spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতানির্বাচিত ১০ কবিতা : হাননান আহসান

নির্বাচিত ১০ কবিতা : হাননান আহসান

রাত্রি জানে

সাতখানা ঘর, উঠোনবাড়ি, চিলেকোঠা
তক্তাপোশে সিংহকেশর, ময়ূর আঁকা
জলদঘোড়ার জন্য তখন দরাজ খোলা
চাঁদ নেমেছে মখমলে ওই সোহাগ মাখা।

ঘরের ভেতর উপল ঘরের ঠাসবুনুনি
চার দেয়ালের সন্নিবেশে চান্দ্র-ভাসি
সন তারিখের ছেঁড়া খাতার দৃশ্যগুলো
একলা মানুষ দমসানো সুখ ঝরছে রাশি।

কেউ দেখেনি নিবিড় ছায়া সঙ্গোপনে
হস্তগত পূব কিনারে ঝিরঝিরানি
রাত্রি জানে সাক্ষী থাকে স্থিরীকরণ
ঘুম জড়ানো হিরণপ্রভা সঙ্গে আনি।

অট্টালিকায় প্রলেপ দেয়া গন্ধ সুবাস
বুকের ভিতর ইচ্ছেখুশির তপ্ত জমা
মন্দাকিনী হয় বুঝেছে, নয় বোঝেনি
দিক বলয়ে নিরুচ্চারে দাঁড়ি-কমা।

সাতখানা ঘর, উঠোনবাড়ি, চিলেকোঠা
চৌকাঠে ঠায় কুমুদবতী অন্ধকারে
দিন চলে যায়, মাস চলে যায়, বছর গুনি
সাগর শুকোয় জল-পিপাসা পদ্মাপাড়ে।

কবিজন্ম

বয়সের ভার নিয়েও তিনি অবিচলিত
নিজস্ব ক্রিয়াকর্মে।
বুড়ো বটগাছ যেমন প্রসারিত
দাঁড়িয়ে থাকে।
সাহিত্যের শাখা জুড়ে
বাহারি ফুলের মেলা। অতীন্দ্রিয়
সব সুবাস জমে থাকে বারান্দায়
আকণ্ঠ গরিমায়। বরাবর বরাবর
পাতারা খেলছে বেমালুম।
আজন্ম লালন করে
করিডোরে।
স্বপ্নরা খেলা করে মৃদুভাসে
সৃষ্টির আনন্দ সবুজে হলুদে
নীলকন্ঠ পাখিরা যখন উড়ে
আসে।
আজন্ম বয়স তখন অপার
মহিমায়।

মায়ামেঘ

নিজের ভাবনাগুলো জবুথবু হয়ে বসে থাকে
মেলাতে পারি না অনেককিছু

তুমি বসে থাকো আনমনে। মায়ামেঘ
ক্যানভাসে খোঁজে অদৃশ্য হাত

মেলাতে পারি না তবু শরীরী ভাঁজ
কতখানি গভীর মুছে ফেলে খাদ

আমি বসে থাকি জোছ্না বাহু তুলে
সুবাসিত সমুদ্দুরে যাব বলে

তুমি থাকো। অপার বিস্ময়।

ভালো মানুষ

বাবা বলতেন মানুষ হবার কথা
অর্থ নয় লোভ নয় মোহ নয়
ভালো মানুষ হতে হবে

বাবারা ভেবে দেখেনি
অর্থ লোভ মোহ কীভাবে বিসর্জন দেব

ভালো মানুষের কি অর্থ লাগে না
ভালো মানুষ কি লোভহীন হয়
ভালো মানুষের কি মোহ থাকে না

আমি এখনো গুলিয়ে ফেলি
ভালো মানুষ কাকে বলে

অর্থ লোভ মোহ ভেতরে রেখে
ভালো মানুষ হয়ে ওঠা
কঠিন নয় কখনো

মানুষ দোষে গুণে ভরা

নিপাট ভালো মানুষ একটি গাছ
ফলবতী গাছ

গাছ তো মানুষ নয়
তবে মানুষরূপী গাছেরা ভালো মানুষ

নেত্যকলি

ভোট চেম্বারে হতবাক আমাকে দেখে
অফিসার বললেন
শ্বাস নিন। সুস্থ থাকুন।
বাড়ি ফিরে যান।
এক উর্দিধারী পুলিশও
একই সখ্যতা দেখাল।
চড়া রোদে গাছপালারাও সিঁটিয়ে আছে।

আমার আঙুলের কালি প্রমাণ করবে
আমি ভোট দিইনি তা হবে না
দিয়েছি তো—
চড়া রোদে আকছার এমন হচ্ছে।

নিজের সঙ্গে কথা হল না
হাতের রোমগুলো নিরুত্তাপ, জড়ভরত।
আমার কীসের ভয়
গণতন্ত্র এগোচ্ছে। গণতন্ত্রের মানুষ…

শুভ হোক তোমাদের জয়
এত চড়া রোদ যে
বেরোনোর ছায়া পেলুম না।

সময়ের চিঠি

সময় খোলা চিঠি লেখে
আকাশকে। বাতাসকে। মাটিকে।
গাছপালা পশুপাখি সবাইকে
তবু মানুষকে লেখে না একটিও শব্দ।

অঙ্কের খাতা খুলে রেখে সময়
পথেঘাটে থমকে দাঁড়ায়
আবার চলে। চলতে থাকে…
তবু অমানুষদের চিনতেই পারে না।

হুইশেল বাজিয়ে চলে যায় ট্রেন
কত দূরে। নদী হ্রদ পাহাড় ডিঙিয়ে
মায়াবন্দরে রাত্রি নেমে এলেও
থেমে থাকে না অমোঘ সময়।

মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে তুলসী তলায়
বসে বসে আহ্লাদিত হয়
প্রকৃতিকে চিঠি লিখে লিখে ক্লান্ত সময়
তবু মানুষকে লেখে না কিচ্ছু।

রোদের জামা

একটা মৃতদেহ পড়ে আছে
রাস্তার ওপর। রক্তে মাখামাখি
প্রতিদিন কেউ না কেউ, আমাদের-ই
আমরা নিরাসক্ত চেয়ে থাকি।

লতাগুল্ম জানে, ইটের ঘায়ে
ক্ষতবিক্ষত এই নির্দোষিতা
বাতাস জানে, গরম ছ্যাঁকাটুকু
আর জানে সেই বৃদ্ধ পরমপিতা।

চতুর্দিকে আগুন নিয়ে খেলা
নগ্নিকা আর কাপড় কোথায় পাবে
অমানবিক রোদ পুড়েছে জামা
গোগ্রাসে সব জন্তুগুলো খাবে।

নিশ্চুপেরা ভাবতে পারেন একা
সময় কিন্তু আসছে যাচ্ছে রেগে
দাঁড়ি কমার পাঠ যাবে ঠিক চুকে
কুকুরগুলো ঘুমোয় জেগে জেগে।

যা হচ্ছে তা হতেই হবে কেন
তার তো একটা থাকবে কিছু মানে
সমাজটাকে বদলাবে কে, তুমি?
ছলচাতুরী বড্ড মানুষ জানে।

এই রাজা

দেশ যখন নির্লজ্জ হয়ে পড়ে
প্রজারা হয় দাস
গাছের বাতাবিলেবু
গন্ধ ছেটায়
পাখিরা ঝিমিয়ে পড়ে।

দেশ যখন বেআব্রু হয়ে ওঠে
লজ্জা ঢাকে বেগবান বায়ু
গঙ্গা-যমুনার অসহায়তা
ঠিকরে বেরোয়। অনবগুণ্ঠিতা…

দেশের মানুষ যখন বেহায়া হয়
রাজা আঙুল নাচিয়ে বলে—
ভোট ব্যাঙ্ক, গুরুকুল!
মার। আরো জোরে। মার। মার।

গাছপালা কান পেতে শোনে
প্রকৃতি ভিরমি খায়
রাজা উল্লসিত।
চোখে মলম লাগায়।

কূটকচালি

গাছের পাতায় খেলছে পাখি
বাতাস নাচে রূপ গুলানো
চতুর্দিকে হিম পড়েছে
আসছে ভেসে নদীর গানও।

ঘাসফড়িঙের লম্ফ জারি
স্বপ্ন জালে ভাসছে মাটি
দিগ্বিদিকে চন্দ্র-তারা
উজ্জীবনে রঙের বাটি।

সন্ধে নামে দিঘির পাড়ে
চতুষ্কোণে পরম হিয়া
কে যাবে রে আরামপ্রিয়
আবছা আলোর ভিতর দিয়া।

এসব আমার কূটকচালি
বুঝে নিন ভাই পায়েসসেবী
উলটে দেব পালটে দেব
কৃপা যদি করেন দেবী।

চেনাচেনি

এ জীবনে মানুষ চেনা হল না
যেমন চেনা হয়নি ঘাসপাতা
ঢোলকলমি আর আড়ংঘাটা।

অনন্ত কপালে যে বা যারা
টিপ সাঁটে অবলীলায় তাদের
গন্তব্য আজও জানা হয়ে ওঠেনি।

অনাবিল সুগন্ধি মেখে
কতবার লালনতলায় গান বেঁধেছি
বাতাস খেলতে খেলতে চলে যায়
তার নাগাল পাইনি কোনোদিন।

হাভাতে মানুষ চৌকাঠে পা দিয়ে
অনিবার্য হয়ে উঠলেও
তাকে চেনা যায়নি অনির্বেদ কারণে।

মানুষ চিনতে চিনতে বুড়ো হয়েছি
মানুষ চেনা হল না
ফলবতী গাছও চেনা হল না।

              
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
- Advertisment -

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

তনজিম আতিক on কবিতাগুচ্ছ
নয়ন আহমেদ on না
খান কাওসার কবির on লুৎফর রহমান রিটন নামা
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ
সাজ্জাদ সাঈফ on বাছাই কবিতা
নয়ন আহমেদ on বাছাই কবিতা