আবু তাহের সরফরাজ
প্রতিদিনের জীবনযাপনে আমাদের মুখের যে ভাষা, সেই ভাষায় লেখা কবিতার সংখ্যা আজকের সময়ে নেই বললেই চলে। খুব পেঁচিয়ে, খটোমটো শব্দের কেরদানি প্রদর্শন করে আজকাল বেশিরভাগ কবি তাদের কবিতার শরীর নির্মাণ করেন। আসলে তাদের ভেতর কবিত্ব নেই। না-থাকলে কী হবে, কবি যে তাদেরকে হতেই হবে! তাই, ভাষার ওপর শব্দের খাচমা-খামচি করে কবিতার মতো কিছু একটা লিখতে পারলেই তাদের আত্মতৃপ্তি। আর সুবিধে হচ্ছে, আজকের সময়ের কবিতার পাঠক গণমাধ্যম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। গণমাধ্যম সাহিত্যের প্রচারপত্র। কবি হিসেবে বারবার যে নামগুলো পাঠক চোখের সামনে দেখতে পাবে, সেই নামগুলোর বাইরে আর কোনো কবি থাকতে পারেন, এই ধারণাই পাঠকের নেই। এহেন ডামাডোলে সবচেয়ে মারাত্মক যে সংকট তৈরি হয়েছে তা হচ্ছে, কবিতা আর অকবিতার পার্থক্য ঘুচে গেছে। কেউ কেউ বলেন যে, আধুনিক কবিতার ধরনই এমন। বুঝলে বুঝপাতা, না-বুঝলে তেজপাতা। কিন্তু কবিতার প্রকৃত ও মেধাবী পাঠক জানেন, সময়ের সাথে-সাথে কবিতার আঙ্গিক ও প্রকাশভঙ্গি বদলে গেলেও কবিতার ভেতর লুক্কায়িত শিল্পের ঐকতান একই রয়ে যায়। শিল্পের এই ঐকতানই কবিতা। আঙ্গিক কিংবা প্রকাশভঙ্গি কবিতা নয়। এসব কেবল কবিতার বাইরের খোলস। চকলেটের মোড়ক কিন্তু কেউ খায় না। মোড়ক খুলে ফেলে দিয়ে চকলেটটাই আমরা মুখে পুরে দিই। আবার, কোনো চকলেটে যদি মোড়ক না থাকে তাহলে সেই চকলেট আমরা কিনি না। খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সেই কবে অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত লিখে গেছেন ‘কুটির’ কবিতাটি। আজও, এবং ভবিষ্যতের যে কোনো সময়ে সেই কবিতার শিল্পসুধা আমাদের প্রাণের স্পন্দনকে দোলায়িত করে, করবে। এ ধরনের অনেক কবিতার নাম উল্লেখ করা যায়। ছন্দের সুশৃঙ্খল ছক ভেঙে আধুনিক গদ্যকবিতার যাত্রা শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। এখন আমরা যারা ‘আধুনিক কবিতা’ লিখেছি বলে খুব গর্ব করি, এসবের চেয়েও তুমুল আধুনিক কবিতা রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে বেরিয়েছে। ‘ক্যামেলিয়া’র নাম উল্লেখ করাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। আধুনিক হোক কিংবা প্রাচীন-রীতি হোক, সব ধরনের কবিতার অন্তর্নিহিত রূপটি হচ্ছে শিল্পের ঐকতান। কিংবা বলা যেতে পারে, বোধের সরল বয়ান। যাপিত-জীবনের নানা অনুষঙ্গে প্রতিদিনের ব্যবহারিক ভাষায় এসব উদাহরণযোগ্য কবিতা লেখা হয়। যেসব কবি এ ধরনের কবিতা লিখে গেছেন কিংবা লেখেন, তারা শিল্পসম্পন্ন কবিতার ধারাবাহিক ঐতিহ্য বহন করে চলেন। তৈমুর খানের কবিতা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি কবিতার সেই ঐতিহ্য বুকের ভেতর খুব নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করেন। মনে হওয়ার কারণ, তার কবিতার ভেতর পরম মমত্ব টের পাওয়া যায়। প্রতিটি শব্দ যেন এক একটি দৃশ্য। আমাদের প্রতিদিনের যাপিত-জীবনের পরিচিত টুকরো-টুকরো ছবি তার কবিতার বাঁকে-বাঁকে ছাপচিত্র হয়ে আঁকা থাকে। এসব ছবি আমাদের খুব আপন। এসব ছবি আমাদের মমতার বোধকে উজ্জীবিত করে। তাড়িত করে। কখনো কখনো আমাদের শৈশবকে ফিরিয়ে আনে। যে কোনো মহৎ কবিতা পাঠে পাঠকের ভেতর যে উপলব্ধি হয়, তৈমুর খানের কবিতা পাঠে সেই একই অনুভূতি পাঠকের অন্তর্জগতে জন্ম নেয়। কথাটা খুব উচ্চকিত শোনালেও তার কবিতা যেসব পাঠক এরই মধ্যে পড়েছেন, তারা মাথা নেড়ে স্বীকার করবেন যে, মন্তব্যটি যথার্থ। ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়া যাক—
কত জল, হেলেঞ্চা ফুলের গান
গ্রামের পুকুর পারে শৈশব খুঁজে পাই
টুকরো টুকরো আকাশ নেমে আসে
শরতের শুভ্র হাসি, বিহঙ্গে নতুন উড়ান
মায়ের আঁচল ধরে থাকি
অনন্ত সময়ের তীরে মায়ের নিখুঁত মুখচ্ছবি বহু ঢেউ,
বহু রজনীর ঘুমভাঙা চোখ—
সকাল হয়
সকালে সকালে নামে আলোর কপোত
সোনালি মার্বেলগুলি গড়িয়ে যেতে থাকে পুজোমণ্ডপের দিকে
জলরঙের ছবি হয় স্মৃতির উঠোন…
শাশ্বত কবিতার শিল্পের ঐকতান এই কবিতায় আমরা পেয়ে যাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, প্রতিটি শব্দই এক-একটি ছবি হয়ে কী রকম স্মৃতিকাতর করে তুলছে আমাদের। শৈশবের পরম নির্ভরতা মায়ের আঁচল। মায়ের আঁচলে আমরা প্রত্যেকেই নিশ্চিত নির্ভরতা তীব্রভাবে অনুভব করতাম। এরপর আমরা বড় হয়ে গেছি। আমাদের মায়েরাও এখন আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। অনন্ত সময়ের তীরে এখনো তবু মায়ের মুখচ্ছবি অসংখ্য ঢেউয়ের সম্মিলনে নির্মিত হয়। আর আমরা টের পাই, মমত্ব। প্রগাঢ় মমত্ব। অথচ যে জীবন আমরা যাপন করে চলেছি সেই জীবনে সেই মমত্ববোধ আমরা আর খুঁজে পাই না। যাপিত এইসব সময়গুলো যেন রাত্রির নিকষ অন্ধকার। আমরা হাতড়ে বেড়াই নির্ভরতা। মায়ের আঁচলের মতো নিশ্চিন্ত আশ্রয়। রাত কেটে গিয়ে সকাল হয়। কিন্তু আমাদের যাপিত-জীবন একই রকম থাকে। তবে আমরা মনের চোখে দেখতে পাই, জলরঙের ছবি হয়ে ওঠে আমাদের স্মৃতির উঠোন।
এই তো কবিতা। সত্যিকারের শিল্পসম্পন্ন কবিতা। জীবনের গভীরতর বোধকে শিল্পের অতল থেকে দক্ষ ডুবুরির মতো তুলে এনেছেন তৈমুর খান। পাঠকের অন্তর্জগৎকে প্লাবিত করে গভীর মমতা ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিটি শব্দে। কবিতায় এ ধরনের কারুকাজ শিল্প-উৎকর্ষতার পরিচয় বহন করে। প্রচুর কবিতা লিখেছেন তৈমুর। এরই মধ্যে নিজস্ব একটি কাব্য-বৈশিষ্ট্যও তিনি তৈরি করতে পেরেছেন। এই বৈশিষ্ট্য বাংলা কবিতার সকল মহৎ কবির বৈশিষ্ট্য। তবে তৈমুরের কৃতিত্ব হচ্ছে, নিজ-সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি সেই বৈশিষ্ট্যকে নতুন রূপে নির্মাণ করে নিতে পেরেছেন। এই দিক দিয়ে তিনি শক্তিমান একজন কবি। নিজের বলার কথা আর কারো মতো করে না বলে নিজের মতো করেই তিনি বলেন। তবে সেই বলার ভেতর থাকে শিল্পের ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতা। এটা যদি না-থাকতো তাহলে বলা যেত, তিনি শিল্পের উপরিতলের কবি। তৈমুরের কবিতার পাঠক জানেন, সেই কথা বলার মতো কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তার কোনো কোনো কবিতা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন আত্মার ভেতর থেকে উৎসারিত ডাক শুনতে পান। কী রকম যেন তন্ময়তা টের পাওয়া যায় তার কবিতায়। কবিতা তো আজকাল কতজনই লিখছেন। গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত পাঠক কতই তো কবিতা পড়ছেন। কিন্তু তৈমুর খানের কবিতার মতো শিল্প-সুষমা আর কারো কবিতায় আমাদের চোখে পড়ে না। তার কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের মমতার সুরটি আমাদের আত্মার ভেতর অনুরণিত হতে থাকে। তার কবিতার আস্বাদ এমনই অনন্য যে, বারবার তার কবিতা পড়তে ইচ্ছে হয়। ‘আমার ইচ্ছা’ কবিতাটিতে একটু চোখ বোলানো যাক—
ও জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় ডিমের খোসা
পচা আম, কাঁঠালের ভুতি…
আমি ওর মুখের দিকে চাইতে পারি না
ছাদের ওপর উঠে ও চাঁদ ও নক্ষত্রদের ডাকে
অন্যগ্রহের মানুষদের ডাকে
আমি ওর মোবাইল নাম্বার চাইতে পারি না
আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে থাকি
অন্ধকারে ওর মুখ হেসে ওঠে
ওর মুখের হাসি লিখে রাখি
আমার সাইকেল ওর রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায় আমার চপ্পল নিঃশব্দে ওর জানালা পেরোয় আমার ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে
লুকিয়ে লুকিয়ে পাখি হয়
শরৎ-ঋতুর মেঘ হয়
সোনালি ধানের রোদ হয়
পদাবলির ঢেউ হয়
নিটোল একটি প্রেমের কবিতা। সহজ কথার বুনন, অথচ কী গভীর উপলব্ধি! যেন একটি গল্প। গল্পই তো! মেয়েটি জানালা দিয়ে এটা-ওটা নিচে ফেলে। ছেলেটি এ নিয়ে তাকে কিছুই বলে না। হয়তো সেসব নোংলা ছেলেটির গায়েও এসে পড়ে। কিন্তু মেয়েটির প্রতি মুগ্ধতার কারণেই ছেলেটি কোনো অভিযোগ করে না। মাঝে মধ্যেই মেয়েটি ছাদে ওঠে। চুপচাপ বসে থাকে। মেয়েটির তন্ময়তা দেখে ছেলেটির মনে হয়, মেয়েটি বুঝি চাঁদ ও নক্ষত্রদের ডাকে। কিংবা ভিনগ্রহের মানুষদের ডাকে। এসময় তার মুখে এক রকম হসির ঝিলিক খেলে যায়। এমন আত্মমগ্ন ষোড়শীর প্রতি মুগ্ধ না-হয়ে থাকাই যায় না। তাই তো ছেলেটি তার মনের খাতায় মেয়েটির হাসি লিখে রাখে। লিখে রাখে, কিন্তু সেই লেখা মুখে প্রকাশ করে না। মেয়েটির জানালার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যায়। বুকের ভেতর লুকনো থাকে ইচ্ছের সিম্ফনি। সেই ইচ্ছে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেটির বুকের ভেতর পাখি হয়, শরতের মেঘ হয়, সোনালি ধানের রোদ হয়, আর পদাবলির ঢেউ হয়। ইচ্ছের যে রূপান্তর তৈমুর খান উল্লেখ করেছেন, তার প্রতিটি বাক্যই এক-একটি আলাদা আলাদা কবিতা হয়ে ওঠে। ইচ্ছে পাখি হওয়ার মানে, ইচ্ছেটা পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে থাকে। বুকের ভেতর কিচির-মিচির করতে থাকে। ছটফট করতে থাকে। আবার শরতের মেঘ হয়ে ছেলেটির বুকের ভেতর জমে ওঠে ইচ্ছে। হয়তো সেই মেঘ ঝরে পড়ে তার হৃদয়ের অতলে, পাঠক হিসেবে আমরা কেবল তা ধারণা করে নিতে পারি। সোনালি ধানের ক্ষেতে যখন দুপুরের রোদ পড়ে, কী আশ্চর্য চকচকে রঙ ছড়িয়ে পড়ে—তা আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে। মেয়েটির প্রতি মুগ্ধতা সেই রকম রঙ ছড়িয়ে দেয় ছেলেটির বুকের জমিনে। আর শেষমেষ পদাবলির ঢেউ হয়ে ইচ্ছেটা কবিতা লিখতে বাধ্য করে ছেলেটিকে। আজকের প্রজন্মের কাছে প্রেমের এই উপলব্ধি আত্মগত নয়, শরীরী। আর তাই, এই প্রজন্মের কোনো প্রেমিক ইচ্ছেকে লুকিয়ে রেখে তাকে পাখি হতে দেবে না। শরতের মেঘ হয়ে ইচ্ছের বর্ষণ তার কাছে সময়ের অপচয়। মেয়েটির ফুরফুরে চপলতা এই প্রজন্মের প্রেমিককে পদাবলির ঢেউ হয়ে তাড়িত করবে না। বরং, কামবোধ জাগ্রত করবে। মোবাইল নাম্বার চাওয়ার ভীরুতা তেপান্তরে পাঠিয়ে আজকের প্রজন্ম মেয়েটির সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করবে। এরপর কামবোধ ছড়িয়ে দেবে কথা ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে। তাই হয়তো নতুন প্রজন্মের কোনো কবির কবিতায় শ্বাশত কবিতার শৈল্পিক ঐকতান আমাদের কানে ধ্বনিত হয় না। তারা যেসব কবিতা লেখে তার বেশিরভাগই প্রলাপ বলেই আমাদের মনে হয়। আর আমরা বলি, এসব নতুন সময়ের কবিতা। বুঝতে বুঝপাতা, না-বুঝলে তেজপাতা। ঠিকই যে, নতুন এসব কবিতা তেজপাতার মতো তেজ ছড়ায়, কিন্তু তাতে বোধের গহনে শিল্পের কোনো ঘ্রাণ ছড়ায় না।
কবিতায় যেসব উপমা ও চিত্রকল্প তৈমুর খান ব্যবহার করেন সেসব উপমা ও চিত্রকল্প পাঠককে ঘোরের ভেতর টেনে নিয়ে যায়। এই ঘোর যাপিত-জীবন থেকে পাঠককে বের করে শিল্পের আশ্চর্য উপলব্ধির জগতে বিচরণ করায়। কয়েকটি উদাহরণ পড়লেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে—
ক. উন্মাদ বিকেলে একটি সান্ধ্য-ধারণা তোমাকে দিই।
খ. জীবনের সরু হাঁটা পথ স্বপ্নের মোড়ক খুলে দ্যাখে শুকনো কিংশুক।
গ. পাখির খুশিতে হাসছে নতুন দিন/বিষাদকে আজ কোথায় পাঠাবো, বকুল?
ঘ. সঙ্গমের খোলা রাস্তায় বাজনা বেজে ওঠে/বিবাহ উৎসবে নেচে ওঠে রাত।
ঙ. সব নারীরাই কাছে ডাকছে/আমি যেতে পারি না/আমার সব ইচ্ছা জল হয়ে যায়।
চ. গায়ে গা লাগিয়ে চলে যাচ্ছে দিন।
ওপরের বাক্যগুলো পড়ার পর বুঝতে বাকি থাকে না যে, কী শৈল্পিক মোহ কবিতার ভেতর দিয়ে তৈমুর খান ছড়িয়ে দিতে পারেন পাঠকের বোধের জগতে। কবিতা পড়ার পর পাঠক যদি তাড়িত না হন, পাঠক যদি কবিতার রঙে রাঙিয়ে না ওঠেন, তাহলে সেই কবিতা কাঠখোট্টা প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আজকাল এ ধরনের কবিতার সংখ্যাই বেশি চোখে পড়ে। তবে যেসব পাঠক সত্যিকারের কবিতার আস্বাদ পেতে চান, সেসব পাঠক খুঁজে খুঁজে তৈমুরের কবিতা পড়েন, এটা আমি নিশ্চিত হয়েই লিখছি। যদিও কবিতার পাঠক নেই বললেই চলে। যারাও বা আছেন তারা গণমাধ্যম দ্বারা প্রভাবিত। এর বাইরে কয়েকজন পাঠক নিশ্চয়ই আছেন, যারা যাপিত-জীবনের একটুকরো অবসরে হাতে তুলে নেন প্রিয় কবির কবিতার কোনো বই। এরকম কিছু পাঠক তৈমুরের আছে। কারণ, তৈমুরের কবিতা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। চিত্রকল্প অনন্য। পাঠকের প্রতিদিনের জীবনের সাথে সেসব দৃশ্য আন্তরিক হয়ে মিলেমিশে আছে। যেন মনে হয়, আমার কথাগুলোই, আমার অনুভূতির রঙই তৈমুরের কবিতার ভেতর দিয়ে ফেরত পাচ্ছি।
তৈমুরের প্রায় সকল কবিতাই এক-একটি আলোর ঝলকানি। যে আলো শিল্পের, যে আলো জীবন-উপলব্ধির। জীবনকে নানাভাবে নানা রঙে দেখতে পাওয়া যায় তৈমুরের কবিতায়। তার কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সহজেই পাঠক ঢুকে যেতে পারেন কবিতার রূপ-বৈচিত্র্যে। যেন ছিপছিপে একটি নদীর ওপর বাঁশের সাঁকো তৈমুরের কবিতা। সেই সাঁকোর ওপর দিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যেতে যেতে চারপাশের প্রকৃতির অসংখ্য উপাদান চোখে পড়ছে। আর, সেসব দৃশ্য মুহূর্তেই আন্তরিক মমতায় আমাদেরকে আলিঙ্গন করছে। সবার কবিতা কিন্তু পাঠককে আলিঙ্গন করে না। আলিঙ্গন করার ক্ষমতাও রাখে না। কারণ, সবার কবিতার সুরে শিল্পের ঐকতান ধ্বনিত হয় না। নব্বইয়ের দশকের কবি হয়েও তৈমুর খান বাংলা কবিতার ঐতিহ্যগত আবহ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ফুটিয়ে তুলছেন তার প্রতিটি কবিতার শরীরে। সেই অর্থে আমরা বলতেই পারি, সময়ের বলয় ভেঙে তৈমুর খানের কবিতা আবহমান বাংলার কবিতা। মানবীয় বোধ ও সৌন্দর্য-চেতনার পাপড়ি মেলে ফুটে ওঠা এক-একটি নিটোল সূর্যমুখি। আমরা জানি, সূর্যমুখি সবসময় সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। একইভাবে, তৈমুর খানের কবিতাও সূর্যসম শিল্পের মহৎ উপলব্ধির দিকে চেয়ে থাকে। এ কারণেই আমরা দেখি যে, তৈমুরের লেখা প্রতিটি কবিতাই পার্থিব ভাষায় লেখা হলেও অপার্থিব দীপ্তিতে রাঙানো। রঙ-বেরঙের আমাদের এই জীবনকে নানাভাবে নানা রূপে চোখে পড়ে তৈমুরের কবিতায়। ফলে, তৈমুর খানের কবিতা আমাদের পড়তেই হয়।
“শাশ্বত কবিতার শৈল্পিক ঐকতান তৈমুর খানের কবিতা ” গদ্যটি পড়লাম। তৈমুর খানের কয়েকটি কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এবং সেগুলোকে শিল্পের আলোয় বিশ্লেষণ করে শৈল্পিক সৌন্দর্য তুলে ধরার হয়েছে। উদ্ধৃত কবিতাংশগুলো একটি বিমেষ ধরনের কবিতার। তৈমুর খানে কবিতার সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। তার কবিতার একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে অন্তরঙ্গ বেদনা যা অনালোচিত অসহায়ত্ব থেকে উৎসারিত। সেসব বেদনার কোনো কোনোটির নাম লেখা আছে বর্তমান সময়ের দেওয়ালে। তিনি জেনেও কবিতায় সে নামগুলো স্পষ্ট করে বলেন না,– কেবল ইঙ্গিত রেখে দেন। অন্তরঙ্গ অপ্রত্যক্ষতায় বেদনা-ক্ষোভ–অসহায়ত্ব–প্রতিবাদের কথা বলা তার কবিতার অন্যতম প্রধান গুণ। আলোচক আবু তাহের সরফরাজকে ধন্যবাদ জানাই তৈমুর খানের কবিতার ওপর নিবিড় আলোকপাত করার জন্য। কবি তৈমুর খানের জন্য শুভকামনা।