অনুবাদ: এনামূল হক পলাশ
আল-খানসা (৫৭৫-৬৪৫)
তার নাম তুমাদির বিনতে আমর। আল-খানসা নামে বেশি পরিচিত। আরব বিশ্বের বিখ্যাত নারী কবিদের একজন তিনি। আল-খানসা নবী মোহাম্মদ সা. এর জীবদ্দশায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
তার সময়ে নারী কবিরা মূলত মৃতদের জন্য শোককবিতা লিখতেন এবং তা জনসম্মুখে প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করতেন। ভাই শাখর ইবনে আমর ও মুয়াবিয়া ইবনে আমর। শাখরের জন্য লেখা শোককবিতার কারণে আল খানসা এসকল প্রতিযোগিতায় সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি সাহিত্যের নারী কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে পরিচিত। চালাক-চঞ্চল স্বভাব ও মন কাড়া চেহারার জন্য তাকে খানসা (হরিণী) নামে ডাকা হতো আর খানসা নামেই ইতিহাসে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তার পিতার নাম আমর ইবনে শারিদ। তিনি ছিলেন কায়স গোত্রের সুলায়ম শাখার সন্তান। তাদের গোত্র বনু সুলায়ম হিজায ও নাজদের উত্তরে বসবাস করতো। আব্বাসীয় যুগের কবি বাশশার ইবনে বুরদ বলেন, আমি যখন নারী কবিদের কবিতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি তখন তাদের প্রত্যেকের কবিতায় একটা না একটা দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করি। লোকেরা প্রশ্ন করলো: খানসার কবিতারও কি একই অবস্থা? বললেন: তিনি তো পুরুষ কবিদেরও উপরে।
সকল আরব উমাইয়া কবি খানসাকে আরব নারী কবিদের মাথার মুকুট জ্ঞান করেছেন।
আধুনিক যুগের মিসরীয় পণ্ডিত ডঃ উমার ফাররূখ খানসার সম্পর্কে বলেছেন, “খানসা সার্বিকভাবে শ্রেষ্ট আরব কবি। তাঁর কবিতা সবই খণ্ড খণ্ড। অত্যন্ত, বিশুদ্ধ, প্রাঞ্জল, সূক্ষ্ম, শক্ত গঠন ও চমৎকার ভূমিকা সংবলিত। তার কবিতায় গৌরব গাথার প্রাধান্য অতি সামান্য। তার মারসিয়ার অর্থ স্পষ্ট, সূক্ষ্ম ও কোমল এবং আবেগ-অনুভূতির সঠিক মুখপত্র। দুই ভাইয়ের প্রশংসায় অতিরঞ্জন থাকা সত্ত্বেও তা বেদুঈন পদ্ধতি ও স্টাইলের দিকে সঠিক।
আরব শ্রেষ্ঠ কবি আল নাবিগা তার সম্পর্কে বলেন “আল খানসা জিন ও মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি।”
মোটকথা, কাব্য শক্তি ও প্রতিভার দিক দিয়ে খানসার স্থান দ্বিতীয় স্তরের তৎকালীন আরব কবিদের মধ্যে অনেক উঁচুতে। তার কবিতার একটি দিওয়ান ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বৈরুতের একটি প্রকাশনা সংস্থা সর্বপ্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে দিওয়ানটি ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হয়।
মক্কার দুমাতুল জান্দালে, ইয়েমেনের সানয়ার নিকটস্থ স্থানে, মক্কার উকাজ প্রভৃতি স্থানে কবিদের কবিতা চর্চা ও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান হতো। এর মধ্যে উকাজের কাব্য মেলা সবচেয়ে রমরমা ও প্রসিদ্ধ ছিলো। সেই সময় তিনি আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। সেই সম্মেলনে সম্মান হিসেবে সবার থেকে আলাদা করার জন্য শুধু তার তাবুই লাল রঙে তৈরি করা হত। আরবের বড় বড় কবিগণ এ সম্মেলনে যোগ দিতেন এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। খানসা এই সকল মেলায় ও সমাবেশে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং উকাজ মেলায় তার মারসিয়া অপ্রতিদ্বন্দী বলে স্বীকৃতি পায়। তবে হিজরি ১২৯ সনে খারেজিদের দ্বারা লুণ্ঠিত হওয়ার সময় উকাজ বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়।
আল খানসার মৃত্যু সন নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একটি মতে, হযরত উসমানের খিলাফতকালের সূচনা পর্বে ২৪ হিজরি / ৬৪৪- ৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। পক্ষান্তরে অপর একটি মতে, ৪২ হিজরি/ ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের কথা এসেছে।
তার কবিতার মাস্টারপিস হল তার ভাই সাখরের প্রতি তার প্রশংসা। সাখর আরবের একজন গোত্র প্রধান ছিলেন যিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন এবং পরে প্রতিদ্বন্দ্বী বনি আসাদ গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানের পর মারা গিয়েছিলেন।
তার কবিতা ক্ষতি, জীবন, প্রেম এবং প্রস্থান সম্পর্কে সূক্ষ্ম রূপক পূর্ণ। তবুও, রোমান এবং পারস্যদের বিরুদ্ধে মুসলিম যুদ্ধের সময় তার চার সন্তান নিহত হওয়ার সময়, আল-খানসা তাদের কাছে কোনো প্রশংসা লিখতে অস্বীকার করেন এই বলে যে ইসলাম তাকে মৃতদের জন্য বিলাপ না করতে শিখিয়েছে।
আল-খানসা এর কবিতা
অনুবাদ: এনামূল হক পলাশ
সাখর এর জন্য বিলাপ – ১
আমার চোখ অবিরল অশ্রু ঝরানোর জন্য হও উদার,
আর সাখরের জন্য অশ্রু ধারা বয় আমার কান্নার।
সারা রাত ছিলাম জেগে আমি পারিনি ঘুমাতে;
আমার চোখ ছিলো যেন পাথরে ঘষা খাওয়া রাতে ।
যদিও দেখার কথা ছিল না চোখে দেখেছিলাম তারা;
নিজেকে ঢাকতে ছিলনা কিছুই জামার ছেঁড়া অংশ ছাড়া ।
লড়াইয়ে হয়তো তারা তার বন্ধুকে রক্ষা করতে পারতো,
খেলায় যারা অস্ত্র, দাঁত আর নখ নিয়ে যুদ্ধ করতো।
ভেতরে ঘোড়ার দল সাগ্রহে তাদের লাগাম টানবে,
যেমন সিংহরা আভির্ভুত হয় সরস চারণ ভূমিতে।
সাখর এর জন্য বিলাপ – ২
যে দিন ছিল সাখরের ছেড়ে যাওয়ার
তার চেয়ে দুঃখময় দিন নেই আর।
মিষ্টি যেন হয়েছে চিরতরে
খুব তিক্ততায় গেছে ভরে।
সাখর ছিলেন আমাদের অধিপতি,
আমাদের গোত্রের প্রধান সেনাপতি।
শীতকালে সাখর উৎসব করতো আর
তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিতেন সবার।
আমরা যখন ক্ষুধায় ছিলাম কাতর
তখন নিহত হয়েছিল আমাদের সাখর।
সাখর আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন
একটি পর্বত যার শীর্ষে আগুন যেন।
দৃঢ়, নিখুঁত মুখ আর ধার্মিক সেই জন
ভয়ের সকালে করেন যুদ্ধের প্রজ্জ্বলন।
তিনি পতাকার বাহক গোত্রের ভক্ত,
তিনি রক্ষা করেছিলেন আমাদের রক্ত,
তিনি সাক্ষী ছিলেন সমাবেশের
এক সেনাবাহিনী মুখোমুখি শত্রুর,
উট বলিদানকারী, নিপীড়িতদের ধারক,
বন্দীদের মুক্তিদাতা, হাড় সংস্কারক।
আমি বলি পৃথিবীতে তার মতো
আর কেউ ছিল না উদার এতো।
সাখর এর জন্য বিলাপ – ৩
গোত্র করেছে সময় নষ্ট আবার,
সকল ছেলেরা আমার পিতার,
আমি অশ্রুতে হলাম পরিণত
আমার কান্না ঝরে পড়ে অবিরত।
হে সাখর, মৃতদের জন্য কবরে
বিলাপ বা বিষাদ কি ছিল সবরে?
সাখর ও তার ভালোবাসাকে
আল্লাহ যেন দূর করে না রাখে।
অথবা আমার খলিফা মুয়াবিয়াকে
আল্লাহ অবশ্যই তাড়াবেন গদী থেকে।
আল্লাহ যেন সাখরকে না দূরে ঠেলে দেন,
কারণ আমার ভাই বরাবর দানশীল ছিলেন।
মহান কাজ দিয়ে প্রচারিত আমার ভাই,
আমি তার জন্য অবিরাম কান্না করে যাই।
আল্লাহর কসম করে বলি,
আমি শোকের দীর্ঘ পথ চলি।
আল্লাহ পাহাড়ের চূড়া ঠিক করেন,
আল্লাহ দুনিয়ায় পানি বর্ষণ করেন।
যা ধারণ করতে আকাশে ভাসে
সকালের মেঘ বৃষ্টি হয়ে আসে।
সাখর এর জন্য বিলাপ – ৪
নিদ্রাহীন আমি রাতকে জাগিয়ে রাখলাম,
চোখের পাতায় কালো দাগ নিয়ে থাকলাম।
যদিও প্রহরী নেই, আমি তারা দেখেছিলাম
আমি ঢিলা গাঊনে আবৃত হয়ে ছিলাম।
কারণ আমি খবর শুনেছিলাম তার-
আনন্দের কোনো খবর নেই আর:
‘এই খানে সাখর,
মাটিতে পতিত, পাথরের ভেতর।’
তাহলে যাও, আল্লাহর কাছে,
তোমার হৃদয় ভুল প্রেরণায় আছে।
তোমার পছন্দ বর্শার উজ্জ্বল ডগা
যা রাতকে করে মাতাল রগরগা।
তুমি, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জন্মগত মুক্ত মস্তান,
আর তুমি যাও – চূড়ান্ত মুক্তির সন্তান!
আমি তোমার জন্য কান্নায় হব বরবাদ
খুব লম্বা এক বলয় যেন ঘুঘুর আর্তনাদ।
আর তারারা উদ্ভাসিত করে
পথিকের চলার রাস্তা ধরে।
তাদের সাথে হবেনা শান্তি কখনো মিলে
যাদের সাথে তুমি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলে,
চমৎকার অতিথিসেবকের কালো পাত্র
সাদা না হওয়া পর্যন্ত তার কালো গাত্র।