তৌফিক জহুর
একজন কবি চিরটাকাল একাই পথ চলেন। তাঁর চারপাশে থাকেন শত সহস্র শুভাকাঙ্ক্ষী অনুরাগী স্বজন এবং সমসাময়িকেরা। শেষ পর্যন্ত কলমের শক্তিই কবিকে তাঁর নিজের আসনে সমাসীন করে। আমরা যাঁরা নব্বই দশকের কবিতা ট্রেনের সওয়ারী হয়ে একটা বগিতে চেপে বসেছি অনন্তের পথে, আমাদের সুবিধে হলো, আমরা আমাদের অগ্রজদের সান্নিধ্য স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি অকৃত্রিমভাবে। একটা সম্মানবোধ আমাদের মধ্যে সদা জাগ্রত আমাদের অগ্রজদের জন্য। কবিতা এমন একটা শিল্প যেখানে চালাকির আশ্রয় নেয়াটা বোকামি। এবং এ ধরনের কাজ যে বা যাঁরা করেন তাঁরা সমকালে হয়তো কিছুটা আলোর দরজা দেখলেও মহাকাল হয়ে যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। খুব বেশিদিন হয়নি কবি মাকিদ হায়দার (২৮.০৯.১৯৪৭-১০.০৭.২০২৪) ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। বগুড়া লেখক চক্রের বাৎসরিক মাহফিলে যুক্ত হয়ে লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সত্তর দশকের কবি মাকিদ হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে। সেটিও পাঁচ বছর আগে। অনেকটা আলাপ জমে গিয়েছিল সেদিন বগুড়া জেলার জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। আমি উপরের যে কথাগুলো লিখেছি, সেদিন আলাপের মধ্যে মাকিদ হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় ওই বিষয়গুলো ছিল। তিনি ওখানে বসেই আমার সে সময়ে প্রকাশিত ” পাখি বিক্রি কাহিনি” ও ” কে তোমাকে ডেকে নিয়ে যায় বারেবারে” পাঠ করেছিলেন। তারপর কথা শুরু হলে তিনি আমাকে অদ্ভুত এক কবিতার রাজ্যে টেনে নিয়ে যান। যে কবিতা এখনো পৃথিবীতে নাজিল হয়নি, হয়তোবা সেই কবিও এখনো পৃথিবীর আলো হাওয়ায় আসেননি, তিনি সেই অগ্রসরমান সময়ের কবিতা কেমন হবে, তখনকার পাঠক সমাজের মানসিকতা কেমন হবে তা নিয়ে অল্প কথায় দারুণ বললেন। আমি চিরকালই মুগ্ধ শ্রোতা। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তাঁর বয়ান। সমাজ সচেতন ও রাজনীতি মনস্ক চিন্তার একটা পরিষ্কার রূপ পেয়েছিলাম তাঁর বয়ানে। তারপর তাঁর কবিতার পথে হেঁটে যাই। তাঁর কিছু কবিতা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করে।একটা আবেগের জায়গা তৈরি হতে থাকে কবি মাকিদ হায়দার ভাইয়ের জন্য। ” তোমার পাশে, অদূরের নাগরদোলা কবিতাগুলোয় একটা আকর্ষণ আছে। আছে আকুতি। আমরা কবিতা দুটো পাঠ করি বোধের আয়নায়:
০১.
তোমার পাশে
মাকিদ হায়দার
ডাকবে শুধু আমায় তুমি
থাকবে শুধু আমার পাশে
থাকবে তুমি।
কাঁদলে শুধু কাঁদবো আমি
বিজন রাতে একলা আমি
তোমার পাশে।
জোনাক আলো জ্বালবো আমি
যেথায় তুমি একলা থাকো
আমায় ছেড়ে।
ডাকবে লোকে হঠাৎ করে
সাতসকালে সাঁঝের বেলা
তখন তুমি বাসর ছেড়ে
একপা দু’পা তিনপা করে
বেড়িয়ে এলে দেখতে পাবে।
দাঁড়িয়ে আছি তোমার পাশে।##
০২.
অদূরের নাগরদোলায়
মাকিদ হায়দার
কেন যে সম্মতি দিলাম তার প্রস্তাবে
যেতে হবে সাথে নিয়ে তাকে
দেখবেন তিনি
চৈত্র সংক্রান্তির মেলা।
গিয়ে দেখি শহরের সব লোকজন
উঠে বসে আছে
নাগরদোলায়।
হঠাৎ আমায় সেই তিনি বললেন
চলো যাই দূরে যাই
যাওয়া যাক দূরে কোথাও।
পুনরায় সম্মতি দিতে গিয়ে মনে হলো
হয়তোবা মেয়েটির প্রিয় হতে পারে
গুড়ের বাতাসা।
কিছু না বলে হঠাৎ
তাকালেম আকাশের দিকে
চেয়ে দেখি চৈত্রের শেষ মেঘ দ্রুত লয়ে
আসছে আমার দিকে।
অদূরের নাগরদোলায়
কেউ নেই আর।
চৈত্র সংক্রান্তির মেলায়
শুধু ছিলেম দুজনে।
একজন পাঠক একটি কবিতার প্রেমে তখনই পতিত হয় যখন সেই কবিতার ভাব, ভাষা, নির্মাণশৈলী, শব্দ প্রয়োগ, ছন্দ, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা অকৃত্রিমভাবে সন্নিবেশিত হয়। কবি মাকিদ হায়দার দীর্ঘ পাঁচ দশকের অধিক সময় কবিতার মধ্যে ডুবে ছিলেন। তাঁর কবিতার কিতাব খুব বেশি না। কিন্তু লিখে গেছেন আমৃত্যু। মাকিদ হায়দারের কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা (১৯৭৬), আপন আঁধারে একদিন (১৯৮৪), ও পার্থ ও প্রতিম (২০০৭), কফিনের লোকটি (২০১১), যে আমাকে দুঃখ দিলো (২০১২), প্রিয় রোকোনালী (২০১৩), মুমুর সাথে সারা দুপুর (২০১৪)। এছাড়াও তার একটি গল্পগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধের বইও রয়েছে।
কেনো একজন কবিকে নিয়ে সমাজ কথা বলে? একজন কবির জন্য কেনো যুগ যুগ ধরে সমকাল ও ভবিষ্যত প্রজন্ম বুদ হয়ে থাকে? উত্তরটা খুব সহজ হলেও সৃষ্টির জায়গাটা অত্যন্ত গভীর। সমাজকে স্বপ্ন দেখানো একজন কবির কবিতা টিকে থাকে শত শত বছর। সমাজ বদলানো কবির কবিতার লাইনগুলো একসময় মানুষের মুখে মুখে পাঠ হতে থাকে। তিনি তাঁর সৃষ্টির বিশালতার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেন। দেহের মানুষটি ছবির ফ্রেমে ঠায় নিলেও তাঁর সৃষ্টি অচিন্তনীয় অকল্পনীয়ভাবে জীবন্ত হয়ে থাকে বর্তমান। এজন্যই কবিতার পথ বড়ই আহ্লাদিত ও আকর্ষণীয়। কবি মাকিদ হায়দারের কবিতাগুলোর মধ্যে কথোপকথন এর একটা স্টাইল আছে। নিজস্ব রাস্তা নির্মাণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ভাষার কারুকাজ ও শব্দ প্রয়োগে যথেষ্ট সচেতন তিনি। যা বোঝাতে চেয়েছেন তা একজন পাঠক ঠিকঠাক বুঝতে পারবেন। কারণ, শব্দ প্রয়োগে তিনি কখনোই কোনো কবিতায় জটিলতার আশ্রয় নেননি। তিনি দারুণ ছান্দসিকও। একজন কবি এতো পথ চলতে গিয়ে কোথাও মনে হয়নি তিনি তাড়াহুড়ো করছেন, কবিতায়। কবিতায় জবরদস্তি নেই। পাঠ করলে মনে হচ্ছে, তিনি যা চেয়েছেন অনয়াসে সেভাবেই শব্দের ঠাসবুনোন করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমরা আর কয়েকটি কবিতা লক্ষ্য করি:
০১.
হাজার বছর
(প্রিয়জন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম)
মাকিদ হায়দার
ইচ্ছে করে হাজার বছর বেঁচে থাকি। ইচ্ছেটুকু পূরণ হলে লিখব না আর পত্র-চিঠি তাহার বাড়ির ভুল ঠিকানায় মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মেঘের সাথে ভেসে বেড়াই, সময় পেলে রাখব ঢেকে দহন আমার, তাহার বাড়ির শিউলিতলায়। পরশু রাতে ঠিক করেছি পুড়ব না আর জোছনা-রোদে, ইচ্ছে তবু জেগে থাকে একটি মুখ দেখার…
০২.
সঙ্গে যদি
(শ্রদ্ধাভাজন কবি মাহমুদ আল জামান)
মাকিদ হায়দার
তীর্থে যাবো সঙ্গে যদি নিতে ধুইয়ে দিতাম সোনার চরণ দুটি। কুড়িয়ে দিতাম হারিয়ে যাওয়া মুখ, প্রেমিক কবির দৃষ্টিভেজা চোখ। তীর্থে যাবো সঙ্গে যদি নিতে। নাইবা গেলাম গয়া-কাশী যেতাম, সুদূর বৃন্দাবন। সেথায় গেলে হয়তো আমি ফিরে পেতাম কারো হারিয়ে যাওয়া মন তবু যদি তীর্থে…
০৩.
অতীত কাহন
(কবি হায়াত সাইফ শ্রদ্ধাভাজনেষু)
মাকিদ হায়দার
মনের সুখে সেলাই করি মনের অসুখ। মাঝে মাঝে পরের বাড়ির শাড়ির আঁচল। সব শাড়িতে দহন দেখি দহনসহ সেলাই করি একটি, দুটি, তিনটি শাড়ির গোপন কথা। শাজাদপুরের একটি শাড়ি কেঁদে আমায় বলেছিল, রবিঠাকুর কথা দিয়েও নেয়নি তাকে কলিকাতায়। জোড়াসাঁকোর লাল বাড়িতে। কবিরা সব কথা দিয়েও কেউ…
০৪.
বিবরণ
[কবি শ্যামলী মজুমদার, প্রীতিভাজন]
মাকিদ হায়দার
ছেড়ে এলাম, ফেলে এলাম, বাঁশবাগানের মাথার ওপর দুই শালিকের ঝগড়া-বিবাদ। হুতোম এবং লক্ষ্মীপেঁচার আলাপ বিলাপ। ফেলে এলাম, ছেড়ে এলাম, সরল মুখের করুণ চোখের ভেজা পাতা। যে-পাতাতে লেখা ছিল সময় পেলে বেড়িয়ে যেয়ো, দেখতে পাবে কেমন আছি মাঘ পৌষে আসো যদি। বসতে দেবো চোখের পাতায়, সেলাই ছাড়া…
০৫
শেষ মেয়েটি
[কবি আসাদ চৌধুরী শ্রদ্ধাভাজনেষু]
মাকিদ হায়দার
চৈত্র মাসের তিরিশ দিনে নিজের দেহ পোড়াই রোদে কেঁদে ভাসাই মনের যতো ক্লেদ যাতনা। কেন পোড়াই, কেন ভাসাই, জানতো শুধু কাজীবাড়ির শেষ মেয়েটি, জানতো আরো বাঁশবাগানের পায়ের নিচে পড়ে থাকা মচমচানো বাঁশের পাতা। কাজীবাড়ির শেষ মেয়েটি বলেছিলো, আর হবে না আগের মতো… শেষ করেনি পরের টুকু। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ,…
০৬
দেবী
[কবি, শঙ্খ ঘোষ শ্রদ্ধাষ্পদেষু]
মাকিদ হায়দার
দেখি নাই শুধু শুনিয়াছি তিনি নাকি অপরূপা। ভাবিলাম, হইলেও হইতে পারেন তাহাতে আমার কী, ই, বা আসিয়া যায় তথাপি বুকের মধ্যে কষ্ট অনুভব করিলাম চিনচিন করিতে লাগিল অবুঝ হৃদয়। শুনিলাম, সেই অপরূপার কথা, শুনিবার পর হইতেই অনেক যুবকেরই নাকি ঘুম হইতেছে না, এমনকি আমার নিজেরও।…
নিজস্ব চিন্তার গভীরতায় আমি কিছু বয়ান করেছি। কিন্তু পাশাপাশি কয়েকটি কবিতা রেখে যাচ্ছি। আমার বয়ানের স্বপক্ষে। একজন পাঠক গভীর মনোযোগ সহকারে তাঁর কবিতার সদর দরোজা খুলে অন্দরমহলে প্রবেশ করলে বুঝতে পারবেন, তিনি তাঁর সময়কে ধারণ করে, একটা পরিবর্তনকামী সমাজ গঠনে চিন্তার রেনুকণা ছড়িয়েছেন। স্বপ্নের জায়গা থেকে। কবিতার মধ্যে দিয়ে। যিনি কবিতার মধ্যে ডুবে যান, তাঁর আর কখনোই কবিতার সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ থাকেনা। তিনি ধীরে ধীরে কবিতার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। নিজেই এক মহারাজা হয়ে যান। কারণ, কবিতার মাধ্যমে তিনি যাপিত জীবনের প্রেম, আশা, ভালোবাসা, কামনা, বাসনা, স্বপ্ন প্রকাশ করতে থাকেন, যতদিন তাঁর কলম থাকে সচল। কবিতাই কবির মুক্তির পথ। প্রকৃত কবি সত্ত্বা সেই মুক্তির পথের সন্ধান পেয়ে যায়। কবিতার জন্যই একজন কবি চিরটাকাল একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করেন তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী।কবি মাকিদ হায়দারও ভ্রমণ করেছেন আমৃত্যু, কবিতার ভ্রমণ। কবিতার রসদ সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন এলাকার সাহিত্য অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে, সমুদ্রের কাছে, পাহাড়ের চূড়ায়, নতুন শহরে, গ্রামের মেঠোপথে কবি বিচরণ করে এমন কিছু আবিষ্কার করেন, এমন কিছু দেখেন যা সাধারণ মানুষের চোখ কখনোই দেখতে পায়না। কবি সেই সব সৌন্দর্য অবলোকন করে কবিতার শরীরে আঁকেন এমন এক ছবি যা পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। মাকিদ হায়দার ভাইয়ের দীর্ঘ কবিতা জার্ণিতে এই ভ্রমণ ছিলো। তাঁর কবিতার শরীরে আমরা নতুন সব রসায়ন খুঁজে পাই। তাঁর নিজস্ব চিন্তার গভীরতায় তিনি এঁকেছেন দুর্দান্ত কিছু ছবি। যে কবিতা পাঠ করলে সহজেই সেই ছবি দেখা যায় বোধের আয়নায়। ” প্রিয় রোকোনালী (২০১৩)”…. আমাদের সেই ভাবনাকে উসকে দেয়।
লেখক : কবি, সম্পাদক :উদ্যান