spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যসাযযাদ কাদির

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

সাযযাদ কাদির

কাজী জহিরুল ইসলাম

ঊননব্বুই সালের কথা। গার্মেন্টসের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে যোগ দিই আনসার ভিডিপির পত্রিকা ‘পাক্ষিক প্রতিরোধ’-এ। পরে এটি মাসিক হয়ে যায়। তখন এর সম্পাদক ছিলেন জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ। আমি এবং অনিমেষ বড়াল একসাথে যোগ দিই। এখানেই সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল চাকরি করতেন। কোনো এক কারণে শুনেছি তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আগে এর সম্পাদক ছিলেন আরেফীন বাদল। আরেফীন বাদল তখন তারকালোক পত্রিকা করেন। একদিন জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে তারকালোক অফিসে নিয়ে যান। আরেফীন বাদলের সাথে দেখা করবেন, তাঁর লেখা দরকার প্রতিরোধের জন্য। যতদূর মনে পড়ে অফিসটি ছিল নিউ মার্কেটে। সরকারী গাড়িতে চড়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতে একুশ বছরের এক যুবকের বেশ মজাই লাগছিল। আরেফীন বাদলকে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল সাযযাদ কাদিরকে। সাযযাদ কাদির তখন তারকালো পত্রিকায় চাকরি করতেন। সেদিনই প্রথম সাযযাদ ভাইকে দেখি এবং প্রথম দেখাতেই তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য তাঁর দখলে, এক ঘণ্টার আড্ডায় আমি তা বুঝে ফেলি। তিনি তাঁর একটি কবিতা পড়ে শোনান, কুয়াশা ভেজা গ্রামের আলপথ ধরে হেঁটে আসার কথা ছিল সেই কবিতায়। দৃশ্যটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এবং আজও আমি সেই দৃশ্যটি দেখতে পাই। নব্বুই সালের জুন মাসে আমি ‘প্রতিরোধ’ ছেড়ে দিয়ে ব্র্যাক-এ যোগ দিই, চলে যাই হবিগঞ্জে। সেখানেও মন টেকে না, আবার চলে আসি ঢাকায়, একানব্বুই সালে। একদিন প্রেসক্লাবে, কোনো এক অনুষ্ঠানে, সম্ভবত কবিদের সংগঠন অনুপ্রাসের অনুষ্ঠান ছিল, দেখা হয় সাযযাদ ভাইয়ের সাথে। তিনি আমাকে চিনলেন। এবং বেশ আদর মাখা কণ্ঠে বললেন, আমি দিনকাল -এ বসি, তুমি এসো, লেখা নিয়ে এসো কিন্তু। আমি পরদিনই যাই, সারারাত জেগে একটি ফিচার লিখি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কমলা দিঘির ওপর। সাযযাদ ভাই খুব খুশি হন। শুধু ছেপেই দেন না, আমাকে বলেন, তুমি প্রতি সপ্তাহে ফিচার লেখ। আমি সাযযাদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি বুঝতে পারেন, আমার আগ্রহ কবিতায়, ফিচার লিখেছি তাঁকে খুশি করার জন্য। কবিতাও ছাপব, ফিচারও ছাপব। তিনি দুটোই ছাপতে থাকেন। দিনকাল -এর ফিচার বিভাগে প্রতি সপ্তাহেই আমার লেখা ছাপা হতে লাগলো। কোনোদিন ফিচার, কোনোদিন কবিতা।

সানাউল্লাহ নূরী তখন এর সম্পাদক। কবি লিলি হক নূরী ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসতেন। সাযযাদ ভাই, নূরী ভাইকে গিয়ে বলেন, নূরী ভাই, আপনার লাইলি এসেছে। নূরী ভাই ক্ষেপে যান। আমি মুখ টিপে হাসছি দেখে সাযযাদ ভাই এক স্লিপ নিউজপ্রিন্ট বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ইংরেজীতে লেখ লিলি। আমি লিখলাম, এলআইএলওয়াই। এবার সাযযাদ ভাই বলেন, এর নিচে ইংরেজিতে লেখ লাইলি। আমি লিখি এলআইএলওয়াই। দুইবার তো একই জিনিস লেখলা। এখন বল, আমি কি ভুল বলেছি? আমি হা করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। নূরী ভাইয়ের কোনো বানান নিয়ে সন্দেহ হলেই সাযযাদ ভাইকে ডাকতেন। সাযযাদ ভাই বানান ঠিক করে দিতেন। শুধু নূরী ভাই না, পাশের ঘরে বসতেন নিউজের মানুষেরা, আহমেদ মূসা তখন নিউজ এডিটর, আনওয়ারুল কবীর বুলু, মুশারফ করিম এরা নিউজে কাজ করতেন। মুশারফ করিম ছোটদের জন্য গল্প/উপন্যাস লিখতেন। মাঝে মাঝে দিনকালে তাঁর লেখা গল্প ছাপা হত। তিনি এক প র্যায়ে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। সম্ভবত সেই উপন্যাসের নাম ছিল কোকাকাকা, মানে খোকা কাকা। ময়মনসিংহের লোকেরা খোকাকে কোকা বলে, লেখাটি ঐ অঞ্চলের পটভূমিতে রচিত এবং তিনি নিজেও ঐ অঞ্চলের মানুষ। তাই এর নাম দিয়েছিলেন কোকাকাকা। মুশারফ করিমকে প্রায়শই সাযযাদ ভাইয়ের কাছে আস্তে দেখেছি বানান বিভ্রাট মেটানোর জন্য। নিউজরুমের অন্য কারোরও বানান সমস্যা হলে সাযযাদ ভাইয়ের কাছে আসতেন। সাযযাদ ভাইকে কোনোদিন দেখিনি বানানের জন্য অভিধান দেখছেন।
প্রতি শনিবারে আমি দিনকালে, সাযযাদ ভাইয়ের কাছে, গিয়ে হাজির হতাম। এক পর্যায়ে আমি আর বাসা থেকে লিখে আনি না। ওখানে বসে বসেই লিখতে শুরু করি। গদ্য রচনাগুলো আমি লিখে তাঁকে দিতাম। তিনি সেটা গুটুর গুটুর করে এডিট করতেন। এডিট করার পরে মনে হতো, এতোগুলো ভুল ছিল! অথচ লেখার পরে মনে হয়েছিল একদম নির্ভুল একটি রচনা তৈরী করেছি। সাযযাদ ভাই মাঝে মাঝে, আমাকে পরীক্ষা করার জন্যই হয়ত, বলতেন এই সেন্টেন্সটা এভাবে করে দিব, না তোমারটাই রাখব? স্বভাবতই আমার নিজের বাক্যের প্রতি প্রীতি থাকত কিন্তু তা কখনোই প্রকাশ করতাম না। কিন্তু কোনোদিন মনে হয়নি সাযযাদ ভাই এডিট করাতে আমার লেখার অঙ্গহানি হয়েছে। বরং সব সময়ই মনে হত, লেখাটি অনেক সমৃদ্ধ এবং শুদ্ধ হয়েছে।

একদিন কবি রাজু আলীম এসে সাযযাদ ভাইকে বলেন, কাজী জহিরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের কে, আপনি তাঁর লেখা প্রতি সপ্তাহে ছাপেন। সাযযাদ ভাই বলেন,
তুমি কে? কি নাম তোমার?
রাজু বলে, আমার নাম রাজু আলীম।
কি করো?
সাযযাদ ভাই, আপনি আমাকে চেনেন না, আমি কবিতা লিখি।
রাজু কোনো কবির নাম না, এটা আমার পিয়নের নাম। তুমি বেরিয়ে যাও।
রাজু অপমানিত বোধ করে, কিন্তু বসেই থাকে। সাযযাদ ভাই তখন দারোয়ানকে ডাকেন। দারোয়ান এসে রাজু আলীমকে বের করে দেয়। এরপরে নিচে, সিঁড়িতে ওঠার মুখ, কলাপসিবল গেইট লাগানো হয়। পরের শনিবারে আমি গেলে সাযযাদ ভাই আমাকে এই ঘটনা বলেন। অথচ রাজু আলীম আমার বন্ধু। পরে আমি বইমেলার মাঠে রাজু আলীমকে ধরি, রাজু ক্ষমা চায়। আমরা আবার বন্ধু হয়ে যাই।

এরপর আমি বিদেশে চলে এলে সাযযাদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। পরে আবার যখন তিনি মানব জমিনে যোগ দেন আর আমি ছুটিতে ঢাকায় যাই, একদিন দেখা হয়। আমাকে লেখা দিতে বলেন। আমি বিদেশ থেকে লেখা পাঠাই, তিনি সেই লেখা ছাপেন। এখানে একটি কথা বলি, সাযযাদ ভাই পণ্ডিত মানুষ ছিলেন কিন্তু খুব যে নির্মোহ ছিলেন তা কিন্তু না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিজি হওয়ার জন্য তিনি বেশ তদ্বির করেছিলেন। আমাকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন বলে তদ্বিরগুলো করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়েই যেতেন। পরে (১৯৯৫ সালে) অবশ্য তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। সাযযাদ ভাই কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় সংবাদপত্রের সাথেই জড়িত ছিলেন, বিচিত্রা, সংবাদ, আগামী, তারকালোক, দিনকাল এবং মানব জমিনে কাজ করেন। কিছুকাল তিনি রেডিও পিকিংয়েও (তখন বেইজিং নাম হয়নি) কাজ করেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এতো অগাধ জ্ঞান আমি খুব কম মানুষেরই দেখেছি। সাযযাদ ভাইকে আমি সারাজীবন আমার গুরু মনে করেছি, আমৃত্যু করব।
যা-ই করেন না কেন, তাঁর আমৃত্যু তৃষ্ণা ছিল ভালো কবিতা লেখা। কবিতার অন্বেষণেই ছুটেছেন সারা জীবন। সাযযাদ কাদিরের একটি কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

একবার এমনি এক বসন্তের দিনে
লুশান-এর চূড়ায় উঠে উধাও নীলিমার দিকে তাকিয়ে –
আরেকবার
হুয়াংশান-এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে
মনে হয়েছিল
ঝাঁপ দিই মেঘের সমুদ্রে –
উড়ে যাই নিঃসীম অনন্তের বুকে!

একবার ঠিক বুঝেছিলাম একটু পরেই বন্ধ হবে বুকের ধুকপুক
তাই চোখ বুঁজে ছিলাম আগে থেকেই
একবার মনকে বোঝানোর আশায়
বিছানায় এ পাশ ও পাশ করেছি সারা রাত
একবার জেনেশুনে পান করেছি যন্ত্রণাবিষ
কাতর হয়েছি সয়ে-সয়ে শতেক জ্বালা
একবার মুখ ফিরিয়ে তার চলে যাওয়ার পরও
অপেক্ষায় থেকে নিয়েছি পরম প্রেমের স্বাদ
আবার একদিন কোনও কারণ ছাড়াই
একাই হেসেছি, একাই গুনগুন করেছি গান
একবার শুধু তাকেই বেসেছি ভাল যে বাসে না
বাসবেও না কোনও দিন।

(বসন্তে একদিন)

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২৯ জানুয়ারী ২০১৮।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ