে ভরা
মাছেদের সঙ্গে খেলা করতে ভালোবাসতো সে, চাইতো
যে তার খোলা জাং-এর ওপর
স্বাভাবিক, ছোট পাখিরা নেচে বেড়াক।
দন্তুর কুমীরের দল তাকে কামড়ে ধরতো বার-বার
মাছেদের ছদ্মবেশে এসে
প্রতিটি সঙ্গমের সময় ব্যাকুল, ব্যথিত চিলের ঝটপটানি
এবং কান্নায় ভ’রে যেতো ওই বালিকার শরীরের
অপ্রস্তুত, লজ্জিত দ্বীপ।’ (বালিকা)

‘তুমি আমার রক্তে প্রবল নিম্নচাপ জাগিয়ে তোলো
সারাক্ষণ জাহাজডুবি হয় আমার হাত ও পায়ের ভিতর
তুমি কি অন্তত একবার সৎ,প্রফুল্ল বৃষ্টি হয়ে
আমার শরীরের ওপর ঝরতে পারো না?
তোমার গলার স্বর আমাকে সাপের ফণার মতো প্রহার করে
যখনই তোমার মুখ দেখি আমি চিৎকার ক’রে উঠি
-‘ঢুকিয়ে দাও এই ক্ষুধিত বুকের ভিতর তোমার
মুখ সম্পূর্ণ, সবটা ঢুকিয়ে দাও।’ (ক্ষুধা)

‘ভিখিরিদের লা-ইলাহা চিৎকারে ডুবে যায় পৃথিবীর নরক–
প্রত্যেকেই ও-রকম চিৎকার করে।
হাসপাতাল চিৎকার করে নিঃস্ব, কানা ভিখিরি হয়ে
জাহাজ চিৎকার করে, মোটরের হর্ন চিৎকার ক’রে ওঠে
দুঃস্বপ্নের ভিতর
রমণীর শরীরের সামনে ব’সে পুরুষ বোবা, হাবা, কানা
আর কালা হয়ে খুঁজে কিছু, চিৎকার ক’রে’ (অবিশ্রান্ত)

                                               ‘আমার কপালে আঁকা রয়েছে পলাতক হরিণ
                        ও জেব্রাদের পায়ের ছাপ

বিনা অপরাধে যাবজ্জীবন সাজা হয়ে গেছে আমার:
ফাঁসিকাঠের পাটাতনের নিচে যে রকম ভয়াবহ
শূন্যতা থাকে, আমার দু’চোখ সেরকম শূন্যতায় ভর্তি।’
(আমার কপালে আঁকা রয়েছে পলাতক হরিণ)

‘সমস্ত শরীর ঘাসে ঢেকে তোমরা রাঁধো
টেবিলে ডালের বাটি এগিয়ে দাও
ঘাস কিঞ্চিত সরিয়ে সঙ্গম কর
শিশুকে গুম করে দাও ঘাসের জঙ্গলে
দুধ খাওয়াও
মাকড়শা,আরশোলা ও পোকামাকড়দের মৃত্যুর ফাঁস
ঐ ঘাসের জঙ্গল
বিষাক্ত সাপের আনাগোনার রাস্তাও ঐ ঘাস
শুধু যখন চুল খুলে আয়নার সামনে গুনগুন গান কর
ঘাসের জঙ্গল থেকে তোমাদের মুখ বেরিয়ে আসে’ (ঘাস)

‘কালো স্তম্ভ বুকের ওপর নেমে এলো
আমি এর নাম রেখেছি সন্ধ্যা
ঘোলাটে শাদা জিভ চেটে দিল আমার শরীর
এর নাম রেখেছি ভোর
ঊরুর থলথলে গরম চর্বি বন্ধ ক’রে দিলো নিঃশ্বাস
আমি এর নাম রেখেছি দুপুর
মাথার ভিতর লাল সুরকি ভাঙতে শুরু করলো
প্রকাণ্ড এক দুরমুশ
আমি এর নাম রেখেছি রাত’ (নাম)

‘মুখের উপর ঝাঁপ দেয় আর একটি মুখ
ধারালো নখ দিয়ে সে কেবল আমাকে ছিঁড়তে থাকে
আরেকটি দুরমুশের ভোঁতা ও বিশাল আঘাতে মুখ চ্যাপ্টা করে দেয়,
একটি মুখ সহাস্য ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় মুখের আলো
বছরের-পর-বছর গম্ভীর হয়ে অন্য একটি বসে থাকে
মুখের সামনে’– (মুখ)

‘ঘুম চামড়ার নিচ থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে
মগজে ঢুকে পড়ে
ঘুমের শরীর অনেক কাঁটা গুটানো থাকে
ভয়ের কাঁটা, অনুশোচনার কাঁটা, সন্তাপের কাঁটা
তীব্র ঘুমের চামড়ার গায়ে বেঁধে যায়
শরীরে চামড়ায় তখন ফুটতে থাকে ক্লান্তি
সন্তাপ আর অনুশোচনা।’ (ঘুম)

‘আমি কবিতার শিকল ভেঙে পালাবো আজ,
শুধু আমার দু পায়ের চিহ্ন থাকবে বালুর ওপর-
কবিতার শিকলের বাড়ি খেয়েছি দিন রাত
চোখ নষ্ট হয়ে গেছে– বোধ নষ্ট হয়ে গেছে
কবিতার শিকলের ভীম আঁটুনিতে-
নগ্ন চরাচর পড়ে থেকেছে দুপাশে।’
(শিকল আমার গায়ের গন্ধে)

কবি শামসের আনোয়ারের জীবিত অবস্থায় প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতার উল্লেখিত পংক্তি তাঁর কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমাদের বিমোহিত করে। সেই সঙ্গে আমাদের বিষন্ন, বিমর্ষ করে বাংলা ভাষার এই শক্তিশালী কবির অকাল আত্মহত্যা। কলকাতার নাগরিক জীবনে যেমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ রয়েছে। তেমনি গভীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বয়ে আনে প্রবল হতাশা। কবিতায় যাপিত জীবন শামসের আনোয়ারের ভেতর কোন হতাশা তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে নিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছিল তা আজও গভীর রহস্যময়তায় ঢাকা।
কবি একরাম আলী লিখেছেন, ‘ষাটের দশকের কবি হিসেবে যাঁদের আলগাভাবে চিহ্নিত করা যায়, শামশের ছিলেন তাঁদের একজন এবং প্রবলভাবে ব্যতিক্রমী। কেননা তাঁর জীবনটাই ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের বজ্রআঁটুনির বাইরের। ভয়ঙ্কর রকমের অন্তর্মুখী ছিলেন এই অভিজাত মানুষটি।… একটা জীবন তিনি কাটাতে চেয়েছিলেন, যে জীবন নিশ্চিদ্রভাবে কবিতা বেষ্টিত। নিজেকে তিনি ব্লেডে কেটে কেটে পেন্সিলের মতো এমন তীক্ষ্ণ মুখ করতে চেয়েছিলেন, যেন কোথাও এক কণা মেদ না থাকে। যেন তার ভঙ্গি হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক। এই কারণে শামসেরের কাব্য ভাষা হয়তো খটখটে হয়ে উঠেছে। যেমনটা গড়পড়তা বাংলা কবিতা পাঠক আশা করেন না। ফলে তাঁর কবিতা সাধারণে ততটা পঠিত হয়নি। যতটা পঠিত হলে কোন কবির কবিতা মুখে মুখে ঘোরে। অবশ্য তাতে শামসেরের বা তাঁর কবিতার কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি। কেননা জনপ্রিয় হওয়ার কোন আকাঙ্ক্ষা শামসেরের ছিলই না। তিনি এতটাই নির্বাচিত এবং খেয়ালি জীবনযাপন করতেন,সেখানে তাঁর অনুভিপ্রেত কোনো কিছুরই প্রবেশাধিকার ছিল না।…তাঁর কাজই ছিল ভবিষ্যতের অর্থাৎ ধ্বংসের দিকে হেঁটে যাওয়া আর হেঁটে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে জমিয়ে রাখা শ দেড়েক ঘুমের ট্যাবলেট তিনি ১৯৯২এর অক্টোবরে খেয়ে ফেলেন। তারপর দীর্ঘ পাঁচ মাস কোমায় আচ্ছন্ন থেকে এসএসকেএম হাসপাতালের বেডে সরকারি সাহায্যের ব্যর্থ চিকিৎসা নিতে নিতে ১৯৯৩এর ১২ জুন তাঁর আকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুকে তিনি খুঁজে পান।’
ভাবতে বিস্ময় লাগে বাংলা ভাষার এই শক্তিশালী আধুনিক কবি সাহিত্য সমালোচকদের অদ্ভুত উদাসীনতায় বাংলা কবিতা প্রিয় পাঠকের কাছে তিনি এখন কেবল বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. “বেপরোয়া আধুনিক কবি শামসের আনোয়ার ” একটানে একবার পড়লাম। কিন্তু আমি আরও কয়েকবার পড়বো । শামসের আনোয়ারের কবিতা পড়েছি এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে । কিন্তু এই গদ্যটি পড়ার পর মনে হচ্ছে এমন একজন কবি কেন আরও অনেক বেশি আলোচিত হননি এবং এখনও হচ্ছেন না কেন? শুধু এই গদ্যে শামসের আনোয়ারের যেসকল কবিতাংশ/ কবিতা উদ্ধৃতি করা হয়েছে, কবি হিসেবে তার অনন্যতা ও শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা পেতে তা যথেষ্ট। আবু রাইহান যথেষ্ট মননশীলতার সঙ্গে শামসের আনোয়ারকে উপস্থাপন করেছেন। এমন একটি চমৎকার লেখার জন্য লেখক আবু রাইহানকে সাধুবাদ জানাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ