সংস্কৃতি (বা কৃষ্টি) হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অন্তর্গত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষের দ্বারা অর্জিত অন্য যেকোনো সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস।ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা হেলেন স্পেনসার-ওটেইয়ের মতে, সংস্কৃতি হলো কিছু বুনিয়াদি অনুমান, মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির, বিশ্বাস, নীতিমালা, প্রক্রিয়া এবং আচরণিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি–যা এক দল মানুষ ভাগ করে নেয় এবং সেই সমষ্টি দলের প্রত্যেক সদস্যের আচরণকে এবং তার নিকট অন্য সদস্যের আচরণের ‘অর্থ’ বা সংজ্ঞায়নকে প্রভাবিত করে (কিন্তু নির্ধারিত করে না)।
সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়।সংস্কৃতি শব্দটা এসেছে মারাঠি ভাষা থেকে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলায় কালচার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটা প্রস্তাব করলে রবীন্দ্রনাথ এর অনুমোদন দেন। এর আগে বাংলায় কৃষ্টি শব্দটি চালু ছিলো কালচার অর্থে। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্টি শব্দটা মনে করতেন, কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত, সুতরাং কালচার অর্থে সংস্কৃতিই উপযুক্ত।
নন্দনতত্ত্ব ও সংস্কৃতিকে একটি অভিন্ন রেখায় রেখে আলোচনা করলে নন্দনতত্ত্বের আলোচনাকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করাই শ্রেয়। সংস্কৃতি এতো বিস্তৃত যে, নন্দনতত্ত্বের আলোচনা করলে তাতে সংস্কৃতির আলোচনাই উঠে আসব।আমরা “নন্দনতত্ত্ব ও সংস্কৃতি” বিষয়ক এই আলোচনায় সংস্কৃতির বাতাবরণের মধ্যে নন্দনতত্ত্বকে পর্যালোচনা করবো।
নন্দনতত্ত্ব দর্শনের একটি শাখা যেখানে সৌন্দর্য, শিল্প, স্বাদ এবং সৌন্দর্য সৃষ্টি ও উপভোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে বললে নন্দনতত্ত্ব মানুষের সংস্কৃতির সংবেদনশীলতা ও আবেগের মূল্য এবং অনুভূতি ও স্বাদের বিচার নিয়ে আলোচনা করে। নন্দন শব্দের অর্থ হতে পারে–যা থেকে আনন্দ পাওয়া যায় বা যার দ্বারা আনন্দ দেওয়া যায়। আমরা জানি, সংস্কৃতি নির্ভর পৃথিবীর সব কিছুই সুন্দর বা নান্দনিক নয়, সবকিছুর অনুভূতিও নান্দনিক হয় না বা শিল্পিতও হয় না। সুন্দর অনুভূতি বা প্রকাশভঙ্গির নামই ‘নন্দনতত্ত্ব’।
আসলে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নান্দনিকতার মূল সুর হচ্ছে ‘সৌন্দর্য’। নান্দনিকতা দর্শন-নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং একটি বিমূর্ত সত্তা। রুচি, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, বিচার, মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সঙ্গে নান্দনিকতার রূপ নির্ভর করে। কবিতায় নান্দনিকতার সমষ্টিবোধ ক্রমশ ব্যক্তিবোধে রূপান্তরিত হয়। নান্দনিকতা প্রচলিত সমাজকাঠামো ভিত্তিক সংস্কৃতিতে খুব পুরাতন এক ধারণা, তবে পাঠক ও লেখক সমাজে (সাহিত্য-শিল্পের ক্ষেত্রে) এর পঠন ও আলোচনা যথেষ্ট মূল্য দিয়ে করা হয় না।। নান্দনিক সর্বজনীন বা নান্দনিকতার সার্বজনীন রূপ আছে কিনা তা নিয়েও একটি সমস্যা রয়েছে। একেক দেশের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে নান্দনিকতার সার্বজনীন রূপ একেক রকম। ধর্মীয় সংস্কৃতি, সামাজিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন নান্দনিক রূপ পাওয়া যায়।যেমন, সাদা রঙের পোশাক সামষ্টিকভাবে মুসলমানগণ ব্যবহার করেন বিধবা হলে আর খ্রিষ্টানগণ বিয়ের দিনে!
সংস্কৃতির ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও নন্দনতত্ত্বের কিছু সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অনেকেই নান্দনিকতার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য আঁকতে চেষ্টা করেছেন। ডেনিস ডাটন (Denis Dutton) সাতটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন; যা এখানে উল্লেখ করা হলো : দক্ষতা (Expertise), গুণিতা (virtuosity), অ-উপযোগী আনন্দ (Non-utilitarian pleasure), শৈলী (Style), সমালোচনা (Criticism), বিশেষ ফোকাস (Special focus), কল্পনা (Imagination)। নান্দনিক আন্দোলনের চারিত্র লক্ষ করলে কয়েকটি প্রবণতা ও স্বভাব দেখা যায় নন্দনতত্ত্বে :
১. নন্দনতত্ত্বের প্রধান ধারণা হচ্ছে সৌন্দর্য। এটি এই ভিত্তির উপর নির্ভর করে সৌন্দর্যের সাধনা এবং স্বাদের উচ্চতা অনুসন্ধান চালায় নন্দনতত্ত্বে।
২. প্রাচীনকাল থেকে নন্দনতত্ত্ব ধারণা চলে আসছে। তবে মূলত এটি একটি ভিক্টোরিয়ান বিরোধী আন্দোলন যা ১৯-শতকে সংঘটিত হয়েছিল এবং এরপর থেকে শিল্প – সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে একটি বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৩. নন্দনতত্ত্ব যেমন প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে পর্যালোচনা করে, তেমনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা, বক্তব্যের পরিবর্তে পরামর্শ এবং সৌন্দর্যের ব্যবহারিক ক্ষেত্র নিয়েও আলোকপাত করে।
শিল্পসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার-বিবেচনার ধারাটি প্রাচীন। শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির পেছনে দুটো শক্তি সক্রিয়। প্রথমত, শ্রম (তা মূলত মানসিক, কিছুটা দৈহিক), পরিবেশ এবং নিসর্গ প্রভাব। ‘নিসর্গ’ কখনো হয়ে ওঠে সৃষ্টির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রেরণা। নান্দনিকতার ধারণাটি আমাদের কাছে প্রাচীন গ্রিস থেকে এসেছিল। প্রাচীন দার্শনিকরা মানব ক্রিয়াকলাপের বিভিন্ন বিভাগ এবং সংজ্ঞা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তারা সুন্দর এবং কদর্য এই সম্পর্কের ভিত্তিতে মানবের অঙ্গপ্রতঙ্গের প্রতিচ্ছবিগুলোর নাম করণ এবং ঐ অংশগুলোর ‘ইন্দ্রিয়গত’ রূপ তুলে ধরতে চেয়েছেন।
যুগে যুগে পরিবর্তিত সংস্কৃতিতে নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের ধারণা বা বহিঃপ্রকাশে ভিন্নতা দেখা যায়। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন গ্রিস, প্রাচীন রোম, সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা এবং চীনের সভ্যতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে প্রাচীন নন্দনতত্ত্বের ভিত। গ্রিকরা মানবদেহকে সুন্দর হিসেবে দেখেছে। তারা নগ্ন, পেশীবহুল শরীরকে আদর্শ, সৌন্দর্য এবং সঠিক অনুপাতের সঙ্গে অনুভব ও প্রকাশ করার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। পশ্চিমা মধ্যযুগীয় শিল্প মূলত রোমান ক্যাথলিক ছিল। যেটি ছিল ধর্মীয় প্রকৃতির। যার উদ্দেশ্যও ছিল মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিবেচনা করে অধ্যাত্ম সৌন্দর্যের অনুসন্ধান।
১৭-শতকের শেষ থেকে ২০-শতকের গোড়ার দিকে, পশ্চিমা নন্দনতত্ত্ব একটি দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য যাত্রা শুরু করে। সেই সময়ের দার্শনিক বামগার্টেনের মতে, নন্দনতত্ত্ব হলো ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার বিজ্ঞান। অর্থাৎ তাঁর জন্য সৌন্দর্য ছিল এক নিখুঁত ধরনের জ্ঞান। আবার জার্মান দার্শনিক হেগেলের মতে, সমস্ত সংস্কৃতি শিল্পের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয় এবং তা সৌন্দর্যের বস্তুনিষ্ঠ প্রকাশ। শোপেনহাওয়ার নন্দনতত্ত্বকে ‘বিশুদ্ধ বুদ্ধির বিষয়’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে নাট্যশাস্ত্রকে ‘ষষ্ঠ বেদ’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নাট্য ও কাব্য সাহিত্য মূল্যায়নের রীতি থেকেই নন্দনতত্ত্বের সূত্রগুলোকে আমরা আবিষ্কার করি ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে।ফলে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বে উন্মোচিত হয়েছে রসবাদ, অলংকারবাদ,রীতিবাদ, বক্রোক্তিবাদ, ধ্বনিবাদ প্রভৃতি।
ক্যালিগ্রাফি ইসলামিক শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত। সেই ক্যালিগ্রাফিতে আমরা সৌন্দর্যের নানা প্রকাশ দেখতে পাই।তাছাড়া ইসলামী চিত্রকলাতেও বস্তুর নানামাত্রিক সৌন্দর্যের দিক উঠে আসে আরবি সংস্কৃতির প্রভাবে। চীনা শিল্প, সাহিত্য , সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব দাওবাদ, কনফুসিয়ানিজম এবং বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কনফুসিয়াস নন্দনতত্ত্বে শিল্পে মানবিকতার ভূমিকার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।আফ্রিকান নান্দনিকতায় বা সৌন্দর্যের তিনটি চূড়ান্ত লক্ষণ রয়েছে: (১) কামুক সৌন্দর্য (Sensuous beauty); (২) রূপের সৌন্দর্য (beauty of form); (৩) অর্থ বা প্রকাশের সৌন্দর্য (beauty of meaning or expression)।
নন্দনতত্ত্বের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সৌন্দর্যতত্ত্বে তিনটি প্রশ্ন মূল (১) বস্তুজগতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বিকাশ; (২) মনোজগতে সৌন্দর্যানুভূতির ব্যাখ্যা, এবং (৩) শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের প্রবহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ধারাতে ক্রমাধিক পরিমাণে আনন্দজনক জীবনযাপনের তাগিদে সুন্দর, অসুন্দর, মহৎ, হীন, হর্ষ এবং বিষাদ প্রভৃতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাপকতার দিক থেকে নন্দনতত্ত্ব কেবল শিল্পকলার সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে না। শিল্পকলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি প্রয়োগগত দিক মাত্র। ব্যাপকভাবে নন্দনতত্ত্বের আলোচ্য হচ্ছে মানুষ ও সংস্কৃতি। তার সৃজনশীল ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশে, মহতের জন্য জীবন উৎসর্গে, দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে যে আনন্দানুভূতি সে বোধ করে কিংবা বর্বরতার আঘাতে যে ঘৃণা তার মনে উদ্ভূত হয়, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্য।
উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় ‘নন্দনতত্ত্ব’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তিনি ইংরেজি শব্দ ‘এসথেটিক্স’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘নন্দনতত্ত্ব’ শব্দটিকে গ্রহণ করেছিলেন। এসব ছাপিয়ে বলা যায় যে, নান্দনিকতা ১৮ এবং ১৯ শতকের একটি সাহিত্যিক এবং শৈল্পিক আন্দোলন, যা সৌন্দর্যের গুরুত্বের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল। সৌন্দর্য ছিল এসব কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। শিল্পীদের জন্য, সৌন্দর্যের নিজস্ব মূল্য ছিল যা অনুসরণ করা মূল্যবান। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ স্লোগান নান্দনিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) এমন একটি বৈজ্ঞানিক দর্শন, যেটির মূল্য (Values) নিয়ে আলোচনা করা। কোনো তথ্য বা ঘটনার মূল্য নির্ধারণ করাই নন্দনতত্ত্বের কাজ। মূল্য বলতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির নৈতিক-অনৈতিক দিকের মূল্যায়ন হলো এই মূল্যের অর্থ। নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের পারস্পারিক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। নন্দনতত্ত্ব এক সুগভীর চেতনা। এ চেতনা শিল্পের জগৎজুড়ে ব্যাপ্ত। অনন্য উপলব্ধি যার অন্তরাত্মা। ভাবের পরিপূর্ণতা এবং প্রকাশের তীব্র আকুতি নন্দনতত্ত্বের গভীরে প্রোথিত।
নন্দনশাস্ত্রের জনক বমগার্টেন তাঁর Aesthetica (১৭৫০) গ্রন্থে নন্দনতত্ত্বকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন। শিল্প ও সংস্কৃতির মধ্যে কবিতাকে তিনি perfect sensate discourse (নিখুঁত সংবেদনশীল বক্তৃতা)হিসাবে দেখতে চেয়েছেন। সেই কবিতায় অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্য (transcendental beauty) হচ্ছে নন্দনতত্ত্বের অন্যতম অনুষঙ্গ। অর্থাৎ নান্দনিকতা সর্বজনীন হয়ে বিশ্ববোধে রূপান্তরিত হয়। নন্দনতত্তের মাহাত্ম্য এখানেই।
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি,শিল্পকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যা সাধারণত অন্তর্ভুক্ত।
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি,শিল্পকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যাকে সাধারণত অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে নীতিশাস্ত্রেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে সমাজ-সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনে সৌন্দর্যতত্ত্বের ভূমিকা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে সৌন্দর্যানুভুতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আদিম অনুভূতি বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির মোকাবিলায় আদিমকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। এরুপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো কোনোটি মানুষের মনের আবেগময় প্রতিক্রিয়া। এই আবেগময় প্রতিক্রিয়ার মূলে মানুষের জীবন রক্ষার অচেতন জৈবিক প্রয়োজনই আদিকালে সমধিক কাজ করেছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা এবং শক্তির প্রকাশকে আপন জীবন রক্ষার সহায়ক কিংবা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্ত শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মনে জাগরূক রাখার সে চেষ্টা করেছে। এই আদিম বোধ থেকেই আদি শিল্পকার্যের সৃষ্টি। এই উৎস থেকে সামাজিক ভালোমন্দ বোধেরও উৎপত্তি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নন্দনতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সৌন্দর্য। কিন্তু সৌন্দর্য বিষয়টি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক, যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যজনের কাছে তা সুন্দর না-ও হতে পারে। সৌন্দর্য অনির্দিষ্ট, যেহেতু বিভিন্ন দার্শনিক এবং শিল্পের পণ্ডিতগণ একই সংজ্ঞায় উপসংহারে আসতে পারেননি। এর মধ্যে প্লেটো, সক্রেটিস এবং নিটশে উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেকেই নন্দনতত্ত্বে সমাজ ও সংস্কৃতিকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছন।
সৌন্দর্য কী, তা বর্ননা দিয়ে অপরকে বোঝানো যায় না, এটি অসংজ্ঞায়িত। সৌন্দর্য উপলব্ধির বিষয়, তাই এটি বুঝে নিতে হয়। তবে সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়ে নন্দনতত্ত্বকে মূল্যায়ন করলে উপলব্ধি সহজ হয়ে ওঠে।যেমন, বাঙালি জীবনে বিয়েকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিবেচনায় উপলব্ধি করলে এর নান্দনিক সৌন্দর্য মূল্যায়িত হয়।বিয়ে শুধু মন্ত্র পাঠ নয়, সেখানে অনেক আচার রয়েছে।বর-কনের পোষাকে বাঙালির সংস্কৃতির অবয়ব যেমন উঠে আসে,তেমনি বাঙালির নান্দনিক দিকও উঠে আসে।
বিয়েতে হলুদ অনুষ্ঠান,হলুদ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নানা কৃত্যাচার ও গান-বাজনা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির নান্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টির প্রকাশ ঘটায়।
তবে এই প্রকাশ একই সাংস্কৃতিক পরিবেশে কারো কাছে আত্মগত রূপে ধরা দিতে পারে, আবার কারো কাছে বস্তুগত রূপে। এখানেই নন্দনতত্ত্ব উপলব্ধির স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব।যেমন, রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন সৌন্দর্য আত্মগত।তাই তিনি লেখেন:
‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো
পুবে-পশ্চিমে
গোলাপের দিকে তাকিয়ে বললুম, সুন্দর
সুন্দর হল সে।
… বিধাতা কি আবার বসবেন সাধনা করতে
যুগ যুগান্তর ধ’রে।
প্রলয়সন্ধ্যায় জপ করবেন-
‘কথা কও, কথা কও’,
বলবেন ‘বলো, তুমি সুন্দর’,
বলবেন ‘বলো, আমি ভালোবাসি?’ (আমি)
অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের মতে আমরা যেরূপে উপলব্ধি করি, জগৎ সেরূপেই ধরা দেয়।
অন্যদিকে কবি নজরুল সৌন্দর্যকে বস্তুগত রূপে অবলোকন করেন।তাই তিনি লেখেন:
“তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?
চাঁদের হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী, বলে না তো কিছু চাঁদ॥
চেয়ে চেয়ে দেখি ফোটে যবে ফুল
ফুল বলে না তো সে আমার ভুল
মেঘ হেরি ঝুরে চাতকিনি, মেঘ করে না তো প্রতিবাদ॥
জানে সূর্যেরে পাবে না, তবুও অবুঝ সূর্যমুখী
চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতাকে, দেখিয়াই সে যে সুখী॥
হেরিতে তোমার রূপ মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ॥”
অর্থাৎ বস্তুর মধ্যেই সৌন্দর্য রয়েছে। ব্যক্তি-মানুষ সে সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ওঠে। নজরুলের মতে নন্দনতত্ত্ব আত্মগত নয়,বস্তুগত।
নন্দনতত্ত্বকে বিবেচনায় রেখে শিল্পী, সমালোচক এবং চিন্তাবিদরা শিল্পকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নান্দনিক মূল্যের বিচার অর্থনৈতিক, নৈতিক বা রাজনৈতিক মূল্যের সাথে যুক্ত করে নিয়েছেন। এইভাবে নান্দনিক বিচার ইন্দ্রিয়, আবেগ, বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত, ইচ্ছা, পছন্দ, মূল্যবোধ, অবচেতন আচরণ, প্রশিক্ষণ, প্রবৃত্তি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করেও মূল্যায়িত হয়েছে। কিন্তু মূল্যায়নের মূলে কাজ করে নন্দনতত্ত্বের সাংস্কৃতিক দিকটি।যে কোনো শিল্প মূল্যায়নে স্থান -কাল-পাত্র একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ।সেই অনুষঙ্গের ভিতটা গড়ে ওঠে যার যার দেশ ও জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক মনন দিয়ে।কাজেই নন্দনতত্ত্ব ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক।