spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যরুদ্র : আমার স্মৃতিতে

লিখেছেন : মোরশেদ শফিউল হাসান

রুদ্র : আমার স্মৃতিতে

মোরশেদ শফিউল হাসান

*

রুদ্রের সঙ্গে আমার পরিচয়, যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭৪ সালের শেষদিকে। পরিচয়টা করিয়ে ছিলেন কামরুল ভাই। আজকের মন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলাম। তখন লালবাগে তাঁর একটা ছাপাখানা ছিল শাহীন প্রেস নামে। এখনও প্রেসটা আছে কি না জানি না। তিনি নিজে সেখান থেকে ‘কালস্রোত’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এছাড়াও আমাদের মতো অনেক লিট্ল ম্যাগাজিন কর্মীর আশ্রয়স্থল ছিল তাঁর সে প্রেসটা। তখন আমরা যে কামরুল ভাইকে দেখেছি তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র ও স্বল্পভাষী একজন মানুষ, আর ভীষণ রকম বিনয়ী। পত্রিকা ছেপে টাকা বাকি ফেলে আসার পরও কামরুল ভাই মুখ ফুটে সে টাকার তাগিদ দিতে পারতেন না। আজকের দিনে টেলিভিশনের পর্দায় নিয়মিত যে মন্ত্রী কামরুল ইসলামকে দেখি তার সঙ্গে সেদিনের তাঁকে ঠিক মেলাতে পারি না। আমরাও সে সময় একটা লিট্ল ম্যাগাজিন বের করতাম ‘যুবরাজ’ নামে। পত্রিকাটির তিনটি সংখ্যাই মাত্র বেরিয়েছিল। তিনটি সংখ্যাই ছাপা হয়েছিল কামরুল ভাইয়ের ওই প্রেস থেকে। পত্রিকার কাজে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত একবার, কোনো কোনোদিন এমন কি দুবারও, আমাকে ও আরেক সম্পাদক হুমায়ুনকে (সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব মুহম্মদ হুমায়ুন কবির, তখন সে অবশ্য হুমায়ুন আজিজ নামেই লিখত) প্রেসে যেতে হত। তো একদিন কামরুল ভাই-ই মনে আছে আমাদের দুজনকে রুদ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রুদ্র তখন খুব সম্ভব ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শ্রেণীর ছাত্র। প্রেসে সেদিন রুদ্র তাঁর একটি পত্রিকা বা কবিতার বইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ফলে ওই প্রাথমিক পরিচয়ের বেশি সেদিন তাঁর সঙ্গে আলাপ আর এগোয়নি। তাছাড়া, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তার ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’ নামটাও আমাদের কাছে কেমন যেন ঠেকেছিল। আজ আর মনে নেই, সেদিন কামরুল ভাই বলেছিলেন, নাকি রুদ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পর তার কাছ থেকেই কখনো শুনেছিলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নিজের নামের তফাত করতেই সে তার নামের আগে ওই রুদ্র কথাটা বসিয়েছিল। তখনই কি সে জানত একদিন সেও দেশবিখ্যাত হবে, সেদিন আরেক খ্যাতিমানের সঙ্গে নামের মিলের সমস্যা ঘুচাতেই কি ছিল তার এই আগাম ব্যবস্থা?

এরপর রুদ্রের সঙ্গে আবার দেখা হয়, এবং এক সময় কীভাবে কীভাবে যেন ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়ে গেল, গফুর মিয়ার ক্যান্টিনের আড্ডায়। ততদিনে শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন উঠে গেছে। তার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি এলাকায় চালু হয়েছে গফুর মিয়ার ক্যান্টিন। সেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যার পরও অনেকটা সময় অবধি চলে আমাদের আড্ডা। আমাদের সিনিয়র ও জুনিয়র অনেকেই– লেখক, সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মী সেখানে আড্ডা দিতে আসেন। রুদ্রদের একটা বড়সড় দল ছিল, যার মধ্যে ছিল আলী রিয়াজ, কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, আলমগীর রেজা চৌধুরী, মঈনুস সুলতান, আরো অনেকে। বয়সে ওরা আমাদের কিছু কনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, অল্পদিনেই সে ব্যবধান কমিয়ে আমরা একই আড্ডার মানুষ হয়ে উঠলাম। রুদ্র, কামাল, জাফর ওয়াজেদরা তখন দুই হাতে কবিতা লিখছে, ছাপছে, বিভিন্ন কবিতা পাঠের আসরে পড়ছে। রিয়াজ লিখছে প্রবন্ধ, ওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার গল্প। এর মধ্যে গফুর মিয়ার ক্যান্টিনের জায়গা বদল হয়, চালু হয় লাইব্রেরির দিকের গেট ঘেঁষে হাাকিম মিয়ার চায়ের দোকান (আজ যা হাকিম চত্বর নামে পরিচিতি পেয়েছে)। দু-জায়গায়ই আমাদের দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা হয়। শাহবাগের নতুন ভবনে পাবলিক লাইব্রেরি স্থানান্তরিত হল, এর মধ্যে কী একটা গোলযোগের কারণে যেন একবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আড্ডা দেওয়ার পথ তখন রুদ্ধ। আমরা গিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম পাবলিক লাইব্রেরির নতুন ক্যান্টিনটাতে। সেখানে দুপুরবলা প্রায়ই দেখতাম রুদ্র আয়েশ করে গরুর মাংশ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। আমাদের অনেকেরই তখন ফুটো পকেট, দুটো বা একটা সিঙ্গারা বা ভাগাভাগি করে এক কাপ চা খেয়ে কোনোমতে পেটের খিদে নষ্ট করি। তখনই জানলাম, কবিতা লিখলেও, যাকে বলে ‘ভাত-না-জোটা’ কবি, তা সে নয়। রুদ্রের কথা ভাবতে গেলে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে আমার তার সে ধীরেসুস্থে ভাত খাওয়ার দৃশ্যটি মনে পড়ে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিপ্রতিভার মূল্যায়ন এর মধ্যেই কেউ কেউ করেছেন। যোগ্যজন আগামীতেও এ নিয়ে লিখবেন বলে আশা করি। পাঠক হিসেবে আমি প্রথম থেকেই তার কবিতার একজন অনুরাগী। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কবিতা অনেকেই লেখেন, কিন্তু আমাদের কালে রুদ্র তার কবিতায় সে চেতনার প্রকাশ অত্যন্ত শিল্পিতভাবে ঘটাতে পেরেছে। তার এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি ভাবীকালেও কেউ না দিয়ে পারবেন না বলে আমার ধারণা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি এখানে আপাতত তার প্রতিভার অন্য এক দিক সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। সেটি তার প্রতিবাদী চেতনার সাংগঠনিক অভিব্যক্তি। যার অন্তত একটি পর্বের আমি সাক্ষী। সাক্ষী আরও অনেকেই। তবে তাঁরা কেউ কোথাও লিখেছেন বা কখনো লিখবেন কি না জানি না।

১৯৭৫এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর একটা মহল তখন দেশকে পুরনো পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই তারা প্রথম থাবা বসাতে চায়। তারই অংশ হিসেবে তাদের পক্ষ থেকে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তন, শহীদ মিনার ও স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা, সূর্যসেন হলের নাম বদলে বাদশাহ ফয়সল হল রাখা ইত্যাদি দাবি উঠতে থাকে। যারা সেদিন এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে হয়তো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত সে সব ছাত্র সংগঠন ও তাদের কর্মীরা তখন ক্যাম্পাসে বলতে গেলে পিছুহটা অবস্থায়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দলমতের অনুসারী আমরা কয়েকজন বন্ধু এ ব্যাপারে একটা কিছু করা প্রয়োজন মনে করি। সে ভাবনা থেকেই গঠিত হয় ’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি-কর্মী সমন্বয় কমিটি’। কমিটির পক্ষ থেকে স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি বিরোধী অপতৎপরতার নিন্দা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে ১৯৭৭ সালের ৩০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৫২ জন ছাত্র ও সংস্কৃতি-কর্মীর স্বাক্ষর সংবলিত একটি বিবৃতি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়। উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের প্রায় গোড়ার দিকেই (১২ নং) ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নাম। আমাদের সেই আন্দোলন সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও তার বাইরে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক মহলের মতো ছাত্র সংগঠনগুলোও সে-সময় স্পষ্ট দুটি শিবিরে বিভক্ত। একপক্ষ চিহ্নিত ছিল ’আওয়ামী-বাকশালী’ হিসেবে, আর অন্যপক্ষ তখন তাদের ‘প্রতিরোধ’কারী। কিন্তু, আজ বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি যে, আমাদের সেদিনের সেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কর্মসূচিতে উভয় তরফের ছাত্র ও সংস্কৃতি-কর্মীরাই ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছিল। সবাই মিলেই ‘কমিটি’, এর কোনো একজন বা দুজন নেতা ছিল না। এমন কি আহ্বায়কের কোনো পদও ছিল না। বাস্তব কারণেই আমরা এই কৌশলটা নিয়েছিলাম। উদ্যোক্তাদের একজন হিসেবে প্রথমদিনের সভায় আমি সভাপতিত্ব করেছিলাম, আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। দ্বিতীয় দিনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন সৈয়দ জহির সাদেক, তিনি যুক্ত ছিলেন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। তৃতীয় দিনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আবরার চৌধুরী, তিনি করতেন বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠনের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন আবু করিম, তিনি যুক্ত ছিলেন জাসদপন্থী ছাত্রলীগের সঙ্গে। এমন কি খন্দকার মুশতাকপন্থী ডেমোক্রেটিক ছাত্রলীগের সভাপতিও সেদিন আমাদের সে কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, বিবৃতিতে সই করেছিলেন। আমাদের বিবৃতি প্রকাশের পরপরই কমিটির বক্তব্যের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ১৫টি লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সক্রিয় আটটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের দুটি বিবৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সমন্বয় কমিটির মাস খানেকের কার্যক্রমে অনেকগুলো কর্মসূচি আমরা পালন করেছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো সভা বা কর্মসূচি থাকত। সবচেয়ে বড় যে আয়োজনটা আমরা করেছিলাম তা হল রবীন্দ্র প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে আগের দিন বিকেলে কলাভবন প্রাঙ্গনে প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আসর। পরদিনের পত্রিকার সংবাদে দেখা যাচ্ছে মোট ৩৬ জন কবি সে অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ বা আবৃত্তি করেন। এসব প্রতিটি কর্মসূচি সফল করে তোলার ক্ষেত্রে রুদ্র ও তাঁর বন্ধুরা আলী রিয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, কামাল চৌধুরী প্রমুখ অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মনে পড়ে কবিতা পাঠের আসরের দিন অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক পূর্বমূহুর্তে জানা যায়, পুলিশ আমাদের অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করতে দেবে না। খবরটা শোনা মাত্র প্রধান অতিথি (যিনি ততক্ষণে অনুষ্ঠানস্থলে চলে এসেছিলেন) রিকশা ঘুরিয়ে প্রস্থান করেন। ঘটনাটির উল্লেখ করে ২০ আগস্ট ১৯৭৭ তারিখের দৈনিক সংবাদ-এর উপসম্পাদকীয় কলামে লেখা হয় :

“.. সাহিত্যসভার জন্যও মাইক পাওয়া গেল না, কেন? সাংস্কৃতিক সমন্বয় কমিটি সেই সভার উদ্যোক্তা বলিয়া? নাকি রবীন্দ্রনাথ? … শুনিলাম দৈনিক বাংলার সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান মাইক ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়াতে সেই সাহিত্যসভায় কবিতা পাঠ না করিয়াই কোনো এক জরুরী কাজে অফিসে চলিয়া গিয়াছেন। যে সাহিত্যানুষ্ঠানে সরকার মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেন নাই সরকারী পত্রিকার সম্পাদক হইয়া সেই সাহিত্যসভায় কবিতা পড়িবার কিছুটা ঝুঁকি রহিয়াছে বৈকি! সরকার গোস্বা করিতে পারেন। অগত্যা তরুণদের বজ্রকণ্ঠেই আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করিয়া সেদিন কবিতার শব্দ উচ্চারিত হইল। মাইক লাগিল না। তরুণরাই মাইক হইল।”

বলা বাহুল্য, ‘মাইক হয়ে ওঠা’ সেই তরুণদের একজন ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। সেদিনকার কবিতা পাঠের আসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাদের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের অনেককে বারবার অনুরোধ করেও উপস্থিত করা যায়নি (তাঁদের কারো কারো নাম উল্লেখ করলে হয়তো আজ অনেকেই আশ্চর্য হবেন, আর তাঁদের মধ্যে ভাগ্যক্রমে যাঁরা এখনও জীবিত আছেন, তাঁরা লজ্জা পাবেন)। একমাত্র ব্যতিক্রম অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। সবার কবিতা পাঠ শেষ হতেই আহমদ ছফা (তিনিও কবিতা পড়েছিলেন) হঠাৎ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ঘোষণা করে বসলেন : ‘এখন সবার উদ্দেশে কিছু বলবেন প্রফেসর কবীর চৌধুরী’। কিন্তু কবীর স্যার বক্তৃতা করতে উঠে দাঁড়াবার আগেই অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আলী রীয়াজ দ্রুত অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। পাছে অনুষ্ঠানে একমাত্র বক্তা হিসেবে কবীর চৌধুরীর উপস্থিতি নিয়ে কেউ বিভ্রান্তি ছড়ায়, আমাদের কার্যক্রমকে দলীয় রঙে চিহ্নিত করে। সেদিন এ রকম অনেক কঠিন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের।

সমন্বয় কমিটির বিবৃতিটি বাংলা ও ইংরেজি প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত বা বিশদভাবে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকায় বিবৃতি পৌঁছাতে গিয়ে দেখেছি প্রতিটি পত্রিকারই (আজাদ, সংগ্রামসহ) কর্মরত সাংবাদিকদের কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের নিজেদের অক্ষমতার কথা জানিয়েও, আমাদের উদ্যোগকে উৎসাহিত করেছেন। ওয়াহিদুল হক, অন্যভাবে না পেরে, নিউনেশন পত্রিকায় পুরো বিবৃতিটি চিঠিপত্র আকারে ছেপে দেন। এ অবস্থায় দুটি পত্রিকার ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাজনক। নাম ধরেই বলি, দৈনিক সংবাদ এক সপ্তাহ পর ভেতরের পাতায় বিবৃতিটি (তখন অবশ্য পূর্ণ আকারেই) ছেপেছিল। এর আগে না ছাপার কারণ, পরে জেনেছিলাম, কারা কী উদ্দেশ্যে ওই সময়ে ওরকম একটা ‘হঠকারী’ উদ্যোগ নিয়েছে, সে-সম্পর্কে সন্দেহ! তাঁদের সেই সন্দেহ দূর করে বিবৃতিটি প্রকাশের জন্য হামিদ ভাইকে (ম. হামিদ) সেদিন ব্যক্তিগতভাবে সংবাদ অফিসে গিয়ে সেখানে কর্মরত পার্টিজানদের কাছে আমাদের তরফে তদ্বির করতে হয়েছিল। আর বিচিত্রা শেষাবধি বিবৃতিটি বা এ সংক্রান্ত কোনো খবর (তাদের সপ্তাহের সংবাদ পাতায় সংক্ষিপ্ত আকারেও) ছাপেনি। কারণ সেখানে কর্মরত একজন রাজনীতি-সচেতন কর্তাব্যক্তির মনে হয়েছিল, এটি আসলে ‘আওয়ামী-বাকশালীদে’র নবরূপে আত্মপ্রকাশের অপচেষ্টা। রুদ্র ও রিয়াজ নিজেরা গিয়ে যুক্তিতর্ক করেও তাঁর সে ধারণা বদলাতে পারেনি। মনে আছে সন্ধ্যায় ব্যর্থ মনোরথ রুদ্র বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির বারান্দায় বসে সখেদে আমাকে তাঁর সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিল। শেষে আবরার চৌধুরী ও আফসান চৌধুরী নিজেরা গিয়ে বোঝাবার পর আমাদের ২২ শ্রাবণের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানটির সংক্ষিপ্ত সংবাদ-বিজ্ঞপ্তি বিচিত্রা ছেপেছিল। আবরার ও আফসান দুজনেই লেখক শিবির করত। ফলে তাদের প্রচেষ্টা কিছুটা ফলদায়ক হয়। এমন কত যে অভিজ্ঞতা ওই কটা দিনে আমাদের হয়েছে।

আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকা অবস্থায়ই ২৮ আগস্ট ১৯৭৭ বহিরাগত শিবির কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গনে নির্মীয়মাণ অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি ভাঙতে আসে। এর কদিন আগে রাতের অন্ধকারে জিপিওর সামনের প্রায়-সমাপ্ত ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যখন হামলা চালানো হয়, আমরা কেউ কেউ তখন টিএসসিতে নজরুল মৃত্যুদিবসের একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। খবর শুনে কলাভবনের কাছাকাছি আসতে দেখা গেল, ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সাধারণ ছাত্ররাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হামলাকারীদের প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে সেদিন হামলাকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এদিন রুদ্রকে অত্যন্ত সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকায় আমরা দেখেছিলাম। বিকেলে জহুরুল হক হল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার না করেই সেদিন তাঁরা সাধারণ ছাত্রদের তরফে বক্তব্য রেখেছিলেন। রুদ্র সংস্কৃতি কর্মী সমন্বয় কমিটির পক্ষে আমাকে উক্ত সভায় বক্তব্য রাখার জন্য বললে, আমি তাঁকে বলি, আমাদের ভূমিকার আপাতত এখানেই ইতি হওয়া উচিত। এবার ছাত্র সংগঠনগুলো এগিয়ে আসুক। রুদ্র আমার যুক্তি মেনে নিয়েছিল। 

পরবর্তী সময়ে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী আন্দোলনে একজন কবি ও সংস্কৃতি-কর্মী হিসেবে রুদ্রের সাহসী ভূমিকা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। কবিতা পরিষদ গঠনেও তার অবদানের কথা জেনেছি। আমি তখন সরকারি চাকুরে, আমার কর্মস্থল ঢাকার বাইরে। কবিতা পরিষদের প্রথম সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে আমিও ছিলাম একজন বক্তা। অধ্যাপক খান সারোয়ার মুর্শিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে আলোচনা সভায় বাকি যাঁরা বক্তব্য রেখেছিলেন তাঁরা সবাই স্বনামখ্যাত, কৃতবিদ্য ব্যক্তি। যতদূর জানি রুদ্র ও জাফর ওয়াজেদ এরাই সেদিন আগ্রহী হয়ে আমাকে বক্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল, আমার প্রতি তাদের এক রকম অন্ধ ভক্তি বা ভালোবাসা থেকে। নয়তো আমার কী যোগ্যতা ও রকম একটি বিদগ্ধমণ্ডলীতে ঠাঁই পাবার?

তাঁর মৃত্যুর আগে শেষ একুশে বইমেলায় কোনো এক শুক্রবার সকালে আমি স্টলগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ পিঠে কার যেন করস্পর্শে ফিরে তাকালাম : ‘মোরশেদ ভাই !’ দেখি, রুদ্র। এর আগে শুনেছিলাম সে একবার গুরুতর অসুস্থতা ভোগ করে উঠেছে। সেদিনও দেখলাম সে যেন পা টেনে টেনে কষ্টে হাঁটছে। অল্প দু-চারটা কথা হয়েছিল সেদিন তার সঙ্গে। সেদিন কি জানতাম, সেটাই হবে রুদ্রের সঙ্গে আমার শেষ দেখা!

……..

প্রথম প্রকাশ : হিমেল বরকত সম্পাদিত : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ, ২০১৫। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা