spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধআহমদ ছফা : তার অনন্যতা

লিখেছেন : মোরশেদ শফিউল হাসান

আহমদ ছফা : তার অনন্যতা

মোরশেদ শফিউল হাসান

—————————–

আহমদ ছফার ব্যক্তিচরিত্রে এক ধরনের খ্যাপাটেপনা ছিল। অনেকক্ষেত্রে আমরা যাকে প্রতিভার স্বভাবধর্ম বা চারিত্রলক্ষণ হিসেবে গণ্য করে থাকি। বিশ্বজুড়েই অনেক সৃষ্টিশীল প্রতিভা এমনকি মহামানবের মধ্যে যা দেখা যায়। তাঁর লেখায় ও বচনে এক ধরনের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সেটাও তাঁর সাহসের নামান্তর। কিন্তু এগুলো ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের একপিঠ মাত্র। অন্যপিঠে তিনি ছিলেন খুবই সংবেদনশীল, দরদী ও বিনয়ী চরিত্রের একজন মানুষ। অন্যের গুণ বা যোগ্যতার স্বীকৃতি দেওয়ার এবং তাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর সমকক্ষ ব্যক্তি তাঁর সমসময়ে আমাদের দেশে আরেকজনও ছিলেন বলে মনে হয় না। শত্রুমিত্র নির্বিশেষে যারাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, কিংবা তাঁকে মোটামুটি চিনতেন, তাঁরাই এই সত্যের স্বীকৃতি দেবেন। মতামত, আদর্শগত বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা কোনো বিশেষ সময়ের ভূমিকার কারণে বয়োজ্যেষ্ঠ বা মুরুব্বি স্থানীয় যাঁদের হয়তো কঠোর সমালোচনা করতেন, সাধারণভাবে এড়িয়ে চলতে চাইতেন, সামনা সামনি হলে তাঁদের সঙ্গেও অত্যন্ত তাজিমের সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন। কখনো কখনো ছোট শিশুর মতো অভিমানে মুখ ফিরিয়ে থাকতেও তাঁকে দেখেছি। কিন্তু উল্টোদিক থেকে সামান্য সম্ভাষণই তাঁর সে অভিমানকে মুহূর্তে গলিয়ে পানি করে দিত। এমন ঘটতে আমি এবং নিশ্চয় বিভিন্ন সময় যারা তাঁর কাছাকাছি এসেছেন, তাঁরা কমবেশি দেখেছেন। 

     আমার পরিবারে গুরুজনকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম বা কদমবুসি করার রীতিটির প্রচলন ছিল না। এ যাবত আমি কাউকে করিওনি। ফলে প্রথম যেদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ছফা ভাইকে দেখলাম ছুটে গিয়ে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে, খুব অবাক হয়েছিলাম। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ চরিত্রের সঙ্গে ব্যাপারটিকে আমার একেবারেই মানানসই মনে হয়নি। এমনও ভেবেছিলাম, সবার সামনে মজা করলেন না তো! কিন্তু তাঁর সঙ্গে কবীর স্যারের স্নেহসিক্ত কথাবার্তা এবং উল্টোদিকে ছফা ভাইয়েরও বিগলিত মুখচ্ছবি, পাশে দাঁড়িয়ে দেখার পর, আমার সে ভুল ভেঙেছিল। এর আগেপরে অনেকবারই নানা প্রসঙ্গে ছফা ভাইয়ের মুখে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মহৎ অন্তকরণের প্রশংসা, তাঁর প্রতি নিজের অপরিসীম কৃতজ্ঞতার কথা শুনেছি। তাঁর খুব দুর্দিনে কবীর স্যার নাকি নিজে উদ্যোগী হয়ে বাংলা একাডেমির  একটা গবেষণা বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন (কবীর চৌধুরী তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক, সেটাই ছিল তখন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদ ) । যদিও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অংশ হিসেবে কবীর চৌধুরীর মতো মানুষদের সমালোচনায় আহমদ ছফা ছিলেন ক্লান্তিহীন। ড. আনিসুজ্জামানের সরাসরি ছাত্র তিনি ছিলেন না। কিন্তু একাধিকবার আনিস স্যারের সাক্ষাতে একইরকম বিনীতভাবে কথাবার্তা বলতে, তাঁর ‘দোয়া’ চাইতে আমি ছফা ভাইকে দেখেছি। আনিস স্যরের বিদ্যাবত্তা, গবেষণাকর্ম এবং পরিশীলিত রুচির প্রশংসায়ও তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ। এ প্রসঙ্গে আনিস স্যার সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাকের মন্তব্যের উল্লেখ করতেন।  অধ্যাপক আহমদ শরীফের তো তিনি একসময় ভক্ত বা অনুরাগীই ছিলেন।  যেমন ছিলেন বদরুদ্দীন উমরেরও। লেখক শিবির নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে সে সম্পর্কে সাময়িক চির ধরে।  মনে আছে টিএসসি সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত পুনর্গঠিত লেখক শিবিরের (যতদূর মনে পড়ে শাহরিয়ার কবীর তখন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক) একটি অনুষ্ঠানে ছফা ভাই জাসদপন্থী দু-একজন সংস্কৃতিকর্মীকে (নাম মনে আছে, কিন্তু বলতে চাইছি না) নিয়ে বা হয়তো তাঁদেরই উস্কানিতে গোলযোগ বাধাতে গিয়েছিলেন। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন এলাকা থেকে আমি ও রেজওয়ান সিদ্দিকী সেদিন কৌতূহল নিয়ে কী হয় দেখতে গিয়েছিলাম (টিএসসিতে যাওয়ার আগে ছফা ভাই শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে এসে তাঁদের সে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সবাইকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন)। কিন্তু সভা শুরু হতে ছফা ভাই যখন উঠে দাঁড়িয়ে নতুন কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সভাপতির আসন থেকে শরীফ স্যার এক ধমকে (যদিও ‘আপনি’ সম্বোধন করে) তাঁকে বসিয়ে দেন। ছফা ভাইও বাধ্য ছাত্রের মতো বসে পড়েন। সঙ্গীরা এরপরও কিছুটা গোলমাল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু  ছফা ভাই-ই তাঁদেরকে টেনে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আমাদের ‘নাটক’ দেখার সাধ অপূর্ণ থেকে যায়।  কিন্তু লেখক শিবির নিয়ে বিরোধের জেরেও ছফা ভাইকে কখনো দেখিনি সমালোচনা করতে গিয়েও  আহমদ শরীফ বা বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্য করতে বা তাঁদেরকে খাটো করতে। বিপরীত দিকে তাঁরাও শুনেছি (আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই) ‘ছফা পাগলা’কে স্নেহ-প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখতেন। বিশেষ করে শরীফ স্যারের প্রতি তাঁর মনোভাবটা শেষ পর্যন্ত মান-অভিমানের ছিল বলে আমার মনে হয়েছে।    

    দুজন মাত্র ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁকে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য এমনকি  সম্বোধন করতে আমি বরাবর দেখেছি। অন্তত ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়ের পর থেকে শেষাবধি এই বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল আমি নই, সমসাময়িক অনেকেই এর সাক্ষী। তাঁদের একজন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং অন্যজন অধ্যাপক সাঈদুর রহমান।  কেবল লেখক শিবির নিয়ে দ্বন্দ্ব কিংবা নেপথ্যের অন্য কোনো কারণ এর পেছনে কাজ করেছিল, ছফা ভাই তাঁদের প্রতি যতটা বিদ্বিষ্ট ও ক্ষমাহীন ছিলেন, বিপরীত দিক থেকে তাঁরাও তাই ছিলেন কি না আমার জানা নেই। তবে ছফা ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর কমিউনিটি হাসপাতালে ছুটে গিয়ে আমি সি ই চৌ স্যার ও বদরুদ্দীন উমর দুজনকেই সেখানে উপস্থিত দেখতে পাই। এ সময় কোনো এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার স্যারের কাছে ছফা ভাই সম্পর্কে কোনো তথ্য (মন্তব্য নয়) জানতে চাইলে তিনি দূর থেকে আমাকে দেখিয়ে দেন ।  হয়তো ভেবেছিলেন, আমি তথ্যগুলো দিতে পারবো। তবে আমিও সব তথ্য দিতে পারিনি, মনে আছে। 

   ছফা ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে আমি একাধিকবার ড. মফিজ চৌধুরী, অধ্যাপক হোসনে আরা হক-আজিজুল হক, অধ্যাপক শাহেদ আলী, অধ্যাপক আবদুল গফুর, বশীর আল হেলাল, শামসুজ্জামান খান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, লুতফর রহমান সরকার, চিত্তরঞ্জন সাহা, মোস্তফা কামাল (প্রকাশক, বুক সোসাইটি) এঁদের কাছে গিয়েছি। একবার তিনি আমাকে অধ্যাপক রাজ্জাক স্যারের বাসায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন।  যাঁদের নামোল্লেখ করলাম প্রাতিষ্ঠানিক আনুগত্য, মতাদর্শিক অবস্থান এবং স্বভাব-চরিত্রে, বলাই বাহুল্য, তাঁদের মধ্যে অল্প থেকে বিস্তর পার্থক্য বা ব্যবধান ছিল। কিন্তু সবার সঙ্গেই তাঁর ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা-স্নেহ-প্রীতির সম্পর্ক। আমার চেনাজানার মধ্যেও এমন অনেকে আছেন, যারা আমার চেয়ে বেশি জায়গায় তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। তাঁরাও আশা করি আবার বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।

     সমসাময়িকদের মধ্যে ঈর্ষা-অসূয়া বা পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে এটা বেশি বৈ কম দেখা যায় না। আর দু-তরফ থেকেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়মে এটা ঘটে। অনেকক্ষেত্রে স্রেফ মান-অভিমানও এর পেছনে কাজ করে থাকে।  বিশ্বসাহিত্য বা শিল্পের ইতিহাস থেকে এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেওয়া যাবে।  বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ -ডি এল রায়, জীবনানন্দ-সুধীন দত্তের ব্যাপারটা যার বড় উদাহরণ । সঙ্গীতে মোজার্ট-সালিরির এই শৈল্পিক ঈর্ষা নিয়ে তো পুশকিন একটা কাব্যনাট্যই লিখেছেন। হুমায়ুন আহমদের সঙ্গে আহমদ ছফার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবনতির পেছনে হয়তো এমন কোনো কারণই কাজ করেছিল। যেহেতু দুজনই তাঁরা মানুষ ছিলেন, ঈশ্বর নন।  অন্য তরফের কথা জানি না, তবে হুমায়ুন আহমদের সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের অবনতি নিয়ে আহমদ ছফা মনে মনে কষ্ট পেতেন। প্রায়ই তাঁর, হুমায়ুন আহমদের  এবং আনিস সাবেতের পুরানো বন্ধুত্বের দিনগুলোর গল্প করতেন।

      হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর রেষারেষি বা তা অতটা তীব্র রূপ নেয়ার  পেছনে খুব সম্ভব তৃতীয় পক্ষের প্ররোচনা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। পত্রিকায় যখন এই চাপান-উতর চলছিল, তখন আমি ঢাকার বাইরে চাকরি করি। ফলে বাদানুবাদগুলো পড়ার সুযোগ আমার তখন যেমন, তেমনি পরেও, এখন পর্যন্ত, হয়নি (সেগুলো পরে কোথাও সংকলিত হয়েছে কিনা, তাও জানি না)। ঢাকায় ফিরে বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে এবং পরে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি। অন্যদের কথা বলতে পারবো না, তবে আমার বন্ধুদের অভিমত ছিল, হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এই প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া ছফা ভাইয়ের মোটেও ঠিক হয়নি। পত্রিকার কাটতি বাড়াতে কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক নাকি তাঁদের এই লড়াইয়ে নামিয়েছিলেন। সেলিব্রিটিদের রেসলিং গ্রাউনডে নামিয়ে এভাবে পাঠক আকর্ষণের ব্যাপারটা সবদেশেই কমবেশি হয়ে থাকে। ছফা ভাই প্রথমে স্বীকার করতে না চাইলেও, পরে মনে হয় বুঝেছিলেন বিষয়টা। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে শাহবাগের অফিসে ছফা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সেখানে হুমায়ুন আজাদকে আমি তাঁর সঙ্গে গল্প করতে দেখি। হুমায়ুন আজাদকে (চট্টগ্রাম কলেজে তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন) নিয়ে আমার সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা (মনি হায়দারের ‘উসকানি’তে) গাজি টিভির ‘শিল্পবাড়ি’ অনুষ্ঠানে আমি কয়েক বছর আগে বলেছি। 

     আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন আজাদ দুজনের ব্যক্তিত্বের ধাঁচ এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য একেবারেই ভিন্ন ছিল। তাঁদের দুজনের লেখার মধ্যেও যার পরিচয় পাওয়া যাবে। আহমদ ছফা ছিলেন খুবই সামাজিক — সম্প্রসারিত পারিবারের সদস্য, নিকট এমনকি দূর সম্পর্কের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের  প্রতি দায়িত্বশীল — একজন মানুষ। কারো বিপদ-আপদের কথা শুনলে সহজেই বিচলিত হতেন, আর্থিক ও অন্যান্যভাবে সহায়তার হাত বাড়াতেন। তখন সাধারণত শত্রুমিত্র বিবেচনায় রাখতেন না। কাউকে ডাক্তার দেখাতে হবে, হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কাউকে স্কুলে বা কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতে হবে, বকেয়া বেতন পরিশোধ বা পরীক্ষার ফিস জমা দিতে হবে, ধারকর্জ করে হলেও তিনি উদ্ধারে নেমে পড়তেন। সঙ্গে করে প্রভাবশালীদের কাছে নিয়ে যেতেন। প্রয়োজনে অর্থাৎ কার্যোদ্ধারে তদবির-তোষামোদও করতেন। এমনকি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সাহায্যেও তাঁকে তৎপর দেখেছি। সেখানে তিনি তথাকথিত বিপ্লবী বা বুদ্ধিজীবী  নয়, বরং একজন সংবেদনশীল সামাজিক মানুষ ছিলেন, সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে যিনি সচেতন। এভাবে আহমদ ছফার দ্বারা উপকৃত মানুষ ঢাকায় শুধু নয়, ঢাকার বাইরে সারা দেশে অজস্র আছেন। আর নতুন লেখক-শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা, তাঁদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় মানুষ তাঁর সমকালে বা আজ একজনও পাওয়া যাবে না। প্রথম প্রথম যখন দেখেছিলাম কোনো বাসায় বেড়াতে বা হাসপাতালে কাউকে দেখতে, তিনি টাকা ধার করে হলেও ফলফলারি কিনে নিয়ে যান (এমনকি আমাদের বাসাতে বেড়াতে এলেও), খালি হাতে কিছুতেই যাবেন না, তখন তাঁর এই অতি-সামাজিকতা সত্যি সত্যি পছন্দ করিনি। একজন বিদ্রোহী মানুষের সঙ্গে বিষয়টা মেলাতে পারিনি। পরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আজ যারা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার আইডল হিসেবে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এক সারিতে আহমদ ছফার নাম উচ্চারণ করেন, তাঁরা কজন এই আহমদ ছফাকে চেনেন? (না, এই বক্তব্যের দ্বারা আমি কোনোভাবেই হুমায়ুন আজাদকে খাটো করছি না, তিনি আমার শিক্ষক, তবে আগেই বলেছি, তাঁদের ব্যক্তিত্বের ধাঁচ এবং মানসিক বৈশিষ্ট্য ছিল স্পষ্টতই আলাদা)। 

     আমাদের তরুণ বয়সে ঔদ্ধত্যকে আমরা অনেকেই সদ্গুণ বলে বিবেচনা করতাম। এক নেতার মুখে (যিনি আবার ছফা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন) ‘বিপ্লবী ঔদ্ধত্যে’র প্রয়োজনীয়তার কথাটা উচ্চারিত হবার পর তাঁর দলীয় অনুসারীদের যেন এর অনুশীলনে নেমে পড়তেও দেখেছিলাম। ফলে ছফা ভাই যখন কারো সম্পর্কে ‘বেয়াদব’ বা  ‘ও তো একটা জাত বেয়াদব’ কথাটা বলতেন, স্বাভাবিকভাবেই নিতে পারতাম না। কথাটাকে ‘বিপ্লব-বিরোধী’ বলে মনে হতো। কিন্তু পরে বুঝেছি তিনি কারো সম্পর্কেই কথাটার ভুল প্রয়োগ করেননি। 

      দুটো ঘটনার উল্লেখ করে এ লেখাটা শেষ করতে চাই ।

       কবি শামসুর রাহমান তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। ওই পত্রিকায় তখন প্রেসিডেন্ট এরশাদের কবিতা ছাপা হচ্ছে।  এ নিয়ে বিশেষ করে তরুণরা বিক্ষুব্ধ। একদিন এমন কয়েকজন তরুণ সাহিত্যকর্মী ছফা ভাইয়ের শাহবাগের অফিসে বসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিল। আমি ছিলাম নীরব শ্রোতা। ক্ষোভ প্রকাশের এক পর্যায়ে তরুণদের মধ্যে একজন শামসুর রাহমানের কবিকৃতি সম্পর্কে একটা প্রগলভ মন্তব্য করে বসে। শোনা মাত্র ছফা ভাই খেপে গেলেন। ‘বেরোও, বেরোও, এক্ষুণি এখান থেকে বেরোও। শামসুর রাহমানের কটা কবিতা পড়েছ? পড়ে তারপর এসো।’ সত্যি সত্যি তিনি তাকে সেদিন তাকে বাধ্য করেন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। এভাবে কতজনকে যে তাঁর ঘর থেকে বের করে দিতে দেখেছি! তিনি নিজে হয়তো তখন শামসুর রাহমানের সমালোচক, কিন্তু একজন তরুণ পড়াশুনা না করে কবির কবি-প্রতিভার প্রতি তাচ্ছিল্য দেখাবে, এই বেয়াদবি তিনি সহ্য করতে নারাজ। 

     এবার দ্বিতীয় ঘটনা। আমি তখন বক্সিবাজারে থাকি। সেখান থেকে রোজ সকালে বুয়েটের ভেতর দিয়ে ছফা ভাইয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ১০৭ নং কক্ষে আসি। তারপর তাঁর সেই মাটির স্টোভে নিজ হাতে বানানো কালো চা খেয়ে গণকন্ঠ অফিসে রওনা হই (ছফা ভাইকে চিনতেন এমন কে আছেন যিনি সেই চায়ের স্বাদ পাননি?)। আমি তখন গণকন্ঠে চাকরি করি আর তিনি, চাকরি না করলেও, পত্রিকায় কলাম লেখেন। তাছাড়া  এমনিতেও প্রায়দিন  তিনি পত্রিকা অফিসে যেতেন। পত্রিকাটির অফিস ছিল ওয়ারিতে। তাঁর সঙ্গে যাওয়ার সুবিধা হলো রিক্সায় যাওয়া যায়। না হলে আমাকে পুরো পথ হেঁটেই অফিসে যেতে হত।  যাওয়ার পথে তিনি মাঝে মাঝে বাংলা একাডেমিতে কিংবা গুলিস্তানের গ্রন্থ কেন্দ্রের অফিসে নামতেন। কারো কারো সঙ্গে দেখা করতেন।  সেদিনও তেমনি তিনি গ্রন্থ কেন্দ্রে নেমেছেন । তিনি গিয়ে ঢুকলেন কায়সুল হকের কক্ষে (তাঁর সঙ্গে ছফা ভাইয়ের বেশ খাতির ছিল)। আমি সেই সুযোগে বন্ধু মঞ্জু সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কিছুক্ষণ পরের ঘটনা, ছফা ভাই, মঞ্জু সরকার, আমি (কবি মাহবুব বারীও ছিলেন কিনা মনে নেই) আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি, এ সময় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম সম্ভবত পরিচালক ফজলে রাব্বী সাহেবের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি দ্রুত ওয়াশরুমে যেতে যেতে ছফা ভাইকে দেখে কিংবা তাঁর সালামের জবাবে জানতে চাইলেন, “কী করছো এখন?” আমি তাঁর এ প্রশ্নের মধ্যে দোষের কিছু দেখিনি। ছফা ভাই উত্তর দিলেন, “লিখি।” মুস্তাফা নূরুল ইসলাম ফিরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, “লেখো তো বুঝলাম। কিন্তু চলে কীভাবে?” ছফা ভাই জানালেন তিনি লিখেই খান।  ছফা ভাইয়ের জবাব শুনে অধ্যাপক ইসলাম হয়তো অবাক হয়েছিলেন। একটু অবিশ্বাসের মনোভাবও প্রকাশ করেছিলেন কি? মনে নেই। যাক, তিনি তো এরপর ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। ছফা ভাই এদিকে মহাখাপ্পা, ‘কী মনে করে সে? বই লিখে আমি কত টাকা পাই জানে?’ তিনি তো রাগে গজগজ করছেন। বেরুলেই তাঁকে ধরা হবে। ইতিমধ্যে  অফিসের আরও কেউ কেউ সেখানে জুটে গেছে। উপস্থিত সবাই যেন পরের সে সম্ভাব্য মজাটা উপভোগ করতে চান। ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ চেতনা থেকে কেউ কেউ এমনকি ছফা ভাইকে উস্কানিও দিচ্ছিলেন। আমি পড়ে গেলাম মহাচিন্তায়। সত্যি সত্যি না তিনি  একটা ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেন (আমাকে তো তিনি বরাবর ভীরু- ভদ্র ছেলে বলে মনে করতেন, সুতরাং আমার নিষেধ হয়তো তিনি শুনবেন না)। যাই হোক, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি এক সময় বেরিয়ে এলেন, তারপর আমাদের সামনে দিয়ে ফিরে যেতে যেতে ছফা ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”  শুনে ছফা ভাই কী করলেন? যাকে বলে ব্রীড়াবনত মুখে শুধু বললেন, “ঠিক আছে।” এত বছর পরও তাঁর সেদিনের সে লাজুক মুখচ্ছবিটি এখনও আমার চোখে ভাসে। 

তো এই ছিলেন আহমদ ছফা, আমাদের অনেকের ‘ছফা ভাই’।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা