spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাদীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম

দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম

গোলামের পুতেরা

সে ভাবছে তার আম্মার কথা।
তার আম্মা নিরেট কিষাণী।

নিরক্ষর মানুষ। বর্ণমালার সামনে তিনি অন্ধ ও মূক।
হরফের ভাষা তার কাছে দুর্বোধ্য। হরফের পথ ” দুর্গম গিরি কান্তারমরু”।

আম্মা কী তবে গণ্ডমূর্খ !

তা কি করে হয়! আম্মাতো ঠিকঠাক পাঠ করেন প্রতিনিয়ত আব্বাকে।
আব্বার রাগ,অভিমান,প্রেম ভালোবাসা ভোরের দহলিজে ক্বারী সাবের কোরান তেলাওয়াতের মতো আম্মা পাঠ করে যান সুরেলা সুরে।

আম্মা পাঠ করতে পারেন লাউয়ের কচি ডগার ভাষা।
মুরগির খোপে আর্তনাদ বুঝে সকাল সকাল খুলে দেন খোপের ঝাপ।
খুদ খুঁড়া ছিটিয়ে দেন আঙিনার একপাশে।

এমনকি আম্মা চুলোর উপর ভাতের হাঁড়িতে টগবগ করা চালের বেদনা কিংবা পরিপক্কতা পাঠ করেন নিবিষ্ট চিত্তে।

চালেরা বালেগ হলে ভাত হয়ে যায়।
একটা ভাত টিপ দিয়ে বুঝে নেন সকল ভাতের পক্কতার উত্তাপ।

সে তার আম্মার কথা ভাবে।

ভাবছে তার আম্মার কথা।
আম্মা কি করে জানেন যে,

‘ আমি গোলামের পুত।’
শৈশবেই আম্মা বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন কেন , ” আমি গোলামের পুত”!

কলমিডাঙ্গায় একবার খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে আম্মা কলমি ডগা পিঠে ঝপাং ঝপাং মেরে হাত টানতে টানতে বললেন ‘গোলামের পুত বাড়িত আয়’।

এক পাল কিশোর কিশোরী
চৈত্রের দুপুরে পুকুরের পানি করলে ঘোলা

মা হাতে গাছের মরা ডাল নিয়ে
‘ গোলামের পুত জলদি ওঠ’ বলে তাগাদা দিতেন আমার শৈশবকে।
আম্মা কি কখনও বলতেন,

‘ লেখাপড়া করে মানুষ হ পুত, নাহলে গোলামের পুত গোলামই থাকবি। ‘

সে ভাবছে তার মায়ের কথা।

মা খুব রেগে গেলে বলতেন
” গোলামের ঘরের গোলাম”। এই গালি খুব সুলভ ও সহজ। গ্রামের প্রতিটা মা তার সন্তানকে এই গালিটা দেন খুব সাবলীল ভঙ্গিতে।

সে ভাবছে তার মায়ের কথা।

মা কেন তাকে গোলামের পুত কিংবা গোলামের ঘরের গোলাম ডাকতেন? তার আব্বা কি গোলাম ছিলেন? সব স্বামীরা কি তার স্ত্রীদের সামনে গোলামের পোষাক পরেই ঘুরে? তার দাদী, তার দাদীর দাদীও কি তাদের পুত্রদের এভাবে বকতেন? তার স্ত্রীও কি তার পুত্রকে এভাবেই শাসায়?
তার আম্মার কথায় ভাবনাতে দোলতে থাকে সে পেন্ডুলামের মতো।

আম্মাতো বোকা মানুষ!
তিনি জানেন না আর্য অনার্য দ্রাবিড় কাহিনী।

বাংলা ভাষার গলায়
সংস্কৃতির ফতোয়াবাজদের ছুরি ধরার ইতিহাস আম্মা জানার কথা না।
শশাঙ্ক, দাহির,গৌড়গোবিন্দের নির্মমতা আম্মা জানেন না।
তারপরও আম্মা অথবা আম্মারা কেন আমাদের শৈশব ও কৈশোর থেকেই বলে আসছেন ‘গোলামের পুত’।
১৭৫৭ সালের পর শতাব্দী শতাব্দীকাল গোলাম ছিলাম আমরা ।

আমাদের প্রপিতা বা তার পূর্বপুরুষদের গলায় ছিল গোলামীর জিঞ্জির।

আম্মা ও আম্মারা তারা সবাই কি জেনে গেছেন সে অতীত!

জিঞ্জির ভাঙতে সবুজ ঘাস রক্তাক্ত হয়েছে।
প্রান্তরে প্রান্তরে হয়েছে অসম লড়াই।
কত শত নামে লড়েছি ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে।
বাবা আদম শহিদ,
শাহজালাল,ফকির বিদ্রোহ,বাঁশের কেল্লা,দারুল হরব ফ্রন্টে লড়তে লড়তে সিপাহি বিদ্রোহের কেন্দ্র ছুঁয়েছি।

বিশাল বৃটিশ কামানের সামনে গর্জে উঠেছে হাবিলদার রজব আলী।

বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সেদিন ঘন সন্ধ্যায় ডাক দিয়েছিল একটা কোকিল।

গাছে গাছে,ডালে ডালে ঝুলে থাকা স্বাধীনতাকামী শহিদদের নামের নামতা পাঠ করেছিল কোকিল তার বিষাদ সুরে।

ঢাকার রাজপথে ঘন অন্ধকারের আধিপত্য।
বীর চট্টলা বিধবা নারীর মতো চুপচাপ।

শাহজালালের সিলেট নির্জীব নিস্ক্রিয়।

মহাবীর ঈশা খাঁ গভীর ঘুমে।
সাত বীর শ্রেষ্ঠরা বার্ধক্যজনিত সমস্যায় কাতর।
আমরা এখন রাজা দাহিরের হাতে বন্দি মুসলিম নারীর মতো অসহায়।
আম্মা ! ও আম্মা তুমিও কি ঘুমিয়ে গেছ?

একটা কঞ্চি নিয়ে তোমার ছেলেদের ডেকে বলো
” গোলামের পুতেরা সজাগ হ”
‘গোলামের ঘরের গোলামরা পিছনে তাকিয়ে দেখ’ ,

গোলামীর জিঞ্জির নিয়ে রেল ভর্তি ফৌজ আসছে।

আরেকবার গলা আটকে গেলে গোলামীর জিঞ্জিরে
আল্লার কসম অনন্তকাল আউশ আমন ধানের ছড়ার মতো উৎপন্ন হবে তোদের ঘরে ঘরে গোলামের পুত।

গভীর ঘুম থেকে জেগে
আম্মা আম্মা বলে রাতা মোরগের মতো ডেকে ওঠি।
জেগে দেখি জিঞ্জিরের ভয়ে কাঁপছে তালগাছ,তালপুকুর,
ধানক্ষেতসমেত আমার পবিত্র স্বদেশ।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. অসাধারণ একটা কবিতা। আধুনিক কবিতার গতর নির্মাণের আর্কিটেকচার কবি ভালো করে জানেন। অনেক ভালোবাসা কবির জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ