আমান আবদুহু
……
সম্প্রতি একটা বই পড়লাম, ওয়াহিদ সুজনের লেখা “অসুখের দিন”। ওয়াহিদ সুজনের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নাই, কখনো দেখা হয় নাই। তবে উনার লেখার সাথে দেখা অন্তত সতেরো/আঠারো বছর তো হবেই। সেই ব্লগের সময় থেকে। তখনও সামহোয়ারইনব্লগ পুরাপুরি সোয়াইনব্লগে রুপান্তরিত হয়নাই। ওখানে উনি লিখতেন। পরে নানা জায়গায় উনার লেখা পড়েছি।
ওয়াহিদ সুজনের লেখার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। শান্ত, কিছুটা নিরাবেগী। যেন প্রতিক্রিয়াহীন দর্শকের মতো জীবনকে দেখে যাচ্ছেন। কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আবার একই সাথে তার লেখায় সরলতা এবং মানবিক অনুভূতি প্রকাশের কোন কমতি নেই। এই এক ধরণের প্রকাশ্য ও আপাতঃ বৈপরীত্য উনার লেখাকে আলাদা করে। বিভিন্ন ব্লগ পড়ার সময় আমি মনে মনে হাসতাম আর নিজে নিজেই ভাবতাম লোকটা আসলেই দার্শনিক। যদ্দূর জানি উনি ফিলোসফির গ্র্যাজুয়েট। পরিচিত যারা ফিলোসফি পড়েছে তাদেরকে দেখে দার্শনিকমার্কা উদাস জ্ঞানী মনে হয়নি কখনো, তাদের অনেকেই অন্য কিছুতে সুযোগ না পেয়ে অথবা পড়ালেখায় অবহেলা করে জাস্ট একটা ডিগ্রির জন্য এ বিভাগে ছিলো। অন্যদিকে উনার লেখা পড়েই আমার মনে হতো এই লোকটা মনে হয় আসলেই ফিলোসফির স্টুডেন্ট হওয়ার মতো লোক। যদিও কখনো দেখা হয়নি এবং বাস্তবে বুঝার সুযোগ হয়নি। এই লোক যে গড়পড়তা বাংলাদেশীদের মতো না, তার আরেকটা ইশারা হলো অনেক ক্রিমিনাল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম আড়াল করা। এইটা এথিকাল কাজ। অবশ্য উনি এথিকস থেকে করছেন না কি মামলার শংকা থেকে করছেন তা জানার সুযোগ আমার নাই। ভূমিকার বর্ণনা থেকে মনে হয় এথিকস থেকে করেছেন।
ব্যাক্তি ওয়াহিদ সুজনকে নিয়ে কেন এতো কথা বললাম বইয়ের কথা বলতে গিয়ে? কারণ বইটা উনার খন্ডিত আত্মজীবনী। উনার গলব্লাডার অপারেশন, সেই অপারেশনে ডাক্তারদের ফেইলুর, বছরের পর বছরের অমানবিক ভোগান্তি, বারংবার অপারেশন ও নানা চিকিৎসা বা অপচিকিৎসার ঘটনা –এইসব লিখেছেন। এইসব লেখাতেও উনার সেই বৈশিষ্ট্যটা রয়ে গেছে। এতো কষ্টের পরও, যেইটা হিউম্যান এরর অথবা ক্রাইমও বলা যায়, ক্রিমিনালদের প্রতি উনার ক্ষোভের কোন জোরালো প্রকাশ নাই। বরং বাংলাদেশের মতো একটা দেশে একজন সাধারণ মানুষ এই পদ্ধতিগত নির্যাতন ও অবিচারের শিকার হওয়ার একটা নৈর্ব্যাক্তিক জবানবন্দী যেন রেখে গেছেন। তবে অনুভূতি প্রকাশের শক্তিটাও থেকে গেছে। প্রতিক্রিয়ায় বারবার আমার মনে হইছে সুস্থতার জন্য প্রতি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া দরকার। এই ধরণের ভোগান্তি একটা মানুষকে না শুধু, পরিবার ও সুহৃদদের জীবনকে আক্রান্ত করে। অনেক সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়।
বইটাতে কিছু জিনিস পরোক্ষ আছে। আবছায়া। সেই সব বিষয় কিছুটা বুঝেছি কিন্তু এই লেখক ভদ্রলোকের কাজই হলো ঝাপসা রেখে দেয়া, সুতরাং আমি আর প্রকাশ করতেছি না অনুমানের উপর ভর করে। তবে এতটুকু বলা যায় যে আপনি যদি বিষয়গুলো জানেন তাহলে আফসোস করবেন। কথা ছিলো বাংলাদেশে যে আদর্শবাদী লোকগুলো নিজেদের সততার মাধ্যমে আদর্শকে সমাজে মজবুত করবে, কিভাবে গণ-বাটপারির মাধ্যমে, কেবলমাত্র যে কোন উপায়ে নিজেদের আর্থিক প্রাপ্তির বিনিময়ে পুরা আদর্শকে মোটামুটিভাবে আমাদের জীবদ্দশার সময়কালের জন্য ডুবিয়ে দিয়েছে তার একটা করুণ ও নেপথ্য দলীলও বটে এ বইটা।
ওয়াহিদ সুজনকে ছাত্রজীবন থেকে চিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক দশকএর নবীন। সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চাপীঠএ নিয়মিত আসতেন। তখনও তার কোনও বই বার হয়নি, বিক্ষিপ্ত লেখালেখির চেয়ে নিজের বিষয়ে অধ্যয়নে মনোযোগ ছিল। তবে অসুখের দিন নামক বইয়ের আলোচনায় তার নির্লিপ্তির যে কথা বলা হয়েছে তা যথার্থ। তার সংযম অসাধারণ। তার আরও কটি বইয়ের খবর নেটে পেয়েছি, দুর্ভাগ্যবশত একটাও পাওয়া হয়নি। আশা করি তার বইগুলো পাওয়ার চেষ্টা করব।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ শামীম ভাই। পাঠচক্রের কোনো বড় ভাই বা বন্ধু কখনো আমার বই পড়ছে কিনা জানা নেই। মানে কখনো উনাদের কোনো মন্তব্য চোখে পড়ে নাই। এ নিয়ে বিচলিত তাও নয়। বরং একদম অজানা মানুষেরা নিজেদের মতো করে দেখছে, সেটাই ভালো লাগে। ভালোবাসার জন্য আবারো ধন্যবাদ।