spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েশাহীন রেজা'র কবিতা : মায়াবী পর্দার সিনেমা

লিখেছেন : মাহমুদ নোমান

শাহীন রেজা’র কবিতা : মায়াবী পর্দার সিনেমা


মাহমুদ নোমান

মাঝেমাঝে আমার কাছে মনে হয়, কবির কবিতা কবির আচার আচরণ মাত্র। কবিতা পড়েই কবির অবয়ব চোখে ভেসে আসে। কবি কতোটুকু কাতর হলে কী শব্দবিভাজনে নিজেকে শাণিত করে আর কখন হাসলে, হেসে ওঠে পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য; সত্যি টের পাওয়া যায়। কেউ টের না পেলে সে দায় আমার নয়। কৈশোরকাল থেকে কবিতার ঐশ্বর্যে বিচরণ থাকাতে শাহীন রেজাকে আমি সে কবে থেকে জানি! অথচ শরীরী দেখা হয়েছে এইবছরে আর আমার হৃদয়ে আঁকা চিত্রকর্মটির সবটুকু মিলিয়ে নিলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে; অতি বিস্ময়ে শাহীন রেজার কবিতায় সৌন্দর্যচেতনাতে বুঁদ হয়ে থাকাটাকে সার্থক মনে হলো। এতোদিন যে শাহীন রেজার আচার আচরণ পাঠ করে এসেছি,সে থেকে শরীরী শাহীন রেজার এতোটুকু অমিল পেলাম না…

স্মার্ট শব্দগুচ্ছে কবিতার নান্দনিক পরিমিতি,ছন্দের স্পন্দিত মাধ্যমে, শাহীন রেজার কবিতা আমার ভেতরটাকে জাগিয়ে দিয়েছে, সৌন্দর্যময় ঐশ্বরিক ব্যথায়; মনে হয়,কবিরা পরস্পরের আত্মীয়। সে অনেককাল থেকে চেনা। যখন শাহীন রেজা কবিতায় বলেন —-

বাজারে যাবো না শেলী সকাল হলে/
মাংসের দোকান থেকে উড়ে আসা মাছি/
চশমার কাঁচ ঘেঁষে প্রণয়ের কথা বলে/
ঘিন ঘিন শুয়োর নাচে,মনে হয় দূরে গিয়ে বাঁচি।/

বাজারে যাবো না শেলী পাজামাটা তুলে রাখো আজ/
কবিকে কি মানায় বলো ছেঁড়া চপ্পলের সাজ?/

সত্যিইতো, কবির ব্যক্তিত্ব আলাদা। কবি সমাজের দর্পণ। রাষ্ট্রের সত্যিকারের নেতা একজন কবি-ই… কবির আলাদা কোনো লিঙ্গ থাকতে নেই। অথচ এখনকার কবি নামধারীরাই কবির সম্মানহানি করেছে। কে কাকে খারিজ করে দেবে, মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেবে এমন অপতৎপরতার সময়ে আমি পাঠ করলাম,বলতে পারেন আকণ্ঠ সৌন্দর্যে ডুব দিলাম ‘শাহীন রেজার নির্বাচিত ৫০ কবিতা’ গ্রন্থে। লেখকরা এখন কলমে লিখে না,আঙ্গুলের স্পর্শে লেখে,আবার বেশিরভাগ সেটাও না করে সবসময় একটা অদৃশ্য কাঠি রাখে একাডেমিক শিক্ষিত হয়ে। সে কাঠি দিয়ে কারো বুকে,পিঠে, পাছায় সারাক্ষণ গুঁতাতে থাকে। চেঁচাতে থাকে ‘ এর কবিতা হচ্ছে না,ওর কবিতা হচ্ছে না’, এ কী কবি…’
এসব তর্ক যাঁর মুখ থেকে শুনি, প্রারম্ভেই উনার প্রতি সারাজীবনের বিতৃষ্ণা জন্মে। সত্যিকারের ছোটলোক মনে হয়। কেননা কবিতা কখনো পুরোপুরি খোলাসা করার বিষয় নয় যখন, সরাসরি কবিতা হয় না বলাটা চরম মূর্খতা। আমি মনে করি, কবিতা হয়ে ওঠা বলতে কবিতার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। প্রাণহীন কবিতা কখনো ভাবাও উচিত নয়,যদি আপনি কিছু একটা লেখে কবিতা বলে চালিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে শাহীন রেজার কবিতা আমার সাথে কথা বলেছে,কেঁদেছে, হেসেছে এমনকি জাগতিকজ্ঞানের সবকিছু আলাপও হয়েছে। এটা জানার জন্য কবির কবিতাগুলো পড়তে হবে,যতক্ষণ কবিতা পড়বেন কবির নামটি মেধা ও মননে না এনে; তারপর আপনার ভাবিত কল্পজ্ঞানের সুরাহা পেতে পারেন। শাহীন রেজার কবিতায় প্রাণ আছে এটা জোর দিয়ে বলার কারণ হচ্ছে,শাহীন রেজা তাঁর কবিতায় প্রাণহীন কোনোকিছুতে মজেননি, এমনকি প্রাণহীনতাকেও প্রশ্রয় দেয়নি। প্রকৃতির এক নির্ভেজাল কবি,হৃদয়ের কুঠিরে উনার ভাবমগ্নতা মাটিসংলগ্ন হয়ে তারুণ্যের প্রতীকী ;
আরেকটা কথায় এখন বাজার সয়লাব যে,এখনকার কবিতা ছন্দের নয়। এটা একটা ফ্যাসাদপ্রিয় মানুষের অতি বাড়াবাড়ি,কেননা কবিতা যদি হয়ে ওঠে সেটি আর ছন্দহীন নয়। সেটি বাজারের ছন্দেরও অধিক শক্তিশালী। কবির কাজ নতুন ছন্দ তৈরি করা,জোরপূর্বক তথাকথিত ছন্দ মানা নয়। সেক্ষেত্রে শাহীন রেজার কবিতাকে আমার অগ্রগামী মনে হলো। কখনো কখনো শাহীন রেজার কবিত্বের মেধায় চমকে ওঠেছি,এই বয়সে এসে নিজের বোধকে ভাঙতে ভাঙতে এগোচ্ছেন। কয়েকটি কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবেন–

ক.
সে জানে ছায়ার ভিতর আলিঙ্গন উষ্ণ ক্রমশ/
রোদের ভিতর জন্মের পোড়া কাঠ; /
– দ্বিতীয় দরজা; ১৪পৃ.)

খ.
অসতর্ক জোছনায় রমণীরা যেন মাছ,পুরুষেরা সাহসী ধীবর।
– অসতর্ক জোছনায়;২১ পৃ.)

গ.
বাকীপথ যেতে হবে এভাবেই/
বুকের সুড়ঙ্গ ঘেঁষে একটি হলুদ সাপ/
শুয়ে আছে বহুকাল মরা নদীটার মতো।
– কিছু মেঘ কিছু রোদ;২৯ পৃ.)

ঘ.
শহরের সবগুলো বৃক্ষ আমার নয়/
আমাকে তাই বাধ্য হয়ে ধার করতে হয় ছায়া,
– ছায়া; ৩৫ পৃ.)

০২.

এখনকার কবিতার ভাবপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো পরাবাস্তবতা। কীভাবে এক সত্যকে অন্য সত্যে নান্দনিকতার উপর্যুপরি বলয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে একেকজনের কবিতা। যাঁকে আমি বলি ঠেঁস কথা। অথচ অনেকের কবিতা তাতে এতো দুর্বোধ্য আর অনর্থক বাড়াবাড়ি হয়ে ওঠে যে, পাঠকদের হতাশায় পর্যবসিত করে। চরম বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। শাহীন রোজার কবিতার মধ্যে পরাবাস্তবতার আড়াল থাকলেও সেটি প্রাণবন্ত ; কেননা শাহীন রেজার কবিতার বিষয় মাটি,মানুষ ও প্রকৃতি আর জল মেঘ বৃষ্টি অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই, অনেকক্ষেত্রে পরাবাস্তবতার বলয়টি ছিন্ন করে দিয়েছে কবিতার মধ্যে সত্যিকারের আন্তরিকতা ; চিত্রকল্পে শাহীন রেজার কবিতাকে বেশ সুখকর মায়াবী পর্দার সিনেমা মনে হয় আর উৎপ্রেক্ষায় বেশ মার্জিত ; ‘শাহীন রেজার ৫০ কবিতা’ গ্রন্থের কিছু কবিতা তাৎপর্যে বিশেষকরে উল্লেখিত, ‘কেন ভুল পথে যাবো’ কবিতাটি শাহীন রেজার নিজের পছন্দের কবিদের সাথে ভাবপূর্ণ হৃদয়াত্বক কথাবার্তা পাঠকমাত্র বেশ উপভোগ করবে। তেমনি ‘আচ্ছালাতু খয়রুম মিনান নাঊম’ কবিতাটি কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা বেশ সুনিপুণ দক্ষতায় উঠে এসেছে। তেমনি ‘শক্তির অন্দরে একদিন’ কবিতাটিও পাঠকরা মজিয়ে পড়তে পারবেন। আবার,শাহীন রেজা কবিতায় অসৎ সঙ্গকে বেশ নাকানিচুবানিও দিয়েছেন সারল্যের ভাষায়। এসব খুঁজে বের করা সহজতর নয়,অন্তত ‘শাহীন রেজার ৫০ কবিতা’ গ্রন্থের ‘চুরুট’ কবিতাটি এক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তদুপরি শাহীন রেজাকে আমার মনে হয়,চিরযৌবনের আপাদমস্তক প্রেমের কবি… ভালোবাসায় কতটুকু রসায়নী তাৎপর্য এঁটে তিনি নিত্যনতুন কবিতা লিখতে পারেন এককথায় অসাধারণ; বিরহকে কী দারুণ দ্যোতনাময় করে তোলেন, কিছু নমুনা দিতে দিতে আমার লেখা শেষ করছি —

ক.
ছিলাম দাঁড়িয়ে আমি সেই সত্যনগর
চারদিকে গণিকারা যেন অজগর
আমাকে চেয়েছে তারা ক্ষুধা ও রতিতে
রাত্রি দিনের মাঝে তীব্র ক্ষতিতে
– সত্যনগর; ৯ পৃ.)

খ.
দুঃখ ছিলো না,দুঃখ থাকে না কোন
বর্ষা শুধু ভিজিয়েছে বনপথ
অনাগত সব মুহূর্তই প্রজাপতি
আষাঢ়েও তাই গতিময় দ্বৈরথ।
– দ্বৈরথ ;১৩ পৃ.)

গ.
একটি পাতা আমার হাতে একটি পাতা বুকে
একটি পাতা রাত্রি জাগে বনমহুয়ার সুখে

একটি পাতা চিতায় জ্বলে একটি পাতা ঠোঁটে
একটি পাতা প্রেম হলো যে সব পেমিকের ভোটে।
– একটি পাতা ;৫২ পৃ.)

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কাজী জহিরুল ইসলাম এর কবিতা
এড. শাহানারা স্বপ্না on লেট ফ্যাসিজম
Adv. Shahanara on যুদ্ধশিল্প