(১) জীবন কী ও কেন?
** জীবন কী ও কেন? এটা তো একটা দার্শনিক প্রশ্ন। কেউ এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর আজ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছেন কিনা, আমার জানা নেই! সাধারণ মানুষ অবশ্য এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন না। বেঁচে থাকাটাই তাঁদের কাছে বড় কথা, তত্ত্বের জটিলতা ঘেঁটে জীবন কী ও কেন, খোঁজার কোনো বিলাসিতা তাঁদের নেই। তবে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, সৃজনশীল মানুষ, তাঁরা হয়তো খোঁজ করেন, কোনো একটা ধারণায় পৌঁছান, সেই ধারণাকে ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু বলাই বাহুল্য, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত, সর্বজনগ্রাহ্য কখনই নয়।
আমিও নিতান্তই সাধারণ মানুষ। জীবন সম্পর্কিত কোনো জটিল ভাবনা আমার নেই। বরং বলা যেতে পারে, বস্তুগত দৃষ্টিকোণে আমি জীবনকে পর্যবেক্ষণ করি। আমি মনে করি, একটা জীবন মানে সেই জীবনে অতিবাহিত প্রতিটি বছর, মাস, দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড, পল, অনুপল… ইত্যাদির যোগফল। তবে কোনো ক্ষণই বিচ্ছিন্ন নয়, বরং দ্বান্দ্বিকতার দরুন প্রতিটি ক্ষণ একে অন্যের সঙ্গে জড়িত এবং তাই ধারাবাহিক।
আমি জীবনচর্যায় ভাববাদী কোনো বিষয় ও ভাবনাকে স্বীকার করি না।
(২) আপনার শৈশব-কৈশোর কোথায় কেটেছে? কীভাবে কেটেছে?
** আমার জন্ম জামশেদপুরে, বড় হয়ে ওঠা জামশেদপুরে, পড়াশোনা জামশেদপুরে। কর্মজীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল ওড়িশার বেলপাহাড়ে। তবে কয়েক বছর পরে ফিরে আসি জামশেদপুরে এবং আমার পরবর্তী কর্মজীবন অতিবাহিত হয়েছে একটি কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হয়ে। প্রসঙ্গত জামশেদপুর সম্পর্কে কিছু কথা জানাই। সারা বিশ্বে জামশেদপুর শহরের পরিচিতি লৌহ ও ইস্পাত কারখানার জন্য। একই জাহাজে একবার বিদেশযাত্রা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ও শিল্পপতি জামশেদজী নুসেরওয়ানজি টাটা। বিবেকানন্দ তখন টাটাসাহেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ভারতে লৌহ ও ইস্পাত কারখানা স্থাপন করার জন্য। টাটাসাহেব সেই পরামর্শে উৎসাহিত হয়ে কারখানার জন্য জায়গা নির্বাচনে কাজে মনোনিবেশ করেন। সেইসময় বিখ্যাত জিওলজিস্ট প্রমথনাথ বসু সার্ভে করে আবিষ্কার করেন, বর্তমান জামশেদপুরের (তখন এই স্থানের নাম সাকচি ছিল) অদূরে প্রচুর লৌহ আকরিক সঞ্চিত আছে। তিনিই তখন টাটাসাহেবকে এখানে কারখানা গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ দেন। শুরু হয় টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি (টিসকো) কারখানা স্থাপনের কাজ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৯০৭ সালে এবং কারখানার উৎপাদন শুরু হয় ১৯১১ সালে। কিন্তু আফসোসের কথা, তার আগেই ১৯০৪ সালে প্রয়াত হয়েছেন টাটাসাহেব। পরবর্তী সময়ে ১৯১৯ সালে এই জায়গার নামকরণ করা হয় তাঁর নামে জামশেদপুর এবং রেলস্টেশন কালিমাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় টাটানগর। বর্তমানে সময়ে শুধু টাটার লৌহ ও ইস্পাত কারখানা নয়, বরং অসংখ্য কারখানায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে এই শিল্পাঞ্চল।
একসময় শিল্পনগরী জামশেদপুর ছিল মূলত বাংলাভাষী অধ্যুষিত শহর। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীতচর্চা হতো অনায়াস পরিবেশে। বাংলামাধ্যম স্কুলও ছিল যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে অন্য ভাষাভাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কর্মসূত্রে তাঁদের আগমন ঘটল। তাতে একটা সুফলও ঘটেছিল। তৎকালীন বিহার রাজ্যের অন্তর্গত এই শহরে (বর্তমানে ঝাড়খন্ড রাজ্য) বিভিন্ন ভাষাভাষীদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন ঘটল। আমি জন্মকাল থেকে বড় হয়ে উঠেছি এই পরিবেশ ও আবহাওয়ায়। এখনও আছি। এজন্য আমি আনন্দিত এবং তৃপ্ত।
(৩) সাহিত্যে এলেন কেন? কীভাবে এলেন? অর্থাৎ শুরুটা কীভাবে?
** সাহিত্যের সঙ্গে আমি যুক্ত হলাম কবে এবং কীভাবে, এই প্রশ্নের উত্তরে আমার পূর্বপুরুষদের পরিচিতি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করতেই হয়। শুনেছি, আমাদের বংশের আদি নিবাস ছিল বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসতের কাছে তৎকালীন দেগঙ্গ গ্রামে। তখন গ্রাম ছিল, এখন শহর হয়ে গেছে। এটা আমার ঠাকুরদার কয়েক পুরুষ আগের কথা। সেই পূর্ব পুরুষদের কোনো একজন নীলকুঠির দেওয়ানের চাকরি নিয়ে চলে গেছিলেন পূর্ববঙ্গে। তখন সেই জায়গাটা কোন জেলার অন্তর্গত ছিল, আমার ঠিক জানা নেই, তবে পরবর্তী সময়ে তা ছিল নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া পরগণার অন্তর্গত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পরে সেই পরগণা জেলায় রূপান্তরিত হয়। এখন আমরা আমাদের দেশ বলতে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালির নাম উল্লেখ করে থাকি। কুমারখালি তখন নেহাতই গ্রাম ছিল, শুনেছি, এখন তা বেশ বড় শহর হয়ে উঠেছে। আমাদের বংশের কয়েক পুরুষ কুমারখালিতেই বসবাস করেছেন। আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা গদাধর সেন, ঠাকুরদার বাবা হলধর সেন, ঠাকুরদা জলধর সেন, আমার পিতৃদেব অমিয়কুমার সেন (অর্থাৎ ঠাকুরদার চতুর্থ পুত্রসন্তান) – সবাই কুমারখালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে আমার দাদু (ঠাকুরদা) কলকাতায় চলে আসেন এবং আরও পরে আমার বাবাও চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে টাটার কারখানায় চাকরি করতে আমার বাবা আসেন জামশেদপুরে। এটা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ঘটনা। তখন থেকে শুরু হয় আমাদের জামশেদপুরে বসবাস। শুনেছি, আমাদের দেশ কুমারখালি গ্রাম সেই যুগে ছিল রত্নপ্রসবিনী। এই কুমারখালিতেই ছিলেন লালন ফকির, লালনের শিষ্য কাঙাল হরিনাথ, কাঙালের শিষ্য জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব (ভট্টাচার্য), মীর মশারফ হোসেন। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারও কুমারখালির মানুষ। এমনিতে কুমারখালিতে আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিল ঠাকুরবাড়ির জমিদারির অন্তর্গত। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার দাদুকে গড়াই নদীর ধারে কিছুটা জমি দান করেছিলেন, যে জমিতে দাদু ‘হিমালয়’ নামে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। সেই বাড়ি অবশ্য আর নেই, অনেকদিন আগেই তা গড়াই নদীর গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে।
আমার জন্মের অনেক আগেই দাদু প্রয়াত হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে। তাই তাঁর সান্নিধ্যের সুযোগ ও সৌভাগ্য আমার জীবনে ঘটেনি। তবে পারিবারিকভাবে দাদুর কথা শুনতে শুনতে কিছুটা চেতনে কিছুটা অবচেতনে তাঁকে স্পর্শ করতাম। দাদুর সান্নিধ্য না পেলেও পারিবারিক সূত্রে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ থেকে শুরু করে মোট সাতটি পত্রিকা ও সংবাদপত্রের সঙ্গে সম্পাদনা কাজে জড়িত ছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে আজীবন দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, শিশুপাঠ্য লিখেছিলেন অজস্র। আর বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের পথিকৃৎ বলা হয় তাঁকে। এসব কথা জেনে আমি সেই ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম। টুকটাক লেখালেখি করতাম। তবে সবই ছিল কাঁচাহাতের লেখা। আরও মজার কথা, সেই সময় একটা হাতেলেখা পত্রিকা সম্পাদনা করার জন্য আমি আদাজল খেয়ে লেগেছিলাম। না, সেসব কিছুই আর হয়নি। মিডল স্কুলে পড়া হাফপ্যান্ট পরা নিতান্তই নাবালকের ছেলেমানুষী আর কী! তবে বলা যেতে পারে, সম্পাদনার হাতেখড়ি তখনই হয়েছিল।
(৪) আপনি একাধারে একজন কবি ও সাহিত্যবিশ্লেষক অর্থাৎ বহুমাত্রিক। আপনার কথা বলুন!
** আমি দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছি, আর সেই কারণে সম্ভবত আমাকে কবি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে আমি আদৌ সাহিত্যবিশ্লেষক কিনা, নিশ্চিত নই। আমি সাহিত্য বিভিন্ন ফরম্যাটে লিখে থাকি। কবিতা, গল্প, উপন্যাসিকা। প্রয়োজনে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি, কিন্তু সংখ্যায় তা খুবই সামান্য। যতদূর মনে পড়ে, ছেলেবেলায় প্রথম সাহিত্যচর্চা আমার শুরু হয়েছিল পদ্য রচনা করে। তার পাশাপাশি কয়েকটা গদ্যও লিখেছিলাম। আরও মনে পড়ছে, আমার লেখা প্রথম মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল জামশেদপুরেরই একটি পত্রিকায়। জামশেদপুরে বাঙালিদের অনেকগুলো ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ক্লাবের নাম বেঙ্গল ক্লাব। টাটা কোম্পানির সৌজন্যে তা হয়েছিল। জামশেদপুরে বিভিন্ন ভাষাভাষীর নিজস্ব ক্লাব ও সংস্থা আছে। কোম্পানি শহরে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজ নিজ সাহিত্য ও সংস্কৃতি্র ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সব সময় সহযোগিতা করে এসেছে। তা সেই বেঙ্গল ক্লাব কিশোরদের জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। নাম ছিল ‘সৃজনী’। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। সেই পত্রিকায় আমার গল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পের শিরোনাম ছিল ‘শেষ দেখা’। আর কবিতার কথা যদি বলেন, সঠিক মনে করতে পারছি না, সম্ভবত ‘সৌরভ’ অথবা ‘সুবর্ণরেখা’ পত্রিকায়। আমি তখন কিছুটা বয়সে ও মননে বড় হয়ে ঊঠেছি। তখন উত্তাল সত্তর দশকের আন্দোলন চলছে। আমি কলেজে পড়ি। সেই আন্দোলনে আমরা কম বেশি সবাই প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার অনেক বন্ধুই সরাসরি আন্দোলনে যোগদান করেছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ধরা পড়ে যায়। নির্মম পুলিশি অত্যাচার করা হয় তাদের ওপর। কাউকে কাউকে মেরে ফেলা হয়। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই সাধারণ মানুষের মনে জেগে ওঠে ক্ষোভ ও ক্রোধ। সেই ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, চলচ্চিত্রে। মনে পড়ে, সেইসব দিনে যেসব কবিতা আমি লিখেছিলাম, সবই ক্রোধের কবিতা এবং প্রতিবাদী কবিতা। আমি তখন গল্পও লিখতাম সেই ধারাতেই। সেসব গল্প ও কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পরে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, এভাবে হবে না। ভাষা ও সাহিত্যকে আয়ত্ত্ব করতে হবে। আমি অ্যাকাডেমিক্যালি পড়াশোনা শুরু করলাম। এম এ পাঠ্যক্রমে পড়লাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, বৈষ্ণব পদাবলী, বিভিন্ন সাহিত্যিকদের প্রচুর লেখা। আরও পড়লাম ছন্দ-অলঙ্কার, পোয়েটিকস, মঙ্গলকাব্য, চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আরও কত কী! এভাবেই পড়তে পড়তে বুঝতে বুঝতে আমি সাহিত্যকে স্পর্শ করার জন্য আকুল হয়ে পড়লাম। সেইসঙ্গে একটু একটু করে শুরু হলো আমার লেখালেখির বাঁকবদল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর আমি বাংলাসাহিত্যে গবেষণা শুরু করেছিলাম এবং পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলাম।। বিষয় ছিল – বাংলাসাহিত্য ও জলধর সেন।
আমার লেখালেখির পাশাপাশি আমি পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করে আসছি দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে উঠেই একটা হাতেলেখা পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলাম। পত্রিকার নাম ছিল ‘পথিকৃৎ। আরও পরে ‘সারস্বত’ নামে একটি মুদ্রিত পত্রিকা প্রথম সম্পাদনা করেছিলাম। এই দুটি পত্রিকাই ছিল ক্ষণস্থায়ী। তবে ‘কালিমাটি’ মুদ্রিত পত্রিকা ১৯৭৮ থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর সক্রিয় আছে।
‘কালিমাটি’ পত্রিকা জামশেদপুর থেকে প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রথম তা জামশেদপুর ভিত্তিক ছিল। লিখতেন জামশেদপুরের লেখকরা। কিন্তু ক্রমশ পত্রিকার চরিত্র বদলাতে থাকে। জামশেদপুরের বাইরে থেকে লেখা আসতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণীর লেখকের বিভিন্ন বিষয়, ভাবনা ও শৈলীর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। মহাশ্বেতা দেবীর বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা পাঠাতেন। বারিদবরণ ঘোষ, সুধীরকুমার করণ, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, কলিম খান, সাধন চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্র গুহ, সুবিমল বসাক সবাই লেখা পাঠাতেন ‘কালিমাটি’কে সমৃদ্ধ করার জন্য। এর পাশাপাশি স্বদেশ সেন ও বারীন ঘোষাল ছিলেন। জামশেদপুরের লেখকেরা ছিলেন সুধীরচন্দ্র সেনগুপ্ত, ড. সত্যেন্দ্র দে, গোপালহরি বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মলোচন বসু, প্রভাতরঞ্জন রায়, সত্যকিঙ্কর কুন্ডু, ভূষণচন্দ্র গোপ, স্বদেশ সেন, বারীন ঘোষাল, নীতা বিশ্বাস, প্রভাত চক্রবর্তী, অশোক চক্রবর্তী, গুণধর মন্ডল, পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র, দীপক চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ ঘোষ, স্বাধীন বসু, তাপস চট্টরাজ, ড. বৈদ্যনাথ ত্রিপাঠী এবং আরও অনেকে। এঁদের সবার লেখায় ‘কালিমাটি’ এক অন্য উচ্চতায়, এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অঙ্কনশিল্পী ও আলোকচিত্রশিল্প ভূদেব ভকতের একের পর এক অনবদ্য প্রচ্ছদশিল্প। বলা বাহুল্য, এইসব শ্রদ্ধেয় লেখক ও শিল্পীরা শুধুমাত্র শুধুমাত্র লেখা পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন না, বরং ‘কালিমাটি’র একান্ত আপনজন ছিলেন। আর তাই ‘কালিমাটি’ একেবারে শুরুতে কিছুটা জামশেদপুর ভিত্তিক থাকলেও তার পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। ভারত ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশের লেখকদের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে। মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার পাশাপাশি সম্পাদনা করেছি আন্তর্জাল পত্রিকা ‘কালিমাটি অনলাইন’ পত্রিকা। এই অনলাইন পত্রিকা বারো বছরে পদার্পণ করেছে। বিশ্বের আশিটির বেশি দেশে পঠিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তার ১২১টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আর মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকা বিগত চুয়াল্লিশ বছরে ১১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
৫) আপনার অভিজ্ঞতা ও বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক ও বর্ণিল। বিচিত্র। এই সামগ্রিক সত্তাকে কীভাবে দেখেন? কীভাবে উপভোগ করেন?
**অভিজ্ঞতা তো ব্যাপক ও বিশাল। খুব কম কথায় তা তো বলাও যাবে না! এই দীর্ঘ সময়ে এত এত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তাঁদের সান্নিধ্যে এসেছি, এতরকম ঘটনা ও পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তা বলতে গেলে আমি খেই হারিয়ে ফেলব। তবু কিছু অভিজ্ঞতার কথা, যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, বলছি। আমার মনে আছে, ‘কৌরব’এর উদ্যোগে জামশেদপুরে সম্ভবত দু’তিনবছর ‘ভুবনমেলা’র আয়োজন হয়েছিল। মেলার ঠিক আগেই ‘কালিমাটি’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংখ্যা নিয়ে মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। চেনা ও অচেনা মানুষদের অনুরোধ করছিলাম পত্রিকা কেনার জন্য। তার মধ্যে একজন ‘কালিমাটি’ হাতে নিয়ে বেমওকা প্রশ্ন করেছিলেন, এটাই কি প্রথম ও শেষ সংখ্যা? আমি হকচকিয়ে গেছিলাম সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে। আর হয়তো সেই দিনই জামশেদপুরের সাকচি হাইস্কুল বা আমবাগান স্কুলের প্রাঙ্গনে আয়োজিত ভুবনমেলায় দাঁড়িয়ে অবচেতনে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম, আমি আজীবন ‘কালিমাটি’ সম্পাদনা ও প্রকাশ করে যাব। হ্যাঁ, এখন আমার বয়স হলো প্রায় তিয়াত্তর এবং এখনও ‘কালিমাটি’ নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
প্রসঙ্গত আর একটা কথা উল্লেখ করি। ওড়িষ্যার বেলপাহাড় থেকে চাকরি ছেড়ে ফিরে আসার পর আমার কোনো স্থায়ী চাকরি ছিল না। উপার্জন ছিল অনিয়মিত। কিন্তু আমি ছিলাম আমার মা-বাবা ও দুই দাদার আশ্রয়ে। তাঁদের প্রশ্রয়ে একদিকে যেমন আমি নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, অন্যদিকে ’কালিমাটি’ পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতে শুরু করেছিলাম। সেই পরিস্থিতিতে পত্রিকা প্রকাশের যে কী আর্থিক অনটন ছিল, তা ভুক্তভোগীরা জানেন। কিন্তু আমি দমে যাইনি। তারপর বিয়ে করি। আমার স্ত্রী চাকুরিরতা ছিলেন। সমীরদা (সমীর রায়চৌধুরী) আমাদের সেই দুঃসময়ের কথা জানতেন। তিনি এই প্রসঙ্গে একটি পত্রিকায় লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত আলোচনায় লিখেছিলেন যে, কাজল তার নিজের উপার্জনে পত্রিকা প্রকাশ করে আর তার স্ত্রী নিজের উপার্জনে সংসার চালায়। সত্যিই তাই। আমার স্ত্রী চিত্রা এভাবে আমার পাশে না দাঁড়ালে ‘কালিমাটি’কে শেষপর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম কিনা, আমার জানা নেই।
৬) এ যাবৎ সর্বমোট আপনার কটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে?
** আমার প্রথম প্রকাশিত বই কবিতার। প্রকাশিত হয়েছিল ‘কালিমাটি প্রকাশনী’ থেকে। ‘এই পীচরাস্তা শব্দের হারমোনিয়াম’। ভূমিকা লিখেছিলেন স্বদেশ সেন। দ্বিতীয় বইও কবিতার ‘বাজে শুধু শার্টের বোতাম’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘কালিমাটি প্রকাশনী’ থেকে। ভূমিকা লিখেছিলেন বীতশোক ভট্টাচার্য। তৃতীয় কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রিয়শিল্প প্রকাশনী’ থেকে। বারীন ঘোষাল ভূমিকা লিখেছিলেন। ‘দলছুট এক স্বপ্নঠগ’। আর চতুর্থ কবিতার বই ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী’ থেকে। বইয়ের নাম ‘বাহবা কোরাস’। ভূমিকা লিখেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী। আমার মোট ১০টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্যে আছে ‘নির্বাচিত কবিতা’ সংকলন ও ‘কবিতা সমগ্র ১’। ‘কবিতা সমগ্র ১’এর সুদীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন মলয় রায়চৌধুরী।
আমার প্রথম ছোটগল্পের বই ‘বর্ণ বিবর্ণ’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘অভিযান পাবলিশার্স’ থেকে। ছোটগল্পের মোট তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। চতুর্থ বইটি এখন প্রেসে। এছাড়া আমার চারটি ঝুরোগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে ‘চিন্তা প্রকাশনী’ থেকে। আর প্রকাশিত হয়েছে দুটি উপন্যাসিকা, প্রতিটি বইতে দুটি করে উপন্যাসিকা সংকলিত হয়েছে।
আমার আরও একটি কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে বই সম্পাদনা। এখনও পর্যন্ত আমি মোট ১৭টি বই সম্পাদনা করেছি বিভিন্ন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিকের।
৭) আপনি ঝুরোগল্পের উল্লেখ করলেন। এসম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। এই ভাবনাটা আপনি কোথা থেকে পেলেন?
** ‘ঝুরো’ একটা নতুন ভাবনা। একটা নতুন কনসেপ্ট। যদিও শব্দটা বহুল প্রচলিত এবং ব্যবহৃত। আমরা সবাই সাধারণ কথাবার্তায় শব্দটি প্রায়শই প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু সেই শব্দের গভীরে যে কী প্রবল ত্বরণ ক্রিয়াশীল, সে সম্পর্কে ততটা অবহিত নই। যদি অবহিত হতাম, তাহলে এই ভাবনার মধ্যে ক্রমশ এবং নিরন্তর ঘনিয়ে ওঠা রূপান্তরের অকূল সম্ভাবনার পূর্বাভাষ অনেক আগেই পেতাম। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষেরা নিতান্তই মধ্য মেধায় অবস্থান করি, দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব ও তার প্রায়োগিক বা অ্যাপ্লায়েড দিকটি সম্পর্কে ততটা সচেতন থাকি না, আর তাই জগত ও সংসারে, সজীব ও নির্জীবে, স্থাবর ও জঙ্গমে অনেক কিছু ঘটে যাবার পরে, অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যাবার পরে, আমরা তার কারণ খুঁজতে সচেষ্ট হই, তার বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
ভাবনাটা হঠাৎই এসেছিল আমার মাথায়। আমি আমার চারপাশের জনজীবন ও যাপনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে উপলব্ধি করলাম যে, পৃথিবীতে কারও জীবনই সম্পূর্ণতা লাভ করে না। কোনো কাজ, কোনো দায়িত্ব, কোনো কর্তব্যই শেষ করা যায় না। সব কিছুতে অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়। এমন কি এই সৃষ্টি নিজেই তো অসম্পূর্ণ! যদিও তার যাত্রা সম্পূর্ণ হবার লক্ষ্যে ও আকাঙ্ক্ষায়। আর তাই যদি হয়, তাহলে সৃজনশীল প্রতিটি মানুষ সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যা কিছু সৃজন করার প্রয়াস করছে, তাও কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না। নির্দিষ্ট কোনো পরিণতিতে পৌঁছতে পারে না। অথচ মানুষ যা কিছু সৃজন করে, তার লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা থাকে সম্পূর্ণতায় পৌঁছনোর জন্য। কিন্তু যেহেতু পৌঁছতে পারে না, তাই তার মনে ক্রমশ ধূমায়িত হতে থাকে এক ধরনের হতাশা ও ব্যর্থতার মেঘ। যা তাকে প্ররোচিত করে কৃত্রিমভাবে পূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য। যাঁরা প্রকৃত গুণী, শিক্ষিত ও প্রতিভাবান সাহিত্যিক ও শিল্পী, তাঁরা সেই কৃত্রিমতাকে পরিহার করে অত্যন্ত নিপুণভাবে অসম্পূর্ণতাকেই মেলে ধরেন, যা থেকে পাঠক ও দর্শকরা নিজ নিজ মানসিকতা ও বোধ অনুযায়ী পূর্ণতার খোঁজ শুরু করেন।
আমার সাহিত্যজীবনে দুজন মূল অভিভাবক বা মেন্টার হচ্ছেন স্বদেশ সেন ও সমীর রায়চৌধুরী। দুজনেই আজ নেই। স্বদেশদা আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন কবিতায়। তিনি বলতেন, কাজল তুমি যে কবিতা লিখছ, তা ভালো কবিতা। তোমার নিজস্ব ডিকশনও তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু জেনে রাখো, শুধু ভালো কবিতা লিখলে হবে না, তোমাকে লিখতে হবে নতুন ধারার কবিতা। আর স্বদেশদার এই নির্দেশ ও আদেশই আমাকে ভেতর থেকে আলোড়িত করে তুলেছিল। আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। আর সেই ভাবনারই ফসল এই ‘ঝুরো’ কনসেপ্ট। আমি সমীরদার সঙ্গে এই বিষয়ে ও প্রসঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করেছি সাক্ষাতে এবং ফোনে। তিনি আমার নতুন ভাবনাকে আরও গভীর ও প্রসারিত করেছেন। এবং সমীরদাই নামকরণ করেছেন ‘ঝুরোগল্প’। আমি গল্প লেখার ফরম্যাটে এই ‘ঝুরো’ কনসেপ্ট প্রথম ব্যবহার করেছিলাম। পরে আমি কবিতার ফরম্যাটেও প্রয়োগ করেছি। আমার কবিতা সংকলন ‘ঝুরোকবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘বৈভাষিক প্রকাশনী’ থেকে।
প্রচলিত ধারায় ছোটগল্পের মধ্যে পরিণতি আরোপের ব্যাপারটা অত্যন্ত প্রকট। আবার অণুগল্পের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। বস্তুতপক্ষে, ছোটগল্প ও অণুগল্পের মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোনো পার্থক্য নেই। দু’নামে গল্পের শ্রেণীবিভাগ করা হলেও তারা মূলত একই। যদি ছোটগল্পকে একটা গাছের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে অণুগল্পকে তুলনা করা যেতে পারে সেই গাছের বনসাইয়ের সঙ্গে। যেটুকু তফাৎ তা শুধুমাত্র আয়তনে ও শব্দ সংখ্যায়। এবং আরও একটা কথা হচ্ছে, অণুগল্পের জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ সংখ্যার সীমাবদ্ধতার উল্লেখও থাকে না। ১টি শব্দসংখ্যা থেকে শুরু করে ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০… যা খুশি হতে পারে। আর ছোটগল্প ও অণুগল্প সব ক্ষেত্রেই একটা নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ঝুরোগল্পে এই নির্দিষ্ট পরিণতিতে পৌঁছনোর ব্যাপারটাই থাকে না। গল্প হঠাৎই শুরু হয় এবং হঠাৎই শেষ হয়ে যায়। অসম্পূর্ণতা ঝুরোগল্পের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কোনো নিটোল গল্প লেখার দায় ও তাগিদ থাকে না। অথচ গল্পটি পাঠকের মনে ক্রমশ চারিয়ে যায়। মাত্র ৪০০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ঝুরোগল্প।
আপনারা লক্ষ্য করুন, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সব কিছুই একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে। মানে আগের স্ট্রাকচারটা ভেঙে পড়ছে। ঝরে পড়ছে। সেই ঝরা থেকে আবার কিছু একটা তৈরি হচ্ছে, আবার সেটাও ঝরে যাচ্ছে। আগে এক দলের শাসন ছিল, এখন বহুদল মিলে শাসনতন্ত্র চালাচ্ছে। আগে কোম্পানি ছিল, এখন কর্পোরেট হয়েছে। বিভিন্ন পুঁজি একত্রে মিশছে। দেশ ভাঙছে, রাজ্য ভাঙছে, প্রকৃতি ভেঙে ভেঙে পড়ছে। সবকিছুই ভঙ্গুর বা ঝুরো।
রবীন্দ্রনাথের লেখা স্মরণ করুন – ‘যে ফুল না ফুটিতে ঝরিল ধরণীতে’ এবং ‘যে নদী মরুপথে হারাল ধারা’ – না তারা কেউ ব্যর্থ হয়নি। এই আংশিকের নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, তাৎপর্য আছে। আমাদের জীবন সামগ্রীক জীবনধারার ভগ্নাংশ মাত্র। প্রতি মুহূর্তে আমরা বদলে যাচ্ছি, চরিত্র বদলে যাচ্ছে, আচরণ বদলে যাচ্ছে। আমরা তো একটা মানুষ নই, বরং অনেক মানুষের সমষ্টি। আমরা প্রতি মুহূর্তে ঝরে যাচ্ছি। একদিন পুরোপুরি ঝরে যাব। থাকব না আর। গল্প লেখার ক্ষেত্রেও তাই। গল্প তো নির্মাণ। আমরা নির্মাণ করি। যিনি ঝুরোগল্প লিখবেন, তাঁকে ভাবতে হবে, লিখতে লিখতে তিনি কখন কলমটা তুলে নেবেন। ব্যস, ঐটুকুই। গল্পটা অসমাপ্ত থাকবে। ওপেন এন্ডেড।
বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। বিশিষ্ট অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় আমার বন্ধু। বিশ্বসাহিত্যে তাঁর দখল আছে। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, বিশ্বসাহিত্যে এই ফরম্যাট এখনও পর্যন্ত তিনি খুঁজে পাননি। আর শ্রদ্ধেয় মলয় রায়চৌধুরী এই প্রসঙ্গে লিখেছেন – “প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে, ‘ঝুরোগল্প’ নামের কনসেপ্ট এবং উৎপত্তি সম্পূর্ণরূপে বাঙালির। এর সঙ্গে ইউরোপ বা আমেরিকার গল্প-রচনার কোনও অবদান নেই। ঝুরোগল্প রচনার আঙ্গিক, কাঠামো ও ভাবনা ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক, কবি, গল্পকার-ঔপন্যাসিক কাজল সেন এবং অধুনান্তিক ভাবুক, কবি ও গল্পকার সমীর রায়চৌধুরীর”। (ভূমিকা : ১০জন লেখকের ৫০টি ঝুরোগল্প ১, চিন্তা প্রকাশনী)
৮) আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন?
** আমি অবশ্যই সত্তর দশকে অবস্থান করি। আমার জন্ম পঞ্চাশের দশকে হয়েছিল। সাল ১৯৫২। এইসূত্রে একটা কথা উল্লেখ করি, কাজল সেন আমার সাহিত্যনাম। পোশাকী নাম ড. অনুপকুমার সেন।
৯) আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন?
** না। এখনও পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। নিজের দেশ, বিশেষত কুমারখালিতে যাবার সৌভাগ্য হয়নি। এটা আমার জীবনের একটা অপূর্ণতা। তবে স্বপ্ন দেখি, একদিন যাব। কুমারখালিতে আমাদের জ্ঞাতিরা নিশ্চয়ই আছেন। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হব। মিলিত হব কাঙাল হরিনাথের পরিজনদের সঙ্গে। আর দেখে আসব ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র প্রেস, যে মুদ্রণযন্ত্রে পত্রিকা ছাপা হতো, তা নাকি সযত্নে সুরক্ষিত রেখেছেন কাঙাল হরিনাথের বংশধররা।
১০) কেমন পৃথিবী কামনা করেন?
** শোষণমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি আমি। যে পৃথিবীতে মানুষের পরিচিতি হবে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে।
……….
সাক্ষাৎকার গ্রহণে: সাজ্জাদ বিপ্লব
জুন ৩০, ২০২৪
কাজলদা একজন বড়ো মাপের লেখক এবং দক্ষ সম্পাদক।