কান্না
……
উৎসর্গ : কররেখার ধাঁধায় সর্বশহীদ শাহজাহান, মোহাম্মদ ফারুক, ওয়াসিম আকরাম, আবু সাঈদ, ফয়সাল আহমেদ শান্ত, অজ্ঞাতনামা একটি ভাই।
আজ নিউইয়র্ক থেকে আমার এক বন্ধু ফোন করে,
কিন্তু কথা বলে না, আমার বন্ধুটি কোন কথা বলে না
কেবল ফুঁপিয়ে কাঁদে, নদীর পাড় ভাঙার মত কাঁদে সে।
আমার ধারণা হয়– ঢাকায় যে তার বোন স্কয়ার হাসপাতালে
ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে– সে বোনটি হয়তো মারা গ্যাছে।
কিন্তু আমার বন্ধুটি বলে- না তার বোন ঘুরে দাঁড়িয়েছে,
ওর ঝুঁকি নেই, শরীর বরং অনেকটাই ভালোর দিকে।
বন্ধুটি কাঁদে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অবিরল কাঁদে আর বলে–
আমি তো আদতে দেশে ছিলাম না বললেই চলে,
পঁয়তাল্লিশ বছর বাইরে আমি, দেশে তেমন ছিলামই না
ভেবেছিলাম যাবো তো– শেষ দিনগুলো দেশে থাকবো!
বন্ধুটি বলে, কাল থেকে মনে হচ্ছে আমি দা ভিঞ্চির
দুনিয়া কাঁপানো পেইন্টিং ভিট্রুভিয়ান ম্যান হয়ে গ্যাছি-
আমি আবু সাঈদ– আমি দা ভিঞ্চির ভিট্রুভিয়ান ম্যান দুনিয়ার ভরকেন্দ্রে মায়া ও নিষ্ঠুরতার একান্ত সিন্থেসিস;
আমিই সার্কেল ও চতুর্ভুজ– দুনিয়ার ভরকেন্দ্রে একজন
আবু সাঈদ- বরকত, আসাদ ও একটানা নূর হোসেন।
আমার বন্ধুটি কেবল বলে– আমি জানি না কেন এতো
অসহায় বোধ করি- আমার সন্তানেরা মারা পড়ছে
গুলির মুখে ছিঁড়ে যাচ্ছে ওম, শীত, রোদ ও স্মৃতির ক্ষুর।
দুটি কথা বলেই আমার নিঃসন্তান বন্ধুটি আবার কাঁদে-
আমি বাংলাদেশ,আমিই মা– আমার সন্তানেরা খুন হচ্ছে,
ঘরে, পথেঘাটে, রাস্তায় আমার সন্তানেরা থেঁতলে যাচ্ছে!
বন্দী শিবির থেকে
……….
হামাক ভাইদের কাছে নতজানু এই সংহার কালে
এই দুর্বিনীত পৃষ্ঠায় কৃতজ্ঞ হামাক বোনের কাছে
কেননা তারা মনে করিয়ে দিয়েছে আমরা আসলে
কতোটা ক্রীতদাসের খাসকামরায় ন্যুব্জ হয়ে আছি।
ভুলে গিয়েছিলাম কতোটা মুখস্থ বুলির নিচে
প্রাগৈতিহাসিক কালের চোখ ধাঁধানো মিথ্যার
সরাইখানায় আকন্ঠ ডুবে তালিয়া বাজাচ্ছিলাম আমরা।
তোমাদের কাছে আজানু কৃতজ্ঞতায় নতজানু আমি
তোমরা রক্তে লিখে দিয়েছো আমাদের কারাবাস,
ভেবেছিলাম কালের পুতুল হয়েই একজীবন সাবাড়
করে দেবো- কিন্তু তোমরা দেখিয়েছো ব্ল্যাকআউটের
রাত্রি কী- কীভাবে কারফিউ নেমে আসে নিজের
রক্তে ধোয়া স্বাধীন নিজভূমে।
কতোটা মৃত্যুর বরাভয় অর্জন করেছো তুমি,
হামাক বোন পুলিশকে বলে, না না লাঠিচার্জ করবা না,
করবে যদি গুলি করো, গুলি।
আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম– রক্তের সাঁকো বেয়ে এনেছি ঘুঘুপাখির সুরের ঝর্ণা, কিন্তু এরা মিথ্যা ছিল
তোমরা নতুন করে আমাদের পুরনো বংশপরম্পরা
আর রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানের সাথে যুক্ত করে দিয়েছো।
আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে, একশত বছর আগে
এভাবে বন্দী শিবিরের ভেতরে ছিলাম, এভাবে গলগলিয়ে
আগুন জ্বলে উঠেছিল, এভাবে ব্ল্যাকআউটের রাত্রি
নেমে এসেছিল– সশস্ত্র বাহিনী দরজা ভেঙে রাইফেল দাগিয়ে বলেছিল– হল্ট, মাদারচোদ অধিকার পোন্দাও!
মিল-অমিল
…….
হাশরের দিনের কথা শুনি–
ময়মুরুব্বিরা কয়- হুঁশেদিশে থাকো মিয়া,
হাশরের দিন কেউ কাউকে চিনবে না–
মা বুঝবে না তার সন্তান কে, ছেলে চিনবে না
তার বাবাকে, মা-কে;
আজকের অতি ভঙ্গুর দিনে আমার দেশ–
তাকে দেখে বুঝতে পারি হাশরের দিন
কেমন হবে, আমরা কতোটা অসহায় বোধ করবো!
তবে কেমন জানি তাজ্জব ব্যাপার ঘটছে–
একটা জিনিস কিন্তু মুরুব্বিদের বর্ণনার সঙ্গে
খাপেখাপ মিলছে না–
আজ আমার জন্মভূমি হাশরের থেকেও অধিক হাশর,
কিন্তু আমরা সবাই সবাইকে চিনতে পারছি।