আবু তাহের সরফরাজ
বাংলাদেশে যে যত বেশি জনপ্রিয়, তার প্রতিভা নিয়ে তত বেশি সন্দেহ করার সুযোগ রয়েছে। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ হুজুগে। নিজের চিন্তাকে একটু খাটিয়ে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সূক্ষ্মবোধ এ জাতির নেই। জাতির এই চরিত্র শামসুর রাহমান ফুটিয়ে তুলেছেন তার ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায়। চিল কান নিয়ে গেছে। কানে হাত না দিয়েই চলছে ছোটাছুটি। মিটিং। বন-বাদাড় পেরিয়ে ছুটে চলেছে চিলের খোঁজে। এই দেখে ছোট একটি ছেলে বললো, কান তো কানের জায়গাতেই আছে। মিছেমিছি খুঁজে চলেছো। সত্যিই মিছেমিছি গুজবের পেছনে ছুটে চলে বাঙালি। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে গণমাধ্যম জনগণের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। গণমাধ্যমের প্রচারেই তৈরি হয় যে কোনো ব্যক্তির জনপ্রিয়তা। আসলে জনপ্রিয়তার ভেতর কৌশলগত এক রকম ফাঁকি রয়েছে। বিশেষ করে সাহিত্যে। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক কাগজগুলোর সাহিত্য সাময়িকী হাতেগোণা কয়েকজন সাহিত্যিকের উপনিবেশ। এসব লেখককেই প্রতি সংখ্যায় ঘুরে-ফিরে প্রচার করে সাময়িকীগুলো। ভাবখানা এমন যে, তাদের প্রচারিত নামগুলো ছাড়া দেশে আর কোনো সাহিত্যিক নেই। বইমেলা এলে বইয়ের যে সংবাদ তারা প্রচার করে সেখানেও ওইসব লেখকদের বাইরে আর কোনো লেখকের বইয়ের হদিস থাকে না। অথচ তারা যাদেরকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রচার করছে তাদের কারো কারো সাহিত্যমান খুবই নিম্নমানের। তাদের যোগ্যতা হচ্ছে, হয় তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর, না-হলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। গণমাধ্যম তাদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়। বিনিময়ে তাদেরকে প্রচার করে। এই ডামাডোলে বঙ্গের কবিসমাজ এখন রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত। বঙ্গের পাঠককুলের যেহেতু নিজস্ব শিল্পবোধ ও রুচি এখনো গড়ে ওঠেনি, সেহেতু সাময়িকীগুলোর বারবার প্রচারিত নামগুলোকেই তারা দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক হিসেবে মান্য করতে শুরু করে। জনপ্রিয়তার ভেতর লুকনো বেচাকেনার সূক্ষ্ম শিল্প বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। দেখা যাচ্ছে, যে যত জনপ্রিয় সে তত বেশি অমেধাবী। অবশ্যি সকলেই নয়, তবে বেশিরভাগই এমন।
নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি কামরুজ্জামান কামু। জনপ্রিয় হলেও তার প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ করার কোনোই সুযোগ আমাদের নেই। কারণ, তিনি ক্ষমতাধর কোনো মানুষ নন। না রাজনৈতিকভাবে, না প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। যদি তাই-ই হয়, তাহলে গণমাধ্যম কোন লাভের আশায় তার কবিতা ছাপে? লাভের বিষয়টি হচ্ছে, কামুর কবিতার প্রচুর পাঠক। কামুর কবিতা ছাপলে ওই সংখ্যাটির পাঠকও বেড়ে যায়। কামুর পাঠকপ্রিয়তা আজকের গণমাধ্যমের রমরমার আগে থেকেই। বঙ্গের আরসব কবি থেকে এখানেই কামুর স্বাতন্ত্র্য। কবিতা প্রচারের জন্য কামু কখনোই দৌড়ঝাপ করেননি। প্রচার-মাধ্যমই নিজেদের স্বার্থে কামুর কাছে এসেছে। গণমাধ্যম ও সাহিত্যিকদের লেনদেন-কারবারের বাইরে কামুর অবস্থান। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে থাকতেই তার কবিতা ঢাকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোয় ছাপা হতে থাকে। কামুর কবিতার প্রসাদগুণ এমনই যে, সেই সময় থেকেই তার কবিতা পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতার ভেতর অনুভূতির সহজ-সরল প্রকাশ পাঠককে মুগ্ধ করে। গ্রাম্য প্রকৃতির সরল সরসতা তার কবিতাকে নব্বইয়ের দশকের আরসব কবিদের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করে। সেই সঙ্গে রয়েছে ছন্দের সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। ফলে, তার কবিতার ভেতর শৈল্পিক পর্যটনে পাঠকের আনন্দ হয়। কবিতার এই শিল্প-সুষমাই কবি হিসেবে কামুকে এনে দ্যায় বিশেষ খ্যাতি। এই খ্যাতিকে ছাপতেই দৈনিক পত্রিকাগুলো কোনো লেনেদেন ছাড়াই কামুকে গ্রহণ করে নেয়। অবশ্য এসব গ্রহণ-বর্জনের তোয়াক্কা কামু করে না। কারণ কামু জানেন, কবিতার প্রকৃত পাঠককে তার কবিতার সান্নিধ্যে আসতেই হবে। কামুর এই আত্মবিশ্বাস অহঙ্কার নয়, শিল্পীর শিল্প-যাপনের মর্মবোধ।
বেশিরভাগ কবিই গ্রাম থেকে জীবিকার প্রয়োজনেই হোক কিংবা কবিখ্যাতি পেতেই হোক, পাড়ি জমায় ঢাকার বুকে। প্রথমদিকে গ্রাম্য প্রকৃতির সরলতা ও ঘ্রাণ তাদের আচরণে ও কবিতায় ফুটে উঠলেও জটিল নাগরিক জীবনে ধীরে-ধীরে সেসব মুছে যায়। গ্রাম্য সরলতার কারণে কেউ কেউ হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। ফলে, ব্যক্তিজীবনে তারা যান্ত্রিক মানুষ হয়ে আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে চেষ্টা করে। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে তাদের কবিতায়। প্রকৃতির নিবিড় সুর হারিয়ে তাদের কবিতা হয়ে ওঠে নাগরিক জীবনের ক্লেদ-কুসুম। এবং কারো কারো ধারণা হয় যে, নগর-কেন্দ্রিক অনুভূতি কবিতার ভেতর ছড়িয়ে দিতে পারলেই সেটি আধুনিক কবিতা। গ্রাম ও প্রকৃতির অনুষঙ্গ আধুনিক কবিতায় এখন আর চলে না। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় বসতি গড়ে তুললেও কামুর ভেতর কখনোই এই পরিবর্তন ঘটেনি। তার অন্তর্জগতে সবসময়ই প্রতিপালিত হয়েছে গ্রাম্য প্রকৃতি। প্রকৃতির সরলতা তাই তার কবিতার সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির উদারতা তার কবিতাকে দিয়েছে আবহমান বাংলা কবিতার আদল। দাদা খায়রুজ্জামান বকসী কণ্ঠে ছোটবেলায় তিনি শুনতেন বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি। সেই সুর তার ভেতর কী রকম হাহাকার ছড়িয়ে দিতো। বিষাদ সিন্ধুর কাহিনি শুনে বাংলার ঘরে ঘরে নারীদের হাসান-হোসেনের জন্য কেঁদে বুক ভাসানের দৃশ্য তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। গ্রামে বেড়ে ওঠার কারণে প্রকৃতির গহনের সুর তার অন্তঃকরণে অনুরণিত হতে থাকে। গ্রামীণ দৃশ্যগুলো তার চোখে শ্যামলিমা হয়ে এখনো রয়ে গেছে। নিজের গ্রাম্য-সরলতা নিয়ে তার ভেতর নগর-কেন্দ্রিক কোনো হীনমন্যতা নেই। বরং, গ্রাম্য-সরলতাকে তিনি পরম আদরে তার ভেতর প্রতিপালন করেন। ফলে তার কবিতায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের দ্যোতনা ছড়িয়ে থাকে। যা এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগেও পাঠকের হৃদয়কে তাড়িত করে। সেই সঙ্গে রয়েছে ছন্দের অনবদ্য দুলুনি। এই অর্থে কামুকে বলা যায় বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের উত্তরসূরী। ছন্দ বাংলা কবিতার আদি ঐতিহ্য। সেই চর্যাপদ থেকেই ছন্দের আনন্দে কবিতায় শব্দের বুনন চলে আসছে। যেসব কবিতা এখনো বাঙালির মুখে-মুখে ফেরে সেসব কবিতার বেশিরভাগই ছন্দে রচিত। বলা হয়ে থাকে, ছন্দই হচ্ছে কবিতার প্রাণ। এই বলাটা যথার্থ। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় বাঙালি যতই যান্ত্রিক ও জটিল সিস্টেমে ঘুরপাক খাক, ছন্দোবদ্ধ সহজ-সরল কবিতা এখনো বাঙালি পাঠকের আন্তরিক আতিথেয়তা পায়। প্রমাণ, কামুর কবিতা। তার কবিতার মতো সুখপাঠ্য কবিতা নব্বইয়ের দশকে আর কেউ লিখতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। আর কারো কবিতায় কামুর কবিতার মতো সরলতা ও সরসতা আমার চোখে পড়েনি। নব্বই-উত্তর দশকগুলোর কবিদের কবিতাতেও নয়। বরং পরবর্তী দর্শকে অনেক কবিই তার কবিতার অনুগামী হতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শব্দের বুনন ছাড়া কামুর কবিতার মতো প্রাণ-স্পন্দন সেসব কবিতায় অনুপস্থিত।
ছন্দ কামুর মজ্জাগত। শিশুর সারল্যও কামুর প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই দুইয়ের সম্মিলনে কামুর কবিতা শিল্পের যে সৌন্দর্য মেলে ধরে, সেই সৌন্দর্য আবহমান বাংলা কবিতার সৌন্দর্য। শিল্প-সচেতনা ও সূক্ষ্ম মেধার কৌশলে কামু সেই সৌন্দর্যকে সমকালের যাপিত জীবনের সঙ্গে রাঙিয়ে তোলেন। ফলে, তার কবিতা হয়ে ওঠে এই সময়ের কবিতা। আমাদের যাপিত-জীবনের শিল্প-উপাদান। কামুর প্রথম বইয়ের নাম ‘কবি মুখপত্রহীন’। এই বইয়ের ‘ফড়িং দিন এবং দৃশ্যাবলি’ কবিতাটি পড়া যাক।
ফড়িংয়ের পিছনে ছিল খড়কুটো এবং দুপুর। তাহাদের ঘিরে বৃক্ষগুলি চক্রাকারে ঘুরিতেছে। ভূমির পিছনে দৃশ্য। খড়ের পিছনে দৃশ্য। গরুর পিছনে দৃশ্য। দৃশ্যের পিছনে এই সর্বময় দৃশ্য সমাহার। মাইল ফলকে গেঁথে ছিল এক ব্রহ্মচারী দাঁড়কাক। মহিষের পিঠে অলস সঙ্গীত রচে সোনালি ফড়িং। তাহাদের দিনগুলি দ্রষ্টব্যে চক্রাকারে ঘুরিতেছে। ব্রহ্মচারী। অদ্ভুত স্বর-বিন্যাস। আমারও অনেকগুলো দিন ফড়িং এবং খড়ের পিছনে প্রতিধ্বনিময় মুহূর্ত উদ্ভিদ।
কবিতাটি পরার পর কৈশোরিক দিন-যাপনের এক-টুকরো ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দুপুরবেলা। ফড়িংয়ের পেছনে ছুটছে এক কিশোর। কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে। তাদের সাথে সাথে গাছপালাও যেন ঘুরছে। ভূমি, খড় ও গরুর পেছনে প্রকৃতির নানা উপাদানের দৃশ্য। সেসব দৃশ্যের পেছনে সকল দৃশ্যের সমাহার যেন। সড়কে মাইল ফলকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি দাঁড়কাক। কামু বলছেন, কাকটি ব্রহ্মচারী। বলার কারণ, দাঁড়কাকটি সকল জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। তার মতো করে কিশোর কামু ঘুরতে পারে না। নিঝুম দুপুরের ভেতর থেকে উঠে আসছে প্রকৃতির নিবিড় সুর। কৈশোরিক বিস্ময়ে কিশোর ছেলেটি কান পেতে সেই সুর শুনতে চেষ্টা করে। তার মনে হয়, মহিষের পিঠে বসে সোনালি ফড়িংটিও যেন প্রকৃতির সুরে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। প্রকৃতির সকল কিছুর দিনগুলো চাকার মতো ঘুরছে। সকলেই সকল জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিশোর কামুরও অনেকগুলো দিন কেটে গেছে ফড়িংয়ের পেছনে। এই যে স্মৃতি-কাতরতা, এই যে প্রকৃতির গহনে কান পেতে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হওয়া— কামুর কবিতার এই বৈশিষ্ট্য প্রথম বই থেকেই পাওয়া যায়। এই বইয়ের কয়েকটি কবিতায় ছন্দের বিন্যাস থাকলেও কিছু-কিছু কবিতা গদ্যের ফর্ম্যাটে আমরা দেখি। যা পরের কোনো বইতে তেমনভাবে চোখে পড়ে না। ছন্দের নিবিড় আন্তরিকতায় তার কবিতাগুলো পাঠকের হৃদয়বাড়ি বসবাস করে। দ্বিতীয় বই ‘অহেতু গুঞ্জনমালা’তে কামুর কবিতা আরও টানটান ও সরল কথার ব্যঞ্জনায় অভিনব হয়ে ওঠে। এই বইয়ের ‘অহেতু গুঞ্জনমালা’ কবিতায় কামু লিখছেন:
এহেন ঘটনাকালে কী জানি কী ছিল ভালে
শত্রু এসে ভাই নামে ডাকে
আগে পিছে ঢোঁক গিলি কী ভাই তু কোথা ছিলি
তুঁহুঁ বিনা ফল নাহি পাকে
তুঁহুঁ বিনা বক্ষমাঝে নানামুখী বাদ্য বাজে
কোনো বাদ্য স্মরণে না রয়
অহেতু গুঞ্জনমালা তোমার নিলয়ে বালা
বায়ুপথে প্রচারিত হয়।
বাংলা কবিতার এই ভঙ্গি ও ভাষারীতি ঐহিত্যগত। আবার, কিছু শব্দও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বহন করছে। এ ধরনের অনেক শব্দই কামুর কবিতায় আমাদের চোখে পড়ে। তবে কামুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেসব শব্দ বেশ মজা করে কামু উপস্থাপন করেন। ফলে পড়তে গিয়ে মনে হয়, কামুর কবিতাই পড়ছি, আর কারো নয়। অনেকেই পাঠকের কাছেই ঐতিহ্যগত এই ভাষাশৈলীকে সেকেলে মনে হতেই পারে। তবে তাদের ভেবে দেখা দরকার, বাইরে থেকে দেখতে মোড়ক একই রকম হলেও ভেতরের চকলেটের স্বাদ নতুন, যা পাঠক এর আগে পায়নি। কামু যেহেতু বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে ধারণ করেই শুরু করেছেন তার কাব্যযাত্রা, সেহেতু তার পাঠকেরও অভাব ঘটেনি এখনো পর্যন্ত। যারা বুঝদার পাঠক, কামু তাদের কাছে আদরণীয়। প্রকৃত পাঠক জানেন, নব্বইয়ের দশকের আরসব কবিদের মতো নিরস শব্দের কারুকাজ কামুর কবিতায় নেই। ‘অহেতু গুঞ্জনমালা’ থেকে এবার দুটি কবিতা পড়া যাক:
গ্রাম-সালিশির রাতে, পুনরায় প্রকৃত সিঁধেল
ঘরে ঢুকে, অন্ধকারে তোমাকেই ধান ভেবে
জড়িয়ে ধরেছে
তুমির নিথর ছিলে, ধান ছিল
আশেপাশে ছড়ানো-ছিটানো।
‘প্রেমিক’
সেদিনই বুঝেছি আমি, আহতের চেয়ে বেশি
টান ছিল নিহতের প্রতি।
তথাপি তোমাকে এই পদ রচনার কালে বলে রাখি,
ভেবে দেখো, বিবাহের বহুদিন পরে
ক্লিশে জীবনের ফাঁকে, মাঝে মাঝে
অন্য কোনো ধানের লাবণ্য দেখে টলে যাওয়া
কত সাবলীল!
‘পরকীয়া’
মানুষের আদি প্রবৃত্তিকে কত সাবলীলভাবেই না ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দুটি কবিতায়! পণ্ডিতি দেখিয়ে শব্দের ঘোরপ্যাঁচ নেই। সহজ কথা সহজেই বলে দিচ্ছেন কামু। তবে সেই বলার ভেতর পাঠককে ভেবে নেয়ার একটু স্পেস তিনি রেখে দিয়েছেন। এতে করে কবিতার সঙ্গে পাঠক নিজের ভাবনাকে একীভূত করতে পেরে আনন্দ পায়। ধান কাটা শেষ। ঘরে-ঘরে ধান মজুদ। এই মওসুমে বাড়ি বাড়ি ধানচোরের উপদ্রব বেড়ে যায়। ধানচোর ধরা পড়েছে। তার বিচারে যে রাতে গ্রামে সালিশ বসে সেই রাতেই আবার প্রকৃত সিঁধেল ঢুকে পড়ে একটি বাড়িতে। বাড়ির বউকে সে জড়িয়ে ধরে ধান ভেবে। বউটি কিন্তু নিথর হয়ে পড়ে রইল। কোনো সাড়া-শব্দ করলো না। এর দুটো মানে আমরা ধরে নিতে পারি। এক. বউটি ভয়ে চিৎকার করেনি। দুই. লোকটি ছিল আসলে বউটির প্রেমিক, ধানচোর নয়। এমনটি ভেবে নেয়ার কারণ, কবিতার শিরোনাম ‘প্রেমিক’। ঠিক এর পরের কবিতাটিতে বউটির স্বামী বলছেন, সেদিনই তিনি বুঝেছেন, আহতের চেয়ে নিহতের প্রতি বেশি টান ছিল। এই ‘টান’ শব্দটিও পাঠককে টানটান করে তোলে। এরপর তিনি বলছেন, বিয়ের অনেক দিন পর দাম্পত্য যখন ক্লিশে হয়ে যায় সেই সময় আরেক নারীর লাবণ্য দেখে টলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। যৌন-তাড়নার এই দ্বান্দ্বিক অনুভূতি ফ্রয়েডীয় লিবিডো চেতনাকে ফুটিয়ে তোলে। যৌনতার এহেন রূপ পাঠক হিসেবে আমাদের স্বস্তি দ্যায় না।
কামুর তৃতীয় বই ‘মামুজির নৌকায়’। এই বইতে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে কামুর আকুলতা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। পাঠকও কামুর প্রতি এক ধরনের আত্মীক টান অনুভব করেন। পৃথিবীতে মানুষের জীবন একার যাত্রা নয়। এখানে সকলে মিলেই একসাথে আমাদের যাত্রা। কিন্তু জীবন-সংগ্রাম প্রত্যেকের একার। কেউ কাউকে ভবনদী সাঁতরাতে হাত বাড়িয়ে দেবে না। এই সত্য ছন্দোবদ্ধভাবে শব্দের বুননে ‘বাংলা নদী’ কবিতায় গেঁথে তুলেছেন কামু।
নৌকায় চড়িয়া মামু পাল তোলে নৌকায়
উপরে আকাশ তাতে বিদ্যুৎ চমকায়
চামড়ায় চমক লাগে চর্বিতে গমক
ছোট তরী তাতে চড়ি নানামুখী লোক
হৃদয়-বাণিজ্য-সুধা নদীতে বিলয়
যে কোনো মুহূর্তে যদি নৌকাডুবি হয়
ঢেউয়ের ঝাপ্টায় নৌকা তক্তা হয়ে যদি
চারদিকে ছড়ায়ে পড়ে এই ভরা নদী
এই খরপরশায় এয়সা ক্ষুরধারে
মামুজি সাবধানি লোক অ-নিত্য সংসারে
হয়তো তরায়ে যাবে সকলেই ভাবে
যে-যার মতন করে সকলে সাঁতরাবে
যে-যার মতন করে তীরের সন্ধানে
সংগ্রামিবে যাত্রিগণ সম্মুখের পানে
তাহে মামু গাহে গান বাতাসে মধুর
প্রতিধ্বনি ছলাৎছল সঙ্গীতের সুর
যাত্রিদের মঙ্গলের বার্তা হয়ে হয়ে
বাংলা নদী তার বুকে নৌকা যায় বয়ে
বাংলা নদীর ছলাৎছল ঢেউয়ের মতো কবিতাটির প্রতিটি শব্দে ছন্দের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ছন্দের ঢেউগুলো এতটাই পরিমিত যে, পাঠককে সেই ঢেউ মুগ্ধতার আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পড়ার সময় চুম্বকের মতো আকর্ষণ পাঠক টের পান তার ভেতর। কবিতাটি পড়ার পর কিছু সময় চুপচাপ ভাবতে বাধ্য হয়। আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় প্রতিটি মানুষই একজন আরেকজন থেকে পালাচ্ছে। প্রত্যেকের গলায় ঝুলে রয়েছে অদৃশ্য একটি নোটিশ। তাতে লেখা, ‘দূরত্ব বজায় রাখুন’। কিন্তু মামুজি এমনই একজন মানুষ যিনি মানুষকে একসাথে মিলিয়ে দিতে চান। তাই তো ছোট একটি নৌকায় মামুজি পাল তুলে দিয়ে বৈঠা নিয়ে বসেন। নৌকায় নানা শ্রেণির যাত্রি। আশঙ্কা ওঠে, হঠাৎ যদি ঝড় উঠে নৌকা ডুবে যায়! মামুজি ভাবেন, ঝড় উঠলে যে যার মতো করে সাঁতরে তীরে উঠবে। এই ভেবে মামুজি গান ধরেন। সেই গানের ভেতর দিয়েই তিনি যাত্রিদের মঙ্গলবার্তা হাওয়ায় ছড়িয়ে দেন।
‘তুমি মোর গোল্ডেন বিজনেস’ কবিতায় কামু লিখছেন:
নিঃসীম নৈঃশব্দ জুড়ে অতর্কিত ধ্বনির ব্যঞ্জনা
ভেসে এলো একা একা নাকি কোনো কবির কল্পনা
ভাসায়ে আনিল তারে পৃথিবীর এই পারে বঁধু
তোমার আমার ঘর আহরণ করি মোরা মধু
মহাবিশ্বে বিরাজমান নৈঃশব্দ হঠাৎই ধ্বনির ব্যঞ্জনা হয়ে ভেসে এলো। পৃথিবীর এক কোণে কামুর সংসার। সংসার থেকে কামু ও তার প্রিয়তমা মধু আহরণ করেন। পঙক্তিগুচ্ছ পড়ার পর মধু আস্বাদের তৃপ্তি পাঠকের মনেও সঞ্চারিত হয়। পাঠক বুঝতে পারেন, কুটিল ও জটিল এই মর্ত্যলোকে সংসারই মানুষের নিরাপদ আশ্রয়। ‘মামুজির নৌকায়’ বইয়ের কবিতাগুলোয় এরকম নানা অভিব্যক্তি কামু প্রকাশ করেছেন। সেসব অভিব্যক্তি জীবনবোধের গভীরতার দিকেই আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে। কামুর কৃতিত্ব হচ্ছে, শব্দকে ছন্দের দোলনায় চড়িয়ে আনন্দের ভেতর দিয়ে পাঠকের ভেতর তার স্বকীয় অনুভূতি সঞ্চারিত করেন। চতুর্থ বই ‘নিগার সুলতানা’তে কামুর এই প্রকাশ প্রগাঢ়ভাবে পাঠকের চোখে পড়ে। ‘মাতৃভূমি’ কবিতায় কামু লিখেছেন:
কে তুমি নিশুতি বাঙলাদেশের পাখির সুরে গো ডাকো
চি-আও! চি-আও! ধ্বনির আবেগে রাত জেগে বসে থাকো
না না পাখি নয় তারা নয় সে তো দুর্বিনীত নিগার
আমার হাড্ডি খুলে বাঁকা করে গড়ে সে নিজের হাড়
আমার শিশুরা দোলে তার কোলে যেন প্রকৃতির বুকে
বাদুর-ছানারা ঝুলে আছে কালো মাই চুষবার সুখে
যেন বকসারি আকাশের গায়ে রেখা টেনে চলে যায়
পূর্ণিমা রাতে সে যেন আমার মায়ের মাদুলি চায়
আমি খরগোশ কালো দাঁড়কাক সবুজ পাখির ডানা
ঝাপটাই যেন আকাশের মতো নীলরঙ শামিয়ানা
ফুলে উঠে ফের খুলে পড়ে যায় চৌচির বৈশাখে
আমি শুয়ে আছি কান খাড়া করে ঠাণ্ডা মাটির ডাকে
…………………………………………………..
সুখে চেপে ধ’রে রাখো তো আমারে মুখে চেপে ধ’রে রাখো
পলে ও বিপলে আতায় কাঁপালে ঘনীভূত হয়ে থাকো
দেখো আমবনে বটনির্জনে নিখিলনদীর কূলে
কামু ফিরে যায় ভ্রুণ হয়ে তার মায়ের নাভির ফুলে
মা, মাতৃভূমি ও প্রিয়তমা স্ত্রী এই কবিতায় একীভূত হয়ে অনিবর্চনীয় এক উপলব্ধির জন্ম দ্যায়। এই উপলব্ধি মানবিক সত্তা ছাড়িয়ে আধ্যাত্মিক বোধকে জাগিয়ে তোলে। এই বইতে নতুনভাবে কামুর প্রকাশ ঘটে। আগের বইগুলোতে যে কামুকে আমরা চিনেছি, এই কামু তার থেকে অনেক বেশি স্থির ও আধ্যাত্ম। সংসারের নিবিড় আলিঙ্গনে সুখের আনন্দে যে উদ্বেলিত। নিগার সুলতানাকে তিনি বলছেন, ‘বুকে চেপে ধ’রে দেখো তো জীবন কাঁপে কেন প্রিয়তম!’ জীবনকে নতুন রূপে নতুন বৈচিত্র্যে উপলব্ধি করেছেন কামু। এই উপলব্ধিই তার জীবনকে কাঁপিয়ে তুলছে। বিশ্ব ভুবনের মায়ায় জড়ানো এই যে লতায়-পাতায় নিবিষ্ট হয়ে বেঁচে থাকা, এই মায়ার তীব্র টান তিনি অনুভব করছেন। পঞ্চম বই ‘চেয়ে আছো’তেও কামুর এই যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই বইয়ের কবিতাগুলো কামুর অন্তর্জগতের নিবিড় উষ্ণতায় পাঠকের চিন্তার জগতে উত্তাপ ছড়াতে থাকে। ষষ্ঠ বই ‘আমি রোহিঙ্গা’তে কামুকে আমরা দেখতে পাই মানবতাবাদী একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে। ‘আমি রোহিঙ্গা’ কবিতায় তিনি লিখছেন:
আমার এই নাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেল
নাফ নদী যাক ভেসে
আমার রক্ত ছিটকে পড়ুক
ওপারে বাংলাদেশে
আমি মানুষ না আমি রোহিঙ্গা
আমাকে হত্যা কর
আমার আল্লাহ বড় বেরহম
নাই কোনো ঈশ্বর
মিয়ানমার থেকে প্রাণ মুঠোয় নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন দরদি ভাষায় আর কেউ কি কবিতা লিখেছে? গণমাধ্যম প্রচারিত কতই কবি তো আমাদের রয়েছে? কারো বুকে কি মানবতার এই আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে? আজকে গাজায় নির্বিচারে মুসলিমদেরকে হত্যা করে চলেছে ইহুদিরা। এমনিভাবে নানা সময়ে নিজ ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে মানুষকে। ইতিহাসের সেই বর্বোচিত অধ্যায় রোহিঙ্গাদের ভেতর প্রতিফলিত হতে দেখলেন কামু। তার ভেতর থাকা শিশুর সরলতা আহত হলো। এই বইতেই কামুর মৃত্যু-চেতনার প্রচ্ছন্ন প্রকাশ ঘটে। ‘এ বাদলে আমি তব হব অনুরাগী’ কবিতায় তিনি লিখলেন:
…………….
হঠাৎ হসন্তসম
হস করে থেমে
তক্তা ’পরে শুয়ে রবো
কোনো রবিবারে
কিংবা কোনো সোমবারে
মৃত্যু হতে পারে
তোমার আমার কিংবা
যে কোনো কারোই
………………….
সাজ্জাদ শরিফ কিংবা
আনিসুল হক
তারাও তো মারা যাবে
পৃথিবীর বুকে
রাষ্ট্র ফেলে মারা যাবে
কামাল চৌধুরী
……………..
লক্ষ্যণীয় যে, এই কবিতায় কোথাও অন্তমিল নেই। অথচ কবিতাটি পড়তে গিয়ে পাঠকের সেদিকে খেয়ালই নেই। বরং মৃত্যুর মতো শাশ্বত ও অবশ্যম্ভাবী একটি চেতনা পাঠক মর্মে মর্মে অনুভব করে চলেছেন। যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, মৃত্যু সবারই হবে। মৃত্যু হবে জেনেও পুরস্কারের লোভে কবিদের যে ছ্যাবলামি তা নিয়ে কামুর কবিতা ‘ইন্ডিয়ান পুরস্কার’।
পুরস্কার পুরস্কার লাগবে নাকি ভাই
তোমারে একটা পুরস্কার দিয়াই দিতে চাই
ভারতবর্ষ ঘুইরা আসলা ভারত বঙ্গমাতা
এই ধর যে জয় গোস্বামী হইল তোমার ব্রাদার
এরচে বৃহৎ আর কী আছে— বাংলায় করবা রাজ
বাংলাদেশের আর কবিদের মাথায় পড়ব বাজ
কোলকাতা কি কোলকাতা ভাই কোলকাতা হয় ইন্ডিয়া
কোলকাতা যায় গোয়া মারাইতে বাংলাদেশের বিন্দিয়া
এ ধরনের বেশ কিছু স্যাটায়ার কবিতা কামু লিখেছেন। এসব কবিতায় খুব সহজ ভাষায় তিনি অসঙ্গতির প্রতি ইঙ্গিত করেন। এই যেমন ওপরের কবিতাটিতে তিনি বাংলাদেশের এক শ্রেণির কবিকে কটাক্ষ করে বলছেন, এরা কোলকাতা যায় আসলে গু* মারাইতে। না-হলে কলকাতায় এদেও কাজ কি? কলকাতা থেকে ঢাকায় নামি কবিদের এনে অনুষ্ঠান করা এবং নিজেদের গলায় তাদের হাত দিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে নেয়া। আবার কলকাতায় গিয়ে তেলাতেলি করা। কবিদের এহেন বেহায়াপনা কামুকে অস্বস্তি দ্যায়। কারণ, কামু নিজেও কবি। কলকাতা গিয়ে গু* মারা দেয়া কবিদের থেকে বড় কবি।
সপ্তম বই ‘আমাকে এবার পিছমোড়া করো’তে এসে কামুর স্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। মনে হয় যেন, সর্বভূতে কবি হিসেবে কামু নিজেই বিরাজ করছেন। সকলের সমুদয় যন্ত্রণা ও দুঃখতাপ কামু ধারণ করছেন নিজ সত্তায়। এই সত্য আমরা উদ্ঘাটন করতে পারি যখন কামু লেখেন:
পৃথিবীর বুকে আমি সেই কবি
আমি সেই চণ্ডাল
আমি সেই লোক কালো ও বধির
আমার রক্ত লাল
আমি সন্ত্রাসী আমি ধর্ষক
আমি ধর্ষিত নারী
আমি তোরই ছেলে বুকে তুলে নে মা
ফিরেছি নিজের বাড়ি।
ওপরের পঙক্তিগুলো পাঠে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, কামু যেন হাজরে আসওয়াদ। জগতের সকল পাপ শুষে নিয়ে যে পাথর নিজেই কালোবর্ণ ধারণ করছে ধীরে ধীরে। কামু একইসঙ্গে ধর্ষক ও ধর্ষিত নারী। মানবিকতার কোন পর্যায়ে একজন মানুষের উত্তরণ ঘটলে এই রকম উপলব্ধি তিনি করতে পারেন, তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের দরকার আমাদের হয় না। সকল শ্রেণির মানুষের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনকে নিজের ভেতর ধারণ করে কামু এবার ফিরতে চান নিজের বাড়ি। নিজের বাড়ি বলতে কামু আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছেন? এর উত্তর পাওয়া যাবে তার অষ্টম বই ‘এখানে শিয়ালমুখী ফুল হয়ে ফুটে আছো’র ফ্ল্যাপে। কামু লিখেছেন, ‘ওগো ফুল, হৃদয়ের ইসমে আজম, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমার নামেই এই কবিতার বইয়ের নাম দিলাম এখানে শিয়ালমুখী ফুল হয়ে ফুটে আছো। যেদিন মরে যাব, সেদিনও বিষণ্ণ মনে এইভাবে তুমি ফুটিও বাংলায়।’ মনে পড়ছে সেই বিখ্যাত গানটি, এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে/সুন্দর এই পৃথিবী থেকে একদিন চলে যেতে হবে। মরমের উপলব্ধি টের পাওয়া যাচ্ছে কামুর সাম্প্রতিকতম কবিতাগুলোতে। এসেছে জীবনবোধের মাত্রাজ্ঞান। প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হয়েছে কামুর কাব্যসৃজন পদ্ধতি। কবি হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও এই স্থিতি যে কারো জন্য জরুরি।