চর্যাপদের ১০টি কবিতা
১.
কচ্ছপ দোহনে উপচে উঠেছে পাত্রখানি
গাছের তেঁতুল খেয়ে গেল জলের কুমীর
উঠোন জুড়ে তোমাদের সংসার,
বধূ শোনো,
তোমার কানের দুল চুরি গেছে কালরাতে
নিয়ে গেছে কোন চোর
সংসারের প্রবীণলোকেরা ঘুমিয়ে অঘোর
জেগে আছো শুধু তুমি বধূটি, একাকী
বল,কার কাছে খোঁজ করা যায় চুরির অলংকার
দিনদুপুরে কাকের ভয়ে মূর্ছা যাও
অন্ধকার গাঢ় হলে সেই তুমি কামমত্ত হয়ে ওঠ গভীর গোপন
চর্যার কবি সে কথা ভাসিয়ে দিল
কতটুকু তার বুঝেছ বল, কোটিতে একজন!
২.
একসাথে দুজনকে নিয়ে শুঁড়িকন্যা ঘরে ঢোকে
সুপুরি ছালের বাখরে ফেনিয়ে ওঠে দিশি মদ।
শান্ত-নিবিড় ফেনিল সেই গেঁজে ওঠা,
যাতে অজরামর দৃঢ় হয় ঘাড়গর্দান।
দরজায় দাঁড়িয়ে গন্ধ শোঁকে সেয়ানা মাতাল
নিমেষে ঢুকে যায় ঘরের অন্দরে
তারপর চৌষট্টি ঘড়ায় ছোটে অঢেল ফোয়ারা।
কেউ আর ঘর ছেড়ে বাইরে আসেনা
ছোট এক ঘড়া বেয়ে নেমে আসে সরু নল
চর্যার কবি বলেন নিবিষ্ট থাকো এই আয়োজনে।
৩.
জঙ্ঘা চেপে রেখে যোগিনী আলিঙ্গন করে
সমস্ত সময় কেটে যায় পদ্ম আর বজ্রের আশ্লেষে
যোগিনী, এক মুহূর্ত তোকে ছাড়া বাঁচবে না এ জীবন…
চুম্বনে চুম্বনে পান করি তোর ললনা রসনা।
শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধক রেখেছি, থেমে গেছে চন্দ্র সূর্য
কবি গুডরী বলে,সে যৌনমিলনে নিবিষ্ট আবেশ
নর ও নারীর মাঝে থাক পোশাকের আড়ালটুকু…
৪.
ভবনদী বয়ে যায় গভীর গহনলোকে
দুপাশ কর্দমাক্ত মাঝখান অথই গহীন।
ধর্মের আয়োজনে অদ্বিতীয় এক সাঁকো তৈরি
করেছেন চাটিল
পারগামী ভক্ত যাতে পার হতে পারে।
মোহবৃক্ষ ছেদন করে তৈরি তার পাটাতন, অদ্বয়কুঠারে।
সাঁকো পারাপার কালে বামে কিংবা দক্ষিণে ঝুঁকোনা
মোক্ষ তোমার সামনে, কেন তুমি দূরে যাবে
তুমি পারগামী হতে চাও—
সিদ্ধাচার্য চাটিলকে জিজ্ঞাসা কর পথের ঠিকানা।
৫.
কাকে ছাড়ি…কাকেই বা ধরে রাখি বল, কী ভাবে
চারিদিক ঘিরে কিসের এত হাঁকডাক !
হরিণ, তোমার শরীরই তোমার শত্রু,জেনো
ভুসুক কখনো শিকার পেলে ছাড়ে না…
হরিণ চুপচাপ, ঘাসে মুখ দেয়না, জল স্পর্শ করেনা
হরিণ জানেনা কোথায় তার হরিণীর বাস…
সতর্ক হরিণী বলে, শোন, এখনি এ-বন ছেড়ে চলে যা তুই! নিমেষে বিদ্যুৎবেগে ছুট দেয় ভয়ার্ত হরিণ
উড়ে যায় তার ছুটন্ত ক্ষুরধ্বনি।
ভুসুক জানায় কেউই বুঝল না এর মর্মার্থ ঠিকুজি।
৬.
আলিতে কালিতে পথ রুদ্ধ হয়ে আছে
বিমনা কাহ্ন ভেবে পায়না কোথায় নিবাস হবে তার ..
ইন্দ্রিয়জ্ঞানীরা সত্য সম্পর্কে উদাস থেকে গেল
তারা স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কিংবা কায়-বাক্য মন কিংবা
দিবস সন্ধ্যা রাত্রি এই তিন সংখ্যার প্রতিনিধি…
তারা সংখ্যায় তিন এবং এই তিনই হল ভিন্ন…
কাহ্ন বর্ণনা করে এই জগৎ-সংসার পরিচ্ছিন্ন
যারা এসেছিল তারাই আবার চলে গেল।
এই আসা-যাওয়ার সারাৎসার, কাহ্ন জেনেছে
বিশুদ্ধ মন মহাসুখের সমীপবর্তী হতে পারে
কিন্তু কাহ্ন-হৃদয়ে তা প্রবেশ করেনি।
৭.
ছোট নৌকোখানি ভরে গেছে সোনার অলংকারে
রুপো রাখার ঠাঁইটুকু সেখানে নেই আর
কামলি, তুমি শূন্য আকাশপথে নৌকা বাও
গতজন্মের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে বুঝি
খুঁটি উপড়ে রাখ,মেলে দাও কাছি
কামলি, তুমি সদগুরুকে জিজ্ঞাসা কর
জেনে নাও বেয়ে যাওয়ার পথ…
নৌকার গলুই ধরে ওই দেখ দেখা যায় সমস্ত চরাচর
দাঁড় নেই, বৈঠাবিহীন এ নৌকা কিভাবে এগোবে,
সমস্ত পথ মিলেমিশে বাম-ডান একাকার হল
পথই তবে কি মহাসুখ মিলনকুঞ্জ, বল…
৮.
দুদিকের স্তম্ভ ভেঙে ফেলে ছিন্নভিন্ন হল বন্ধন
মদমত্ত কাহ্ন বিলাসে খেলায় পদ্মবনে ছুটে যায়
যেন জলকেলি প্রমত্ত হস্তী ছোটে হস্তিনীর দিকে।
মত্ত হৃদয় নৈরাত্মায় এসে পারমার্থিক তথতা বিলায়।
ভাব-অভাবে আর কেশাগ্র পার্থক্য থাকে না।
দশদিক জুড়ে অক্লেশ পরমার্থ আহরিত হল।
৯.
নগরের বাইরে, ডোমনি তোর কুঁড়েঘর
তুই কেবল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস সেই ব্রাহ্মণ বালককে
ডোমনি, তোর সঙ্গে আমি সাঙ্গা করব
আমি ঘৃণাহীন যোগী, নগ্ন কাপালিক।
এক পদ্মফুলের চৌষট্টি পাপড়ি—
সেখানে ডোমনি আর কাহ্ন নাচ দেখাবে
ওলো ডোমনি, বল তো তুই কার নৌকোয়
রোজ রোজ যাস আর ফিরিস?
রোজ তুই তাঁত আর চাঙাড়ি বেচে বেড়াস…
ডোমনি শোন, তোর জন্য আমি হাড়ের মালা পরেছি
পুকুরঘাটে একা তুই বসে বসে মৃণাল খাস
আমার দুচোখে তোর সর্বনাশ ঘুমিয়ে আছে।
১০.
নাড়ীশক্তিকে দৃঢ়ভাবে খাটে আটকে রাখা গেল
চারিদিকে বীরনাদে বেজেছে ডম্বরু
কাপালিক সাজে যোগী কাহ্ন বসেছে যোগাচারে
দেহবল্লরী ভাসে দেহের বাসরে।
লোকজ্ঞান পায়ের নূপুর হয়ে বাজে
চন্দ্র-সূর্য সেজেছে কর্ণের অলংকার।
মোহ-রাগ-বিদ্বেষ দগ্ধ হলে সেই ভষ্ম দেহের ভূষণ—
পরম মোক্ষ তখন মুক্তহার হয়ে দোলে।
শাশুড়ি ননদ শালিকে বধ করে ঘরে ফেরে—
তারপর মাতৃহত্যা ক’রে কাহ্ন কাপালিক হল।