তৈমুর খান
২
রাত্রির পায়ে ঘুঙুর বাজছে
—————————————————-
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের এক বিকেলে প্রথম আমার বাড়ির দরজায় ডাকপিয়ন এসে আমার নাম ধরে চেঁচালেন। আট বছরের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র আমি। অচেনা ডাকপিয়নের ডাক শুনে প্রথমত আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তারপর হাতের ইশারায় বললেন, “আয়, তোর জন্য সুখবর আছে!” কী সুখবর? কোথা থেকেই বা সুখবর আসবে? এক ছুটে তার কাছে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি একটা খাতা বের করে বললেন, “এখানে তোর নাম লিখে দে।” তৎক্ষণাৎ নাম লিখে দিলে তিনি আমার হাতে দিলেন একটি মানিঅর্ডার ফর্মের নিচের কিছুটা অংশ। সেখানে লাল কালিতে ইংরেজিতে কিছু লেখা আছে মাত্র তিনটি লাইন। তারপর পকেট থেকে বের করলেন একটি দশ টাকার নোট। এটিও আমার হাতে দিলেন। কিসের টাকা আমি জানতে চাইলে তিনি বললেন, “স্কুল ইন্সপেক্টর দশ টাকা বৃত্তি পাঠিয়েছেন।”
এই দশ টাকা হাতে পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা। বৃত্তি কী তখনও কিছুই বুঝতে পারিনি। একদিন হেডমাস্টার মহাশয় অবশ্য বলেছিলেন, “তুমি বৃত্তি পাবে!” কিন্তু তখনও জানতাম না বৃত্তি কিভাবে পাওয়া যায়। মনে পড়ল একদিন স্কুল ইনস্পেক্টর স্কুল পরিদর্শনে এসে আমাদের ক্লাসে পরপর প্রায় দশটা প্রশ্ন করেছিলেন আর সবগুলো প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে পেরেছিলাম। সেই সময়ই আমার নাম ধাম সব লিখে নিয়ে গেছিলেন। যাইহোক সেদিন টাকা এবং লাল কালিতে লেখা চিরকুটটি বাবাকে এনে দিয়েছিলাম। লাল কালিতে ইংরেজিতে যা লেখা ছিল তার অর্থ করলে দাঁড়ায়—”প্রিয় ছাত্র, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমার কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর শুনে। তোমার বুদ্ধিমত্তার জন্য এই সামান্য বৃত্তি পাঠালাম। আমি তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।” সেদিন এই দশ টাকাই আমার কাছে ছিল মহামূল্যবান। এর আগে কোনোদিন এত টাকা হাতে পাইনি। বাবা সেই টাকা দিয়ে দোকান থেকে কিনে এনেছিলেন ছয় কিলো চাল, পাঁচশো গ্রাম ডাল এবং এক কিলো আলু। তাই দিয়েই আমাদের কয়েক দিন খাবারের যোগাড় হয়েছিল। অনেক রাত অবধি পড়াশোনার সুযোগ হয়েছিল। যদিও এরপর আর কখনো বৃত্তি পাইনি। কিন্তু প্রথম এবং শেষ পাওয়া এই দশ টাকার কথা কোনোদিন ভুলতে পারিনি।
আমাদের সামান্য জমিজমা থাকলেও সারাবছরই অভাবের কবলে পড়তে হতো। জমিতে বছরে একবার মাত্র যে সামান্য ধান হতো তা ধারদেনা শোধ করার জন্য সবই বিক্রি হয়ে যেত। তাই অভাব আর পূরণ হতো না। কোনো কোনোদিন একবেলা খাবার খেয়ে, আবার কোনো কোনোদিন কিছুই না খেয়েও কেটে যেত। ধুলো মেখে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে পা ছাড়িয়ে কান্নাকাটি করতাম। কিন্তু সবাই ছিল নিরুপায়। অসহায়তায় কারও মুখ দিয়েই সান্ত্বনা বাক্যটুকুও বের হতো না। ছোট পিসি হাসিনা তখন কোলে করে আমাকে নিয়ে গ্রামের বিভিন্ন গেরস্থ বাড়িতে যেত। কারও ভাতের মাড়, কারও কাছে চাট্টি ভাত, অথবা কারও কাছে একটু আমানি পাওয়া গেলে তবেই শান্ত হতাম। আমার পরের বোনটি একটু বড় হলে সে মাঠ থেকে তুলে আনত কুড়োবুড়ির শাক। কখনো কখনো আনত পুকুরের হেলা, শালুক অথবা গাছের কদম। কচু তোলার সময় চাষিদের ফেলে দেওয়া এঁঠে অথবা বনকচুর পাতাও নিয়ে আসত। সারাদিন পর তা-ই রান্না হতো। লোকে থালা ভরে ভাত খায়, কিন্তু আমরা খেতাম বনকচু সেদ্ধ, কদম, শালুক পোড়া আবার তালের সময় শুধু তাল ইত্যাদি। এভাবেই বড় হচ্ছিলাম। দাদা ও বাবা বেশিরভাগ সময়েই মাঠে কাজ করত। ঘরের জমির কাজটুকু হয়ে গেলেই গেরস্থ বাড়িতে মুনিষ খাটতে হতো। সকালের দিকে গেরস্থ বাড়ি থেকে তাদেরকে দেওয়া হতো জলখাবার। সে সময় জলখাবার হিসেবে পাই তিনেক মুড়ি, একটা পেঁয়াজ ও একটা কাঁচা লঙ্কা দেবার চল ছিল। দাদি একটা জাম বাটিতে এক বাটি আমানির সঙ্গে কয়েক গণ্ডা ভাত গামছা দিয়ে বেঁধে আমার মাথায় দিয়ে বলতেন, “জলখাবারের মুড়িটা নিয়ে আসবি বাড়িতে খাবারের জন্য।” ভেজা আলে যেতে যেতে জামবাটি মাথায় কাত্ হয়ে যেত আর আমানি গামছা ভিজে চুইয়ে চুইয়ে আমার মুখমণ্ডল বেয়ে ঠোঁটে এসে পড়ত। আমি জিভ বার করে সারা রাস্তা তা চেটে চেটে খেতাম। মাঠে গিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন জলখাবার আসবে। তারপর জলখাবার এলে দাদা অথবা বাবা মুড়িটা নিয়ে আমাকে বেঁধে দিয়ে বলতেন, “একটু থাম, একসঙ্গে খাব!” আমিও থেমে যেতাম। সেই ভেজা ভাত খেতে খেতে আমার মুখেও তুলে দিতেন। যেখানে একজনেরই অসংকুলান, সেখানে দুজন খাচ্ছি! হয়তো তাঁরা শুধু আমানিটুকুই খেতেন। এভাবেই চলছিল বাল্যকাল। কোনো কোনোদিন বাড়িতে ভেজা ভাত না থাকলে মাঠে আর যাওয়া হতো না। সেদিন বাবা বলতেন, “একেবারে স্কুল যাবার পথেই আমার কাছে আসবি। একসঙ্গে খাব।” সেদিন বইপত্র নিয়েই বেরিয়ে যেতাম। বাবা আঁচলে মুড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। তারপর বাবার আঁচল থেকে মুঠি মুঠি মুড়ি নিয়ে খেয়ে স্কুলে গিয়ে টিউবয়েল থেকে জল পান করে তবেই ক্লাসে ঢুকতাম।
গেরস্থ বাড়িতে কাজও সারা বছর চলতো না। তখন তাহালা ডাঙা বলে গ্রামের নিকটস্থ একটি পুকুর পাড়ে ঘুটিং পাথর কুড়াতাম। দাদা, বাবা ও আমি সেইসব ঘুটিং পাথর কুড়িয়ে জমা করতাম। অনেক হয়ে গেলে গোরুর গাড়িতে চাঁচ বেঁধে তা শহরে নিয়ে যেতাম। সেগুলো পরিমাপ করার জন্য একটি কাঠের বাক্স থাকত, এগুলোকে বলা হতো ফেরা। এক ফেরা ঘুটিং এর দাম সেই যুগে মাত্র কুড়ি পয়সা। পাঁচ থেকে সাত ফেরা ঘুটিং হলে আরও দু চার পয়সা চেয়ে নিতেন দাদা।সেই সময় ঘুটিং এর খুব চাহিদা ছিল।সেগুলি চিমনি ভাটায় পুড়িয়ে তা থেকে চুন তৈরি করা হতো। সেই চুন বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতো। যাইহোক সেই ঘুটিং বিক্রির পয়সা দিয়েই বাজার করতেন। রামপুরহাটে পাঁচ মাথার মোড়ে তারিনি খুড়োর চায়ের দোকানে একটা ভাঙা বেঞ্চে গিয়ে বসতেন। হাফপিস রুটি আর কাচের গ্লাসে বাদামি রঙের আধ কাপ চা। তাতেই রুটি ভিজিয়ে খেতাম। এমনি করে বেলা গড়ে যেত। শহরের কাক ডাকত মাথার ওপর। কিছু আলু, পেঁয়াজ ও সবজিপাতি নিয়ে গোরুর গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরতাম। বেশি বেশি ঘুটিং বিক্রি করতে পারলে বছরে একবার মোটা খদ্দর কাপড়ের দড়ি দিয়ে বাঁধা হাফ প্যান্ট কিনে দিতেন আর একটি হাফহাতা জামা। সে সময় জুতো পরার কোনো চল ছিল না। শুধু দাদা ও বাবার পায়ে মোটরের টায়ার কেটে তৈরি করা এক ধরনের স্যান্ডেল ব্যবহৃত হতো।
রাত্রে পড়তে বসে শুধু ঢুল আসত। বেশিক্ষণ পড়তে পারতাম না। বাবা বলে বলে দিতেন তা শুনে শুনে আমিও বলতাম। শুধু পাটিগণিত আর বাংলা শব্দের বানান খুব ভালো করে শিখিয়েছিলেন। সারাজীবন এই দুটি বিষয়ে তাই আমার আর ভয় করত না। ক্লাস সিক্সেই অঙ্কে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছিলাম। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লে অনেক রাতে মা ঘুম ভাঙিয়ে খেতে বসাতেন। কোনো কোনোদিন খুদের জাউ অথবা শুধু কচুশাক। তাই খেয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। বাড়ির কাছাকাছি কোথাও শেয়াল ডাকত। বহু রাত অবধি শুনতাম আমাদের কাঠের ঢেঁকিটির ধান ভানার শব্দ। কাদের ধান ভেনে দিচ্ছে আমার মা-দাদিরা? জানতে পারতাম গাঁয়েরই কোনো গেরস্থ বাড়ির ধান। সারারাত ধান ভেনে যদি কিছু খুদ পাওয়া যায়, কয়েক পোয়া চাল! তাহলে আবার আমরা খেতে পাব! এই আশায় সেদিন আর ঘুম আসতে দেরি হতো না। ধানভানার শব্দ মনে হতো রাত্রির পায়ে ঘুঙুর হয়ে বাজছে।
ভাদ্র মাসে ভোরের দিকে ছোট কাকা ঘুম থেকে উঠিয়ে বলতেন, “চল্, তাল কুড়িয়ে আনি। একখানা বস্তা নে সঙ্গে।”
মনের আনন্দে উঠে পড়তাম আর অন্ধকারে তাল গাছের কাছে গিয়ে তাল খুঁজতাম। অনেক অনেক তালও পেতাম। দুজনে বই আনতে পারতাম না। কিন্তু তাল কুড়াতে গিয়ে অনেকবার বিপদেও পড়তে হয়েছে। বেশ কয়েকবার সাপের মুখ থেকে বেঁচেছি। একবার ভয়ংকর একটি কেউটে সাপ আমাদের দিকে ছুটে আসে ছোবল দেওয়ার জন্য। সেদিন তাল ফেলেই ছুটে চলে আসি। আসলে তাল চুষে চুষে খেয়েও আমাদের দিন যেত। আবার তালের আঁঠিগুলি ছাইয়ের গাদার উপর জমা করে রাখতাম। তা অঙ্কুরিত হলে সাদা সাদা শেকড়গুলি তুলে সেদ্ধ করে খেতাম। আর আঁঠিগুলি কেটে কেটে তার ভেতরের আকুরগুলি খেতে বেশ লাগত। তাই তালের কোনো অংশই ফেলার ছিল না।
ছোট কাকা নাসিরের তালের প্রতি যেমন নেশা ছিল, তেমনি মাছের প্রতিও। নানা সময় আমরা মাঠের খালডোবা, ধানের জমি থেকে মাছ ধরতাম। ল্যাটা মাগুর কই পুঁটি ইত্যাদি মাছই বেশি পেতাম। মাছের সঙ্গে কদম দিয়ে রান্না হতো। ভাত না থাকলেও এক এক বেলা তা-ই খেয়ে কেটে যেত আমাদের। গ্রামের পাশেই হলদি কাঁদর ছিল ছোট নদীর মতোই। প্রতিবছর বর্ষাকালে তাতে বন্যা আসত। বন্যায় ভেসে আসত মাছ। পানি একটু কমে গেলেই আমরা অনেকগুলো ছিপ নিয়ে উপস্থিত হতাম। ট্যাংরা পুঁটি ছুই গুচি মাছের সঙ্গে রুই-কাতলাও পেয়ে যেতাম। একবার কাকার ছিপে একটা অনেক বড় মাছ টোপ খেয়েছিল। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আর তীরে উঠে আসেনি। বাঁশের কঞ্চির ছিপখানাই গিয়েছিল ভেঙে। সেদিন আমাদের খুব আফসোস হয়েছিল। আমার মাছ ধরা শুনে একদিন ক্লাসে অঙ্কের স্যার বললেন, “মৎস্য ধরিব খাইব সুখে, লেখিব পড়িব মরিব দুখে! খুব মাছ ধরিস শুনলাম!”
সেদিন কাচুমাচু করে থেকে গেছিলাম কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কিন্তু মাছ না ধরলে আমাদের চলবে কেমন করে? একথা বোঝাবারও সাহস হয়নি। শুধু জানালা দিয়ে উদাসীন চেয়ে রয়েছিলাম।
ভাই তৈমুর, তোর,আর্শিনিকেতন: রাত্রির পায়ে ঘুঙুর পরলাম। যদিও তোর কঠিনতম,তিক্ত দারিদ্র্যের চিত্র তোর আত্মসংগ্রহে অনেকটাই পেয়েছি। এখানে আরও ডিটেইলস এ আছে।কতগুলো শব্দ বা শব্দের প্রতীকে জিনিস জানা নেই। যেমন,আমানি,ঘুটিং পাথর, ছুই মাছ,চাঁচ,কাদর,কুড়োবুড়ি শাক।কদম ফল আমি ও আমার জমজ ভাই দুজনেই খেয়েছি খিদে মেটাতে।কিন্তু কদম দিয়ে মাছ কী করে খায় এটা প্রথম শুনলাম। অবশ্য দারিদ্র্য অনেক অনেক অচেনা বা অখাদ্য খাবার, সুখাদ্য করে নেয় নিজের প্রয়োজনে।
কদম দিয়ে মাছ রান্না করা হয়। ভাত নেই, কিন্তু কদম-মাছ খেয়েও দিন গেছে। চাঁচ গোরুর গাড়িতে টিন বা চট দিয়ে ঘেরা দেওয়া দেয়াল। এর ভিতর ঘুটিং পাথর রাখলে পড়ে যায় না। কাঁটানটেসহ মাঠের নানা ধরনের শাককে কুড়োবুড়ি বলে। আমানি ভাতে জল দিয়ে রাখলে পরের দিন সেই জল আমানি। ছুই মাছ সর্বদা জলের ওপরে ভেসে বেড়ায়।