মীর সালমান শামিল
একদম ভিন্ন পেশা থেকে এসে সাংবাদিকতায় সফলতা বা সারাজীবন সফল ইঞ্জিনিয়ার, সফল ডাক্তার ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে সফল সম্পাদক হয়েছেন এমন উদাহরণ খুব বেশি নাই। ফরিদ জাকারিয়া লেখক থেকে ওয়াশিংটন পোস্ট, এবং সিএনএনের সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদক পল স্ট্রেইগার, সেটারডে ইভিনিং পোস্টের এডিটর জর্জ হোরস লরিমার এই দুইজনই ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, পরে সাংবাদিকতায় আসেন। বাংলাদেশে শফিক রেহমান চার্টার্ড একাউন্টেন্ড থেকে সাংবাদিকতায় এসেছেন।
তবে মাহমুদুর রহমান সবার থেকে আলাদা। তিনি কোন রকম সাংবাদিকতা না করে সরাসরি ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে একটা সাধারন পত্রিকাকে দেশের জনপ্রিয়তম পত্রিকায় পরিণত করেন। মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে একের পর এক গ্রাউন্ড ব্রেকিং নিউজ হতে থাকে। স্কাইপি কেলেংকারি ফাঁস, বিচার বিভাগের দুর্নীতি, শাহবাগ, ব্লগারদের মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারনা নিয়ে প্রতিবেদন ইত্যাদি ইত্যাদি। ২০১৩ সালে যখন দেশের একটা বিশাল অংশ শাহবাগে বুদ হয়ে আছে, বাকীর চুপ। প্রতিটি টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র শাহবাগের বন্দনায় ব্যস্ত, তখন মাহমুদুর রহমান প্রধান শিরোনাম করেন, ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। আজ আমরা হাড়, অস্থিমজ্জা দিয়ে অনুভব করতে পারছি কতটা সঠিক ছিলেন।
আরব বসন্ত, মিশরের তাহরির স্কয়ারের কারনে সারা বিশ্বেই রাস্তায় বসে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করা একটা রোমান্টিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এর পুরো সুবিধা নেয় নাস্তিক, ইসলাম বিদ্বেষী, ভারতপন্থী গ্রুপগুলো। শাহাবাগ থেকে একের পর ইসলাম, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, মাদ্রাসা, এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ দাগানো হতে থাকে।
তখন মাহমুদুর রহমান প্রথম উন্মোচন করেন ভারতের সাথে শাহবাগের সম্পর্ক, আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের ব্লগে রাসুলুল্লাহ পাককে নোংরাতম প্রচারণা এবং এর ফ্যাসিবাদী চরিত্র। মানুষ আস্তে আস্তে সচেতন হতে শুরু করে। আলেম সমাজ সচেতন হন, জন্ম হয় ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের’। এবং মানুষ পুরোপুরি শাহবাগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যখন শাহবাগের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছিলো না তখন মাহমুদুর রহমান একাই থামিয়ে দিয়েছিলেন শাহাবাগিদের মচ্ছব। তিনি শাহাবাগি শব্দটাকে এমন ন্যারেটিভে দাঁড় করেছেন যে এখন শাহবাগে তিনবেলা পরে থাকা কাউকে শাহাবাগি বললেও সে বরাহের মত চিৎকার করে উঠবে।
ডজন ডজন টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, এবং শয়ে শয়ে বুদ্ধিজীবী এক ব্যক্তির কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। স্বাভাবিকভাবে ফুঁসে উঠে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘আমার দেশে’র সাংবাদিকদের উপর হামলা হতে থাকে, ‘আমার দেশ’ বহনকারী গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর চলে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা, হয়রানিমূলক, এবং হাস্যকর মামলা দায়ের করা হয়। এতেও কাজ না হলে সরকার ‘আমার দেশ’ অফিসে হামলা করে ভাঙচুর চালিয়ে পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। মাঝরাতে একটা প্রতিষ্ঠিত দৈনিকের সম্পাদককে তার অফিস থেকে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এই ধরনের অশোভনীয় ঘটনা বিরলতম।
সরকার শুধু গ্রেফতার করে ক্ষান্ত হয়নি তাকে রিমান্ডে নিয়ে অকথ্যভাবে অত্যাচার করা হয়। ২০১৩ সালে ১৯ এপ্রিল বিবিসি বাংলা রিপোর্টে ফরহাদ মজহার বলেছিলেন,
❝ আমি নিজে তাঁর প্রত্যেকটা হাত ধরে দেখেছি। দু’হাতের কবজিতে গোল দাগ এবং ক্ষতের চিহ্ন দেখেছি। তাঁর পায়ে আমি ক্ষতের চিহ্ন দেখেছি। তিনি অত্যন্ত দুর্বল এবং উঠতে পারছিলেন না। ফলে আমি তাঁর কানের কাছে গিয়ে কথা বলেছি। তবে তিনি নির্যাতনের কথা বলতে চাইছিলেন না। কারণ আবারও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হতে পারে। এমন ভয় তাঁর মধ্যে রয়েছে। ❞
অত্যাচার মাত্রা এতটা ভয়াবহ হয় যে এমনকি মুসলমানদের বিরোধী সংগঠন Reporters Without Borders উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রদান করে। তারা বলে,
❝ মাত্র কিছুদিনের মধ্যে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, প্রতারণা, পুলিশের কাজে বাধা, একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের পোস্টার ছাপা এবং এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। আমরা মনে করি তিনি রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার এবং আমাদের ভয় যে এটা হচ্ছে একজন বিরোধী পক্ষের সামনের সারির ব্যক্তিত্বকে হয়রানি। এবং পুরানা কায়দায় গণতন্ত্র বিরোধী চর্চার দুঃখজনক প্রত্যাবর্তন। আমরা তার মুক্তি দাবি করছি। ❞
তবে মাহমুদুর রহমানের এটাই প্রথম গ্রেফতার না। ভারত/আমেরিকার প্রযোজিত ১/১১ সরকার রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তিত্বদের পাইকারি ভাবে গ্রেফতার করে দেশে বি-রাজনীতিকরন শুরু করে, সামরিক বাহীনির ভয়ে সবাই চুপসে যায়। তখন হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তি এই মচ্ছবের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ফরহাদ মজহার, নুরুল কবির, এবং মাহমুদুর রহমান থাকবেন সেই তালিকার সর্বাগ্রে। তার শক্তিশালী কলম দিয়ে একের পর এক কলাম লিখতে থাকেন। তাতে নড়ে যায় ভারত থেকে নিয়ে ঘোড়া নিয়ে আসা জেনারেলেদের ভীত।
ভারতের মধ্যস্থতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে এবং বিরোধীদের উপর স্টিমরোলার চালানো অব্যাহত রাখে। মাহমুদুর রহমান তার বিরুদ্ধেও তার কলাম লিখে যান। ২০১০ সালে হাস্যকর মামলায় গ্রেফতার করা হয়। একজন সম্পাদককে গ্রেফতার করা হল। অন্য সাংবাদিকেরা চক্ষু লজ্জা দেখিয়ে একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেয় না। বাহিরে থাকাকালীন তারা কেউ মাহমুদুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু লেখে নাই। তিনি গ্রেফতার হবার পর তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মাহমুদুর রহমানকে ব্যঙ্গ করে অভিহিত করে ‘বাইচ্যান্স সম্পাদক’ বলে। কয়েক মাস জেল খেটে মাহমুদুর রহমান মুক্তি লাভ করেন।
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল পুনরায় গ্রেফতার হোন। এবার কয়েক বছর বিনা অপরাধে কারাগারে আটক থাকেন। তবে তিনি কারাগারে বসে ছিলেন না। পড়াশোনা এবং গবেষণা চালিয়ে যান। কারাগারে বসেই তিনি লেখেন, ❝ The Political History of Muslim Bengal: An Unfinished Battle of Faith. ❞
ড. মোহাম্মদ মোহর আলীর ❝ History of Muslims in Bengal. ❞ এর পর এটাই বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে এটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ বই। এই বইয়ে মাহমুদুর রহমান মুসলমান রাজনৈতিক উপ্যাখ্যান বিবৃত করেছেন।
শুধু বাংলাদেশ না উপমহাদেশ, এবং সারাবিশ্বে মুসলমানদের উপর যে জুলুম চলছে সে ব্যাপারে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে তথ্যভিত্তিক বিস্তারিত লিখেছেন মাহমুদুর রহমান। তার একটা প্রবন্ধ, “মুসলমানদের মানবাধিকার থাকতে নেই” জনপরিসরে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলো।
প্রায় ৬ বছর পরে ২০১৯ সালে মাহমুদুর রহমান মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই আবার মিথ্যা মামলার হাজিরার সমস্যার মধ্যে পরেন। একই বছরের ২২ জুলাই তিনি ৫০০ ধারার একটি মানহানির মামলায় জামিনের জন্য গতকাল কুষ্টিয়া আদালতে হাজির হয়েছিলেন।
আদালত প্রাঙ্গনেই পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডার বাহিনী মাহমুদুর রহমানের উপর প্রাণঘাতি হামলা করে। তার সাথে থাকা সহকর্মীরা কোন মতে প্রাণ বাঁচান। তিনি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোন। এর কিছুদিন পর তিনি দেশ ছাড়েন।
এখন তিনি তুরস্কে বসবাস করছেন। “The Political History of Muslim Bengal: An Unfinished Battle of faith” ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। জেল থেকে জেলে, নবরূপে বাকশাল, দুর্নীতিমুক্ত দেশ : সমাজ চিন্তকদের ভাবনা, ১/১১ থেকে ডিজিটাল, জয় আসলে ভারতের তার বিখ্যাত রচনা।
আজ মাহমুদুর রহমানের জন্ম দিন। এই দিনে তাকে শুভেচ্ছা।
“বিষ নিশ্বাসে জিন্দিগী ফের কেঁদে ওঠে বিস্বাদ
নতুন পানিতে সফর এবার হে মাঝি সিন্দবাদ!”
……..
লেখক : গবেষক, ব্রেমেন ইউনিভার্সিটি, জার্মানি।