কবিতা ভাবনা :
কবিতা এক নিবিড় আত্মযাপনের অভিব্যক্তি। জীবনের শূন্যতায় যে বোধ ভাষা খুঁজে ফেরে, যে সামাজিক টানাপোড়েনে নিজের অবস্থানটিও বারবার টাল খায় , যে কথা বলা হয়ে ওঠে না — কবিতা সেই প্রয়াসকেই তুলে আনে। একদিকে প্রেম , অন্যদিকে হাহাকার , বস্তুতান্ত্রিক চাহিদার ঊর্ধ্বে হৃদয়ের মর্মকে উপলব্ধি করার এক মানবিক দায় থাকে কবির। সেই দায় থেকেই সত্যের অন্বেষণ চলতে থাকে। অবশ্যই সুন্দর একটা পৃথিবী, জীবনের সারল্য রূপমুগ্ধতা, আর বিস্ময়ের দরোজায় করাঘাত করাই কবিতার উদ্দেশ্য। আত্মার পীড়িত করুণ সংলাপে ও সংকেতে, রূপকে ও রূপান্তরে গতিময় ক্রিয়ায় কবিতার সিদ্ধি খুঁজতে হয়। বলেই লিখতে হয় —
জ্বরপাখি স্মৃতির বেদানা
ঠুকরে ঠুকরে খায়
বৃষ্টিচাবুকে কাঁদে নদী ঘরে ঘরে
মনের নৌকা তাতেই ভেসে যায়
কবিতাগুচ্ছ :
১
পুরুষজন্ম
আমার পুরুষজন্মের ভিতর এত হাওয়া
এত দ্বন্দ্বময় রাস্তা!
যদিও স্বয়ংক্রিয় আমি
চলাচলে বিনম্র স্তব্ধতা…
পাক খাই
ডুবে যাই
আবার ভাসমান
দৃপ্ত অথবা প্রদীপ্ত নিজেকে মেলে দিতে দিতে
সপ্রতিভ আলোকসাম্যে যা কিছু কথিত
আমি তার উপমা হই, ব্যতিহার হই
ব্যাকরণ জুড়ে সব ব্যাকরণ ভাঙি
ছন্দে বন্দিত হই, অথবা নিন্দিত
পথে পথে সমীহ ছায়ায়
নিবিড় স্মৃতির বাঁক মন্থনে ডাকে
পারি নাকো যেতে
যদিও অমৃতকুম্ভ এখনও অপেক্ষায় আছে
২
নীল সমাচার
মানুষের জন্য দরজা কেউ খুলবে না আর
তবুও মানুষ আছে পৃথিবীতে
বিকেলের শেষ আলোটুকু
এ বিশ্বাস ফেলে চলে যায়
আমরা এক একটি সীমানায়
নিজেদের অন্তর্গত কদর্য হিংস্রজীব পুষি
সে সংবাদ বাইরে বলি না
বাইরে তো সবাই মহান
কেউ দরজা খুলবে না
রাত্রি নামবে
রাত্রির ভেজাগন্ধে ফুটব সবাই
নিজের নিজের শয্যায় কামগন্ধলীলা
অপার্থিব শূন্যতায় ভরা
শূন্যে উড়ে যাব
আমরা সবাই মৃত্যুর ঘোড়া
যজ্ঞ শেষ হলে বলো কোথায় স্বাতন্ত্র্য থাকে আর?
তখন অস্পষ্ট সব নীলসমাচার….
৩
হাসপাতালের দিকে
কিছু নীরবতা আমাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়
যদিও কোনও তৃষ্ণার কথা বলিনি কখনও
যদিও গুচ্ছ গুচ্ছ কোঁকড়া চুলের রমণীদের কথা গোপন রেখেছি
মসৃণ ত্বকের কিছু উপমা খুঁজতে খুঁজতে
আমি শুশ্রূষার অভিমুখে দাঁড়াই
আমাকে ভাসিয়ে দিক সময়
আজ কোনও নৌকার কাছে যাব নাকো আমি
ক্রমাগত এক একটি দ্বীপ, দ্বীপের অরণ্য
আর নীরব ভাষার সংলাপ….
৪
যন্ত্রণার রাস্তায়
যন্ত্রণার রাস্তায় তবুও কিছু ফুলগাছ থাকে
আমি মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেলে তারা চেয়ে চেয়ে দ্যাখে
একটু দাঁড়াই
দু একটা চমৎকার ফাঁকা হাসি অবিরাম শূন্যতা আঁকে
দেখতে থাকি
অথচ কিছুই দেখা হয় না
সব উপলব্ধির চাবি কারা নিয়ে চলে গেছে
শেষ রোদটুকু নির্বাণ বাক্যের মতো পড়ে আছে মেঘে
আজ ফুল কুড়াব না আমি
সব মায়াগাছে বসে আছে মায়াপাখি
চেতনার প্রজাপতিগুলিও বিষণ্ণ
আজ তারা উড়তে চাহে না নিষিক্ত আলোকে
৫
আমরাগুচ্ছ
১.
আমরা টুকরো টুকরো সম্পর্ক নিয়ে চলে যাচ্ছি
এগুলো সেলাই হবে না, ইতিহাস হবে না
রাষ্ট্রনেতারা তীব্র শ্লেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে
মানবীর গর্ভে জন্ম দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক সন্তান
আমরা পরিচয় হারাচ্ছি
সভ্যতা দেখছে আমাদের
আজ আমাদের ভাঙা দেশ, ছেঁড়া সম্পর্ক
আর ভাগাড়ের উল্লাস
২.
এইখানে মৃত্যুর বাড়ি
রোজ এসে আমরা জীবন প্রার্থনা করি
রাঙা মেঘ হয়ে ভাসে জীবনের আবেগ
আবেগ তো যুক্তিহীন, সত্যহীন নিসর্গ মরীচিকা
ঝড়ের তাণ্ডবে লুটোপুটি খায়
চূর্ণবিচূর্ণ দিন ক্ষয় হতে থাকে
চাঁদ ডেকে ডেকে ফিরে চায়
আমাদের ঘুমহীন বারান্দা একা
প্রার্থনা দীর্ঘ হয় কলঙ্কিত রাত্রির কাছে
৩.
সব রাস্তাগুলো কোন্ দিকে গেছে?
আমাদের ধারণার উত্তরগুলো ধর্মপুস্তকে উঠে এসেছে
আমরা জীবনকে দোলাতে থাকি ধর্মের কাছে
সব ধর্ম Nothing can be made from nothing.
শুধু এক বৃহৎ শূন্যের হাতে নিজেকে তুলে দিই
জীবন দাঁড়িয়ে থাকে ধর্মের ধারণার কাছে
ধর্মের ষাঁড়েরা এসে যদিও শিং নাড়ে
আমরা ভিরু, আলো জ্বেলে অন্ধকার দেখি
৪.
তপস্যাও ক্লান্ত হয়
বৃষ্টিস্নাত করে
শরীর যদিও বল্মীকের ঘর
ক’জন বাল্মীকি হই?
তীর্থে তীর্থে আমরা সবাই দস্যু রত্নাকর
৫.
বিভাজন নিয়ে আমরা সবাই বিভাজিত
যদিও কাছাকাছি থাকি
কাছে থেকে দূরে দূরে রাখি
দুপুরে কোকিল ডাকে
আইবুড়ো ভাত
আমাদের বসন্ত আসে যৌবনের সংরাগে
আমরা গুটিয়ে থাকি রেশমের গুটি কেটে কেটে
নিবেদন আমাদের আত্মার দোসর
৬
দম্পতি
মুশকিল আসানের বাড়ি খুঁজতে এসেছে
শহর তোলপাড় হয়ে গেল
হাসপাতালেই বসেছে বিবাহ বাসর
দ্রুত এক নপুংশক সাঁকো পেরিয়ে গেল
মাথাব্যথার শুধু মাথাটুকু দেখা যাচ্ছে
হিয়া নেই, হিয়া নেই, শুধু কাজল
নারীটি কাজল শুধু
আমাদের চিন্ময়ী দ্রাক্ষা ক্ষেত বড়ো অন্ধকার
বাজাতে বাজাতে বাঁশি
সুরও এখন কাতর ঝরনা
নামছে লোকালয় পাহাড়ে পাথরে
আমরা দেখছি আর লাল সূর্যকে
ভেবে নিচ্ছি আলতা রাঙা পা তার
অনেক রাতে প্রাচীন গোরুর গাড়ি থেকে
নেমে আসছে আসান
মুশকিল তারই স্বামী, জ্যোৎস্নার মালা পরে
ভারি সুন্দর হাসছে
দাঁতগুলি ঝিকিমিকি, ঝিকঝিক
ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
৭
লণ্ঠন নিভে যায়নি
লণ্ঠন জ্বেলে এখনও গ্রামের মুখ
পেছন ফিরে চায়
এই পথে আসবে বিশ্বাস…
এই পথেই কবে চলে গেছে…
অথচ পাল্টে গেছে আয়োজন
আগে চলো, আরও আগে
যতদূর যাওয়া যায়…
লণ্ঠন সেকেলে, কবে ভূত হয়ে বসে আছে
পরিত্যক্ত পরিধি জুড়ে এখনও গ্রামের ঢেঁকি
কদাচিৎ ধান ভানে, নবান্নে ব্যস্ত হয়ে ওঠে
জানে না শহর আজ মজে আছে কীরকম মাংসভাতে
আলতা রাঙা পা বেশ চপ্পলে মানায়
উপভাষা জ্যান্ত হয়ে ওঠে
কাবিলনামায় সই করে মেয়েরাও
জল তবু গড়ে গেছে সাঁকোর নীচে
ব্ল্যাক হোল বোঝেনি
বারান্দায় ছাতে সারারাত পাঁয়চারি করে গেছে
সিগারেট মেজাজ
লণ্ঠন নিভে যায়নি
ফাটা কাচ জোড়া দেয়, ছেঁড়া কাগজ গুঁজে রাখে
কালি মোছে চোখের কোণেও
৮
সাফল্য
চারপাশ থেকে বিস্ময় ছুটে আসছে
প্রেমে পড়ার অভিনয় করে
মাত্ করে দিচ্ছি শহর
সবাই রস ঢেলে দিচ্ছে আমাকে
হাবুডুবু করতলে রসিক নাগর হয়ে
করে যাচ্ছি টইটম্বুর দিনপাত
খুব দামি জিনিসও সস্তায় পেয়ে যাচ্ছি
ঘরদোর কলসি কলসি ভরে নিচ্ছি বিলাস
পলিথিন প্যাকেটেও পাচার করছি সম্মান
সাফল্য দেখতে তুমিও আসবে নাকি ?
তাহলে নির্মোক খুলে বসব নিরালায়
শব্দের পৌরুষে তোমাকেও করে নেব জয়
৯
কাজলদিঘি
____________
এখানেই আছি যেমন থাকা যায়
কাজলদিঘির পাড়ে অথিতি আমি
একান্ত কুঁড়ে ঘরে
জলে নামলে জোছনার রাধা
আমি তার ছায়া কুড়িয়ে পাই
খুব যদি ভুল হয়, শূন্যতার পরিধি জুড়ে
নিঃসঙ্গ চতুর ঘোড়া আসে
আমি তার ভ্রুর ধনুকে বাক্য বসাই
বাক্যে কোমল চাঁদ, শব্দে বিনয়
আমি তাকে ঢেকে রাখি অলীক মায়ায়
পড়শি বিকেল থেকে চেয়ে আনি খই
কী সুন্দর রাঙা তার ভেতরের ঘুম
অথবা ঘুমের ডাঙা চর্চিত সন্ধ্যায়
শ্রীরাধা নূপুর খুলে তরঙ্গ পার হয়
যত দেখি কাজলদিঘি নাচে চোখের তারায়
১০
এ বাড়ি পৃথিবীর বাড়ি
একবার কি আসবে না?
এ বাড়ি আমার বাড়ি নয়
এ বাড়ি পৃথিবীর বাড়ি
এ বাড়িতে ঈশ্বর থাকেন
ঈশ্বর বড়ো নির্জন
তোমাকেই দেহ খুলে দেবো
সমস্ত পরাগগুলি নিয়ে যাবে তুমি
আগামীর পৃথিবীতে পরাগে পরাগে
ফিরে আসবে নতুন সন্তান
আসতে পারো ,
আমি ও ঈশ্বর এক বাড়িতেই থাকি
পৃথিবী কোনওদিন আমাদের উদ্বাস্তু ভাবে না
১১
আকর্ষণীয়া
কার আশ্চর্য সংকেত পাই
নিসর্গনাভির ঘোর
সাঁতারের সম্মোহন
উন্মুখ পয়োধরার বাঁশি
কিছুরই বিকল্প বুঝিনি
ক্লান্ত হইনি কখনও
নিবিড় ভরসার উচ্ছ্বাসে
রচিত হয়েছে কাহিনি
বোধের মাস্তুলে পাখি
অনুভূতির ডানায় রঙ্ মাখে
নীরবতা ভাষা তার
ভাষায় স্বপ্নের পরাগ লাগে
দূর দূর ছুঁয়ে যায়
কালের হিল্লোলে মাজা দোলে
আমাকে শেখায় বিনয়…
১২
ঐশ্বর্য
ছ ফুট দু ইঞ্চি ঘর
বারান্দায় সন্ধ্যা নামে তার
পড়শিরা উলুধ্বনি দিলে
সে ঘরও হেসে ওঠে বিবাহমঙ্গলে
দরজায় কানাকানি
হাত ধরে টানে পড়শিনি
ইচ্ছাকুসুম ফোটে, কুসুমে সংরাগ
ঝরা চুমু কুড়িয়ে তুলে রাখি
আহা স্নেহের পরাগ !
১৩
মধ্যবিত্ত
যে দ্যাখে দেখুক
তোমাতে আমাতে আজ নেমেছি পথে
আমরা অক্ষরবৃত্ত, আমরা লবণযুক্ত মোটাভাতে
মধ্যবিত্ত পথ, কাঁচাপাকা, বিপজ্জনক
মাঝে মাঝে গর্ত আর সংঘাত
আগে পিছে কুকুর ডাকে
কুকুরের ডাকনামে আমাদেরও ডাকে
ঝিনুক খুঁজতে আসিনি
ময়লা পোশাক কেচে নিতে
এসেছি সাগরের ঘাটে
ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে মূল্যবোধ
কীভাবে সম্মানীয় ভাবব আজ?
সূর্যের দিকে হাত — আলো দাও
রাষ্ট্রের দিকে হাত — শান্তি দাও
চারিদিকে সমাজ সমাজ…
সম্পর্ক কী করে রাখব ?
তোমাতে আমাতে মাঝামাঝি
আমৃত্যু হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি ।
১৪
ঋতুমতী
আবার হেমন্তকাল এল
গাছের পাতায় লেখা
তোমার চিঠিগুলো
উড়াল বাতাস
আমি নীরবতা ভঙ্গ করিনি
কথা এসে ফিরে গেছে
কুবাক্য চতুর বাক্য কেউকে ডাকিনি
শুধু জলের ছায়ায় নিজেকে দেখেছি
কবে আমি জল হব ? কবে ?
তোমাকে আমার কাছে ডাকব চুপিচুপি
ৠতুতে ৠতুতে তুমিও ৠতুমতী
ধুয়ে নিচ্ছ শরীর তোমার
চুল শুকোচ্ছ আকাশের ছাদে…
১৫
মহাকাল
রোদের দিকে পাখা মেলে দিচ্ছি
শব্দঝড় উঠুক আমার
মৃত্যুর অন্ধকার নেমে এসে
সিঁড়ি ঘিরে বসে আছে
কে কাকে বলবে : রাস্তা দাও !
আমলকী বন, কোকিল কণ্ঠ, নতুন হলুদ ফ্রক্
গোলাপি বসন্ত নিয়ে জেগে আছে
আহ্বানে উড়ছে মৌমাছি
চলো রোগজর্জর
কিছুটা অসুখ সারাই
নিমীলিত চোখে ভ্রুর ধনুকে
এখনও টংকার ওঠে কিনা দেখি
এই সকালে আমি ও আমার ছায়া
পরস্পর ডানা মেলে আছি
মহাকাল আসছে নৌকায়
সমস্ত আকাশ তার দিকে চেয়ে আছে
১৬
আত্মহত্যার খবর
এই মুহূর্তে আত্মহত্যার খবর এসে
পৌঁ
ছা
লো
মৃত্যু লেগে থাকা খবরে
কিছু
যন্ত্রণার
ধ্বনি
চৈতন্যের ঘরে আমিও নির্বাক
পৃথিবীর সব বাতাস শেষ হয়ে গেল নাকি?
সব আলো নিভে গেল নাকি?
খবরের ঘরকন্না নেই
ছেলেমেয়ে নেই
খবর মমতা জানে না
স্তব্ধতার কাছে চলো বিশ্রাম নিই
১৭
বিনীত একটি আশ্রয়ের খোঁজে
এক বিলম্বিত বিড়ম্বনায় পথ হেঁটে যাই
ক্ষতগুলি সারা হয়নি
সেলাই হয়নি ছেঁড়া সম্পর্কগুলিও
এলোমেলো বাগ্ বিতণ্ডার পর
নিরাশার ধূসর কিছুটা পথ
নক্ষত্রখচিত রাত, বিহঙ্গখচিত সকাল
সব পেরিয়ে গেছে
বর্ষার কন্যারাও চলে গেছে বন্যায়
আমি শুধু একা একা কান্নার বৃষ্টিতে ভিজে
বিনীত একটি আশ্রয়ের খোঁজে
কোথায় করুণার বাড়ি?
ঠিকানা নেই
ধর্মের রক্তাক্ত উৎসবে আত্মার কাতর ধ্বনি পড়ে আছে
জ্বরসম্ভূত মেঘের ইশারায়
বসন্তের নিরালা স্বপ্নে দেখি
যদি আসে দিন, আবার শিরায় শিরায় রক্ত চনমনে!
১৮
বিষাদদুপুর
নীরব জানালা খুলে দিলে
হাসির ছটারা জেগে ওঠে
অন্তহীন বুকের ভেতর ক্রমশ আলো
স্বর্গীয় আভাসে মোহিনী উচ্ছ্বাস
আমি তার কাছে প্রশ্রয় চাই
নিবেদন এটুকুই ; কোথাও বিস্ময়
মহিমায় অঙ্কুরিত হয় স্বরলিপি
নির্বাক চেয়ে থাকি
আবেগের পায়েও কি বেজেছে নূপুর?
অনুভব তবে আজও কি ঝরায় রং?
কার স্পর্শে কেঁপে ওঠে এ বিরহপুর?
মন্দাক্রান্তা আজ অক্ষরবৃত্তে যাক
মুখ ঢাকুক আমার বিষাদদুপুর….
১৯
কাঙাল
একটু স্নেহ হবে?
এতকাল শুধু কুয়াশায় হেঁটে হেঁটে
কোথাও বিশ্বাস খুঁজে পাইনি
মানুষেরা অরণ্যে গেছে, সভ্যতা এখন অরণ্যনগর
রাস্তার বিজ্ঞাপনে কত পান্থশালার নাম
কত সুশাসকের স্ট্যাচু এখনও বক্তৃতা দিচ্ছে
চারপাশে এখনও কত হাততালি
আমি অন্ধকার মেখে গড়াচ্ছি কুসুমের দিকে
কুসুমের নরমগালের রোদে কত স্নেহ ঝরে
পৃথিবী মাতাল হয়, সভ্যতা স্বপ্ন বিলি করে
দু’দণ্ড বসতাম পাশে
কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে
আমার মৃত মায়ের জায়নামাজে ঘুমোতাম
কখনও কোনও পাখি ডেকে দিত ভোর হলে
জল নিয়ে ফিরত কোনও নারী নীরব স্নেহের হ্রদে
আজ যদি বিশ্বাস এসে কাছে দাঁড়ায়
আজ যদি প্রসারিত হাতে বিশ্বাস বলে :
দ্যাখো, কোনও অস্ত্র নেই…..
স্নেহমাখা কুসুম তোমার অপেক্ষায় আছে!
২০
তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর
গৃহস্থ মাছেরা এসে দরজা ধাক্কায়
আমার আদৌ কি কোনও দরজা আছে?
এই সলিলে, সময়ের বিমর্ষ সলিলে ডুবে আছি
তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর
দাঁত, মুখ এবং কামড় একসঙ্গে এগিয়ে আসে
আত্মরক্ষার কিছু নেই
অতি সামান্য ভঙ্গুর কল্পনার বাড়ি
বাক্-বিতণ্ডায় দরজা নির্মাণ —
মাছেরা ঘাই মারে
বৃহৎ পুচ্ছ তাড়নায় কেঁপে ওঠে আশ্রয়
কার তবে বন্দনা করি?
এই জলে কোথায় আছ জলেশ্বর ?
২১
আমার কোথাও বাড়ি নেই
ছেলে কোলে বসে আছে মেঘ
বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি ফিরি
সমস্ত আকাশ জুড়ে মেঘের কলোনি
এগলি ওগলি পথে কত না কাহিনি
শব্দের নাকছাবি পরে বসে আছে
কল্পনার রানি
আমার কোথাও বাড়ি নেই, দৃশ্যত অবলম্বন শুধু
যে ডাকে তার কাছে যাই
নক্ষত্রের গান শুনি
জ্যোৎস্নায় যদি কারও ছোঁয়া পাই
হিল্লোল নিয়ে এসে তবে
ধারণায় নির্মাণ করি নতুন আশ্রয়
কোনও কোনও বৃষ্টির রাতে
দেখি ফিরে আসে মনের জানালায়
অতীত স্মৃতির ধ্বনি
আমি তার কাছে আমার সমস্ত চুমু রাখি
আমি তাকে আবার নতুন জাগরণ পাঠাই
…………
পরিচিতি
তৈমুর খানের জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে । পিতা ও মাতার নাম : জিকির খান ও নওরাতুন । প্রথম শিক্ষার সূচনা গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই। তারপর দাদপুর-বাতাসপুর জুনিয়র হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ১৯৮৩ সালে আয়াস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ বি এ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। অভাবের সংসারে শিক্ষালাভের তেমন সুযোগ না থাকলেও প্রচেষ্টা ছিল বলেই পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শিবেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে পরিচয় ঘটলে সেখানেই এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। পরবর্তীতে সেখান থেকেই ড. ললিতা সান্যালের কাছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি সম্পন্ন করেন (২০০১)।
কবিকে দীর্ঘদিন বেকার জীবন অতিবাহিত করতে হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত টিউশান করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কাজের সন্ধানে বেশ কয়েকবার মুম্বই শহরেও গিয়েছেন। সেখানে দৈনিক মজুরের কাজ করেছেন। গ্রামেও মাঠের কাজ, মাটিকাটার কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু কখনোই পড়াশুনো একেবারে ছেড়ে দেননি। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে অংশকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিছুটা হালে পানি পায়। ২০০০ সালের বন্যায় সর্বস্বান্ত কবি দিশেহারা হয়ে পড়েন। নষ্ট হয় তাঁর বহু পাণ্ডুলিপি। তবুও স্মৃতি ও বেদনা নিয়ে আবার জীবনকে আঁকড়ে ধরেছেন। করেছেন সংগ্রাম। ২০০২ সালের এস এস সি পরীক্ষায় পাশ করে হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরিতে প্রবেশ করেন। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি ব্লকের বোখারা জুবেদ আলি বিদ্যাপীঠের সহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। উল্লেখ্য এই বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেছেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক আবদুর রাকিব। বর্তমানে কবি তাঁর নিজ শহর রামপুরহাটেই বসবাস করেন।
নব্বই দশকে অর্থাৎ ১৯৯৩-৯৪ সালে অধ্যাপক ড. নোজফুল হকের সঙ্গে “বালার্ক” বলে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। মাত্র দুটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় রামপুরহাটের “বিকল্প”, “সহেলি”, “ডানা” প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা ও গদ্য লিখতে শুরু করেন। প্রথম কবিতা কবি নজরুলকে নিয়ে প্রকাশিত হয় রামপুরহাট কলেজ ম্যাগাজিনে ১৯৮৪ সালে। পরবর্তীকালে “কাঞ্চিদেশ” পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৯৪ সালে প্রথম কাব্য দৌড় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় “কোথায় পা রাখি” নামে ।সম্পূর্ণ বিনা খরচে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাস। সেই সময় থেকেই প্রথম কলকাতায় পদার্পণ। ২০০২ থেকে বিভিন্ন সময়ে “দেশ” পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। কবিতার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর গদ্যও লিখেছেন কবি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গদ্যের বইও প্রকাশিত হয়েছে।
বীরভূমের চণ্ডীদাস থেকে পেয়েছেন কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার (২০১০) । ২০১৫ তে “প্রত্নচরিত” কাব্যগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন দৌড় সাহিত্য সম্মান । ২০১৭ তে পেয়েছেন অক্সিজেন পুরস্কার ।২০১৮ তে নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার।
কবির বর্তমান ঠিকানা :
রামরামপুর (শান্তিপাড়া), ডাকঘর :রামপুরহাট, জেলা বীরভূম, পিন কোড ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ ।ফোন নম্বর ৯৩৩২৯৯১২৫০
প্রকাশিত গ্রন্থপঞ্জি :
কাব্যগ্রন্থ
১.কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), দৌড় প্রকাশনী
২. বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), দৌড় প্রকাশনী
৩. খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী
৪. আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), কাঞ্চিদেশ প্রকাশনী
৫. বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), কপোতাক্ষ প্রকাশনী
৬. একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), তবু অভিমান প্রকাশনী
৭. জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), তরুণাস্থি প্রকাশনী (বর্তমানে আলকাপ)
৮. তরঙ্গের লীলায় দেখি মাধুর্যের বসতি (২০০৮), বর্ধমান খবর প্রকাশনী
৯. প্রত্নচরিত (২০১১), দৌড় প্রকাশনী
১০. এই ভোর দগ্ধ জানালায় (২০১০) সহযাত্রী প্রকাশনী
১১. জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭), বার্ণিক প্রকাশন
১২. নির্বাচিত কবিতা (২০১৭), আবিষ্কার প্রকাশনী
১৩. স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি (২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, ত্রিপুরা
১৪. উন্মাদ বিকেলের জংশন (২০১৮), প্রিয়শিল্প প্রকাশন
১৫. নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি (২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ ।
১৬. ইচ্ছারা সব সহমরণে যায় (২০১৮) তাবিক প্রকাশন, এক ফর্মা সিরিজ, কলকাতা।
১৭. আত্মসমাহিত পিরামিড (২০১৮), বোধ প্রকাশন, এক ফর্মা সিরিজ, কলকাতা।
১৮. স্বয়ংক্রিয় বিষাদের পর (৩০ ডিসেম্বর ২০১৮), স্রোত প্রকাশনী, নন্দীগ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর।
১৯, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা (২০১৯, বইমেলা), বইতরণী, কলকাতা ।
২০, বৃত্তের ভেতরে জল (২০২২), আগন্তুক প্রকাশনা।
২১, সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে (২০২২), বার্ণিক প্রকাশন।
২২, কাহার অদৃশ্য হাতে (২০২৩), স্রোত প্রকাশনী, ত্রিপুরা।
২৩, কবিতা সমগ্র (১ম খণ্ড ২০২৩), বার্ণিক প্রকাশন।
২৪, সর্বনাশের ডায়েরি (২০২৪), উদার আকাশ প্রকাশনী।
২৫, কবিতা সমগ্র (২য় খণ্ড ২০২৪), বার্ণিক প্রকাশন।
গদ্যগ্রন্থ
১. কবির ভাঁড়ারের চাবি (২০০৬), দ্বিতীয় সংস্করণ (২০১৮), বার্ণিক প্রকাশন
২. মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা (২০১০ সহযাত্রী প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ বার্ণিক প্রকাশন ২০২১)
৩. আত্মসংগ্রহ (১ম সংস্করণ তবু অভিমান ২০০০৭, ২য় সংস্করণ ২০১০ দে পাবলিকেশন, ৩য় সংস্করণ বার্ণিক প্রকাশন ২০১৮),
৪, আত্মক্ষরণ (২০১৬), আবিষ্কার প্রকাশনী
৫, কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা (২০২০), বার্ণিক প্রকাশন।
৬, আত্মস্বর (২০২১), বার্ণিক প্রকাশন।
৭, এই কবিতাজীবন (২০২৩), বার্ণিক প্রকাশন।
গল্পগ্রন্থ
১,জীবনের অংশ (২০১৯), আবিষ্কার প্রকাশনী
উপন্যাস
১, জারজ (২০১৯), বার্ণিক প্রকাশন ।