রফি হক
১.
ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন। তিনি খ্যাতি শিখরে বন্দী করে ফেলেছেন নিজেকে। তাঁর খ্যাতি দেশে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত। portrait Photography -তে তিনি নিজস্ব একটি শৈলী তৈরি করেছেন গত পাঁচ দশকে। পোর্ট্রেটকে তিনি নিয়ে গেছেন আর্টের পর্যায়ে। কনটেম্পোরারি মডার্ণ আর্ট ওয়ার্ল্ডে ফটোগ্রাফি আর্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে পরেই ‘দাদাবাদ’ নামে যে শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলন শুরু হয় তাতে করে আর্টের সকল ব্যাকরণ উড়ে-ফুঁড়ে গিয়েছিল। দাদাবাদীরা আর্টের নতুন নতুন মাধ্যম, উপকরণে বিবিধ কিছু নিয়ে এলো। তাতে যোগ দিলেন জাঁ কক্তো, হানস আর্প, মার্শাল দ্যুশাম্পের মতো ফিলোসফার, থিংকার, ক্রিয়েটিভ রাইটার, ফটোগ্রাফারেরা।
২.
ম্যান রে নামের একজন স্যুরিয়েলিস্ট, দাদাইস্ট, ফটোগ্রাফার–তিনি আমেরিকান কিন্তু তিনি জীবনভর কাজ করেছেন প্যারিসে। ম্যান রে -এর মাধ্যম ছিল ফটোগ্রাফি। আজ থেকে দেড় শ বছর আগেই তিনি ফটোগ্রফিকে আর্ট ফর্মে নিয়ে গিয়ে দারুণ দারুণ সব কাজ করেছেন। পরবর্তীতে ইউরোপ আমেরিকার বহু শিল্পী ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেছেন। আর্ট ওয়ার্ক করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন–ডেভিড হক্নি, সাই টম্বলি, ক্রিস্টো প্রমুখ।
৩.
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ফটোগ্রাফি হলো আর্ট এক্সপ্রেশনের এক বিশাল মাধ্যম। আজ থেকে সোয়া চার শ বছর আগে ডাচ পেইন্টার রেমব্রান্ট আলো-ছায়ার প্রেক্ষাপণে যে-সকল শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন তা ছিল অভাবনীয় । সেখানে মূল খেলাটাই ছিল আলো ছা্য়ার। মনে রাখতে হবে, রেমব্রান্টের সময়ের সাড়ে তিন শ বছর পর ক্যামেরা আবিষ্কার হয়। ক্যামেরাও কিন্তু মূলত আলো ছায়ার রহস্য তৈরি করে। নাসির আলী মামুন গত পাঁচ দশক ধরে ঠিক এই কাজটিই করে যাচ্ছেন। মানুষের প্রতিকৃতি ও আলো-ছায়ার রহস্যকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি সময় ও সময়ের মানুষকে ক্যামেরা ফ্রেমে নিয়ে আসছেন তাঁর নিজস্ব শৈলীতে। ইম্প্রেশনিস্ট, পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের মতো সময় ও সময়ের লোকদের ধরবেন বলে।
৪.
নাসির আলী মামুনকে নিয়ে এত কথা লিখছি রাত জেগে, কারণ মানুষটার জন্মদিন আজ।
শুভ জন্মদিন প্রিয় নাসির আলী মামুন ভাই । আমি বোধহয় নাসির আলী মামুন ভাইকে চিনি কুষ্টিয়া থেকেই। পত্রিকায় তাঁর ছবি দেখতাম। পরিচয় হয় বিরাশি বা তিরাশি সালে চাঁদের হাটের সাহিত্য সভায় অথবা অন্যত্র। ওই পর্যন্তই। তারপরও দেখা হয়েছে নানা জায়গায়, নানা দ্রষ্টব্যে। কেমন আছেন, ভালো আছেন ধরণের দেখা। তাহলে হবে কী? তাঁকে আমি ভালোবেসেছি সবসময়। মামুন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে খুবই কম।
৫.
আমার একটা অভ্যেস আছে আমি দূর থেকে প্রিয়জনদের দেখতেই ভালোবাসিৱ। বেশি কাছে যাই না। খুব প্রিয় যারা হয়েছে আমার জীবনে তাদের বেলাতেও তাই। বিখ্যাত হলে তো আরও দূরে থাকি। কারণ দূর থেকে একজন মানুষকে বহুভাবে দেখা যায় । বহু ডাইমেনশনে। বহু পার্সপেক্টিভে।
.
বেশিরভাগ সময় কাছের মানুষদের নিয়ে, তাদের কাজ নিয়ে লিখতে পারি না। লিখতে গেলে মনে হয় কী লিখব ? লেখা যায় না।
৬.
বহু বৎসর আগে, আমি তখন আর্ট কলেজের জুনিয়ার ছাত্র। একদিন তরুণ-কিশোরদের একটি দল নিয়ে মামুন ভাই এলেন আর্ট কলেজে। সব্বায়ের হাতে ক্যামেরা। আমি প্রিন্টমেকিংয়ের জানালা দিয়ে দেখলাম, দলটি কলেজের পেছনের বড়ো শুকনো পুকরটি পার হয়ে মিলিয়ে গেল কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের দিকে। কৌতুহল হলো খুব। কৌতুহলে, কিছু পরে আমিও গেলাম পেছনে। দেখি, কমার্শিয়াল বিল্ডিংয়ের সামনে বিখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হা হয়ে শূন্য খা খা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁকে ঘিরে বৃত্ত রচিত হয়েছেৱ। সেই তরুণ কিশোরের দলটি ঘুরে ঘুরে ক্যামেরা তাক করে লো এ্যাঙ্গেল থেকে কাইয়ুম স্যারের পোট্রেট তুলছে, সাটার পড়ছে । কাইয়ুম স্যারও অবোধ শিশুর মতো
ঐ খা খা আকাশের দিকেই চেয়ে আছেন।
৭.
এতো অমায়িক, ভালো, বিনয়ী, নরম হাসির বিখ্যাত আলোকচিত্রী মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আবার কয়েকদিন আগে দেখা হয়ে গেল কাটাবনের পাঠক সমাবেশে, শিল্পী মনিরুল ইসলামের একটি আর্টিস্ট টকে। দেখা হতেই আমরা পরস্পরকে দেখে খুবই খুশি। অনেক ছবি তুললাম, ছেলেমানুষের মতো।…কত কথা জমে ছিল। সব ভুলেও গেলাম। ভুলে গিয়ে অনেক কথা বললাম। মনে হলো কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি।….এক কথায় আমি তাঁর ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী । তাঁর জন্মদিন সুন্দর কাটুক । আনন্দে কাটুক । যদিও এই সময়টি আনন্দের নয় । কিন্তু জীবন তো নদীর মতো । বয়ে চলে । মামুনভাইও কাজের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছেন আমাদের সঙ্গে ।
#
.
+রফি হক । শিল্পী । প্রিন্টমেকার
সম্পাদক, শিল্পপ্রভা
সোমবার : ১ জুলাই ২০২৪ ,
১৭ আষাঢ় ১৪৩১