spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যরবীন্দ্র-জীবনানন্দ মিলছে না

লিখেছেন : মজিদ মাহমুদ

রবীন্দ্র-জীবনানন্দ মিলছে না

মজিদ মাহমুদ 

ইদানীং অনেক কবি সাহিত্যিকের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে– তারা কবি হিসাবে যখন যুগল নাম উল্লেখ করছেন, তখন উনিশ বিশ শতকের কবিদের গোদা হিসাবে রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের নাম উল্লেখ করছেন। এমন উল্লেখ করবার বিষয়ে তাদের স্বাধীনতা ষোল আনা। তারা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কুমুদরঞ্জন বা করুণানিধানের নাম উল্লেখ করলেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু সাহিত্যের মান্যতা যেহেতু ব্যক্তি মতের উপরে নির্ভর করে না, সেহেতু ব্যক্তির নৈরাজ্য কেবল তার মানসিক প্রবণতা হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকে।

এক অজ্ঞাত কারণে, আধুনিকযুগের বাংলা কবিতার নির্মাতারা জোড়া পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মাইকেলের জুটি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাবের পরে সে যুগের অবসান হয়ে রবীন্দ্র-নজরুলে পরিণত হয়েছে। নজরুল এত দুর্বার বেগে রবীন্দ্র সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথও তার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বীকার করে নিয়েছিলেন– তার শক্তিমত্তা, তেইশ বছরের তরুণ কবিকে বই উৎসর্গ থেকে নানা রকম প্রশ্রয় দিয়েছিলেন– সেটি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আর কাউকে দেননি। যখন তিরিশের কবিরা নজরুলরের সমবয়সী হয়েও রবীন্দ্রনাথের মুসাবিদা করে বেড়াচ্ছেন, তখন নজরুল গুরুর সঙ্গে লড়ছেন রীতিমত ষাঁড়ের লড়াই।

রবীন্দ্র-ভাণ্ডারী রবীন্দ্র আধিকারিকদেরও টপকে রবীন্দ্র গানের গায়কির স্বাধীনতাটুকু আদায় করে নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া একে একে নজরুল-চমকে কিছু সময়ের জন্য অন্যরা আলোহীন হয়ে পড়েছিল, সে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তই হোক, আর মোহিতলাল মজুমদারই হোক। তিরিশের কবিরা তখন কেবল রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় ক্রোলিং করছেন। ১৯২৭ সালে নজরুলের কাব্য জীবনের শেষ প্রান্তে তারই বয়সী জীবনানন্দ দাশ নানা দ্বিধা ও সংকটের মধ্যে ১৯২৭ সালে ‘ঝরা পালক’ লিখে ফেললেন। নানা দ্বিধা নিয়ে বোদ্ধাজনদের সমীহ কাড়ার জন্য পাঠালেন। কেউ তেমনটি সাড়া দিলেন না। আর দেয়ার মতো মাল-মসলা সেখানে ছিলও না, হয় সেখানে নজরুল অথবা কিছুটা সত্যেন্দ্রনাথ -মোহিতলাল রয়ে গেছে। হতাশ কবি থেমে যাননি ১৯৩৬ সালে ঠিকই এক মাইল ফলক তৈরি করে ফেললেন, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি।’ বাংলা কবিতায় নিজস্ব জায়গা করে নেয়ার পথে তার প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি তার ভাগ্যে সুপ্রসন্ন ছিল না। 

প্রথমবারে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘তোমার কাব্যশক্তি আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে জবরদস্তি করো কেন বুঝতে পারি না।’ হায় রে বেচারা! তবে পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসুদের প্রচারে কিছুটা মত পরিবর্তন হয়েছিল ঠাকুরের, ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি পড়ে বলেছিলেন– ‘চিত্ররূপময়’ — বলেছিলেন এটি তাকে আনন্দ দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতির সঙ্গে নিশ্চয় নির্ভর করে না– জীবনানন্দ দাশ বা অন্য কারো কবি প্রতিভার মান্যতা।

আজ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। নগর কাব্যজনের কাছে– বিশেষ করে যাদের হৃদয়ে একাকীত্ব ক্ষয়িষ্ণু হতাশার বেদনা বাসা বেঁধেছে জীবনানন্দ দাশ তাদের একমাত্র পুরোহিত। সেখানে রবীন্দ্রনাথও কলকে পান না। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ছোটত্ব বা বড়ত্ব নিয়ে আমার এই আলোচনা নয়। আমার বলার বিষয়– রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে যখন জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে ব্র্যাকেটবন্দি করা হয়। জীবনানন্দ দাশ হতে পারেন তাদের কাছে, কিংবা সত্যি সত্যি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী ও শক্তিমান কবি, সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুগল উচ্চারণে কেবল রবীন্দ্রনাথকে করুণা করা। কিংবা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের কারণে তাকে বাইরে রেখে কারো নাম বলা তাদের সাহসে কুলিয়ে উঠছে না।

আমার কথা, যে কারণে বর্তমানে তাদের দৃষ্টিতে নজরুল তার তাঁর সমসাময়িকরা ক্ষয়িষ্ণু ও অনুল্লেখ্য, সেই একই কারণে রবীন্দ্রনাথও অনেকটা ক্ষুণ্ণ। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ তাই রবীন্দ্র মর্যাদার জন্য উপযুক্ত বিচার করা যায় না। 

রবীন্দ্রনাথ যে কারণে এখনো সবার শীর্ষে সে কেবল তার কবিতার জন্য নয়। তার বিশাল সঙ্গীত জগত, ছোটগল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য আর সাংগঠনিক ক্ষমতা। যার কোনটাই জীবনানন্দ দাশের ছিল না। সাংগঠনিক ক্ষমতাহীন একজন মার খাওয়া মানুষ– গান রচনা তাঁর জীবনেও হয়ে ওঠেনি। কবিতা ছাড়া অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমে খুব সফল তাও বলা যাবে না। সেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার আকাশ তোমার বাতাস’ এখনো সর্বব্যাপ্ত শাসন করে যাচ্ছে, কবিতার নাম গন্ধ ছাড়াই, রাষ্ট্রচিন্তা, চিত্রকলা, ঔপনিবেশিক চেতনা, শিক্ষা চেতনা, শান্তি নিকেতন– আরো কত কত কি! সেখানে হয়তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজ অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। হয়তো অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিতে কবিতায় জীবনানন্দ দাশই সেরা। সেখানে দয়া করে রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত করা, তার বিশালতাকে অপমান করারই শামিল। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টিশীলতা সম্পন্ন হয়েছে, বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে। জীবনানন্দ দাশের শুরু বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, অনেকটা ১৯৫৪ সালের পরে। পাশাপাশি নাম উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমকাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন সুনীল-শক্তি, রাহমান-আল মাহমুদ; তেমন জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব বা জীবনানন্দ দাশ- সুধীন্দ্রনাথ হলে যুৎসই হয়।

আমার বিবেচনায়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদি কোনো নাম যুক্ত করার দরকার হয়– সেটা নজরুল– আর কেউ নন। অন্য কিছু বাদ দিলেও এই দুই কবি মিলে যে সুরের জগত নির্মাণ করেছে– যার বিলয় নেই। সব সাহিত্যের, শিল্পকর্মের গায়ে একদিন সময়ের আঁচড় লাগবে, কিন্তু তাদের সঙ্গীত থেকে যাবে। আজ পরিবর্তিত সময়কালে রবীন্দ্রনাথ যে কারণে টিকে থাকবেন, নজরুলও সেই কারণে টিকে থাকবেন ইতিহাস ও বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায়। দুইজনের বিশাল প্রাণশক্তি, এবং ভিন্ন রকমের হলেও ব্যাপক সাংগঠনিক ক্ষমতা।

তাই আমার মনে হয় নজরুলের স্থলে জীবনানন্দ দাশকে রবীন্দ্রনাথের বামে বসাতে চান, তাতে জীবনানন্দ দাশ সম্মানিত হয় না। বরং রবীন্দ্রনাথ ক্ষুণ্ণ হন।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ