কাজী জহিরুল ইসলাম
বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা কী তা জাতিকে বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। এতোদিন আমরা একদল স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যা চেতনার কথা শুনে শুনে বিভ্রান্ত হয়েছি, অনেকেই এই আশঙ্কা করেছিলেন আমাদের নতুন প্রজন্ম হয়ত জানবেই না, এই চেতনার জন্ম দেননি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। সত্তুরের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী, এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা। নয় মাস যুদ্ধের পর ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের ওপর ভেসে উঠেছিল এক অনিন্দ্য সুন্দর ভোরের সূর্য, জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ নামক এক শিশুরাষ্ট্রের। তৈরি হয়েছিল সৌহার্দ্যের, সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের, মানবতার, গণতন্ত্রের, অসাম্প্রদায়িকতার এক নতুন চেতনা। সেই চেতনা ভূ-লুণ্ঠিত হলো ১৯৭৫ সালে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে গঠন করা হলো বাকশাল, গণতন্ত্রের কবর রচিত হলো। বাকশালেরই একটি অংশ কিছু সেনা কর্মকর্তার সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথম রক্তপাতের মধ্য দিয়ে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে একজন সেনাশাসক ক্ষমতা দখল করে নিলো ১৯৮৩ সালে, আবারও ভূলুণ্ঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা গণতন্ত্র।
১৯৯০ সালে আজকের মতই জেগে উঠেছিল এদেশের ছাত্র-জনতা, স্বৈরশাহীর গুলিতে সেদিন প্রাণ দিয়েছিল বুকে-পিঠে গণতন্ত্রের কথা লিখে রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেন, প্রাণ দিয়েছিল ডাক্তার মিলন। তাদের রক্তপাতের ফসল গণতন্ত্র মুক্ত হয়েছিল। এরপর আবারও, ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচনে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো। এরপর আর এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার দেখা পায়নি। অথচ যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনাকে হত্যা করলো সেই ভণ্ডরাই এদেশের মানুষকে আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। তারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে বলে, এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তারা জাতিকে বিভক্ত করে বলে, এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তারা বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে ভিনদেশি যানবাহন চলার সুযোগ করে দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে বলে, এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তারা কথায় কথায় মানুষ খুন করে, তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ খালি করে ফেলে, তারা নিজের বোনদের ধর্ষণ করে কেক কেটে শততম ধর্ষণের সেঞ্চুরী উদযাপন করে এবং আমাদের শেখায় এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যেসব অপরাধ করেছিল, ইয়াহিয়া-টিক্কা খান যা যা করেছিল, কোলাবরেটর বা রাজাকারেরা যা যা করেছিল, সেসব করে তারা আমাদের বলে, এসবই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তারা এক দেশে দুই নীতি চালু করে, যারা তাদের স্তাবক তারা হয় প্রথম শ্রেণির নাগরিক, বৈধ-অবৈধ সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তাদের জন্য, আর যারা এইসব অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তারা নিম্ন শ্রেণির নাগরিক, তারা রাজাকারের মতো ঘৃণ্য উপাধিতে ভূষিত হয়।
আমরা ভেবেছিলাম এদেশের মানুষ হয়ত ভুলেই গেছে এগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে মানুষের ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অধিকার, নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অধিকার, এদেশের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও মানবতা দেখার অধিকার। ভেবেছিলাম নতুন প্রজন্মকে কে শেখাবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হয়ত বিভ্রান্ত এবং বিকলাঙ্গ একটি জাতি গড়ে উঠছে এই দীর্ঘ অন্ধকারের ভেতরে। কিন্তু না, আমাদের সকল আশঙ্কা এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে তারা জানিয়ে দিল, হে বঙ্গ জননী, আমরা সব জানি, ‘মাগো ভাবনা কেন?/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’।
মাথায় লাল সবুজের পতাকা বেঁধে ওরা যখন রাজপথে নেমে গাইতে শুরু করে, ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী’ তখন মনে হয়, আবার বুঝি ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/ রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল’। এদেশের চেতনার সূর্য অস্ত যায়নি। ভণ্ডদের আস্ফালন যতোই উচ্চকিত হোক তারুণ্যের জোয়ারে তা ভেসে গেছে।
২২/০৭/২০২৪
নিউইয়র্ক