তাজ ইসলাম
যুক্তস্বর :একটি ষাণ্মাসিক অনুবাদ সাহিত্য পত্রিকা।এই শ্লোগান নিয়েই তাদের আত্মপ্রকাশ । তারা এ সংখ্যাটি করেছে ” মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য সংখ্যা ” হিসেবে। এর কারণ হিসেবে সম্পাদকীয়তে লিখেন, “মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের প্রতি বাংলা ভাষার পাঠকদের বিপুল আগ্রহ থাকার পরও পর্যাপ্ত অনুবাদের অভাবে সেই আগ্রহের নিবৃত্তি ঘটেনি।অনুবাদ পত্রিকা যুক্তস্বর- এর বর্তমান সংখ্যাটি তাই প্রকাশিত হল মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য নিয়ে।”
যুক্তস্বরে মুদ্রিত হয়েছে প্রবন্ধ,গল্প,কবিতা ও সাক্ষাৎকার।
প্রায় ২০ টি গল্পের অনুবাদ ছাপা হয়েছে। এই গল্পগুলো ফিলিস্তিন, কুয়েত, সৌদি আরব, জর্ডান, ইরাক, মিশর, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরান, ইয়েমেন, তিউনিসিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত গল্পকারদের গল্পের অনুবাদ। যা ছাপা হয়েছে যুক্তস্বরে।
গাসান কানাফানির গল্প “গাজার চিঠি,বাসাম আল মুসাল্লামের গল্প ‘মৎস্যকুমারীর রাত’ , নাজাত খায়েতের গল্প” আমি যদি ছেলে হতাম’।
জামিলা ফাতানি,ফখরি কাওয়ার, মাহদি ইসা আল সাকর, রাশা আব্বাস,আজিজ নেসিন, ইয়াসির আবদেল বাকি, এডগার কেরেটের নাম ও ছোলগল্পের সাথে বাংলাদেশী পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিল অনুবাদ ও ছাপার মাধ্যমে।
“(গাজার চিঠি) গাসান কানাফানির এই গল্প ১৯৫৬ সালে লেখা হয়, ১৯৪৯ সালে পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্যালেস্টাইনের জমি দখলের সাত বছর পর। এর ইংরেজও অনুবাদ ছাপা হয় ১৯৮০ সালে the 1936 Revolt in palestine গল্পগ্রন্থে। আজ ৬৭ বছর পরও প্যালেস্টাইন পরিস্থিতির কোন রকমফের হয়নি, বরং মারণাস্ত্রের অগ্রগতির কল্যাণে হিংস্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ বেড়েছে কয়েক গুণ।)”
গাসান কানাফানি গল্পের শুরু করেছেন চিঠির ঢঙে।
গল্পের শুরু,
প্রিয় মোস্তফা,
তোমার চিঠি পেয়েছি, তুমি জানিয়েছ যে সাক্রামান্তোয় গিয়ে তোমার সঙ্গে আমার থাকার সব ব্যবস্থাই করে ফেলেছ। ওদিকে আমি জানতে পেরেছি যে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে আমার ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে।”
কিন্ত তার আর যাওয়া হয় না।নিজের দেশকে বিপর্যস্ত রেখে,দখলদারের বুটের নিচে রেখে নিজের জাতীকে তিনি আর যাননি। উচ্চশিক্ষার সমস্ত আশা ইস্তফা দেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মোস্তফাকে জানিয়ে দেন ( প্রিয় বন্ধু) ” আমি এখানেই রয়ে যাব এবং আর কখনোই যাব না দেশের বাইরে।”
মোস্তফা মূলত লেখকের গল্প বলার মাধ্যম।তার মাধ্যমেই তিনি বিশ্ববাসীকে জানাতে চান ইসরাইলের বর্বরতা,ফিলিস্তিনের উপর তাদের জুলুমের কথা।নাদিয়া ছোট শিশু। নাদিয়ার সাথে কথোপকথন চলে গল্পে।একটি সংলাপে উন্মোচন হয়ে পড়ে জায়নবাদী ইসরাইলের নির্মমতার চিত্র।প্রকাশ হয় নিরীহ জনতার উপর চলা অত্যাচারের নমুনা। ‘ চাচা’/সে এক হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে ধরে সাদা চাদরটা ওঠায় আর পায়ের দিকে নির্দেশ করে দেখায় – দেখি উরুর ওপর থেকে পা- টা নেই”।
বাসাম আল মুসাল্লাম একজন কুয়েতি ঔপন্যাসিক। তিনি গল্পকার এবং কুয়েত নিউজ এজেন্সি পত্রিকার সাবেক সহসম্পাদক।তার গল্প মৎসকুমারীর রাত ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মাইয়া তাবিত।ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঝর্না রহমান।
গল্প আছে সৌদি আরবের গল্পকার নাজাত খায়েত,মিসরের গল্পকার ইউসুফ ইদরিসসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ২০ জন গল্পকারের । এই তালিকায় ইসরায়েলের গল্পকার এডগার কেরেটের গল্পও আছে।
“নাগিব মাহফুজ আরবি সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী।মিসরিয় এই আরব ঔপন্যাসিক বিশাল কলেবরে মহাকাব্যিক ঢঙের উপন্যাস লেখার পাশাপাশি ছোটগল্প ও ছোট কলেবরে উপন্যাস লেখায়ও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।” ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এই কথাশিল্পীর ছোটগল্প ” শাইখ জাবালাবি”।
” শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করলাম শাইখ জাবালাবিকে খুঁজে বের করতে হবে।” এটা গল্পের শুরুর বাক্য।কে এই জাবালাবি তা গল্পকারের বক্তব্যেই চিনে নিই।
“…..একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ জাবালাবি কে?’
( বাবা বললেন) তিনি একজন খোদার সাধু বান্দা। দুঃখ ও সমস্যা দূরকারী। তিনি না থাকলে আমি নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যেতাম।” তারপর এই জাবালাবিকে খুঁজতে ও খোঁজার প্রেক্ষাপট বয়ান করতে করতেই গল্পের বিস্তার। গল্পের শেষ বাক্যটি এমন ” এখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত শায়েখ জাবালাবিকে আমার খুঁজে বের করতে হবেই।হ্যাঁ, আমাকে খুঁজে বের করতে হবে শায়েখ জাবালাবিকে।”
ইরাকের অগ্রণী কথাসাহিত্যিকদের একজন ফুয়াদ আল তার্কালি।তার গল্প ‘ গোপন সম্পদ”। ‘ঘোটকী ‘তৌফিক ফাইয়াদের গল্প।তিনি প্যালেস্টাইনি গল্পকার। ‘আরব বিশ্বের লোকগল্প’ অনুবাদ করেছেন তানভীর আহমেদ সিডনী। নানান দেশের প্রচলিত লোকগল্পের সমাহার এই পর্ব।আমাদের দেশে প্রচলিত বাঘ ও রাখালের গল্প ইয়ামেনও প্রচলিত।
কবিতা অধ্যায়ে আল – খানসার ৫ টি কবিতা,নাজিম হিকমতের ৫ টি কবিতা,তিনজন ফিলিস্তিন কবির কবিতা, মাহমুদ দারউইশ, কাহলিল জিবরানের ৫টি কবিতা, রুমি হাফিজের কবিতার অনুবাদ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রথিতযশা কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন প্রায় ১৯ জন অনুবাদক।
“আমি ভালোবাসি
আমি হাঁটু গেড়ে বসি: তাকিয়ে থাকি মাটির দিকে/ ঘাস / পোকামাকড় / নীল আভা নিয়ে ফুটে- ওঠা ছোট ছোট কাণ্ড/ তুমি যেন বসন্তের মাটি,হে প্রিয়তমা,/ আমি তাকিয়ে থাকছি তোমার দিকে।”নাজিম হিকমাত,অনুবাদ আজফার হোসেন। সবার অনুবাদই সাবলীল। গল্প ও কবিতা অনুবাদেই পাওয়া যায় মূল লেখার তৃপ্তি। দক্ষ অনুবাদকদের হাতের ছুঁওয়ায় পাঠে পূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায়। কবিতা অনুবাদক হিসেবে আছেন রেজা শামীম,আজফর হোসেন,আলফ্রেড খোকন,শাহেদ কায়েস,সাখাওয়াত টিপু,শাহাদাৎ তৈয়ব।তারা অনুবাদ করেছেন আরব,তুর্কি,সিরিয়া,ফিলিস্তিন,জর্ডান,লেবানন,ইরান,তিউনিসিয়ার নামকরা কবিদের জনপ্রিয় কবিতাসমুহ।
“মুক্তছন্দ আন্দোলনের মতো,গদ্যকবিতা আরবি কবিতায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল।গদ্য কবিতা সমন্ধে সুজান বার্নাডের অভিমত স্মর্তব্য, ” আঙ্গিকের সব ধরণের নির্যাতন, যেটি কবির নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির অধিকারকে হরণ করে এবং ছাঁচে ঢালা কোনো আঙ্গিকে নিজের বক্তব্য প্রকাশে বাধ্য করে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফল হচ্ছে গদ্যকবিতা।” কবিতা,কবিতার ছন্দ,কবিতার বিপ্লব,সংগ্রাম ও রাজনীতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন
ওয়ায়েদ আথাম্নাহ। তার প্রবন্ধের শিরোনাম ” আরব রাজনীতি ও কবিতা- আধুনিক কাল।” ( অনুবাদ : মোস্তাক শরীফ)।
এডওয়ার্ড সাঈদের “প্রাচ্যবাদ” অবশ্য পাঠ্য একটি প্রবন্ধ।এর ভূমিকা ও অনুবাদ করছেন সুরেশ রঞ্জন বসাক।
চাদ স্কট : শিল্পকর্মের সংসর্গে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতি। অনুবাদক: মাইনুল ইসলাম মানিক।
“ইংরেজি সাহিত্যে ‘ দ্য অ্যারাবিয়ান নাইটস’ এর প্রভাব: একটি বিশেষ বিশ্লেষণ” ফাহাদ মোহাম্মেদ তালেব সাঈদ আল – ওলাকি” অনুবাদ: আবদুস সেলিম।
আরও আছে নাগিব মাহফুজের দুটি প্রবন্ধ।তার প্রবন্ধের বিষয় হল ধর্ম,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিন্তা ও বস্তু প্রসঙ্গ।
৮ টি প্রবন্ধ আর সাতজন মহান চিন্তাবিদের সাক্ষাৎকার গ্রন্থিত হয়েছে যুক্তস্বরে।
লেবানিজ কবি ও সাংবাদিক জুমানা হাদ্দাদের দুটো সাক্ষাৎকার এবং লেবানিজ আরেক বিশ্ববিখ্যাত কবি ও কথাশিল্পী কাহলিল জিবরানের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার যুক্তস্বরকে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পরিনত করে তুলেছে। ইয়েমেন,তিউনিসিয়াসহ আরব বিশ্বের কবি,সাংবাদিক,সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারে উপস্থাপন করা হয়েছে সমকালীন চিন্তা, দর্শন ও শিল্পকলার নানা কথা।
এ ফোর সাইজ কাগজের সাড়ে তিনশত পৃষ্ঠার পত্রিকাটির সম্পাদক আনিসুজ জামান।প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত।মূল্য রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা।প্রকাশনা ও পরিবেশনায় : পাঞ্জেরী পাবলিকলশন।
যুক্তস্বর
তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা
জানুয়ারী ২০২৪
“অনুবাদ তো নিজেই একটি ভাষা। এই ভাষা আন্তর্জাতিক। এটি এমন এক দরজা, যার কপাট খুলে বিশ্বসাহিত্যের বিচিত্র ও বিরল আঙিনায় প্রবেশ করা যায়।” যুক্তস্বর বাংলা ভাষাভাষীর জন্য আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রবেশের সুন্দর আয়োজন।
এই আয়োজনের উদ্যোক্তা বাংলা ট্রান্সলেশন ফাউন্ডলশন।”যুক্তস্বর “তাদের অনুবাদ পত্রিকা। এর প্রকাশের ধারাবাহিকতা কামনা করি।এবং বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।