spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যকবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কলকাতায় তিনদিন

লিখেছেন : কামরুজ্জামান

কবি নির্মলেন্দু গুণের সাথে কলকাতায় তিনদিন

কামরুজ্জামান 

আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব কলম্বিয়ার ম্যাডেলিনে আমন্ত্রিত হয়েছি ২০০৮ সালে, ঢাকায় তাদের কোনো এ্যাম্বাসি নেই তাই আমাকে ছুটতে হলো দিল্লি। কলকাতা এর আগে আরো দু’বার যাওয়া হয়েছে,কিন্তু তখনো দিল্লি দূরওয়াস্ত। আমাকে ই মেইলে যে আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছে, তা তে বলা আছে এমন যে আমন্ত্রণ পত্র প্রদর্শন মাত্রই যেনো ভিসা প্রদান করা হয়। আমি দিল্লির কুটনৈতিক পাড়ায় এ্যাম্বাসিতে গিয়ে হাজির, তারা আমাকে জানালো তুমি ইনভাইটেড গেস্ট তোমার কোনো ভিসা ফি লাগবেনা, (যা অন্য যে কারো জন্য চার হাজার রুপি)তুমি আগামীকাল এসে ভিসা নিয়ে যেও। যথারীতি আমি পাসপোর্ট রেখে এসে হোটেল কক্ষে চলে এলাম। পরদিন বিকেলে সংগ্রহের কথা জানানো হয়েছিল তখনই, আমি গিয়ে দেখি আমার ভিসা প্রস্তুত। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো তুমি যাবে কিভাবে? আমি জানালাম আমি কলকাতা থেকে উঠবো তারা আমার শুভ কামনা জানিয়ে সম্ভাষণ জানালো। আমি পরদিন কলকাতা এসে উপস্থিত হলাম। সারারাত ঘুম বিশ্রামে কাটিয়ে দেখি একটু সকালেই নিদ্রা ভেঙে গেলো। ওয়াশরুম হয়ে হোটেলের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম রফি আহমেদ কিদোয়াই স্ট্রিট এর এখানে একটা ছোট কাঁচা বাজার দেখি একটা ভিস্তিওয়ালা দোকানে দোকানে চামড়ার মসক দিয়ে পানি সরবরাহ করছে। আমি অবাক হয়ে নিচে নেমে এসে ভিস্তিওয়ালার চামড়ার মসক দেখতে লাগলাম, কলকাতার একটা গুণ তারা পুরনো কোনো  কিচ্ছুই ফেলে দেয়নি। ভিস্তিওয়ালা জানালো যে আমার এটা দিয়ে তো কাজ চলছে তবে ফেলে দেবো কেনো, আর তাছাড়া পুরনো একটা জিনিস ফেলতে মায়া লাগে। আমি তার কথায় খুব আনন্দ পেলাম তাই তো ওর কাছ থেকে এটা শিখবার আছে যে পুরনো হলেই ফেলে দিতে নেই। আরো একটি বিষয় মনে পড়লো কলকাতার সব লন্ড্রি দোকানে এখনো কয়লার ইস্ত্রি আছে ইলেকট্রনিক ইস্ত্রি র পাশাপাশি। বড় বড় লোহার ইস্ত্রি ভেতরে কয়লার লাল আগুন টকটক করছে।

পকেটে টাকা ফুরিয়ে এসেছিলো, আর মাত্র দু’শ ডলার আছে। ডলার চেঞ্জ করা ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না, তাই সকাল সকালই মানি এ্যাক্সচেঞ্জ দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম, দেখি দোকানের ভেতরে একজন সফেদ লম্বা চুল নিয়ে দরাদরি করছেন ডলারের দাম নিয়ে। তখন শুধু পিঠের উপর ছড়ানো চুল গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম, এত পরিচিত চুল দেহ সৌষ্ঠব। আমি আরো একটু সামনে গেলাম গলার স্বর খুব পরিচিত মনে হচ্ছে, যা আঁচ করছিলাম একদম মিলে গেলো। আমি আনন্দে চেচিয়ে উঠলাম আরে গুণ দা আপনি? গুণ দা তার ভাষায় আরে তুমি এহানে কইত্তে, আমিও বলে উঠলাম আপনে, তিনি জানালেন আমার ভাগ্নের বিয়ে তাই এসেছি। রসিকতা করে বল্লেন দেখ আমাকে ঠকাতে চায়, আমরা হেসে উঠলাম। এর মধ্যেই গুণ দা আমি ডলার একসাথেই চেঞ্জ করে নিলাম, এক ফাঁকে গুণ দা বল্লেন আর কোথাও যেওনা থাকো আমার সাথে, আমি তো, বলেন কি কোথায় যাবো আপনাকে ফেলে, আমার কি মাথা খারাপ? 

শোন বিকেলে মাইকেল এর সমাধিতে যাবো, চলো এখন নাস্তা করি। আমরা আমাদের ঢাকার রেস্তোরাঁ রাধুনিতে গিয়ে সুপ দিয়ে পরটা নাস্তা করলাম। আমি বিল পরিশোধ করবার জন্য মুখিয়ে আছি, গুণ দা কোনো অবস্থাতেই বিল দিতে দিলেন না।

হোটেল কক্ষে ফিরে এলে গুণ দা জানালেন কবি কাজল চক্রবর্তী আসছে একসাথে মাইকেলের সমাধিতে যাবো। নানা কথা বার্তার মধ্যে কিছু সময় কাটতেই কাজল চক্রবর্তী এসে যুক্ত হলেন। টেক্সি নিয়ে আমরা চল্লাম প্রাচীন গ্রেবিয়ার্ডের দিকে, গাড়িতে অনেক কথা চলছে কখনো কবিতা  কখনো, স্মৃতি কথা এইসব। গ্রেবিয়ার্ডের সামনে নেমে আমি টেক্সি ভাড়া দিতে উদ্যত  হলাম গুণ দা সরিয়ে দিলেন, আমি যতই বলি গুণ দা আমার কাছে অনেক টাকা। গুণ দা ততই ধমক রাখো তোমার টাকা, আমি বড় ভাই না, তুমি কেনো খরচ করবে। মাইকেলের সমাধির সামনে গুণ দা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন লক্ষ্য করলাম। মাইকেলের ছ’দিন পরই হনড্রিয়েটার মৃত্যু এপিটাফ খন্ডে তাই উৎকীর্ণ করা। এখানে ভারতের অনেক বিখ্যাত মানুষের সমাধি রয়েছে গুণ দা ডিরোজিওর কথা স্মরণ করে তার সমাধিতে যেতে চাইলেন, কিন্তু তা আর হলোনা কারণ তাঁর সমাধি বেশ কিছুটা ভেতরে তাই। আমরা বেড়িয়ে একটা বেশ সুন্দর রেস্তোরাঁয় দুপুরের আহার গ্রহণ করলাম, কাজল চক্রবর্তী গুণ দা কে কোনো শব্দ করতে দিলেন না বিল পরিশোধের বিষয়ে। বিকেলে কফি হাউজে গিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো, এর আগে আমি কলকাতা এলেও কফি হাউজে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আমার চিন্তার মধ্যে যে কফি হাউজের চিত্র ছিলো এতকাল মান্না দে’র গান শুনে শুনে। আমি বিরক্তিতে কুঁচকে উঠলাম এ কি রে হৈচৈ চেচামেচি, কখন এখান থেকে বের হবো তাই ভাবতে লাগলাম দেখি গুণ দাও বিরক্ত। জানালেন কফি হাউজ আর আগের মত নেই, চলো চলো এই আজাব খানা থেকে বের হই…. 

এভাবেই কখন এত দ্রুত দু’দিন সময় পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। সন্ধ্যায় আমি আর গুণ দা তাঁর হোটেল কক্ষে বসে আড্ডা দিচ্ছি এমন সময় কড়া নাড়ার শব্দ।  দরজা খুলে ভেতরে এসে নমস্কার দিয়ে জানালেন তিনি ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক, খবর পেয়ে এসেছেন দেখা করতে। বেশ আলাপ জমে উঠলো, এক পর্যায়ে ভদ্রলোক গুণ দা’র কাছে লেখা চাইলেন ছাপার জন্যে। গুণ দা বল্লেন দেখুন আমি তো টাকা ছাড়া কোনো লেখা কোথাও দেইনা, তিনি জানতে চাইলেন টাকার অংক কত? দেখুন আমি তো দুহাজার টাকার কমে লেখা দেই না। ভদ্রলোক বেশ কাচুমাচু হয়ে বল্লেন এত টাকা তো এখন হবেনা, গুণ দা জানতে চাইলেন কত আছে? তিনি জানালেন সাড়ে চারশত আছে। তিনি বল্লেন আমি চারশত দিতে পারবো বাকী পঞ্চাশ টাকা পথ খরচ লাগবে। গুণ দা বল্লেন আমাকে দেখিয়ে ওর কাছে চারশত দিয়ে দিন, আমি টাকা বুঝে নিলাম। গুণ দা সম্পাদক সাহেবকে বল্লেন সমস্যা নেই , আপনি আমার ওয়েবসাইটে গিয়ে পছন্দ মতো একটি কবিতা নিয়ে নিয়েন। রাতের খাবার একসাথে খেয়ে আমি কিছুতেই বিল পরিশোধ করতে পারলাম না, যতই আমি জোর করি গুণ দা র এক কথা আমি বড় ভাই থাকতে তুমি কেনো খরচ করবে। আগামীকাল সকালে গুণ দা র ঢাকায় ফিরে যাবার কথা রয়েছে। আমি হোটেল কক্ষে ফিরে এলাম, চিন্তা স্থির করে রাখলাম সকালে উঠেই গুণ দা র কাছে চলে যাবো।

আজানের সাথে সাথেই জেগে দেখি হালকা কুয়াশা গুণ দা র বাস ও সকাল সাতটায়। এক দেড় ঘন্টা আগেই গিয়ে গুণ দা কে ডেকে তুল্লাম। গুণ দা ওয়াশরুম থেকে সজীব হয়ে বল্লেন চলো নাস্তা সেরে নেই, রাধুনি তে নাস্তা সেরে আমি আর কোনো ভাবেই বিল পরিশোধ করতে দিলাম না। গুণ দা বল্লেন তোমার কি এত শখ বিল দিতে? আমি বল্লাম অবশ্য অবশ্যই, আচ্ছা তাহলে দাও। আবার হোটেল কক্ষে ফিরে এসে সব কিছু গোছগাছ করে নিয়ে গুণ দা তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘ আমার কণ্ঠস্বর ‘কলকাতার স্মৃতি মনে রেখে প্রিয় কামরুজ্জামান কে উপহার স্বরুপ ‘ লিখে আমার হাতে তুলে দিলেন, বল্লেন রেখেদাও এটা আমার ভালোবাসা,ভালোবাসার এই নিদর্শনে অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠলো দুই নয়ন। আজ তাঁর ভালোবাসা স্মরণ করে জানাই শুভ জন্মদিন শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি প্রিয় মানুষ….

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ