কাজী জহিরুল ইসলাম
মুগ্ধ,
তোমাকে যখন এই চিঠি লিখছি তখন আমার করতলে,
সেলফোনের নীল আলোর নিচে,
তোমার বন্ধু রবিউলের একটি রক্তাক্ত স্ট্যাটাস,
বলাই বাহুল্য এই রক্ত তোমারই বুক থেকে নেমে এসেছে
এবং সেই রক্তে এখন ভেসে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
রবিউল লিখেছে, যখন তোমরা দুই বন্ধু স্বপ্নপুরি আবাসিক প্রকল্পের
এক টিনশেডে থাকতে,
রাতের কুয়াশা জমে জমে ভোরের দিকে টিনের চাল বেয়ে
গড়িয়ে পড়তো তোমাদের লেপের ওপর, তোমাদের জীর্ণ তোষকের ওপর,
এই রকম একটা দিন আমারও ছিল।
সত্তুরের দশকে, আশির দশকের শুরুর দিকে,
ঢাকার শহরতলী বাড্ডার এক টিনশেডে আমিও বেড়ে উঠেছি,
শীতের জমানো কুয়াশায় অজু করে তখন জেগে উঠত প্রতিটি ভোর,
সেই দারিদ্রের মধ্যে ছিল স্বপ্নের উষ্ণতা, মায়ের স্নেহ, পিতার ভালোবাসা, ভাই-বোনের আলিঙ্গন,
স্বপ্নের ওমে ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল আমার কৈশোর।
আজ, দু’হাজার চব্বিশ সালের জুলাই মাসে, নিস্তব্ধতার গভীরে ডুবে থাকা এক ভোরবেলা,
নিউইয়র্কের একটি সুসজ্জিত লিভিংরুমে বসে
রবিউলের স্ট্যাটাস পড়তে পড়তে
আমার দুচোখে জমা হচ্ছে স্বপ্নপুরির সেই কুয়াশা,
ভিড় করছে দূরের বাড্ডার কুয়াশাবিন্দুরা,
চশমার কাচ অতি দ্রুত ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
চশমার নিচে জমা হওয়া কুয়াশারা ক্রমশ ভারী হতে থাকে;
এবং এক সময় ওরা নিজেদের চেয়ে বড়ো হয়ে যায়,
চোখের সীমান্ত পেরিয়ে তখন নেমে আসে অপমানে লাল হয়ে ওঠা আমার দুই গালে;
এরপর সেই স্রোতধারা হরহর করে ছুটে যায় আরো গভীর কোনো বেদনাকেন্দ্রের দিকে,
সেই পবিত্র কুয়াশার জল গড়াতে গড়াতে ছুটে চলে আমারই বুকের বাঁ দিকটা লক্ষ্য করে;
সম্ভবত এখন আমি কিছুটা বাঁ দিকে ঝুঁকে বসেছি,
জলেরা কখনো ব্যাকরণের অবাধ্য হয়েছে, এমন শুনিনি।
এবার ওরা থমকে দাঁড়ায় ঠিক সে জায়গাটিতে,
যেখানে আমার সদ্য মেরামত করা হৃদয় প্রচণ্ড ক্রোধে রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো ধরাস ধরাস করে লাফাচ্ছে,
হয়ত আমার নতুন হৃদয়খানি এক আশ্চর্য চৌম্বক শক্তি অর্জন করেছে।
রবিউল আরো লিখেছে, তুমি খুব উদাসীন ছিলে,
একদমই নিজের খেয়াল রাখতে না,
আর ছিলে ভীষণ পড়ুয়া,
প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও ছুটে যেতে ক্লাসে,
যদিও মাঝে মাঝে শিক্ষকই ক্লাসে আসতেন না,
তবু তুমি জেদ ধরতে, হেরে গেলে চলবে না, পৃথিবীর মানুষ ঝড়-বৃষ্টিকে জয় করেছে কত আগেই,
মানুষ তুষারপাত ঠেলে কাজে যায়, ক্লাসে যায়,
মরুর হাবুব ঠেলে যায়,
পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ-পথ বানায়,
ডুবো জাহাজে চড়ে জলের অতল স্পর্শ করে,
আর আমি, রূপসা নদীর স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা এই আমি,
বৃষ্টির কারণে ক্লাসে যাবো না, সে-কী হয়?
ওরা, বন্ধুরা, তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে
মুগ্ধ হয়ে শুনত সেসব কথা,
বন্ধুরা যথার্থই বলতো, তোমার চোখ দুটি সারাক্ষণ হাসে,
কী মায়া, কী মায়া সে হাসিতে,
এজন্যই কী মা তোমার নাম রেখেছিলেন মুগ্ধ?
মা টেলিফোন করে বলতেন, বাবা রবিউল, তুমি মুগ্ধকে দেখে রেখো,
মা হয়ত জানতেনই না, তুমি এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছ,
তুমিই বরং দেখে রাখছ সহপাঠীদের,
যখন তোমার বন্ধুরা মেধার সঠিক মূল্যায়নের জন্য নেমে এসেছে রাজপথে,
বুক দিয়ে ওদের আগলে রাখবে বলে তুমি ছুটে গেলে মিছিলের পুরোভাগে;
তুমি যেমন বিশ্বাস করতে পারোনি, আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি,
আমাদেরই করের টাকায় কেনা বন্দুক, আত্মরক্ষার বুলেট,
আমাদের নিরাপত্তা দেবে বলে যারা শপথ করেছিল,
সেই জালিম শাসক, নির্দয় পুলিশ আমাদেরই বুক লক্ষ করে ছুঁড়তে পারে।
মুগ্ধ, তোমারই মতো আমিও একটি জীর্ণ টিনশেডে বেড়ে উঠেছি,
স্বপ্নের পথে ছুটতে ছুটতে আজ আমি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি?
একেই কী সাফল্য বলে? স্বপ্নের চূড়ান্ত লক্ষ্য?
নিজেকে আজ খুব অপরাধী মনে হচ্ছে, তোমাদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ রেখে আসতে পারিনি,
এখনও শাসক নামের নরঘাতকেরা
আমাদের সন্তানের বুক বুলেটের আঘাতে ঝাঝরা করে দেয়
ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের চেয়ে বহুগুণ অধিক নিষ্ঠুরতায়।
মুগ্ধ, তুমি চেয়েছিলে ছাত্ররা মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবে,
কিন্তু আফসোস এদেশের কোথাও মেধার কোনো মূল্যায়ন নেই,
দালাল, চাটুকার আর লুটেরাদের নখের থাবার নিচে আজ বাংলাদেশের মানচিত্র,
কিন্তু আমি হতাশ নই, আমরা যা করতে পারিনি,
তুমি, তোমরা তা করে দেখিয়েছ,
তুমি হেরে যাওনি মুগ্ধ, তুমি হারতে পারো না।
মুগ্ধরা হেরে গেলে যে হেরে যাবে বাংলাদেশ,
হেরে যাবে ইনসাফ,
হেরে যাবে মানবতা, মানুষের অধিকার…
তোমাদের রক্তে আজ নরোম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ,
এবার নরোম মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে সুশাসনের সোনালী শস্য,
বাংলাদেশ আজ বহুদিন পর খুঁজে পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা,
সেই চেতনার খোঁজ তোমরাই দিয়েছ;
তুমি চেয়েছিল পাষণ্ডদের হাত থেকে বন্ধুদের রক্ষা করতে,
ভেবো না তুমি ব্যর্থ হয়েছ,
তোমার নিথর দেহ আজ এতোই শক্তিশালী আর ভারী যে,
পুলিশের ধাওয়া, জলকামানের গোলা কিছুই তাকে নাড়াতে পারছে না,
বরং ওরা এখন তোমার ভয়ে ইঁদুরের মতো পালাবার গর্ত খুঁজছে।
তুমি হয়ত টের পাচ্ছ যে প্রতি মুহূর্তে তোমার হাতের সংখ্যা জ্যামিতিক হাড়ে বাড়ছে,
তোমার পায়ের সংখ্যা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে,
বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশের সকল হাত এখন মুগ্ধের হাত হয়ে উঠেছে,
সকল পা এখন মুগ্ধের পা,
তোমার পদভারে এখন কাঁপছে আটষট্টি হাজার গ্রাম,
কাঁপছে গণভবন,
স্বৈরাচারের অবৈধ প্রাসাদ তোমার পায়ের নিচে পড়ে
ডিমের খোসার মতো ভেঙে যাবে যে কোনো মুহূর্তে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৪ জুলাই ২০২৪