spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যজিয়াউর রহমান : একজন ভিশনারি স্টেটসম্যান

লিখেছেন : মীর সালমান শামিল

জিয়াউর রহমান : একজন ভিশনারি স্টেটসম্যান

মীর সালমান শামিল


জিয়া নিয়ে বাংলাদেশে এখনো নির্মোহ মূল্যায়ন হয়নি।

বিএনপি শাহাবাগিদের প্যাচে পরে পপুলিস্ট রাজনীতি করতে জিয়াউর রহমানকে যুদ্ধের ঘোষক, যুদ্ধের নায়ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারণায় গুরুত্ব দেয়। তবে জিয়াউর রহমানের মূল ম্যাজিকাল ভূমিকা ছিল সিপাহী জনতা বিপ্লবে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দেশে বিবাদমান পক্ষ ছিল চারটা:

এক— জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একাংশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, সিপিবি, এবং রক্ষীবাহিনী।

দুই— সিরাজুল আলম খান এবং কর্ণেল তাহেরের জাসদ এবং তাদের সশস্ত্র গণবাহিনী।

তিন— মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একাংশ এবং সেনাবাহিনীর একানংশ।

চার— এ তিন দলের বাইরে সেনাবাহিনীর অরাজনৈতিক অংশ এবং জনতা।

সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া এই ক্ষমতার লড়াইয়ের বাইরে ছিলেন তবে ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বের জন্য তার সেনাবাহিনী এবং জনগণের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল।

শেখ মুজিবকে হত্যার বদলা নিতে নভেম্বর মাসে মুজিবপন্থী খালেদ মোশাররফ পাল্টা ক্যু করে যা ঠেকাতে মোশতাক আওয়ামী লীগের চার নেতাকে জেলের মধ্যে হত্যা করে।

তবে ক্রমেই খালেদ মোশাররফের শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকে এবং জেনারেল জিয়াকে বন্দী করে। এই অবস্থাতে সেনাবাহিনীর অরাজনৈতিক অংশ এবং জনতা সক্রিয় হয়। জিয়াকে জেল থেকে ধরে এনে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে দেয়। জিয়া দক্ষভাবে বিবাদমান পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনে।

এই চারটা পক্ষই অস্ত্র, জনবলে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং তাদের বৈদেশিক বন্ধুও ছিল। যদি জিয়া পরিস্থিতি শান্ত না করতে পারতেন তাহলে এই চার দল গৃহযুদ্ধে জরিয়ে যেত। মুজিবপন্থীদের সমর্থনে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতো এবং বাংলাদেশকে ভারত এনেক্স করে নিতো, যা ভারতের সেই ১৯৪৭ সালের পরিকল্পনা। জিয়াউর রহমান লিটারেলি বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য হওয়া থেকে রক্ষা করেন।


রাষ্ট্র প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথমেই জিয়াউর রহমান একাত্তরের সংবিধানের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন করেন।

১। ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনাতে— ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’(পরম দয়ালু, দয়াময় আল্লাহর নামে) সংযোজন করেন। সংবিধানের ৮(১) এবং ৮ (১ক) অনুচ্ছেদে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটি যোগ করেন।

২। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আরেক মূলনীতি সমাজতন্ত্র পরিবর্তন করে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’ করেন।

৩। ইসলামি রাজনীতির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

৪। একদলীয় বাকশাল বিলুপ্ত করেন।

৫। সংবাদপত্র থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

৬। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রর্বতন করেন।

৭। সব রাজনৈতিক দল উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।

৮। বাংলাদেশকে নাস্তিক কমিউনিস্ট বলয় থেকে বের করে মুসলমান বিশ্বের সাথে যুক্ত করেন। এটা করতে তিনি সংবিধানে একটা ধারা অন্তর্ভুক্ত করেন— ❝ রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন। ❞ [২৫(২) অনুচ্ছেদ]

◼️
মুসলমান বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনে জিয়াউর রহমানের কার্যক্রম ছিল বেশ সুদূরপ্রসারী। তিনি মুসলমান বিশ্বে বাংলাদেশকে একটা সম্মান জনক অবস্থানে নিয়ে যান।

১। ১৯৭৭ সালে বাদশা খালেদ বিন আব্দুল আজীজের আমন্ত্রণে সৌদি আরব যান জিয়াউর রহমান। যাবার আগে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের গবেষণা করার দ্বায়িত্ব দেন কোন গাছ মরুভূমিতে টিকতে পারে। বিজ্ঞানীরা জানান নিম গাছ।

তাই বাদশার জন্য উপহার হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিয়ে যান দশ হাজার নিম গাছের চারা। বাদশাহকে উপহার দেয়ার সময় বলেন- “গরিব মানুষের দেশের গরিব রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার।” বাদশাহ্ বহু দেশ থেকে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এই অদ্ভুত উপহার আগে তিনি পাননি। এই গাছ উষর মরুতে ছায়া দেবে শুনে তিনি বলেন অবাক হয়ে যান এবং বলেন, আজ থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পরস্পর অকৃতিম বন্ধু।

বাদশা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে চান। এ সময় জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরিব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশাহ তক্ষনাৎ রাজি হলেন। এবং শুরু হয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাইফ লাইন আরববিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি।

জিয়াউর রহমানের দেয়া সেই নিমের চারাগুলো আজ ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া সৌদি জুড়ে। আরাফাতের ময়দানে সবুজ শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে লক্ষ নিম গাছ। সউদি আরবের মানুষ প্রেসিডেন্ট জিয়াকে স্মরণ করে নিম গাছকে বলে “জিয়া সাজারাহ” বা জিয়া গাছ।

২। ১৯৮০ সালের ইরাক এবং ইরান যুদ্ধ শুরু হয়। তখন মুসলমান দেশগুলো একত্রে মিলিত হয় এই যুদ্ধ থামাতে। মুসলমান দেশগুলোর পক্ষ থেকে ৮ জনকে পাঠানো হয় ইরাক-ইরানের মধ্যে সমঝোতা করতে। এই আটজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। বাকীরা ছিলেন ওয়াইসির মহাসচিব, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, ইয়াসির আরাফাত, গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রমুখ। তারা সফলতার সাথে যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হোন।

বিদেশের পাশাপাশি দেশকেও সামগ্রিক ভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা তথা নাস্তিকতা এবং সমাজতান্ত্রিক ফ্যাবরিক থেকে বের করে মুসলমান প্রধান পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসেন। এজন্য—

১। বেতার ও টেলিভিশনে নামাজের সময় আজান প্রচার শুরু করেন।

২। বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস উপলক্ষে, বিশেষ করে ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে বরাত, শবে কদর এবং আশুরা পালন বেশ ঘটা করেই শুরু করেন।

৩। শবে বরাত, শবে কদর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ‘বাণী’ দেওয়া চালু করেন।

৪। বিভিন্ন সেনানিবাসে কেরাত প্রতিযোগিতা চালু করেন৷

৫। পাকিস্তান আমলে দেশে ইসলামিক একাডেমি’ ছিল। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার এটা বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ সালে একে ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ নামে চালু করা হয় তবে কার্যক্রম এবং বাজেট ছিল খুবই সীমিত। জিয়াউর রহমান ইসলামি ফাউন্ডেশনকে কার্যকর করেন।

৬। স্বতন্ত্র একটি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় তৈরি করেন।

৭। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করেন। ১৯৭৫ সালে দেশে ছিল ১,৮৩০টি আর ছাত্র ২,৯১,১৯১ জন। তিন বছরের মধ্যে, ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়ে হয় ২,৩৮৬ এবং ছাত্রসংখ্যা হয় ৪,৪১,২০০ জন।

◼️
জিয়াউর রহমানের আরেকটি গুন ছিল সততা। জিয়াকে নিয়ে একাধিক অভিযোগ থাকলেও তার সততা নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি। হুমায়ূন আহমেদ তার দেয়াল উপন্যাসে একটা ঘটনা উল্লেখ করেন—

❝ …শুক্রবার ভোরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নাস্তা খাচ্ছিলেন। আয়োজন সামান্য। চারটা লাল আটার রুটি। দুই পিস বেগুন ভাজি। একটা ডিম সিদ্ধ। জিয়ার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসেছেন তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর। জেনারেল মঞ্জুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এই আপনার নাশতা ? প্রেসিডেন্ট বললেন, হতদরিদ্র একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাশতা কি যথেষ্ট না ?

…জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছরের শাসনে প্রতি মাঘের শেষে বর্ষন হয়েছিল কিনা তা কেউ হিসাব রাখেনি, তবে এই পাঁচ বছরে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। অতি বর্ষনের বন্যা না, খরা না, জলোচ্ছাস না। দেশে কাপড়ের অভাব কিছুটা দূর হলো। দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া হলো না। বাংলাদেশের নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তে লাগলো। বাংলাদেশের মানুষ মনে করতে লাগলো অনেক দিন পর তারা এমন এক রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছে যিনি সৎ। নিজের জন্য বা নিজের আত্নীয়স্বজনের জন্য টাকা পয়সা লুটপাটের চিন্তা তার মাথায় নেই। বরং তার মাথায় আছে দেশের জন্য চিন্তা। তিনি খাল কেটে দেশ বদলাতে চান। জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোক দেখানো সৎ না, আসলেই সৎ। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল জিয়া পরিবারের কোনো সঞ্চয় নেই। ❞

— হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল, পৃ: ১৮৯, ১৯৩

ফ্যাসিবাদের মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক না, মূল সমস্যা হল সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক। বাকশালি শাসনে গত দের দশক ধরে চলা সাংস্কৃতিক প্রপাগাণ্ডা খোদ বিএনপির লোকদের মনস্তত্ত্বকেও প্রভাবিত করেছে। জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয় নেতা, এই সহজ সত্য কথাটা এখন বিএনপির কেউও স্পষ্ট করে বলতে পারে না।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ