| মাহমুদ নোমান |
নির্ভেজাল আকুতি শুনতে এগিয়ে এসেছি যেন,আবার ঠিক আকুতিও নয় কেমন সহজ সরল কথার প্রস্ফুটিত সৌন্দর্যই হাইকেল হাশমীর কবিতা; এমন কাছে টানতে পারে কিলবিল কিলবিল দ্বিধার দুনিয়াতে দ্বন্দ্বের সামিয়ানায়! আচমকাই উদ্বেলিত করেছে হৃদয়ের আশপাশে যেন সেই নদী- বয়ে আসে ভালোবাসা যোগাতে এবং ভালোআপদ বিলাতে…
এখনকার কবিতা মানে আড়ালের আড়াল, সত্যের অনেক অনেক সত্য এবং ভুলে যাওয়া আসল সত্যে ফিরতেই হয়; কেমন শব্দের মোচড়ানি, কেমন শব্দের উগ্রতা, কেমন মিলনে মিলিত হওয়ার আশে একতরফা খেলে যাওয়া পার্টনারের কিচ্ছুটি তোয়াক্কা না করে, এইরকম মানসিক টর্চার এখনকার ভুবন ফাঁড়া কবিতা, তাই বুঝি হাইকেল হাশমী কবিতা বইয়ের নাম রেখেছেন ‘ শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন’… এই যেন কবি হাইকেল হাশমী নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন নিজের কাছে,তাই বইয়ের নাম ‘সত্তার কাছে চিরকুট’…
আপনার আশপাশের সচরাচর শব্দের বন্ধন প্রীতি সম্মিলন, কোনও তদবির নেই শব্দের খোঁজে, পরিচিত আপন ‘শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন’ যেন হাইকেল হাশমীর কবিতায় আবদ্ধ হল; সাদামাটা দৃশ্যের স্ফূর্তিতে মজে গেছে উপমার সারল্য, অতিক্রমে সূর্যের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠে ভাবিত কল্পজগত আর চমক জাগানিয়া ধাঁধা-
ক.
প্রতীক
অনুরূপ
উপমা
এগুলি দিয়ে তোমাকে বর্ণনা করা যাবে না তাই
তোমাকে বর্ণনা করতে আমি ধার করেছি
নদী
আকাশ
সমুদ্রের
- তোমার খোঁজে;১৩ পৃ.)
খ.
জীবনের
উঁচু নিচু পথ
যদি সমতল হয়ে যায়
তবে
ই সি জি’র সোজা দাগের মতো
জীবন
থমকে দাঁড়ায়!
- সমতল জীবন;২০ পৃ.)
গ.
কতদিন হলো তোমার সাথে দেখা নাই
হ্যাঁ, তোমার সাথে দেখা করতে চাই
তোমাকে বলতে চাই
ওহ জীবন সম্বন্ধে
যেটা ছিটানো, ছড়ানো তোমার আশে-পাশে।
তোমাকে বলতে চাই
ওই শিশিরসিক্ত লাল গোলাপের কথা
যেটা লুক্কায়িত আছে তোমাদের হৃদয়ের মাঝে।
হ্যাঁ, তোমাকে জানাতে চাই
কেন আমার মন বীণার তারে
তোমার হাসির সুর বাজে
দিনে আর রাতে
- বলতে চাই ;৭৩ পৃ.)
ঘ.
প্রত্যেক সামগ্রীর মতো
মানুষেরও একটি মেয়াদ উত্তীর্ণের সময় আছে।
সব সামগ্রীর মতো
মানুষেরও একটি ‘শেল্ফ লাইফ আছে।
সকল সামগ্রীর মতো
মানুষেরও একটি কার্যকরী জীবন আছে।
মেয়াদ উত্তীর্ণের পর সামগ্রী যেমন বিষাক্ত হয়ে যায়
মানুষও নিজের জন্য
অন্যের জন্য বিষাক্ত হয়ে যায়।
সে আর কারোর প্রয়োজনে লাগে না
সে একটি নিষ্প্রয়োজন সামগ্রীর মতো
কখনো এই তাকে কখনো ঐ তাকে
তার পর পিছনে ‘স্টোর রুমে’ চলে যায়,
- জীবনচক্র; ২২ পৃ.)
হাইকেল হাশমীর কবিতায় মূল চালিকা শক্তি উনার ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ ও ইঙ্গিত ‘শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন’ থেকে উপরোক্ত কবিতা ও কবিতাংশগুলো পড়লে বুঝা যায়; হালকা মাল মসলা দিয়েও কেমন মজলিস তোলপাড় রন্ধন করা যায় হাইকেল হাশমীর কবিতা পড়লে বুঝতে পারবেন, এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যের চান্স নেই; তদুপরি প্রয়োজনের উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি ও পরিবেশনা পাঠকমনে আনন্দ দেবে। ‘শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন’ কবিতা বইয়ে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটন-পরিবেশ করোনার সময়কাল নিজস্ব ছাঁচে গড়া সত্যি উপলব্ধি গাম্ভীর্যে উপস্থাপন, অন্যরকম টিউনিংয়ে সহজবোধ্য; ‘আইসোলিশনের অনুধ্যান’ নামের চারটি কবিতা বেশ জমিয়ে দিয়েছে বইটিকে, উন্মোচনের দ্বার বিবেচিত কবিতাটি পড়া যাক –
এখন বারান্দায় বের হলে
গাছে বসা কাক আর কার্নিশে বসা চড়ুই
আমাকে দেখে উড়ে যায়।
আগে যারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো
কখন আমি তাদের জন্য ছিটাবো চাল বা গম;
এবং তারা উড়ে এসে খাবে,
আগে রাতের বেলা
একটি ছোট ইঁদুর ভয়ে ভয়ে
এদিক ওদিক ছুটতো
এখন তারও কোন খোঁজ নেই।
তবে কি জেনে গেছে
মানুষ এখন সংক্রামক ব্যাধির উৎস
তাদের থেকে দূরে থাকা উচিৎ
- সামাজিক দূরত্ব; ৩৫ পৃ.)
ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আর মিথেরই আশ্রয় এবং বিচলিত পৃথিবীর যোগাযোগ, বিষয়-আশয় বিশ্লেষণপূর্বক উপলব্ধ হাইকেল হাশমীর কবিতায় ধরা পড়ে; হালকার ওপর দাগ টানা রোমান্টিসিজম জড়াজড়ি করে থাকে মিছরি মধুকর হ’য়ে; অন্তত এখনকার কবিতাতে অস্থির সময়ে পাঠকমনে স্বস্তি দেবে এই ধরণের কবিতা…
||
শব্দের স্বেচ্ছা নির্বাসন
হাইকেল হাশমী
প্রকাশনা- অভিযান
প্রচ্ছদ – মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য – ৩৫০ টাকা
অমর একুশে বইমেলা ২০২৩