spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধমহাজাগতিক মহাজীবনের কবি গোলাম রসুল

লিখেছেন : তৈমুর খান

মহাজাগতিক মহাজীবনের কবি গোলাম রসুল

তৈমুর খান

পার্থিব আসক্তির মধ্যে যে কবি তাঁর জীবনচেতনাকে বন্দি করেননি, অথবা মহাজীবনের আলোকে মহাপৃথিবীর অন্বেষণ করেছেন যে কবি—তিনিই কবি গোলাম রসুল(১৯৫৯)। আজীবন কবিতাকে লালন করেও চূড়ান্ত ভাবে কখনও আত্মপ্রকাশ করেননি। সর্বদা নীরবে নিভৃতেই নিজেকে আড়াল করেছেন। গ্রাম্য জীবনের ধূলিধূসর হাটুরে মানুষ হিসেবেই বড় হয়েছেন। প্রতিটি মানুষকেই কবির পিরামিড বলে মনে হত। সেই মাটির বাড়ি, বাঁশের খুঁটি, খড়ের চাল, গোবর নিকানো উঠোন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা অজ পাড়াগ্রাম ভাঙড়ে কবি জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিদিন ভেজাভাত খেয়ে মাঠ, চাষ, ফসল তোলা, গোরু-লাঙল এই নিয়েই জীবনের সূচনা। শীতের মরশুমে খেজুর গাছের রস পেড়ে জ্বাল দিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করে বাজারে পৌঁছানোও একটি কাজ ছিল। কখনও মটরশুঁটির ক্ষেতে মটরশুঁটি তুলতে তুলতে মটরশুঁটির দানায় চিকচিক করে ওঠা সূর্যরশ্মিতে মহাকালের বালক সূর্যের ভাষাকে খুঁজে পাওয়ার বিস্ময়ও আবিষ্কার হতে থাকে।কুয়াশায় অস্পষ্ট ব্যাপ্তির স্ফুরণে নিজের মহিমান্বিত অবস্থানটি অনুভব করা এক মহাজাগতিক প্রশ্রয়েরই পরিচয়।
নিরক্ষর পিতা-মাতার প্রথম সন্তান গোলাম রসুল। তারপরেও একে একে ভাইবোন মিলে বারো জন। কিন্তু প্রায় অর্ধেক জনেরই অকাল মৃত্যু। সারি সারি তাদের কবর হয়। তখনই কবরের সংলাপ শুনতে পান কবি ‘একটি কবরখানার সাক্ষাৎকারে’ লেখেন :
“এমন অদ্ভুত রাত্রি আগে কখনো দেখিনি
একটি কবরখানার সাক্ষাৎকার চলছে
আর কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ করতে হবে পৃথিবীর, যত কাজ

আকাশে বাতি জ্বলছে একটি গাছের গোড়ায়
আলো এসে পড়ছে মুখে
আর শরীরের বাদ্যযন্ত্র গুলো বেজে উঠছে”
এই কবরখানার সাক্ষাৎকার একান্ত আত্মগত উপলব্ধিতেই অনুভব করা যায়। কেননা মৃত্যু এক প্রবাহ অনন্তজীবনের দিকেই নিয়ে যায়। সেখানে মৃত্যুতে আর জীবনে কোনও প্রভেদ থাকে না।পিতামহের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সন্ধ্যাতারার আলো দেখতেন। মাঠের দিক থেকে ভেসে আসত অনাদি যুগের কথোপকথন। দীর্ঘশ্বাসও শুনতে পেতেন। আর এক মহাশূন্যতায় মিশে যেতেন । এই শূন্যতার কথা ‘কবরখানার অহংকার’ কবিতাতে উঠে এসেছে:
“একটি কবরখানা আর আমি পাশাপাশি যাচ্ছিলাম
সন্ধ্যা হয়েছে
প্রথম নক্ষত্রটি নির্দেশ করছে রাত্রির
শহরের নিজস্ব আকাশ
আর ওই বিশাল শূন্যতা ছিল আমার ব্যক্তিগত
এর আগে কবরখানার অহংকার কখনও দেখিনি
যতবার এ পথ দিয়ে গেছি সন্ধ্যা এসে ঢেকে দিয়েছে আমাদের বসন্তকাল
ভোর হচ্ছে গলির মুখে
অসময়ের মতো”
নিজস্ব ‘আকাশ’ এবং নিজস্ব ‘বিশাল শূন্যতা’ মৃত্যু যেন সঞ্চারিত করেছে জীবনের ব্যাপ্তিকে। তাই সংকীর্ণ গলির মুখে অসময়ের ভোর দেখা দিয়েছে। যে ভোর পৃথিবীর নয়, অনন্তকালের ভোর।
মায়ের মৃত্যুর পর মাকেও উপলব্ধি করেন যেন মা চাঁদ হয়ে নেমে এসেছে পুকুর ঘাটে। এক ঝাঁক হাঁসের মধ্যেও শুনতে পান তাঁর চেনা স্বর। কখনও মা কাপড় শুকোচ্ছে মহাকাশে। পার্থিব জীবনের সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে মহাজীবনের প্রজ্ঞায় তা সমর্পিত। হোমারের মহাকাব্যের মতো তিনি পাঠ করতেন সেসব। অখণ্ডবলয়ের অংশ হিসেবেই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সঙ্গে গভীর অন্য এক যোগও অনুভব করেন। ‘আমরা একসঙ্গে কেঁদে ফেললাম’ মহামারীর দশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে একটি অসাধারণ কাব্য।মহাকালের মানুষের কান্না অনন্ত দ্রাঘিমায় বেজে উঠেছে। কবির দুঃখ সমস্ত মানুষেরই দুঃখ যেন একটি নীরব পাত্রে রাখা আছে। অনাদি কাল থেকেই তারই কথোপকথন। জীবন তাঁর কাছে মহাসমুদ্রে বিদেশি জাহাজের মতো কখনও দেখা যায়, কখনও দেখা যায় না। কবি তাঁর হৃদয়কে মাটির উপর শুইয়ে রেখে শাশ্বত মাটির কথাই শুনতে থাকেন।
চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, আকাশ, বাতাস তাদের যাবতীয় ক্রিয়ায় মহাকালের সংকেতই প্রকাশ করেছে। সাময়িকতাকে অতিক্রম করে চিরন্তনতায় পৌঁছে গেছে। ব্যক্তি-অনুভূতির প্রচ্ছায়ায় চিরন্তন মানব-অনুভূতির প্রক্রিয়াটি যেমন সচল হয়েছে, তেমনি ব্যক্তি হারিয়ে গেছে মহাব্যক্তির বিস্তারে। প্রাকৃতিক অনুজ্ঞার মধ্যেই আত্মস্ফুরণের চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আশির দশকে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। রাজনৈতিক উচ্চপদেও অবস্থান করেছেন। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। তাঁর কর্মকাণ্ডে দলের ক্ষতি হচ্ছে বলে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয় । এটাও তাঁর জীবনের ধ্বংস। একের পর এক প্রেম। প্রেমও তাঁর জীবনের ধ্বংস। সমাজ অসমর্থিত মিশ্র বিবাহ তাঁকে বিতর্কিত করে তুলেছে। দাম্পত্য জীবনে এসেও আর এক ধ্বংস বহন করেছেন। সমসাময়িক রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্মীয় মেরুকরণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন এসব নিয়েও কি ভাবেননি? অবশ্যই ভেবেছেন।কবিরও মনুষ্য হৃদয় বারবার দগ্ধ হয়েছে।সমাজের প্রতি এক গভীর তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়েছেন। নিজের পরিচয় জানাতে গিয়ে বলেছেন:’আমি তিনবার খুন হয়েছিলাম’। ‘আমার অপরাধ শুধুমাত্র আমি জন্মেছি’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন:
“প্রথমে আমি ছিলাম সংখ্যালঘু
দ্বিতীয়বার আমি নাস্তিক
তৃতীয়বারে কমিউনিস্ট
তারপর থেকে যতবার আমি জন্মেছি ফ্যাসিস্টরা আমাকে ভয় দেখিয়েছে
ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে বন্ধুরা আমাকে কিছু মৌলবাদের প্রসঙ্গ তুলেছে
কিন্তু ওরা জানে না সব ধর্মই হল রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর
আর যে রাষ্ট্র আমাকে বারবার খুন করেছে
আমার অপরাধ শুধুমাত্র আমি জন্মেছি
শেষপর্যন্ত আমি রক্ত আর হাড়ের কলমে লেখা দুর্জয়
আমাদের বিজয় ওই বিশাল আকাশ”
এই রক্ত আর হাড়ের কলমে লিখেই কবি দুর্জয় হয়ে উঠেছেন। মৌলবাদ প্রসঙ্গকে দূরে সরিয়ে চিরন্তন প্রাণ-ঐশ্বর্যের ব্যাপ্তিতে বিশাল মহাকাশকেই বিজয়ক্ষেত্র করে তুলেছেন। আর তখনই জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় নয়, এমনকী সংখ্যালঘু-নাস্তিক-কমিউনিস্টও নয়, কবি একটি পৃথিবী হয়ে উঠেছেন, আর সেই পৃথিবীর নাম মহাপৃথিবী। আর কবিও হয়েছেন মহাজীবনের অধিকারী।
দীর্ঘদিন মালদহের কালিয়াচকে প্রায় স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। পরে আবার ফিরেও আসেন কলকাতায় প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে। যে ধর্মজীবন তিনি অতিবাহিত করেন তাও ধ্বংস। কারণ তা ছিল ধর্মান্ধতার সময়কাল। এখান থেকেই তিনি ধর্মমুক্তির পথে অগ্রসর হন। চারিপাশে দেখার দৃষ্টিকে আরও তীক্ষ্ণ ও সজাগ করে তোলেন। গার্হস্থ্য জীবনে বেড়াল-কুকুর নিয়ে জীবনযাপন শুরু করেন। সামাজিক রীতি-নীতিকে তোয়াক্কা না করেই নিজস্ব ভঙ্গিতেই জীবন অতিবাহিত করার প্রক্রিয়ায় অটল থাকেন। সব মতবাদের ঊর্ধ্বে মনুষ্য জীবনকে মহামানবিক প্রাচুর্যে মহিমান্বিত করেন। কবিতায় নিঃসঙ্গতা এলেও তা কখনো ব্যক্তিক বা সামাজিক বিষণ্নতায় পর্যবসিত হয়নি। বরং তাঁর জগৎ আলবার্ট কামুর জগতের সঙ্গে কিছুটা মিলে যায়। কামু বলেছেন:
“I opened myself to the gentle indifference of the world.”
(Albert Camus, L’Étranger)
অর্থাৎ পৃথিবীর কোমল উদাসীনতায় নিজেকে খুলে দিলাম।
গোলাম রসুলও নিজেকে মুক্ত করেছেন অনন্তের কালসীমাহীন প্রজ্ঞায়। ‘কক্ষচ্যুত’ নামে একটি কবিতায় লিখেছেন:
“কক্ষচ্যুত গৃহ যেখানে আমারা প্রার্থনা করি
আর যে প্রতিধ্বনি ফিরে আসে না

আমাদের ভালোবাসা আর একটি গ্রহ

হাওয়া খুলে খুলে চলে যাচ্ছে
আর আমরা ছড়িয়ে পড়ছি”
পৃথিবী থেকে আর এক পৃথিবীর দিকে অথবা ভিন্নগ্রহের দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই এই মুক্তির একান্ত বোধটি উপলব্ধি করা যায়। কবির প্রতিটি পদক্ষেপেই তাই ছাড়িয়ে গেছে পৃথিবীর অন্বয়। ‘লাল হয়ে আছে রাগী আকাশ’ কাব্যটিতে মনে হল, অবক্ষয়ী চেতনায় এক নরকের বিষাদময় চিত্রকল্পের ভেতর কবি আমাদের টেনে নিয়ে চলেছেন। বাস্তবিক এই পৃথিবীতে কবির স্বয়ংক্রিয় অভিযাপন। বহুমুখী সত্তার জাগরণে এবং উপলব্ধির নৈঃশাব্দ্যিক ব্যাপ্তিতে মোচড় খেতে খেতে আমরা এক মহাজাগতিক অভ্যাস আয়ত্ত করে নিচ্ছি। কবি বলেছেন “মৃত্যু নিয়ে আমার মনখারাপ করার অভ্যাস তাই আমি নরকের সন্ধ্যাকে স্মরণ করছি / আমার স্মারকে ভারাক্রান্ত সূর্যের ছবি / আর নাম না জানা পূর্ণিমার চাঁদের পিঠে উঠে পৃথিবী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে” —তখন ব্যক্তি নয়, সামগ্রিক সত্তারই নরকবাসের ছবিটি ‘রোগগ্রস্ত অন্ধকারে’ পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। আর্থার রিম্বাউদ একটি প্রবন্ধে বলেছেন: “I belive that I am in hell, therefore I am there.” অর্থাৎ আমি বিশ্বাস করি যে আমি নরকে আছি, হ্যাঁ আমি সেখানেই আছি। এখানে সেই প্রতিধ্বনিই শোনা যায়। যখন কবি বারবার বলেন ‘আমার হৃদয় পাথরের মতো কষ্ট পাচ্ছে’ অথবা ‘বৃষ্টিমুখর মৃত্যু’ নিয়ে কবি ‘প্রাচীনকালের একা’ হয়ে হাহাকারের পীড়িত বাজনায় ডুবে যান। এখানে হৃদয় নেই। অথবা হৃদয় মৃত। পৃথিবী যখন নরক, কবির চেতনাও বিলুপ্ত প্রাচীন ইনহিউম্যানের আকাঙ্ক্ষায় পর্যুদস্ত। দি মিথ্ অফ্ সিসিফাস-এ আলবার্ট কামু বলেছেন: “At the heart of all beauty lies something inhuman.” অর্থাৎ সমস্ত সৌন্দর্যের হৃদয়ে কিছু অমানবিক নিহিত রয়েছে। গোলাম রসুলের কবিতায় একথারই রূপান্তর ঘটেছে ‘পৃথিবী এখন শীতল একগুচ্ছ ঘুমের মতো’ অথবা ‘আমাদের জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে’ এই মানবতাশূন্য নরক দর্শনের ভেতর আমরা প্রাচীন আত্মারই মর্মরিত কান্নাকে উপলব্ধি করতে পারছি। ফরাসি কবি আর্তুর র‍্যাঁবো ও মালার্মের ভাবনাতেই ধরা পড়ে তাঁর চেতনার শানিত ঔদার্য।কবির নিজেও জানালেন : “ছিন্নমূল দারিদ্র্য আর কামু আমাকে এই পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে।” কামু বলেছেন:”Nobody realizes that some people expend tremendous energy merely to be normal.” অর্থাৎ কেউ বুঝতে পারে না যে কিছু লোক শুধুমাত্র স্বাভাবিক হওয়ার জন্য প্রচুর শক্তি ব্যয় করে। গোলাম রসুলও তাই করেছেন। ‘বিন্দুতে বিন্দুতে কথা হয়’ কাব্যেও এই ভাবনাকে আরও ঘনীভূত করেছে । সমস্ত কবিতাতেই এক মহাজাগতিক বিস্ময় উঠে এসেছে। রহস্যচারী অনন্ত জিজ্ঞাসায় আমরা যেন ডুবে যেতে থাকি ।
ব্যক্তি জীবনে গোলাম রসুল কোনো ঐশ্বরিক চেতনায় বিশ্বাসী না হয়েও মহাজাগতিক প্রজ্ঞায় সর্বদা সমর্পিত । ভোগ সুখের ঊর্ধ্বে চরম কৃচ্ছ্র সাধনায় কবিতা নিয়েই ভাবতে ভালোবাসেন । নিজস্ব বাস্তবতা সৃষ্টি করে তিনি যেমন বিচরণ করেন, তেমনি নিজস্ব রোমান্টিকতার জগৎও নির্মাণ করেন। তাই তাঁর সৃষ্ট নরক পার্থিবের ক্লেদাক্ত বিষণ্নতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর রোমান্টিকতাও অন্য কবিদের রোমান্টিকতার সঙ্গে মেলানো যায় না। তাঁর কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশকেও টেনে আনা যায় না। ছন্দোহীন নিজস্ব নির্মিতিতেই অনুপ্রাস বহির্ভূত বাক্য বিন্যাসে তিনি কাব্যকলা ধারণ করেন।
ধ্বংসের দর্শনকেই তিনি বিশ্বাস করেন বলেই স্থিতিপ্রাজ্ঞতায় কখনও অবস্থান করতে চান না। এক ধ্বংস থেকে আর এক ধ্বংসের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক মূলত ইতিহাস আশ্রিত রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন দ্যুমা দাভি দ্য লা পাইয়্যত্রি বা আলেক্সঁদ্র দ্যুমা(১৮০২-১৮৭০) বলেছেন :”Yet man will never be perfect until he learns to create and destroy; he does know how to destroy, and that is half the battle.”
(Alexandre Dumas, The Count of Monte Cristo) অর্থাৎ মানুষ কখনোই নিখুঁত হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৃষ্টি ও ধ্বংস করতে শেখে; সে জানে কীভাবে ধ্বংস করতে হয়, এবং এটি একটি অর্ধেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধই গোলাম রসুল করে গেছেন। এক একটি প্রতিরোধের সামনে দাঁড়িয়েছেন। শব্দের পিরামিড যেমন গেঁথেছেন, তেমনি শব্দের তরবারিও ঝলসে উঠেছে।কখনও বল্লমের মতো শব্দ নিক্ষেপও করেছেন।ঝকঝকে ব্যক্তিত্বের মতোই তাঁর নির্মাণশৈলীও।
‘বিস্ময়ের অট্টালিকা’ নামে কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটিও বিস্মিত করে :
“যখন আমি কিছুই দেখি না একটি পাহাড় আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়
তার ভারী শব্দের ভেতর আমি আমার নৈঃশব্দ্যকে স্মরণ করি
দিনগুলো সেই একই রকম ভৌতিক
কবরখানার ধারে জনতার মাঠ হারিয়ে গেছে
আমার আত্মীয়দের আমি আর খুঁজি না
বিস্ময়ের অট্টালিকা
যার সিঁড়িতে বসে আকাশের ডানা ঝাপটানো দেখি
আর আমার হৃদয় সৌরলোকে বিচূর্ণ হয়
আমি কুয়াশায় অভিভূত হই
যখন ভোরবেলায় জাহাজের তলায় সূর্য ঘণ্টা বাজে
যে দিনগুলো হারিয়েছি তারই স্রোত ভেসে ওঠে জলে
শূন্যের মুখে বিমূর্ত আমি ঘুরছিলাম”
শূন্যের ভেতর বিস্ময়ের অট্টালিকা নির্মাণ শেষ হয় না কখনও। মহাজীবনের কারবারি কবিই জানেন সেই রহস্য। শূন্যের মুখে বিমূর্ত ঘুরে বেড়ানোর প্রক্রিয়াটিও এম্পটিনেসে সঞ্চারিত হওয়ার ক্রিয়ায় নিবেদিত। ‘শূন্য যেখানে শূন্য নয়’ কাব্যেও এই এম্পটিনেসের পরিচয়টি গভীর প্রভাব ফেলেছে। এখানেও মহাবিস্ময়ের জাগরণে সাড়া দিয়েছেন। আলোর অন্ধকারে রাস্তার ধারে দেখেছেন বিমূর্ত গলিকে। সময়, স্থান, গ্রহ-নক্ষত্র, দিন-রাত্রিকে ‘তুমি’ সর্বনামে সম্বোধনও করেছেন। পৃথিবী বন্দরে নেমেছে। আকাশে ভেসেছে শহর। স্রোতে ভেসে গেছে মনুষ্যত্ব। মেরুদণ্ড শুয়ে আছে কবরের প্রহরে। কবি নিজের অস্তিত্বের কথা ভেবে দেখেননি জীবনের বিজ্ঞাপনের মতো। শুধু নিজের অবস্থানটি জানিয়েছেন:
“আমি বসে আছি শূন্যে
না-দেখা মহাকাল
আমার বিশ্বাস একটি নৌকা ভাসছে”
এই শূন্য নাথিংনেস-এর মধ্যে বিলীয়মান। জন্ম-মৃত্যুর চেতনাপ্রবাহ থেকে আত্মস্থিত প্রজ্ঞাও এখানে অবস্থিত। সুতরাং নাথিংনেস্ও এম্পটিনেস্ নয়। বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন খুব কম বয়সী যুক্তরাজ্যের একজন ইংরেজ নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার এবং থিয়েটার পরিচালক সারাহ কেন(১৯৭১-১৯৯৯):
“Built to be lonely
to love the absent.
Find me
Free me
from this
corrosive doubt
futile despair
horror in repose.
I can fill my space
fill my time
but nothing can fill this void in my heart.”
(Sarah Kane, 4.48 Psychosis)
অর্থাৎ শূন্যতা অনুপস্থিতদের ভালবাসার জন্য নিঃসঙ্গ হওয়ার জন্য নির্মিত। আমাকে সন্ধান করুন এই ক্ষয়কারী সন্দেহ থেকে, আমাকে মুক্ত করুন বিশ্রামে থাকা নিরর্থক হতাশা থেকেও। আমি আমার স্থান আমার সময় পূরণ করতে পারি,কিন্তু কিছুই আমার হৃদয়ে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটিই গোলাম রসুলের কাছে আত্মিক হয়ে উঠেছে। আবহমান নিজের শূন্যতাকেই বহন করে নিয়ে চলেছেন। উপলব্ধি করেছেন:
“জীবন পরিযায়ী পাখনা
বিরামহীন অন্য এক উড়ে চলা”
এভাবেই অনেক বছর কেটে চলেছে। চাঁদের সিক্সটি স্ট্রিটে হেঁটে চলেছেন কবি। আকাশের নক্ষত্র বুদবুদের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে আর কবিও জলের কিনারায় ঠিকানা খুঁজছেন। চেতনাপ্রবাহের যাপন এমন নিবিড়ভাবেই আপতিত হয়েছে যা ঈশ্বরীয় প্রবর্তনে নিঃসীম স্তব্ধতায় আমাদের পৌঁছে দেয়। কবির বোধ এমনই যে, কোনও না-লেখা বইও সহজে পড়ে নিতে পারে। মেঘের হত্যাকারীও হয়ে উঠতে পারে। শূন্যতার নিচে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে দাঁড়াতেও পারে। বৃষ্টি সমুদ্র নক্ষত্র বাতাস পৃথিবী সবই মহাযজ্ঞের ক্রিয়ায় নিয়ত আবর্তিত হয়েছে। আর সব কিছুর মধ্যেই কবির চেতনাও প্রবাহিত হয়েছে। এই বোধের জগতেই শূন্যতা থেকে স্তব্ধতায় কবি তাঁর বিরাট আত্মাকে মেলে ধরেছেন।
সুতরাং ধ্বংস কবির কাছে এক রূপান্তরের পথ। কবিকে অনন্তজীবনের সোপানে ক্রমশ রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে। আর সেই কারণেই তাঁর কাব্য-কবিতা মহাজীবনের উচ্চারণে উচ্চকিত এক বন্দনা। মুহূর্তকে মহাসময়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ‘আমি’ ও ‘আমরা’ সত্তাও তখন বিস্তৃত হয়ে গেছে:
“আমাদের দিনগুলো সমুদ্রের দিকে যায়
আর আমরা ছড়িয়ে পড়ি
নদীগুলোর দিকে খুলে দিই হাওয়া
যে ভাবে আমাদের অবতরণ ছিল দিগন্তের মতো”
(নামহীন জীবনকে)
জীবনের নাম হয় না, জীবন এক মহাপ্রবাহ। জীবনের পরিচয়ও দিগন্তের মতো। এই দর্শনই তাঁর কবিতায় প্রকীর্ণ হয়ে আছে।
বাংলা কবিতার চিরচেনা পথে হাঁটতে অভ্যস্ত পাঠকরা স্বাভাবিকভাবেই গোলাম রসুলের কবিতায় বিভ্রান্ত হতে পারেন। যে ব্যাখ্যা, যে দর্শন, যে জীবনবোধ নিয়ে বাংলা কবিতার পাঠক কবিতার কাছে উপস্থিত হন; গোলাম রসুলের কবিতায় সেই পথ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। গোলাম রসুল তাঁর সত্তাকে কবিতায় স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তা abnormal psychology হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।বিতর্কিত জীবনের মতো কবিতাও নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘শূন্য যেখানে শূন্য নয়’ কাব্যটিতে তাঁর সৃষ্টির অনন্যতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
কাব্যের শেষ কবিতা ‘শূন্যের চেয়ে শূন্য’তে তিনি লিখেছেন:
“শূন্যের চেয়েও আমি শূন্য হয়ে যাই
আলো পার হয়ে দেখি আমার হৃদয়
যে অনুসরণে তৈরি করে নিয়েছি ভালোবাসা আর স্নেহ
শরীরের ভেতর কেঁপে ওঠে পৃথিবী
প্রতিটি হিংসা ধারালো হতে হতে আত্মহত্যা করে”
এই বোধকে তখন আমরা আর আমাদের সামর্থ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি না। কীভাবে তা ঘটে যায়, কোন্ শক্তিতে তা সচল হয় তা আমাদের ধারণাতীত এক ক্রিয়াসংযোগ। তখন মনে পড়ে যায় অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক, লেখক এবং হলোকাস্ট থেকে বেঁচে ফেরা ও লোগোথেরাপির প্রতিষ্ঠাতা ভিক্টর এমিল ফ্রাঙ্কল(১৯০৫-১৯৯৭)-এর একটি উক্তি: “An abnormal reaction to an abnormal situation is normal behavior.”
(Victor Frankl, Man’s Search for Meaning)
অর্থাৎ একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই হলো স্বাভাবিক আচরণ। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শুধু আমাদের বাস্তব পৃথিবীতে নয়, আমাদের মনোজগতেও নানা ভাঙচুর সৃষ্টি করেছে। যেখানে সদর্থক কোনও মূল্যবোধ নেই। স্বাভাবিকভাবেই কবিও অশ্রয়চ্যুত। আর সেই কারণেই একটি নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি করেছেন যা বিনির্মাণ হিসেবেই তাঁর কাব্যকলায় প্রকাশিত।
মূলত ২০০৮ সাল থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এর আগে অবশ্য কবিতা কবির ভাবনায় ছিল। যখন লিখতে শুরু করলেন তখন মহাস্রোতের মতোই তা বেরিয়ে আসতে শুরু করল। একে একে প্রকাশিত হল:
১) কষ্ট (২০০৯)
২) যশোর রোড (২০০৯)
৩) টিনের বাড়ি(২০০৯)
৪) বৃষ্টির একপাশে উড়ছে পাখিরা (২০১০)
৫) আমি এক অচেনা মানুষ (২০১১)
৬) আমরা একসঙ্গে কেঁদে ফেললাম (২০১১)
৭) বেলা দ্বিপ্রহরে (২০১২)
৮) বিন্দুতে বিন্দুতে কথা হয় (২০১৩)
৯ ) দুই মাস্তুলের আকাশ (২০১৪)
১০) পূর্বাহ্নে ঢেঁকিছাটা ধূসর (২০১৫)
১১) মেঘ এখানে এসে অন্যমনস্ক হয়ে যান (২০১৫)
১২) লাল হয়ে আছে রাগি আকাশ (২০১৬)
১৩)মরুভূমি চিহ্ন (২০১৬)
১৪) নিদারুণ ছায়া (২০১৯)
১৫) বিস্ময়ের গলিতে চাঁদ (২০১৯)
১৬) পৃথিবীর মেঘ আমরা পেরিয়ে এসেছি(২০১৯)
১৭) বিস্ময়ের অট্টালিকা (২০২১)
১৮) শূন্য যেখানে শূন্য নয় (২০২১)
১৯)বালকের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা (২০২১)
২০) কবিতা সমগ্র (১ম খণ্ড) (২০২৪)
আরও কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায়। গোলাম রসুল ক্লান্তিহীন স্রষ্টা। জীবনের অপরিমেয় সামর্থ্য নিয়েই তিনি বাংলা কবিতার জগতে অবিসংবাদিত এক ব্যক্তি।জীবন এবং কবিতাকে সমান্তরাল ভাবেই মহাবিস্ময়ের দিকে নিয়ে চলেছেন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ