তৈমুর খান
সত্তর দশক থেকে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু কবির কয়েকটি কাব্য পাঠ করার সুযোগ ঘটল। সেগুলি থেকেই নির্বাচিত কয়েকটি কাব্যের আলোচনা করা হল এই সংখ্যায়।কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এবং বৈচিত্র্য অনুযায়ী বিভিন্ন দিক থেকে এগুলি বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। গতানুগতিক ধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা নতুন পথের সন্ধানে প্রত্যেক কবিই অগ্রসর হবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন বয়সের এবং বিভিন্ন সময়ের হলেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য অনুধাবনযোগ্য।
💚
কিউবিজম্ ধারার কবিতা
সত্তর দশকের কবি নিখিলকুমার সরকার (জন্ম ১৯৪৬)এর কাব্যগ্রন্থ “নানারঙের হাইফেন” (প্রথম প্রকাশ ২০১৭) সম্প্রতি আমার পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। তিনি বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় কবি নন, কারণ তিনি কম লেখেন, তার পাঠকও কম। বাংলা কবিতার ভিন্নপথ ও ভিন্নস্বরের অনুসন্ধান করেন, বলেই সবশ্রেণির পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যে যে কিউবিজম্ (Cubism) আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল, সেই পথকেই তিনি অনুসরণ করেছেন। কিউবিজম শিল্পীর সৃষ্ট জগৎ ও প্রকৃতিই প্রধান লক্ষ্য। শিল্পীই তার বাস্তবতা ও রহস্যের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেন। পাল সেজান এই প্রসঙ্গে বলেছেন : “Art is a harmony parallel with nature.”(Paul Cezanne, Cezanne. Mont Sainte Victoire)
অর্থাৎ শিল্পও প্রকৃতির সমান্তরালভাবে গড়ে উঠবে।
কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি প্রকৃতির সঙ্গে অন্তর্লীন মানবীয় প্রবৃত্তির এক সমান্তরাল সম্পর্ক এবং কবি নিজস্ব বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। আত্মরতির স্ফুরিত অবগাহনে দোদুল্যমান কবি নিজের ছায়াতেই সম্মোহিত হয়েছেন। নার্সিসাস্ এমনই বহুলতায় সক্রিয় ও স্বয়ংক্রিয় যে জীবনের স্বতশ্চলতাকে প্রগাঢ় করে তুলেছে। ক্ষরণ ও শোভনের পর্যায়গুলি ছাপিয়ে গেছে কবির প্রত্ন-প্যাশন। জর্জর বাস্তবকে নান্দনিক মোহটানে ঘোরের প্রাচুর্যতা দান করেছে। সহজ অনাড়ম্বর, উপমা বর্জিত ভাষার সন্নিধানে কবি উন্মোচন করেছেন তাঁর মর্মযাপনকে : “চির-একুশ নন্দনকাননের বাইরে বেরোতেই দেয়নি, এখনও প্রেম অসময়ের বৃষ্টিতে স্নান করে, সর্দিফর্দি লাগে না, অথচ প্রেমের কত বয়স হল ভাবুন তো” (প্রেমকথা ২)
এই প্রেম তো ভাষা, ফেব্রুয়ারি মাস, কবিতা এবং প্রাজ্ঞ জীবনও । এই প্রেমযাপন চিরন্তন পৃথিবীকেই চেনায় । সংস্কৃতি ও সম্পর্কের ভেতর শয্যা পাতে। কিন্তু
“আপাতত স্ক্রিপ্টে প্রেম নেই”
তা না থাক, জীবনের জার্নিতে প্রেমের পর্যটন চলছেই। আবার ফিরে আসবে। লাইফ সিনেমায় দেখা যাবে। স্ক্রিপ্ট রাইটার জানেন না, পরের দৃশ্যগুলিতে কী লেখা হবে। তিনিই লিখবেন কিনা তাও জানেন না। অনিশ্চয়তার ক্রিয়াগুলি থেকেই এই খণ্ডতা ও দ্বান্দ্বিকতা জীবনেরই দৃশ্যপটে ফুটে ওঠা এক বিস্ময়।
"প্রেমকথা"র নিবিড় পর্যায়গুলি থেকে যে আত্মভাষ্য উঠে এসেছে তা সব ৠতু পার করে ভেসে গেছে অন্তহীন শূন্যতায়। জানালা নিজেই নিজের জানালা নিরীক্ষণ করেছে। বাউল সাধকের মতো নিজের ভেতর নিজেরই রহস্য নিয়ে খেলা। বাউলকথার ধাঁধায় পাঠককে নিয়ে যাওয়া :
“বয়ঃসন্ধির জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে যেতে
নিষিদ্ধ জানালায় চোখ পড়তেই দেখে ফেলেছিল
অলোকসামান্য দৃশ্যটি : চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে…”
কিন্তু সেই চাঁদ তো সর্বৈব সমানুভূতির দরজায় পৌঁছায় না কোনোদিন। তবু ৠতুপর্ণা ষোলোকলায় আবর্তিত হতে হতে উনিশে পা দেয়। প্রেমের আদিসত্তার বিবর্তন থেকে বন্যপ্রাণী বাঘের ভেতরও কবির কামনা ও প্রশ্রয় বিতত চিদানন্দময় :
“আমি বাঘ
আমি মানুষ
আমি বাঘমানুষ”
বাঘ খণ্ড সত্তা, মানুষও খণ্ড সত্তা ; তেমনি বেড়াল মেয়ে, আঁচড়-কামড়, রতিগন্ধময় ও রমণী শৃঙ্গারের রমণী এসে উঁকি দেয়।
আরণ্যক বিনিময়ে সব ভেদ মুছে গেলে আদি ও অনন্ত প্রান্ত মিলে যায়। সেখানে চন্দনবন, অ্যাসাইলাম, সংশোধনাগার রাত্রির রূপকথার অঙ্গ হয়ে ওঠে। খরগোশ-কচ্ছপের গল্পে মানুষের বৈরাগ্য ও ভাষা, চলন ও কথন, পথ ও গন্তব্য মিশে যায়। চরিত্রের বদল ঘটে না। সুররিয়ালিস্টিক ঘটনায় কবি দেখতে পান :
“কচ্ছপ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে —ননস্টপ
গন্তব্য থেকে তার অস্তিত্বের ব্যবধান কমে আসছে
কমে আসছে দ্রুত… হঠাৎই এক অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি উড়ে এসে
খরগোশের ঘুম ভাঙিয়ে দিল —আবার তার দৌড়ানো শুরু”
(খরগোশ বনাম কচ্ছপ)
এই পাণ্ডুলিপির আয়োজনেই আমাদের দৌড় থামে না। কথা ফুরিয়ে যায়। আলো ফুরিয়ে যায়, কিন্তু জীবন ফুরায় না। না-কথা না-আলোর ভেতর আমাদের উপকথা, উপগান, ভাঙা ঐশ্বর্য আর অর্ধ প্রজ্ঞা এবং হিংসা ও অহিংসার বিবরণ ঢলে পড়ে। কবিতা সেই নাগালেই অথবা অন্ধ বিপন্নতায় লোকজ সমীহ থেকে আলো পায়। আমরা পুতুল হয়ে, প্রদীপ হয়ে, শো-কেসে, ড্রয়ারে, টেবিলে অবস্থান করি।
মেমরি কার্ড থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে চলে যাবার সময় দু’জনের মধ্যবর্তী শূন্যতা জুড়ে একটাই শুধু হাইফেন। এটাই সভ্যতার সম্পর্ককে অনুগত উষ্ণতায় কাছাকাছি আনে। ত্রিভুজ, ফানুস থেকে উদ্বাহু বৃক্ষ, শরীরী ভাষা, রক্তনদী, কবন্ধ চরিত্র হয়ে যায়। কবিতাকে নিজস্ব চালেই আত্মনিষ্ঠ কথনের বুননে এক সংলাপধর্মী ব্যাকরণহীন পথে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিউবিজমএর মূলকথা : “Maybe Cubism started this way. Memory re-arranging a face.”(Mary Rakow, The Memory Room)
সম্ভবত কিউবিজম এভাবেই শুরু করেছে, স্মৃতিকে সম্মুখে পুনরায় স্থাপিত করার জন্য।
দু'ফর্মার কাব্যগ্রন্থটির সব কবিতাতেই এই কিউবিজমএর ছায়াপাত ঘটেছে। বিভিন্ন মাত্রার আলোছায়ায় পুনঃপৌণিক ব্যবহার দেখা যায়। কবির ব্যক্তিগত আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ কম। বিষয়বস্তুরও সম্পূর্ণতা নেই। আদিম ভিত্তির উপর বিষয়কে দাঁড় করানোর পথই কবি অবলম্বন করেছেন। সবকিছুকে খণ্ডিতভাবেই দেখেছেন। একাধিক দৃষ্টিকোণ আরোপ করেছেন। বিষয়কে ভেঙে, জ্যামিতিক আকারের উপর জুড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো রূপ পাল্টে দিয়েছেন । অসংখ্য দৃশ্যপট, ক্রিয়া সংযোগ, অলংকারহীন আবেগহীন বিজ্ঞান ও গণিতের ভেতর ভাবনাকে চালিত করেছেন :
“Cubism is … a picture for its own sake.
Literary Cubism does the same thing in literature, using reality merely as a means and not as an end.”
(Max Jacob, The Cubist Poets in Paris: An Anthology)
নিজের স্বার্থের কথা ভেবেই শিল্পীরা সাহিত্যেও কিউবিজমকে নিয়ে আসেন। একইভাবে বাস্তবতাটিকে কেবল একটি উপায় হিসাবে ব্যবহার করেন , শেষকথা হিসাবে নয়। সুতরাং এই আন্দোলন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
নানারঙের হাইফেন : নিখিলকুমার সরকার, কবিতা পাক্ষিক, কলকাতা ৭০০০০৯, মূল্য ৩০ টাকা ।
প্রচ্ছদ :ছবি মার্ক শাগাল, রূপায়ণ শৈবাল নায়ক।
💚
জীবন ও প্রকৃতি পাঠের কবি
“কবিতার জন্য সংসারের নরম সুখ তাচ্ছিল্য করেছি।” কার কবিতার লাইন এটি পাঠক জানেন? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “কবিতার জন্য অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি” বলেছিলেন, কিন্তু এই কবি তো সংসারের নরম সুখ তাচ্ছিল্য করেছেন। “একটি বটপাতার কাছে জীবন শিখি” বলেছেন, তারপর অনুমতি পেয়েছেন “একটি মোমবাতির গল্প” লেখার।
যাঁর কথা বলছি তিনি উত্তরবঙ্গের কবি অজিত অধিকারী (জন্ম ১৯৬৮), ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক। তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “মাঠে মাঠে ক্লাসরুম"(প্রথম প্রকাশ ২০১৮) সম্প্রতি আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। ৬০ টি কবিতা নিয়ে স্মার্ট কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত। কাব্যের মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন :
“আলো দেখে হেসে উঠি তোমার কথায়
নতুন জাতক
মাঠে মাঠে কত ক্লাসরুম
আমি পড়ি মুগ্ধতায়, আমিই পাঠক।”
পেশাগত জীবনে শিক্ষক কিন্তু নেশাগত জীবনে কবি বলেই ক্লাসরুম ছেড়ে তিনি মাঠে নামেন “জীবন বোধির গল্প” শুনতে। কেননা নশ্বর জীবনও উৎসব হয়ে যাবে। প্রকৃতির পাঠশালায় আবহমান মুগ্ধ পাঠক হয়ে তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে পাঠ করেন। নিজ সত্তাকে “তুমি” সর্বনামে সম্বোধনও করেন, জিজ্ঞাসার উত্তরও খোঁজেন। আত্মস্ফুরণের তাৎপর্য বহন করেই অনন্ত সত্তার নানা ক্রিয়ায় লৌকিকতাকে গ্রহণ করেও উপলব্ধির তীক্ষ্ণতা স্পষ্ট করে তোলেন। আর সেই কারণেই লিখতে পারেন :
“শ্মশানে কবিতা পাঠ করে
ফুলগাছে জল দেবো ব্যক্তিগত আয়ুর উদ্দেশে…”
সুতরাং এই পাঠ মৃত্যু এবং বাঁচার মাঝখানে “গুগল ডাঙায়” যার অন্বেষণ। যেখানে আবদুল্লা বাবু কবির স্মৃতিবেদি পরিষ্কার করে দেন। সাবেকি বাদশায়ীয়ানা চোখে এবং হাতে কোদাল নিয়ে তাঁর ক্লাসরুমের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেন। গাছেদের পাতা ঝরা, ফুল ফোটা, ঝম্ ঝম্ বৃষ্টি, পাখির গান, টলটলে নদীজল প্রভৃতি প্রকৃতির অফুরন্ত আয়োজনেই গড়ে ওঠে ক্লাসরুম। কবি বলেন :
“বৃক্ষের কাছে আমি অনন্ত শ্রমণ”
কবি তো শ্রমণই। উজ্জীবিত বোধের ও বোধির বিস্তার এবং তাকে শব্দরূপ দেবার জন্য কবিকে বিশেষ্য, বিশেষণ, অব্যয়ের কথা ভাবতে হয়। বাস্তবের ভেতর দিয়ে “ইয়াহু ম্যাজিক”এর মতো স্বপ্ন দেখতে হয়। প্রত্নদুঃখগুলো জয় করে ধাবিত হতে হয় নৈঃশব্দ্যের তর্জনীর পথে :
“তবু মাঠে মাঠে দেখে বেড়াচ্ছি কালাতীত
ফুল, পাখি, নদী
কেমন করে ছবি আঁকে আশ্চর্য সংকেত”
সাময়িকই শাশ্বত অন্বয়ের সেতুতে উত্তরণ ঘটিয়েছে কবিকে। ধানখেতের গভীর কুয়াশা শবের চাদর, ছাদের ফুলের টব ছলনার রঙ্ আর ভাইয়ের মৃত চোখ দেখেও কবি “দিগন্তে প্রদীপ" জ্বালাতে চান। দুঃখ, মৃত্যু, বিচ্ছেদ বলে কিছু হতে পারে না। সব শূন্যের ভেতর রহস্যখচিত বিশ্ব, নক্ষত্রমণ্ডল প্রবহমান। মানবজমিন পতিত বলে আধ্যাত্মিক ফসল ফলেনি। শ্রীরামপ্রসাদকে কবি স্মরণ করেছেন। মোহবীজ থেকে কবি অক্ষরের বাগান গড়েন। কেননা ব্যক্তিগত ঈশ্বরের শেষদৃশ্য তার মধ্যেই ফুটে উঠবে। আবেগ, স্বপ্ন, প্রেম সবকিছুর মধ্যেই মানবিক প্রশ্রয় যেমন আছে, তেমনি মহাজীবনের প্রশ্রয়ে এক গভীর দার্শনিকের উত্তরণও ঘটেছে। বাবা ও ভাইয়ের দুই শ্মশান দুই পাশে বিরাজ করছে, পার্থিব শূন্যতার দুঃখ থেকে জীবনের মগ্ন পাঠ তখন এরকমই :
“হঠাৎ একদিন অন্ধকারের কুয়াশায়
হারিয়ে গেলে
আর জীবন দোতারাও হয়ে গেল ঘুণে খাওয়া কাঠ
কীভাবে ভালো থাকি
দু’চোখ আজ ঘুঘু ডাকা মাঠ।”
এই দুঃখ ও শূন্যতার ক্লাসরুম থেকে দীর্ঘশ্বাসের বাতাস, কুবলাই খানের বাগান, পিকাসোর ছবি, জীবনানন্দের গাংচিল, রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষের পরের বাংলা, টি এস এলিয়টের দত্ত—দয়াধ্বম—দম্যতা সব ছায়া সংলাপে কবিতার সংসার রোপিত হয়। চিল উড়ে যাওয়া গোল বিন্দুর বিলীয়মান দৃশ্য মহাশূন্যের মহাকাশে মিলিয়ে যায়। কবি বলেন :
“তুমি শুধু শূন্যতা দাও
জ্বলে পুড়ে তবু আমি ধূপ হতে পারি না।”
কবি জীবনের অস্তিত্ব হারাতে চান না। শূন্যতার ভেতর নিজেকে খুঁজেও পান। উডি অ্যালেন তাঁর মিড নাইট ইন প্যারিস এর দ্য শুটিং স্ক্রিপ্ট-এ লিখেছেন :
“The artist’s job is not to succumb to despair but to find an antidote for the emptiness of existence.”
(Woody Allen, Midnight in Paris: The Shooting Script)
অর্থাৎ শিল্পীর কাজ হতাশায় ডুবে যাওয়া নয়, বরং অস্তিত্ব শূন্যতার প্রতিষেধক সন্ধান করা। এই প্রতিষেধক তো শরতের মেঘে, কাজল ভ্রমরের উড়ানে, বালি খুঁড়ে ঠাণ্ডা জলে, জলের স্রোতে অভিমান ভাসিয়ে, কামরূপ এক্সপ্রেসে ঘরে ফিরে কবি পেয়ে যান। বহুরূপী সময় তাঁকে আরোগ্যের দিকে নিয়ে যায়। সহজ সাবলীল আত্মপর্যটনে কবিতাগুলি পজেটিভ জীবন বিন্যাস গদ্যচালে উঠে আসা মরমি উচ্চারণ। দেবাশিস সাহার ইংগিতপূর্ণ প্রচ্ছদও বেশ উপযোগী।
*মাঠে মাঠে ক্লাসরুম : অজিত অধিকারী, সিগনেট প্রেস, কলকাতা ৭০০০০৯, মূল্য ১০০ টাকা ।
💚
সুফি ভাবনা ও অস্তিত্বের জরিপ
বাংলাদেশের তরুণ কবি মালেকুল হক ব্যক্তিগত শূন্যতার ভেতর আত্মতত্ত্বের এক ছায়াপুরাণের নিবিড় সংযোগ বিছিয়ে রেখেছেন তাঁর ইংরেজি কাব্য “ইকো দ্য পিলারস্ অফ নাথিংনেস্”এ। কবি বলেছেন : “Two of us are fusing one another.” সত্তা আর ছায়ার দ্রবণে নাথিংনেস্ প্রজ্ঞারই বিন্যাস যা সুফি ভাবনারই প্রশ্রয় বলা যেতে পারে। এই ভাবনার পথ ধরেই কবির অগ্রসর লক্ষ করি “তসবি ও রক্তবিন্দু”(প্রথম প্রকাশ ২০১৭) কাব্যে। তসবিহ্ ও রক্তবিন্দুর জারণ উপলব্ধির ঝিকিমিকি গ্রাহ্যতা পেয়েছে। বিন্দুগুলির নামকরণ নেই, গ্রন্থন আছে। পর্যবেক্ষণের সুচারু ও আত্মঅভিনিবেশ অক্লান্ত পর্যায় রচনা করেছে। প্রশ্ন ও ক্ষরণের পথ ধরে প্রস্ফুটন অগ্রসর হয়েছে। সূত্র সেখানে সুফিদর্শনের গ্রন্থনার ভূমিকা পালন করেছে। মহামহিম অনন্তের বিধান ও বিস্ময় পার্থিবের বাস্তবকল্পে ধরা পড়েছে। তাই তসবিহর প্রথম দানাটি এমন :
“তোমার হাসির শুদ্ধতা ঝরাপাতা কুড়িয়ে তুলেছে আর আজ স্বয়ং শিশিরবিন্দুতেই চমকে উঠেছে সূর্য।”
আত্মঅভিমুখে ফিরে কবি চৈতন্যের দরজায় উপলব্ধির ইশারাকে জাগিয়ে তুলেছেন। সকাল হলেই মোহাচ্ছন্নতা কেটে গেছে :
“মালেকুল, সূর্য নয় —তোমার মুখেই ম্লান হয়েছে আলো।”
এই আলো শুধু সূর্যের নয়, আত্মজ্ঞানেরও। “তোমার” সর্বনামটিও সেই প্রজ্ঞান সত্তার। একেই কবি ডাকেন :
“নিজের নাম ধরে ডাকি, মালেকুল! মালেকুল! সাড়া দেয় দেওয়াল। ঘৃণায় ক্রোধে রিরংসায় দেওয়াল ভাঙব না কি আমার একত্ব ভেঙে ফেলার জন্য গড়ে তুলব অজস্র দেওয়াল —যেখানে প্রতিধ্বনি এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়ালে পড়ে পড়ে খণ্ডবিখণ্ড হবে —তোমার আমার নাম?”
নিজেকে ঘিরে থাকা দেওয়াল, নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে আনা যে কঠিন তা প্রতিটি সুফিসাধকই জানেন। কবি রণজিৎ দাশ “নির্বাচিত কবিতা”-র ভূমিকায় লিখেছেন :“কবিতা একটি দৃষ্টিভঙ্গি বস্তুত, এই মহাজগতে হৃদয়ের অন্বেষণ।” এই হৃদয়ের খোঁজ পাওয়া তো কঠিন। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই নিজেকে বিবর্তিত করেছেন। অথচ পরমাত্মা রূপে ব্রহ্মবিশ্বে নিজেকে বিস্তৃতও করেছেন। তাঁর ধারণা পেতে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয় মাত্র। কিন্তু কোনো নামই যথেষ্ট নয়। মালেকুল তাকেই তাঁর চৈতন্যবিশ্বে আহরণ করেছেন। নফসের দ্বান্দ্বিক ক্রমান্বয়কে পাশকাটিয়ে আত্মপথের যে প্রবাহকে নির্জ্ঞান প্রান্তরের দিকে চালিত করেছেন তাতে মুক্তির অনুজ্ঞাটিই কার্যত শক্তি ধারণ করেছে। কাব্যে তসবিহর প্রতিটি দানাই পরম সাধকের বিন্যস্ত দার্শনিক উচ্চারণ ।
সমগ্র কাব্যটিতেই কবির অস্তিত্বের একটা জরিপ করা যায়। স্বগত সংলাপের নিবিষ্টতায় যে উত্তাপ মুদ্রিত হয় তা ব্যক্তিস্ব-এর নানা পর্যায়। তবুও পার্থিবতায় সেগুলি ধূসর হয়ে ওঠেনি। আধ্যাত্মিকতায় তা ব্রহ্মবার্তা হয়ে উঠেছে :
“মালেকুল, তুমি তো কাল-কালান্তর জোড়াতালি দিয়েই যাচ্ছ, আফসোস! তোমার শতচ্ছিন্ন ছায়া খণ্ড খণ্ড পড়ে আছে। কেউ কি তা একত্র করতে বসবে?”
খণ্ড খণ্ড ব্যক্তিস্ব বিস্তারে মহাকাল ও মহাজীবনের প্রজ্ঞাটি স্থাপিত হয়েছে। জন্ম ও জন্মের অতীত শূন্যতায় অস্তিত্বের স্বরূপও শূন্য । কিন্তু এই শূন্য তো নাথিংনেস্ নয়। কবি বলেছেন :
“প্রিয়তম! তোমার মধ্যে ফানা হয়ে একটা অবয়বও পেয়েছি ; হারাতে চাই না। নিজের কসম! খোদার মতো নিরাকার হওয়ার নিরর্থ ইচ্ছা আমার নেই। আকার পরিবর্তন করে আকার ধারণে ঐক্য প্রকাশ পায়।”
সুফি কবি খাজা শামসুদ্দিন মোহাম্মদ (হাফিজের রুবাইয়াত) এর কবিতা তখন মনে পড়ে যায় :
“When no one is looking,
swallow deserts and clouds
and chew on mountains
knowing they are sweet bones!
When no one is looking
and I want to kiss God,
I just lift my own hand to my mouth.
(Khwaja Shamsuddin Mohammad, The Rubaiyat of Hafiz)
যখন কেউ দ্যাখে না, তখন মেঘকে, মরুভূমিকে গ্রাস করে তাদের মিষ্টি হাড়গুলি পাহাড়ে চিবিয়ে খেয়ে পিপাসার্ত সত্তায় ঈশ্বরকে চুম্বন করার উদ্দেশ্যে নিজের হাতটি নিজের মুখেই উঠে এসেছে। ঈশ্বর তখন কবি নিজেই। সুফি কবি নিজের ভেতর নিজেকেই দেখেছেন :
“যে চিন্তায় দগ্ধ, সেই চিন্তা আমাকে করে পুনঃনির্মাণ। আমি এই লাগামহীন অশ্বের পিঠে সওয়ার । চিন্তার সৌন্দর্য অন্য কেউ নয়, নিজের মূর্তিতে প্রযত্ন করি।”
৬০ পৃষ্ঠার কাব্যটি পড়তে পড়তে কেবলই জালাল উদ্দিন রুমির কথাটি বেজে ওঠে : “When you do things from your soul, you feel a river moving in you, a joy.”প্রতিটি তসবিহ্ এই আত্মার দিশারি একটা নদীর প্রবাহ হয়ে বয়ে যায় আনন্দের অভিঘাতে। সুফি নিরিখের এই প্রত্যয় সাধকের প্রকীর্ণ উত্তরণের নিবিষ্ট যজ্ঞভূমি। ইংগিতময় প্রচ্ছদের রক্তবিন্দু এক একটি দানায় ধরার চেষ্টা খুব সুন্দর। ধন্যবাদ শিল্পী ধ্রুব এষকে।
*তসবি ও রক্তবিন্দু :মালেকুল হক, প্রকাশক : নাগরী, সিলেট —৩১০০, বাংলাদেশ, মূল্য ১৪০ টাকা।
💚
শিল্প সিদ্ধি নয়, জীবন সিদ্ধির কবিতা
কবিতা লিখতে এসে তথাকথিত কবিদের মতো রোমান্টিকতা বা কল্পনাকে আশ্রয় না করা বা তথাকথিত প্রেম ও মোহকে বর্জন করা খুব কম কবিকেই দেখেছি। যা আছে, যা চোখের সামনে ঘটে, যা কাঁদায়, যা নির্ঘুম করে সেই বোধ ও উপলব্ধির ক্ষেত্র থেকে জীবনকে দেখার মানুষ পুরুলিয়ার কবি অশোক ঘোষ(১৯৫৪)। না, তিনি প্রচার চাননি, যশ খ্যাতিরও দরকার হয়নি। ‘অণুভাব’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করে প্রায় সত্তর দশকের শেষদিক থেকেই সাহিত্য জগতে পা রেখেছেন। লিখেছেন অজস্র কবিতা, কিন্তু কাব্য প্রকাশের তেমন উৎসাহ দেখাননি। এ যাবৎ ছয়টি কাব্য থেকে বাছাই করে প্রকাশ করেছেন ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৭)। উল্লেখ্য এটিও তেমন প্রচারের মুখ দ্যাখেনি। নিজেকে যেমন আড়াল করেছেন, তেমনি কাব্য কবিতাও থেকে গেছে আড়ালে। এই আড়াল দুঃখের, মর্মরিত বেদনার, ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব সন্ধানের এবং অভিমানের। শেক্সপিয়র লিখেছিলেন :”O world, how apt the poor are to be proud!” অর্থাৎ ও দুনিয়া, গরিবরা কতটা গর্বিত হতে পারে! এই ‘গর্বিত হওয়া’র উচ্চারণগুলিই কবিতা হয়ে এসেছে অশোক ঘোষের কবিতায়। নিজেদের দৈন্য আর সংগ্রামের চিত্র যেমন আছে; তেমনি মরমি বিষাদের উত্তরণে সহমর্মিতার ভালোবাসার এক অঙ্গীকারও ধরা দিয়েছে। আশিটি ক্ষুদ্র কবিতার সংকলনে প্রান্তিক জীবনের দীর্ঘশ্বাস, ক্ষুন্নিবৃত্তির হাহাকার এবং অস্তিত্বের বিমূঢ় উত্তাপ অনুধাবন করা যায়। শোষিত পীড়িত নির্যাতিত সেই সব মানুষের কথা কবিতায় যখন উঠে আসে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই হারিয়ে যায় কল্পনা ও রোমান্টিকতা। ‘যে শ্মশান ভূমির উপর জেগেছে ঘাসেরা’ কাব্যের এই অংশে কবি লিখেছেন: ‘খিদের সঙ্গে জীবনের বসবাস’। তখন জীবনও শ্মশানের ছায়া দেখে ডাকিনীর রূপ পেয়েছে। কান্না হয়েছে শ্মশানের শ্লোক। সুখ-দুঃখের তর্পণে চিতার আগুন হয়ে উঠেছে জীবনযাপনের মুহূর্ত। স্বজন হারানো বেদনার কাতরতা থেকে শূন্যতার গ্রাস কবিকে রুক্ষ ভৈরবের দিব্য দৃষ্টি দান করেছে। শ্মশানচারী জীবনের এই মর্মন্তুদ বিষাদকে ব্যঞ্জনাহীন প্রকাশ করেছেন কবি। তাই মাটির গন্ধ লেগে থাকা শরীর মাটিতেই বিলীন করতে চেয়েছেন। যুধিষ্ঠিরের কুকুর থেকে শুনেছেন বিদ্রোহের ডাক। অন্নপূর্ণার কাছেও ভিক্ষার পাত্র এগিয়ে দিয়েছেন। কাব্যের ‘প্রাকৃতিক’ অংশে এই দারিদ্র্যই প্রবল অন্ধকার আর আগুনের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে। লাল পলাশের বসন্ত হয়ে উঠেছে দাহ আর দহনের প্রাক ভাষা। ঝুমুরের গুনগুন গানের নেশা এবং মাদলের তান কবিকে আহ্বান জানালেও যেতে পারেননি। সেই মুহূর্তটিতেই কবি দেখেছেন: ‘শুকনো বাতাস ধুলোর হাওয়া নিয়ে/ দুপুরের ছাতিফাটা রোদে ছোটাছুটি করে’। কবি শুকনো মুখ নিয়ে কুয়োর কাছে ‘জল’ উচ্চারণ করলে, হাহাকারের মত নিচ থেকে প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেয় ‘জল… জল’ বলে। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতিও তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত, বিধুর। ‘চৈত্রের অশোক পলাশ’ অংশে কবি মানুষের মিছিল দেখেছেন। ক্লান্তিহীন বাঁচতে চাওয়া অস্তিত্ব সন্ধানী মানুষ তারা। কেউ উচ্ছেদ হওয়া মানুষ, অধিকার হারা মানুষ, সর্বহারা মানুষ। বাস্তুহারাদের কোলাহল কবিকে-ও নির্ঘুম করেছে। তাদের মধ্যে বিদ্রোহের শপথ জেগে উঠেছে। তাই ‘দীর্ঘরাত্রি ছিঁড়ে/ আগুনের বীভৎস উল্লাস’ দেখতে দেখতে কবি ক্ষণিক জীবন নিয়ে হেঁটে গেছেন। ‘অন্ধকারের দরজা জানালা’ অংশে কবি সুন্দরের সন্ধান করেছেন। তাই ফুল ও নারী এবং পাখির গান কবিকে দুঃখ ভোলাতে চেয়েছে। বাউল পথিক কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতেই নিজের পরিচয় খুঁজেছেন। নিজের ঘাম-শরীরের লোনা গন্ধ এবং অন্ধকারের গহ্বরে ডুবে যাওয়া ও দাঁত বের করে আসা নিজের কঙ্কাল দেখেছেন। এখানেও সেই অস্তিত্ব সংকট। সংগ্রামময় জীবনের কলরোল দিনমজুরির আতঙ্ক গ্রাস করেছে। কবি লিখেছেন: ‘বিষাদের ধ্বনি চোখে জল হয়ে ঝরে’। শকুনের কান্নার ছবিও অবক্ষয়ী চিত্রের সমর্থক হয়ে উঠেছে। মানুষই লাশ হয়ে যায়। নিজের মৃত্যু নিজেই আগলায়। কাব্যের শেষ অংশে আছে ‘এটুকুই বলতে পারি’। অর্থাৎ এখানেই কবির
সিদ্ধান্ত ঘনীভূত হয়েছে। যে অন্ধকার কবিকে জড়ত্ব এনে দিয়েছে, সেই অন্ধকারই বেশি করে স্মৃতিকাতরতায় ডুবিয়ে দিয়েছে। মানুষরূপী শিয়ালের দল, অমানবিক শাসকশ্রেণি কবিকে দুঃখের দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এক সর্বব্যাপী সভ্যতার বিষাদ ও ক্লান্তিহীন অজাগরতা কবিকে ক্ষুব্ধ ও নির্বাক করেছে। তাই লিখতে বাধ্য হয়েছেন: ‘প্রত্যেকটা দিন যুদ্ধের মহড়া/ প্রত্যেকটা দিন বেঁচে থাকা…’ কবিতাকে সরাসরি দেখার ও উপলব্ধি করার, প্রকাশ ও প্রতিবাদ করার এক তীক্ষ্ণ ভাষা পেলাম ‘নির্বাচিত কবিতা’য়।এখানে শিল্প সিদ্ধি নয়, জীবন সিদ্ধির পথেই কবির একাগ্রতা ও আগ্রহ।
নির্বাচিত কবিতা: অশোক ঘোষ, কথোপকথন,৩-এ, হরিনাথ দে রোড, কলকাতা-৭০০০০৯ , প্রচ্ছদ শুভজিৎ গুপ্ত। দাম ১৫০ টাকা।