তৈমুর খান
বাংলা কবিতায় কবি গোলাম রসুলের আত্মপ্রকাশ ঘটল এক বিস্ময়ের জাগরণ নিয়ে। ২০১০-এর পর থেকে তাঁর কবিতা প্রথম পাঠেই আমাদের অনুভূতি জগতে এক তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করল। মনে হল এরকম কবিতা তো আমরা আগে কখনো পড়িনি! মাত্র কয়েকটি বই পড়েই এই বিশ্বাস জন্মাল যে, এই কবি নিঃসন্দেহে আলাদা এবং সম্পূর্ণ আলাদা। ‘অচেনা মানুষ আমি’, ‘বেলা দ্বিপ্রহর’, ‘বৃষ্টির একপাশে উড়ছে পাখিরা’, এবং ‘দুই মাস্তুলের আকাশ’ মাত্র কয়েকখানি কাব্য নিয়েই তিনি উদ্ভাসিত হলেন। এর আগে ও পরে আরও কয়েকখানি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে :’আমরা একসঙ্গে কেঁদে ফেললাম’, ‘মেঘ এখানে এসে অন্যমনস্ক হয়ে যায়’, ‘পূর্বাহ্নে ঢেঁকিছাটা ধূসর’, ‘লাল হয়ে আছে রাগী আকাশ’, ‘বিন্দুতে বিন্দুতে কথা হয়’ ইত্যাদি। ২০১০ থেকে ২০১৬ এই সময় এটুকুর মধ্যেই প্রকাশিত কাব্যগুলি কবিকে পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। পরবর্তীকালে তাঁর কবিতাও বারবার বাঁক নেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু প্রথম পাঠ, প্রথম দর্শন, প্রথম উপলব্ধি কেমন ছিল? এখানে সে কথাই বলতে যাচ্ছি।
কবিতার ভূমিতে বহু চাঁদ গড়িয়ে গেছে, বহু রাত্রি অতিবাহিত হয়েছে। বহু সূর্য উঠেছে, পাখি ডেকেছে, ফুলও ফুটেছে। অশ্রুতে হাত ভিজেছে। আগুনে মন পুড়েছে। নিঃসঙ্গরা দলবেঁধে নেমেছে। গোলাম রসুলের কাছে সে-সব বিদায় নিল, অথবা সঙ্গী হয়ে কথা বলল। নিঃসঙ্গ কি শুধু মানুষ হয়? কবি দেখলেন গাছও নিঃসঙ্গ, চাঁদও নিঃসঙ্গ, রাত্রিও নিঃসঙ্গ। অথবা দেখলেন বহু যুগের পুরোনো নৌকা যৌবনে টলোমলো করছে। নদী চাঁদ বুকে নিয়ে হাসছে। পাথরগুলো কথা বলছে। সূর্য কাঁদছে। খড়কুটোগুলো পৃথিবীর চোখের ভুরু হয়ে ইঙ্গিত করছে। চাদর গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওয়া। মেঘ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছত্রাক পাঠশালা তৈরি করছে। নক্ষত্ররা সাইকেল চালাচ্ছে মোরাম বিছানো রাস্তায়। কোনো কোনো সময় বিশেষণও কথা বলল। অতিলৌকিক জীবনের ছায়ায় হেসে উঠল মানবসভ্যতা। কখনো বিচ্ছেদ গান গাইল। স্বপ্নের ভেতর পাখিরা বাসা বাঁধল। কখনো গাছপালা কীটপতঙ্গ মানুষ সবাই একসঙ্গে কেঁদে ফেলল।
গোলাম রসুল একইসঙ্গে মেটাফোর এবং মেটাফিজিক্সকে মিলিয়ে দিলেন। উপমাকে উপমেয় করে তুললেন। আর বস্তুকে প্রাণময়ী ইচ্ছাময়ী চরিত্রে বদলে দিলেন। মেটাফোরের মধ্যে থাকে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য যাকে tremendous beauty বলা যায়। কবি এক্ষেত্রে কোনো তুলনা বাচক শব্দ ব্যবহার করেন না। মেটাফিজিক্স প্রাণের আরোপে বস্তু জগতের ঊর্ধ্বে এক সংবেদনশীল জগৎ তৈরি করে। মেটাফিজিক্স সম্পর্কে
F.Sommers বলেছেন: Metaphysics treats of the relations obtaining between the underlying reality and its manifestations. অর্থাৎ মেটাফিজিক্স যে অন্তর্নিহিত বাস্তবতার সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অধিবিদ্যার ভিত্তি কবির ভাবনার দর্শনে প্রতিফলিত। কবির আত্মদর্শন সেভাবেই গড়ে উঠেছে যেখানে অস্তিত্বের অন্বেষণ, সত্য নির্ণয় এবং তাবৎ প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ। সপ্তদশ শতকে ইংরেজ কবিরা এই ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। গোলাম রসুল মেটাফোরের সঙ্গে মেটাফিজিক্সের সূক্ষ্ম সমন্বয় ঘটিয়ে জীব ও জড়ের তফাত ঘুচিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলিতে এক অভূতপূর্ব আবেদন আছে যা আদি ও অনন্তের ধারক।
১, সেই শবযাত্রায়
শোকের পোশাক পরে নিয়েছে ঝরনা
একসাথে ছুটছে বৃষ্টি আর আলো
২, ধীরে কাঁপছে বালি
দূরগামী
জলের অভাবে চোখে পান করছে হাওয়া
লাঠির আগায় বসন্ত আর শীতের পরস্পর যাতায়াত
অনন্ত বৃষ্টি পড়ছে ফাটলে ফাটলে
৩, জরাগ্রস্ত শীত
কুয়াশার ভেতর কাশছে নক্ষত্ররা
সব শব্দ বন্ধ হয়ে আছে দরজায়
শুধু প্রাচীন দুর্গটি সাড়া দিচ্ছে
৪, চেঁচাচ্ছে
সিলভার প্লেটের ওপর হাত রাখছে মেঘ
ইতিমধ্যে আঙুলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে কেঁদে কেঁদে
ছন্নছাড়া আকাশের গ্রাম
৫, বুনো ভোরের পাল
জলের গোড়া থেকে ছেড়ে যাচ্ছে
এমনিতে বৃষ্টির আঘাতে ধরাশায়ী সব
পাখিরা উস্কে দিচ্ছে সন্ধ্যাকাল
৬, সাইকেল চেপে কেউ হয়তো ফিরে আসছে বিরহ থেকে
পিঠে হাত রাখছে নিঃসঙ্গতা
৭, বিষয় হারানো রাত্রি
আঁশ ছাড়ানো অন্ধকার
চারিদিকে ঢেউউদ্ধৃত অংশগুলি ঝরনা, বৃষ্টি, আলো, বালি,হাওয়া, বসন্ত, শীত, নক্ষত্র, দুর্গ, মেঘ, আকাশ, ভোর, নিঃসঙ্গতা, রাত্রি, অন্ধকার সবাই এক একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। ক্রিয়াসংযোগে তারা সকলেই সক্রিয় এবং স্বয়ংক্রিয়। ঝরনার শবযাত্রায় শোকের পোশাক পরিধান এবং বৃষ্টি ও আলোর সহগমন মনুষ্যকর্মেরই সহায়ক। বালির কম্পন এবং পিপাসায় হাওয়া পান এবং লাঠির আগায় বসন্ত ও শীতের যাতায়াত মনুষ্য চরিত্রকেই ধারণ করে। তেমনি জরাগ্রস্ত শীত, নক্ষত্রের কাশি, দুর্গের সাড়া, মেঘের চেঁচানো ও সিলভার প্লেটে হাত রাখা, কেঁদে কেঁদে আঙুলগুলো ক্ষয় করা, ভোরের পালের বন্যতা, নিঃসঙ্গের পিঠে হাত রাখা, রাত্রির বিষয় হারানো এবং আঁশ ছাড়ানো অন্ধকার প্রাণিজগতের জৈবনিক ক্রিয়ায় নিষিক্ত হয়ে গেছে। উপমাগুলি একই সত্যের দিকনির্দেশ করেও বহুস্বরিক বহুরৈখিক হয়ে উঠেছে। সত্যটি আত্মস্ফুরণ, এক সত্তার ব্যাপ্তিতে বহুসত্তার অনুগমন। একেই monism বা অদ্বৈতবাদ বলা চলে। কবি বিশ্বাস করেন বস্তু এবং মনের কোনো ভেদ নেই: Thus materialism and idealism or spiritualism are both species of monism. ব্রহ্মবাদে সর্বভূতেষুর মধ্যেই নির্ণীত আত্মাটির দেখা পাওয়া যায়। কবির বোধেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ইহ ও পরাজগতের মাঝেও কবি বিচরণ করেছেন। গোরস্থানের দিকে সরলরেখার চলে যাওয়া, একাকী ধুধু কথার নিচে বাস করা, কাঠের আনন্দঘর, পুতুলের মন, নৌকার উপমহাদেশ, কাগজের হৃদয়, হৃদয়ে জুলুম করা সন্ধ্যার পাখি, নির্জন কান্না, নীরবতার বিজয় উৎসব, কারুকাজ করা দিন আমরা কখনো দেখিনি। মেটাফোরিক কাব্যভাষায় গোপন মর্মের আলোড়ন বহুক্ষণ বাজতে থাকে। কোথাও কোথাও বিশ্বসংসার বিচিত্র উল্লাসে স্পন্দিত হয়। একাকিত্ব নেই। নির্বাসন নেই। শূন্যতারও স্বর আছে, কল্পনা আছে বোঝা যায়।
গোলাম রসুলের কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল না মোটেও। এই লেখার মধ্যে উদ্ধৃতি থেকে কিছু কবিতাংশ পড়লাম। তিনি দারুণ সুন্দর কবিতা লেখেন বলেই মনে হচ্ছে। “সাইকেল চেপে কেউ হয়তো ফিরে আসছে বিরহ থেকে / পিঠে হাত রাখছে নিঃসঙ্গতা ”—–কী চমৎকার কী অভিনব চিত্রকল্প ! তার কবিতার বই সংগ্রহ করবো আশা করি। কবি তৈমুর খানকে অজস্র ধন্যবাদ এই লেখাটির জন্য।