তাজিমুর রহমান
শার্ল বোদলেয়ারের পর কবিতার যে
আধুনিকতার পর্ব শুরু হয়েছিল,তারপর থেকে কবিতা জগত বিভিন্নভাবে আলোড়িত। এই আলোড়নের প্রভাব বাংলা কবিতাও এড়াতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে বলা যায় বোদলেয়ারের হাত ধরে কবিতায় যে তরঙ্গ ধেয়ে এসেছিল সেই ধারায় স্নাত হয়ে বাংলা কবিতাও তার গতিপথ চালিত করেছিল। সুতরাং বহমান ওই ধারায় বাংলা কবিতা আজ আধুনিক অধ্যায় ছাড়িয়ে উত্তর আধুনিকতাকে পর্যন্ত অতিক্রম করে ফেলেছে বলে বিবর্তনের এরকম প্রেক্ষাপটে বাংলা কবিতার মূল্যায়ন করা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।
তাসত্ত্বেও বলতে অসুবিধা নেই যে, জীবনানন্দ উত্তর বাংলা আধুনিক কবিতায় যে বৈপ্লবিক বিবর্তন লক্ষ্য করা যায় সেই হিসেবে বলতে পারি বাংলা কবিতা বিশ্ব কবিতার ভুবনে অবশ্যই আলোচ্য ও তুল্য মূল্য বিচারে শিরোধার্য। এরকম প্রেক্ষিত মনে রেখে আমরা এমন একজন কবিকে নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি যাঁকে নিয়ে তেমন করে কখনো ভাবা হয়নি।কবি আবদুস শুকুর খান। সাতের দশকের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। যাঁকে নিয়ে বাংলা কবিতার এই খোলা প্রান্তরে আলোচনা করা আবশ্যক বলে মনে করি।তবে এক্ষেত্রে কবি নন,কবিতাই হবে মূল প্রতিপাদ্য।
কবির সঙ্গে পথ হাঁটার কি কোন নির্দিষ্ট সময় থাকে! কবি তো এক অর্থে বিশ্বপথিক। তার সঙ্গে পথচলা অর্থ মহাজাগতিক ভ্রমণ। এই ভ্রমণের পথে হঠাৎই ডাক দিলাম কবি আবদুসকে। জানতে চাইলাম জীবনের অসমাপ্ত কবিতাটি কি লেখা হলো? অর্ধচেতনায় তন্ময় কবির ঠোঁট মৃদু নড়ে উঠলো- “কবিতার কাছে পৌঁছতে জীবন ফুরিয়ে এলো;তবু কবিতার কাছে পৌঁছানো গেল না! বুকের ভিতর থেকে গেল সেই অনন্য কবিতাটিকে না লেখার যন্ত্রনা।” (কবিতার বিষবৃক্ষ)।কিছুক্ষণ থামার পর আবার তাঁর স্বগতোক্তি:–
“আমি এক জীবন ধরে সেই কবিতার কাছে পৌঁছতে চাইছি। অন্যের মতো আমার সমাচ্ছন্ন জীবন বহন করে যাচ্ছি অলীক পথে।” (কবিতার বিষবৃক্ষ)।
স্বাভাবিকভাবে সেই অলীকপথে যাত্রার জন্য কবিকে আহ্বান জানালাম।আবহ ‘জীবনের অসমাপ্ত কবিতা’ থেকে ‘অনৃত ভাষণ’ পর্ব। অচিরেই কবি আবদুসের সঙ্গে কবিতা যাপনে আমার (আমাদের) পথ চলা শুরু হয়ে গেল। আবিষ্কারের গূঢ় নেশায় মুসাফিরের মতো যাত্রার শুভক্ষণে অন্বেষণে মাতলাম। লক্ষ্য অমৃত। কবিই হাত ধরে এগিয়ে দিলেন–
১. ‘জীবন দিয়ে শুরু জীবন দিয়ে শেষ তোমার/ শুধু আমাদের মাঝে বিশাল দুঃখের গাছ/ ছায়া হয়ে আছে,’
২. ‘…নিজেকে দেখলে মায়া হয়/ দুঃখ হয়,শুকনো হয়ে আছে ডালপালা/ শুকনো হয়ে আছে শরীর, মন।’ (জীবনের অসমাপ্ত কবিতা)।
জীবনের চড়াই-উৎরাই,দুঃখ,হতাশা,ব্যথা, আনন্দ,সুখ অনিবার্য। আবার আলোর প্রকাশে স্যাডোনেসও স্বাভাবিক। সেই স্যাডোনেস-ই পৌঁছে দেয় কবিকে আলোর বৃত্তে। কবি প্রস্তুতি নেন সেখানে পৌঁছতে। তাই ডালপালা অর্থাৎ হৃদিজন কিংবা আত্মার শরিকদের হারানোর বেদনায় কবির মন শূন্যতার আবহে ডুবে গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি যে সেখানে আসীন থাকবেন না তা জোর দিয়ে বলা যায়।কবি আবদুসও সেই ভাবনার অনুগামী হয়ে ওঠেন এভাবে–‘দিনের শেষে পৃথিবী কাঁদিয়ে বৃষ্টি এল,ঝড় এল’(জীবনের অসমাপ্ত কবিতা)।
যেন স্তবিরতা ভেঙে নতুন কিছু গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।ঝড়-বৃষ্টি তারই অনুষঙ্গ হয়ে রইলো এখানে।ফলে, হতাশা, দুঃখ, শূন্যতা সরিয়ে কবি জেগে ওঠেন সৃষ্টির নেশায়–
‘এভাবে সৃষ্টির গভীরে গিয়ে সৃষ্টি করেছি চাঁদ
জ্যোৎস্না, ফুল—শুধু কি ফুল?’(জীবনের অসমাপ্ত কবিতা)।
এ জিজ্ঞাসা কবির একার নয়।যে কোন সৃজনশীল মানুষের।জীবনে অপূর্ণতা থাকবে। তা যেমন কবিকে চঞ্চল করে,তেমনি চঞ্চল করে তাঁর ভিতরের অনুভূতিকে।তাই আত্মমগ্ন থেকে কবি হঠাৎ জেগে উঠে খোঁজ করতে থাকেন প্রিয়জনকে।কবি আবদুস বা তার বিপরীতে হাঁটবেন কিভাবে? তাই–
‘এমন পড়ন্ত বেলায় তোমার মুখ মনে পড়ে।
আলোর আল্পনা পড়ে জল তরঙ্গে– ভাবনার ভিতরে ঝিরঝিরিয়ে নামে বৃষ্টি আমি ভিজতে থাকি, ভিজে যেতে থাকি।’(পাখি)।
বুঝতে পারছি এ ভেজা বাহ্য নয়,ভিতরে ভিতরে সৃজনের শুকনো মাটি অনুভূতির তীব্র রসে সিক্ত হয়ে ওঠা। ভিজে কি যাচ্ছি না আমরাও! অদ্ভুত এক স্বপ্নিল আবহ যেন। যে আবহে আলোর আলপনা খচিত প্রকৃতি কবির মতো আমাদেরও স্নাত করে দিচ্ছে।
এই অবগাহনেও কবি চঞ্চল।ব্যথাকাতর। তাহলে কি কোন দহনে দগ্ধ হচ্ছেন? জানতে চাওয়ার আগেই এগিয়ে দিলেন কবি –
‘সে ফুলও নিল না,অশ্রুও নিল না দু’পায়ে মাড়িয়ে গেল, আমার অর্চনা।’ (ভোর)
এমন হতাশা,ব্যর্থতা কবি আবদুসের বহু কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে। তাতে কি? ব্যর্থতাই তো সার্থকতার ক্ষেত সৃজন করে। তাই কবির দীপ্ত ঘোষণা সব পুড়ে গেলেও জীবন পোড়ে না।কারণ,কবি জানেন ভালোবাসা সবকিছু আবার পূর্ণ করে তোলে। একটা নতুন জাগরণ ঘটে।কবি তাই বলেন—
‘পাতা পোড়ে ,কাঠ পোড়ে, জীবন পোড়ে না –
যতই মাটির গভীরে যাই ততই
ভালোবাসার টানে ফিরিয়ে দেয় মাটি। আমি থামি,সমাচ্ছন্নতায়, তাপে
মাটি ও অগ্নির বুকে,রৌদ্রাক্ত মানুষের মতো।’ (জীবন পোড়ে না)।
এই জীবন-ই কবির ‘জীবনের অসমাপ্ত কবিতা’-র মুল উপজীব্য। ফলে কাব্যের পাতায় পাতায় সেই জীবনের বহুমাত্রিক রূপ-ই মূর্ত হয়ে রয়েছে। সেখানে জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর আবহ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সিঁড়ি ভাঙা অংকের মতো জীবনের ওঠা-নামা, ভালো -মন্দের দিকটিও। ‘জীবন’ কবিতায় কবির উপলব্ধি –
‘আমি দেখেছি জীবনকে কলকাতার ফুটপাতে খুঁটে খেতে শষ্যের দানা
রাতের অন্ধকারে ফিরি হতে লালসার ঘরে–
আমি দেখেছি জীবনকে গ্রাম্য নারীর বুকে লজ্জার চাঁদ হয়ে
অন্ধকার হয়ে যেতে।’
জীবনের এই রুঢ় বাস্তব রূপ আসলে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতার ফসল। বলা যায় তার যাবতীয় সৃষ্টির ভরকেন্দ্র। নাহলে যে সাদা রং শান্তির বার্তাবাহক তা কেন, কিভাবে এক ভয়ংকর রূপ নিয়ে ফিরে আসছে তাঁর কবিতায়! গ্রাম্য নারীর বুকে লজ্জার চাঁদ হয়ে অন্ধকার হতে ইচ্ছুক কবির চোখে তাই তাই ধরা পড়ে সেই ভয়াল আঁধার – ‘চুপে দেশলাই জ্বালাতে গিয়ে – সরে আসে মানুষের
চামড়া পোড়ার
গন্ধ
মানুষের হিম্ মুখ,’(সাদা ঘোড়া)।
তাসত্ত্বেও কবি জ্বালিয়ে রাখতে চান হৃদয়ে আলো।যে সে আলো নয়,বিদ্যুতের আলো। যা চকিতে সবকিছু আঁধার ছিন্নভিন্ন করে খোঁজ দেবে নতুন দিশার।কবিও বলে উঠবেন এভাবে –
‘অরণ্যে কেউ প্রদীপ জ্বালে না–হৃদয় মমতার ঘরে
সহসা জ্বলে বিদ্যুৎ ‘(অরণ্য)
এই উপলব্ধিকে সঙ্গী করে কবি তৈরি করে নেন তাঁর সৃষ্টির আগামী অভিমুখ।যা তাঁর কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় প্রতীয়মান।
ব্যক্তিজীবনের আবদুস ও কর্মজীবনের আবদুসকে যাঁরা জানেন তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন প্রবহমান প্রচারের উগ্র আলো থেকে দূরে থাকা একাকি এক পরিব্রাজক তিনি। চারপাশের ঘটে চলা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে থেকেও আত্মনির্মাণে যেন এক ধ্যানমগ্ন নামাজী।আর এই বৃত্ত থেকে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক আইডেন্টিটি।যার ছটায় ম্লান হয়ে যাবেন অনেকেই; কিন্তু আবদুস থাকবেন তাঁর নিজস্ব ঘরানায় দীপ্ত।
সুতরাং, কবিকে ফেরাতে চেষ্টা করি তাঁর কবিতা বোধে।সাড়াও দেন তিনি –
‘একটা বোধের থেকে জেগে উঠি
একটা পাখি জন্মে ঘুমিয়ে পড়ি বারংবার।’ (বোধ, নবজন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে)।
এমন স্নিগ্ধ উচ্চারণে কবির মতো জেগে উঠি আমরাও। ‘পাখি জন্ম’ কবি একার কাম্য নয়। এই উজ্জীবিত প্রাণশক্তি সম্পন্ন জন্ম প্রতিটি মানুষের পাথেয়। তাই মৃত্যুর আবহ থেকে জীবনের পথে উত্তরণের যাত্রা কবির ‘নব জন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে’ কবিতাগ্রন্থে।কবি সত্যসন্ধানী। তিনি জানেন জীবনের পাশে মৃত্যু থাকবে।তা’বলে জীবন থেমে থাকে না।এই প্রত্যয়ী দৃষ্টিতে তিনি বিচরণ করেছেন অবলীলায় এই কাব্যের পাতায় পাতায়।যেন মৃত্যুর অবগাহনে এক জীবনপথিক আবদুস।পাঠকের হয়তো মনে পড়ে যেতে পারে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতাটির কথা।ধ্রুপদী শিল্পীর মতো মৃত্যু ভাবনাকে এক নান্দনিক শিল্প ভাবনায় উত্তীর্ণ করে দিয়েছেন কবি। তাই তাঁর নিবিড় উচ্চারণ –
‘প্রতিটি মানুষ যায় পৃথিবীর ঋণ মুছে দিয়ে
হাজার বছরের পথ ধরে হাজার বছর
মাটি ঘাস পাথর তৃণের বিস্ফারিত কুঁড়িটির মতো
অনন্ত পথে –চির শিল্প প্রবাহে
নিজেকে লুকাতে।’(ভিন্নতর খেলা)। আত্মগত এই উচ্চারণে কবি কি মর্মস্পর্শী করে মানুষের বিদায়ের পরও তাঁর শিল্পরূপটি চিরস্থায়ী করে তুললেন।যেন তুলি হাতে ক্যানভাসে এঁকে দিলেন নতুন দৃশ্য।
মানব জীবনের চলে যাওয়া দস্তুর, কিন্তু তারপরেই তার বেঁচে থাকা শিল্প সৃষ্টিতে।এ এক শাশ্বত সত্য। তাই কবির কথায় – ‘কিছুই থাকে না ধরা, মৃত্যু শোক, ভালবাসাবাসি
এ সব সত্য জেনে,তবুও
মৃত্যুর ভেতরে হেঁটে হেঁটে নবজন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে।’(নব জন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে)।
এ নবজন্ম যেন কবির নিয়তি। সত্যি কি তাই!না হলে কেনই বা তাঁর মগ্ন ও দার্শনিক উচ্চারণ–
‘কেন আমি বারংবার জন্ম নিই মাটি ও পাথর হয়ে –মাটিতে পুনর্বার।’ (নবজন্মে ফিরি মৃত্যুর বিষাদে)। এই মাটি জন্মলাভে কবি চোখ ফেরালেন মাটির পৃথিবীর দিকে। সেখানে দেখলেন রুঢ় বাস্তবের এক অসম সমাজব্যবস্থার ছবি।–
‘ভাতের থালায় বসলেই অজস্র হাড় জিরজিরে হাত
ছায়া হয়ে উড়ে আসে–
আমি গ্রাস তুলতে তুলতে চিৎকার করি– ‘যা: যা: ভাগ’
নড়ে না, কিছুতেই নড়ে না –ক্ষুধার্ত বেড়ালের শূন্য চোখ জ্বেলে বসে থাকে
বিত্তবান মানুষের দুয়ারে দুয়ারে।’ (আশ্চর্য ভাতের গন্ধ)।
সহজ জীবন যাপনে বাঁচার ইচ্ছে থাকে সকলেরই। কিন্তু তা যে সব সময় হয় না ভুক্তভোগী মাত্রেই তা জানেন।ফলে বাঁচার জন্য অনেক সময় নিতে হয় বাঁচার কৌশল কিংবা শিখে নিতে বাধ্য হতে হয় তর্জনী ওঠানোর ক্ষমতা।কবির কথায়,–
‘আকাশ নক্ষত্রের ভিতরে যাই–বজ্রের মতো
তর্জনী উঠিয়ে শিখে নিই বেঁচে থাকা।’ (বেঁচে থাকা)।
এসবের মধ্যেও বাঁচার জন্য চাই ভালোবাসা। কবি আবদুস তারও হদিশ দিতে সক্ষম–
‘কি বা চাইবো, চাওয়ার কিছুই ছিল না ভালবাসা শুধু ভালবাসা ছাড়া
এ দুটোই পেয়েছি তোমার নিভৃত আলয়ে।’( মুক্ত জীবন থেকে)।
শেষ পর্যন্ত কবি কি পেয়েছেন সেই অমোঘ ভালবাসা? প্রশ্ন থেকে যায়।তাই হয়তো তাঁর তৃতীয় কাব্য ‘উপেক্ষায় ফেরালে মুখ’ কাব্যটি পাঠকদরবারে এসে পৌঁছাল অন্য কোন বার্তা নিয়ে।
এ কাব্যেও কবি সেই বিষাদঘন স্বপ্ন বুনে যাবার আবহে আবর্তিত।কবি একজন তৃষ্ণার্ত সাধকরূপে এসেছেন এ পর্বে। কখনও চমকের প্রত্যাশী না হয়েও নীরবে সাজিয়েছেন অক্ষর মালা। যেখানে দুঃখ, ব্যথা, আনন্দ, সৌন্দর্য, সমাজ, মানুষ, স্বপ্ন,-স্বপ্নভঙ্গ, জন্মান্তরবাদ,সর্বপরি ভালবাসা বিভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর কবিতায় এসেছে।আর এই ধারা তাঁর ‘আত্মার পাখি’, ‘নৈঃশব্দ্যের স্বর’ কাব্যগ্রন্থগুলিতে জায়মান হয়ে রয়েছে। নিচের উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতিগুলো পড়লে পাঠক আশাকরি তা বুঝতে পারবেন।–
১)“দাঁড়িয়েছি প্রত্যাশিত,দীনতার জ্বালা নিয়ে,নিথর
তুমি ভরিয়ে দেবে,কী রিক্ত ফেরাবে,সে তোমার দায়–
আমি আজন্ম এভাবে আকাঙ্খিত, তৃষ্ণার্ত, আর্ত।” (উপেক্ষায় ফেরালে মুখ)
২)“তোমার আলোক উৎস ছুঁতে
আমাকে অনেক আলোকবর্ষ অতিক্রম করে যেতে হবে।”(অনন্তে)।
৩) “নৈঃশব্দ্যে বাজে বাঁশি,ভাঙা জ্যোৎস্নায়
সুন্দর একা হয়,কাছে আসে,চকিত যায় দূরে…”(যেখানে সুন্দর)।
৪)“বুকের গুহা ছেড়ে উড়াল দিলে পাখি আত্মমগ্ন শরীরে থাকে না ব্যঞ্জনা দ্যোতনাহীন শরীর”(আত্মার পাখি)।
৫)“একটি পাখি যতদূর শূন্যে হারায় একটি জীবন জন্মায় তত গভীরে।”
এই গভীরতার প্রেক্ষিত থেকে কবি এসে পৌঁছালেন ‘কেউ একজন ‘-এর দরজায় কড়া নাড়তে। সঙ্গী তাঁর ‘ছায়ার শরীর’।তাই হয়তো ‘অনৃত ভাষণ’-এর আড়ালে ঘটবে কবির প্রকৃত শাপমুক্তি। অপেক্ষায় থাকি আমরা।কবির পাশাপাশি আমাদেরও পাপমুক্তি ঘটে কিনা! অন্যদিকে,‘কেউ একজন’ কাব্যে কবির অন্বেষণ প্রার্থিত সেই জন, যাঁর হাতে ধরে তিনি খোঁজ পাবেন বলে মনে করেন অনন্য মহাকাব্যের।এক মহাকাব্যিক দর্শনে কবি আবদুস এখানে বিচরণ করেছেন।সীমা ছাড়িয়ে অসীমের খোঁজে, অনন্ত থেকে অনন্তের পথে তাঁর গমন।কখনো সুন্দরের আবহে,কখনো বা সাদা ঘোড়ার চঞ্চলতায় ছুটে গিয়েছেন শূন্য ছাড়িয়ে মহাশূন্যের দিকে।এই পর্বে তাঁর কাব্যভাষা ও উচ্চারণ তাই তাঁর সমকালীন কবিদের থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র রূপে চিহ্নিত করে দেয়।যেন এক মগ্ন সাধক খুঁজে চলেছেন পৃথিবীর গূঢ়তম সৌন্দর্যকে।তাই যাবার আগে তিনি রেখে যেতে চান একটা চিহ্ন।যার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম খুঁজে নিতে পারেন হলুদ পাখির শিষে ভেসে আসা সংকেত কিংবা একাকি বেহালা বাদকের হেঁটে যাওয়ার গূঢ় তাৎপর্য।–
১)‘কেউ একজন
একেক জন্ম উপহার দিয়ে নিবিড় রাখছে সম্পর্ক,আর
বুকের জমা বেদনার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে তুলছে তুফান
মৃত,শুভেচ্ছা পত্র ও জীবাশ্ম ঘেঁটে লিখছে পৃথিবীর বৃহত্তম উপন্যাস লিখছে, লিখতে চাইছে অনন্য মহাকাব্য…’(কেউ একজন)।
২) ‘স্তব্ধতা ভেঙে ছুটে এলো একপাল সাদা ঘোড়া
সাদা সাদা
রক্ত প্রবাহে স্পন্দিত হল শিহরণ, চঞ্চলতা,গান,’ (সাদা ঘোড়া)।
৩) ‘জন্ম জন্ম
লোকটা যেভাবে ধরে আছে
পাখির কূজন,নদীর স্বর, রহস্যময়তাগুলি
এখন লোকটাকে ঈশ্বর ছাড়া কিছুই ভাবি না।’ (লোকটা)।
৪) ‘সময় যদি ফেরে কখনও কোনদিন আত্মাকে আমি কালজয়ী অমরত্ব দেবো।’(আত্মার জন্য)।
৫) ‘আমাদের মানপত্র নেই। জ্যোৎস্না নেই
কিন্তু জীবন রয়েছে।’(জীবন সঙ্গীত-১, ছায়ার শরীর)।
৭) ‘আসলে
সব জীবনের ঠিকানা আছে
সব জীবনই ঠিকানাবিহীন।’ (ঠিকানা,ছায়ার শরীর)।
৮) ‘যাবার বেলা যেন কিছু দাগ রেখে যাই।’(যাবার বেলা,অনৃত ভাষণ)।
এই অসুখী আত্মা নিয়ে কবি আবদুস হেঁটে গিয়েছেন তাঁর পরবর্তী কাব্যের পথে।খুঁজে নিয়েছেন নতুন নতুন বাঁক।আর সেই বাঁকেই ঘটেছে কবির নতুন জন্ম।কবি হিসেবেও পৌঁছে গেছেন পরম সার্থকতায়।