১
এতটা বয়স কী করে হলো?
বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসেও সেই আগের মতোই মনে হয় নবীন কিশোর। অনেক সময় শরীর চলে না। ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না। কিন্তু তবু মনে হয় ছোটবেলাকার মতোই—আমাকে কেউ ভালবাসুক। রাগ দুঃখ অভিমান এখনো তেমনভাবেই সক্রিয়। মাঝে মাঝে ভাবতে বসি—এত বয়স কী করে হলো? এইতো সেদিনও বাবার ঘাড়ে চেপে চারণ কবি গুমানি দেওয়ানের আসরে গান শুনতে যাচ্ছি। এইতো সেদিনই সারারাত জেগে বসে আছি সত্যিপীরের গানের আসরে। পীরদের অলৌকিক ক্ষমতা আর রাজা-বাদশাদের গৃহত্যাগ এবং ফকিরি জীবনের মাহাত্ম্য অনুভব করছি। মাঝে মাঝে নাটকীয় গানের চাপান-উতোরে বেশ মজা অনুভব করছি। আবার কখনো মনে পড়ছে—বাড়ির উঠোনে সন্ধেবেলায় তালাই পেতে বাবার সঙ্গে আলিফ-লাইলার কেচ্ছা শুনছি। সুর করে পড়ছেন ‘হাতেমতাই’ অথবা ‘বিষাদসিন্ধু’। কখনো কখনো ‘জঙ্গে খইবর’ অথবা ‘বড় মওতনামা’। আবার কখনো ‘রামায়ণ’ অথবা ‘মহাভারত’। শুনতে শুনতে কোন কল্পনার রাজ্যে চলে যাচ্ছি, সেখানে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। অবশেষে জয়লাভ। করুণাময় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যাচ্ছে। আকাশের উপর দিকে চেয়ে দেখছি কত অলৌকিক অদৃশ্য ঘটনা সেখানে লিপিবদ্ধ আছে। কত মানুষের দীর্ঘশ্বাসহ-হাহাকার, কত আনন্দ-দুঃখের চিৎকার এখানে শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আজও আমার কানে সেই কন্ঠস্বর বাজছে। সেসব শুনতে শুনতে উঠোনের তালাই-এর উপরেই ঘুমিয়ে পড়ছি। এক ঘুম পর জেগে উঠলেও দেখি বাবার সুর তখনও থামেনি। গ্রামের আরও পাঁচজন এসে আমার চারিপাশে বসে গেছেন। কত রাত যে এভাবেই চলতে থাকে তার কোনো শেষ নেই।
সেইভাবেই বড় হলাম। আজও আমার মধ্যে সেই ছোটবেলা বেঁচে আছে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, সেও থাকবে। বহু চেষ্টা করেও এই ছোটবেলাকে কিছুতেই বড় করতে পারলাম না। আমি যে কারও স্বামী, কারও পিতা, আমি যে আমার ঘরের মুরুব্বি একথা বেমালুম ভুলে যাই। তাই হামেশাই আমার আচরণে এক ছেলেমানুষী অভ্যাস ফুটে ওঠে। কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেও লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে যায়। অচেনা মানুষের কাছে সহজ স্বচ্ছন্দ হতে পারি না। ডাক্তারখানা গেলেও বউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। কলকাতা আসতে হলেও একা আসতে পারি না। টাকা ধার দিয়েও পাওনা টাকা আদায় করতে পারি না। কাউকে কাউকে ধমক দেওয়ার দরকার হলেও আজ পর্যন্ত তা পারিনি। প্রথম যৌবনে যাকে ভালবেসেছিলাম তাকে ভালবাসার কথা আজ পর্যন্ত জানাতে পারিনি। একটা শিশু চিরদিন যে এভাবেই শিশু থেকে যায় তা এই বয়সে পৌঁছে ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছি। তবে আর কখন বড় হব আমি?
আজ যে পরিবর্তনটুকু নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারছি, তা হলো পার্থিব বস্তুতে আসক্তিবিহীন হওয়া। একটা সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েও তেমন পরিপূর্ণভাবে সংসারী হতে পারিনি। জীবনযাত্রায় এলোমেলো পরিপাটিবিহীন চালচলন আজও রয়ে গেছে। অর্থকড়ি জমানোর নেশা যেমন একেবারেই নেই, তেমনি জমিজিরেত কিনেও ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়ার বাসনাও নেই। অতি সাধারণভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা বাবার কাছেই পেয়েছিলাম। প্রতিবেশিনির দেওয়া পুরনো জামা গায়ে দিয়ে প্রথম স্কুলে গেছিলাম। সেদিন আমার পরনের একটি হাফপ্যান্টও ছিল না। বাবা ঘাড় থেকে লাল গামছাখানা নিয়ে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আর পাশের বাড়ির শালেমান ফুফু মুম্বাই শহরে ঝির কাজ করতে গিয়ে এনেছিলেন সেই পুরনো জামাটি। সেইটি পরেই প্রথম আমি স্কুলে যাই। স্কুলের ছেলেমেয়েরা সেদিন আমাকে পাশে বসানোরও উপযুক্ত মনে করেনি। কারণ জামাটি থেকে এক রকমের ন্যাপথলিনের মতো গন্ধ বের হচ্ছিল আর পরনে ছিল গামছা। বলে দারুণ বিসদৃশ মনে হয়েছিল তাদের কাছে। পরবর্তী জীবনে সেই মূল্যবোধই আমি পেয়েছিলাম। জামা যতই পুরনো হোক তা যতক্ষণ গায়ে দেওয়া যায় ততক্ষণ তাকে পরিত্যাগ করি না। তেইশ বছরের মাস্টারি করা জীবনেও সেরকম আভিজাত্য আজও ফুটে ওঠেনি। শ্বশুরের দেওয়া একখানা দামি জুতো আজও পায়ে পরে যাইনি। সমাজের অবহেলিত দরিদ্র দিনমজুর মানুষের মতোই নিজেকেও ভাবতে ভালো লাগে। কেননা আমার জীবন ও ভাবনা, আমার বেড়ে ওঠা ও স্বপ্ন দেখার উৎস এই দরিদ্র অবহেলিত মানুষের মধ্যে থেকেই। সেই সমাজ, সেই জীবন, সেই সংগ্রাম আমার মধ্যে সর্বদা সঞ্চারিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই আমি খুঁজে পেয়েছি আমার বিশ্বাস,আমার আনুগত্য, আমার স্রষ্টা এবং আমার প্রেমকে।
সাহিত্য আমার কাছে মূলত এই মূল্যবোধেরই ভাষা। একটা মাধ্যম মাত্র। নিজেকে প্রকাশ করা, নিজের ভাবনা, উপলব্ধি ও চেতনাকে ভাষা দেওয়া। কেউ যখন বোঝে না, কিংবা ভুল বোঝে; কেউ যখন কষ্ট দেয়, কিংবা আঘাত হানে; ধর্মের নামে,জাতের নামে অপমান করে— তখন তাকে আমি যে ভাষায় জবাব দিতে পারি তা তো সাহিত্যই। বাবা দুঃখ দহনে সর্বদা বিপন্ন হলে যেমন প্রাচীন সাহিত্য পাঠ করে একটা আলাদা জগৎ তৈরি করতেন, পৃথিবীর নির্মম করুণ সহিংস জীবনযাত্রা থেকে নিজস্ব আশ্রয় রচনা করতেন, ভুলে থাকতেন যাবতীয় শূন্যতা ও অপ্রাপ্তিকে—তেমনি আমিও আমার সাহিত্যের কাছে মুক্তি ও বিশ্রাম পাই। নিজেকে বোঝাতে পারি, নিজেকে নিজেই দীক্ষা দিতে পারি, ধৈর্য ও অসীমতায় উত্তরণ ঘটাতে পারি। প্রতিটি অসহায় মুহূর্তগুলিতে এই সাহিত্যই এক রকমের আলোকিত প্রলেপ দান করে আমাকে। তখন আমি আত্মগোপন করি। তখন আমি নিজের ঈশ্বরকে আমার সৃষ্টির মধ্যে দেখতে পাই। আমার হৃদয়ের ক্ষরণকে নিবারিত করতে পারি। বাবা মৃত্যুকালে শুনলেন, বইয়ের আলমারিতে উইপোকা ধরেছে। অনেকগুলি বই নষ্ট করে ফেলেছে। ওইগুলি একে একে ঝেড়ে রাখছি। বাবার কথা বলার শক্তি ক্ষীণ। তবু আমাকে জানতে চাইলেন, “আমার বইগুলি নষ্ট হয়নি তো?
বললাম, “না বাবা, ওগুলো ঠিক আছে!”
পুনরায় বাবা বললেন, “বইগুলো মাঝে মাঝে পড়বে। আমি বইগুলোর মূল অংশগুলোতে দাগ দিয়ে রেখেছি। খুব সহজেই পেয়ে যাবে। বইকে কোনোদিন অবহেলা করো না।”
বইপ্রীতি বাবার চিরদিনেরই। গ্রামীণ সমবায় ব্যাংকে বাবা পিয়নের চাকরি করতেন। সে বাজারে মাসে মাত্র পঞ্চাশ টাকা মজুরি। তাই শুধু ব্যাংকের কাজে সংসার চলত না। ব্যাংকের কাজ করেও বাবাকে ঠিকাকর্মী হিসেবে গেরস্থ বাড়িতে কাজ করতে হতো। মাটিকাটা থেকে ঘাসকাটা, আখের জমিতে নিড়ানি থেকে কচুর সারিতে মাটি তোলা প্রায় সব কাজই করতেন। ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসরকালীন হাজার পাঁচেক টাকা পেয়েছিলেন। বাড়িতে এত অভাব, সারাবছরে মা-কে একখানা ভালো শাড়িও কিনে দিতে পারতেন না। তবু সেই টাকা প্রাপ্তির কথা কাউকে জানাননি। সেই টাকা দিয়ে কিনেছিলেন তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাবলী এবং কাসাসুল আম্বিয়া ও বেদান্তের কয়েক খণ্ড। সেদিন আর বই রাখার জায়গা ছিল না আমাদের মাটির ছোট্ট বাড়িটিতে। বই দেখে নিরক্ষরা মা বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করেছিলেন। প্রায় তিন দিন রা-কথা বন্ধ ছিল। গরিবের বাড়িতে বই মানায়? গ্রামের মানুষ শুনে বলেছিল, “এসব ভীষণ অন্যায়! কী হবে এত বই? বই পড়ে কি পেটের খিদে মিটবে?”
সেদিন আমিই শুধু বাবাকে মনে মনে সমর্থন করেছিলাম। দেশ স্বাধীনের সাত বছর আগে বাবা জন্মেছিলেন। সেই যুগে গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। পায়ে হেঁটে অনেক দূরে যেতেন পড়তে। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। তারপর স্কুলের বেতন দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই লেখাপড়ায় ইতি টেনে মাঠের কাজে নেমে পড়েছিলেন। সাত জন্মেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা কেউ শিক্ষিত ছিলেন না। বাবাই প্রথম। কিন্তু এত পড়ার টান কিভাবে জন্মেছিল তা আজও ভেবে পাইনি। ছোটবেলায় আমাদের ঘরে রাখা পুরনো একটি টিনের বাক্সে উদ্ধার করেছিলাম বাবার খাতা ও কিছু বইপত্র। সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বাবার বিয়েতে পাওয়া জনৈক এক বন্ধুর উপহার মৌলানা কোরবান আলীর লেখা ‘মনোয়ারা’ উপন্যাস। লেখাপড়া শেখার পর প্রথম এই উপন্যাসটিই আমি পড়েছিলাম। এটিই ছিল আমার প্রথম ভালোলাগা। কিছু খাতায় বাবার ড্রয়িং করেছিলেন। সেগুলো এতই চমৎকার যে মাঝে মাঝে মনে হতো কোনো পাকা শিল্পীর হাতে আঁকা। একটা ইংরেজি গল্পের বই এবং একটি বাংলা কবিতার বইও বাবার টিনের বাক্স থেকে পেয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার বই পাঠের দীক্ষা। ২০২৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ বাবা সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেন। আজও তাঁর কবরের পাশে দাঁড়ালে বাতাসে ভেসে আসে কতগুলো কবিতার পংক্তি :
“এলাহী আলামিন আল্লা জগতের সার।
চৌদা ভুবন মাঝে যার অধিকার ॥
একেলা আছিল যবে সেই নিরঞ্জন।
আপনার নূরে নূরী করিল সৃজন ॥
মোহাম্মদ নামে নবী সৃজন করিয়া।
আপনার নূরে তারে রাখে ছুপাইয়া ॥
দুনিয়া করিল পয়দা তাহার কারণ।
আসমানে জমিনে আদি চৌদা ভুবন ॥”
চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বাড়ি ফিরে আসি। সারাক্ষণ মনের আয়নায় বাবার মুখখানা ভেসে ওঠে। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সগিরা”।