আমিনুল ইসলাম
অবক্ষয় বলতে আমরা মূলত মূল্যবোধের অবক্ষয়কেই বুঝে থাকি। কখনো কখনো এটি একটি আপেক্ষিক প্রপঞ্চ বটে। একদেশে যা অবক্ষয় বলে গণ্য, অন্যদেশে তা স্বাভাবিক জীবনাচরণ হিসেব স্বীকৃত হতে পারে। আমাদের দেশে নরনারীর প্রকাশ্যে চুম্বনকে মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে গণ্য করা হবে নিঃসন্দেহে; কিন্তু পশ্চিমা দেশে এটি ইতিবাচক জীবনাচরণ হিসেবে প্রচলিত। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রকাশ্যে ধূমপান একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ অথচ গ্রামবাংলায় এটি এখনও স্বাভাকিতায় গৃহীত এবং ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পশ্চিমাসভ্যতায় নারীর স্বল্পবসনা চলাফেরা প্রশংসিত, কিন্তু আমাদের সভ্যতায় এটি নিন্দনীয় আচরণ বলে পরিগণিত। আর ধর্মের দৃষ্টিতে দেখলে নর-নারীর মুক্ত চলাফেরার একটি বড় অংশই অবক্ষয় হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু অবক্ষয় শুধু একটি আপেক্ষিক প্রত্যয় নয়, এর সর্বজনীন রূপও বিদ্যমান। সর্বজনীন মূল্যবোধের ব্যাপক ধস সর্বজনস্বীকৃত রূপেই মূল্যবোধের অবক্ষয় । সততা, সত্যবাদিতা, ভালোবাসা, পরোপকার, দেশপ্রেম, মানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, দুর্বলকে সহায়তাদান, শিষ্টাচার-এসব দেশ-কাল-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সোনালি মূল্যবোধ হিসেবে গণ্য। এসবের ব্যাপক লংঘন তাই সবদেশে- সব সমাজেই- সবকালেই মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেব চিহ্নিত ও নিন্দিত। উল্লেখ্য, নীতিহীনতার বা অপরাধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা অবক্ষয় নয়, কিন্তু নীতিহীনতা বা অপরাধপ্রবণতা যদি গ্রাস করে ফেলে সমাজের বড় অংশকে, তবে তা অবক্ষয় বলে গণ্য।
কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষ। তারা প্রেম-ভালোবাসা-সত্য-সুন্দর-মানবতা-সর্বজীবে দয়া-সতেজ প্রকৃতির পক্ষের মুখপাত্র। তাই যখনই কোনো সমাজে মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটে, কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা তার বিরুদ্ধে কখনো প্রত্যক্ষভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেন, কখনোবা পরোক্ষভাবে নিজেদের মনোবেদনা ফুটিয়ে তোলেন। T. S. Eliot এর The Waste Land বা বিনষ্টভূমি আসলে ইউরোপীয় আধুনিক সমাজে মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয়, যাকে আমরা ধস বলে অ্যাখ্যায়িত করতে পারি, তারি শৈল্পিক রূপায়ন । আল মাহমুদ যখন বলেন, “মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিত সমাজ”, তখন সমাজ সম্পর্কে কবিদের গভীর ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা পরিস্কার হয়ে ওঠে। একজন হুমায়ন আজাদ যখন বলেন, “সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে”, তখন মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয়ের ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত সতর্কতার সবখানি ব্যঞ্জনা নিয়ে ভেসে ওঠে চিন্তক-ভাবুক-দেশপ্রেমিক-মানবপ্রেমিক মানুষের মানসপটে।
মানবজীবন এবং মানবসমাজ বৈপরীত্বের এক আশ্চর্য সহাবস্থান। যেখানে ধর্ম, সেখানেই অধর্ম; যেখানে আলো, সেখানেই অন্ধকার; যেখানে সভ্যতা, সেখানেই অসভ্যতা; যেখানে মিলন, সেখানেই বিচ্ছেদ; যেখানে বিশ্বাস, সেখানেই বিশ্বাসঘাতকতা; যেখানে পুঁজির পাহাড়, সেখানেই রিক্ততার হাহাকার; যেখানে স্বপ্ন, সেখানেই দুঃস্বপ্ন। সেভাবেই যেখানে মূল্যবোধের অনুশাসন, সেখানেই মূল্যবোধ লংঘন। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়-যুগে যুগে যখন কোনো সমাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে এবং সমাজ অধঃপাতে গেছে, তখনই সেই সমাজে আবির্ভাব ঘটেছে কোনো না কোনো মহাপুরুষের। আমরা যাদের নবী বলি, অবতার বলি, তারা আসলে ছিলেন পতিত মানবসমাজের ত্রাণকর্তা। আবার আরেকটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য যে এককালে যা মূল্যবোধ বলে সমাদৃত ছিল, তা সময়ের বিবর্তনে মূল্যহীন প্রথায় পর্যবসিত হয়েছে। অনেক মূল্যবোধই একসময় মূল্য হারিয়ে অচলপ্রথায় রূপান্তরিত হয়। তার মানে মূল্যবোধের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে দেশ-কাল-শিক্ষা ভেদে ভিন্ন হয়েও থাকে।
মানুষ একটি জটিল প্রাণী। তার চাহিদার শেষ নেই। ক্ষুধা, পিপাসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, বিনোদন-প্রভৃতি মৌলিক চাহিদা তো আছেই, এসব মিটে গেলে মানুষ চায় প্রাচুর্য, ক্ষমতা এবং ভোগবিলাস। সেসব জুটে গেলে তার মনে বাসা বাঁধে অন্যকে শাসন-শোষণ এবং দাবিয়ে রাখার প্রভুত্ববাদী বা সাম্রাজ্যবাদী লোভ। এভাবেই মানুষের চাহিদা লোভে রূপান্তরিত হয় এবং সেই লোভ পরিণত হয় সীমাহীন লিপ্সায়। সমাজে মূল্যবোধের ব্যাপক ও চরম অবক্ষয়ের মূলে আছে মানুষের বা কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ ও লিপ্সা। এই লোভ ও লিপ্সা নানাবিধ—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সেক্সুয়াল, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক প্রভৃতি। মানুষের মধ্যে অনেকটা সর্বজননীনভাবে সবচেয়ে বেশি বিরাজমান অর্থনৈতিক লোভ। মানুষের সম্পদের চাহিদার শেষ নেই। যত পায়, আরও চায়। নিজের অর্থলিপ্সা বা সম্পদলিপ্সা মেটানোর নেশায় সে সমাজের বা পৃথিবীর অপরাপর মানুষকে শোষণ, অন্য মানুষের বা অন্য দেশের সম্পদ নানা ফিকিরে কুক্ষিগত করতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্য মানুষের অধিকার, সুখ-দুঃখ তার কাছে তুচ্ছ বলে গণ্য হয়। সম্পদের নেশায় উম্মত্ত মানুষ হারিয়ে ফেলে মানবিক মূল্যবোধ। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সমতা, সাম্য, ভালোবাসা, মানবপ্রেম, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, দুর্বলকে রক্ষা করা, অসহায়কে সহায়তা দান প্রভৃতি মূল্যবোধ পদদলিত হয়। এটি যেমন ব্যক্তি পর্যায়ে ঘটে, তেমনি জাতিপর্যায়ে, রাষ্ট্রিক পর্যায়ে ঘটে থাকে। জমিদার-ভূস্বামী-সামন্ত প্রভু-খনিব্যবসায়ী-বহুজাতিক কোম্পানি-সাম্রাজ্যবাদী-উনিবেশবাদী রাষ্ট্র প্রভৃতি হচ্ছে শোষকশ্রেণীর মানুষ-গোষ্ঠী-রাষ্ট্রের উদাহরণ। মানবতা-সাম্য-ভালোবাসার কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন।
যারা যত বড় ডাকাত-দস্যু জোচ্চোর দাগাবাজ
তারা তত বড় সম্মানী গুণী জাতি-সঙ্ঘেতে আজ।
রাজার প্রাসাদ উঠিছে প্রজার জমাট রক্ত-ইঁটে,
ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে।
দিব্যি পেতেছে খল কলও’লা মানুষ-পেষানো কল,
আখ-পেষা হয়ে বাহির হতেছে ভূখারি মানব-দল!
কোটি মানুষের মনুষ্যত্ব নিঙাড়িয়া কলওয়ালা
ভরিছে তাহার মদিরা-পাত্র, পুরিছে স্বর্ণ-জালা।
পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়,
নিচে সেথা পাপ-শয়তান-সাকি গাহে যক্ষের জয়।
(‘চোর-ডাকাত’, কাজী নজরুল ইসলাম)
নজরুল ইসলাম উপস্থাপিত এই অর্থলিপ্সা তখন ছিল গোষ্ঠীপর্যায়ে; এখন তা বিস্তৃত হয়ে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্বে সামন্তশ্রেণী ও বেনিয়াদের মধ্যেই মূলতঃ সম্পদলিপ্সা প্রবলভাবে বিরাজ করতো; তখন শিক্ষক-ধর্মনেতা-কৃষক-শিক্ষার্থী-রাজনীতিবিদ-সমাজসেবক প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষ ছিলেন প্রায়ই নির্লোভ এবং পরোপকারই তাদের জীবনের ব্রত ছিল। কিন্তু এখন সামাজিক সেই মূল্যবোধ চাপা পড়ে গেছে সর্ববিস্তারী সম্পদলিপ্সার নিচে। এখন প্রায় সবার মাঝেই বেনিয়ামনের অধিষ্ঠান ও আধিপত্য। প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-শিক্ষালয়-ধর্মালয়-রাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই অর্থ নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অ্যারিস্টটল সংজ্ঞায়িত ‘সামাজিক জীব’ থেকে সরে এসে মানুষ হয়ে পড়েছে বহুপূর্বে অর্থনীতিবিদ স্টুয়ার্ট মিল কথিত ‘অর্থনৈতিক জীব’ (Economic Being)। অর্থই সকল অনর্থের মূল–এই প্রবাদবাক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সর্বত্র। টাকা যার,- তার কাছে ধরা দিচ্ছে সবাই এবং সবকিছু। টাকা থাকলে এখন প্রকৃত ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ না হয়েও এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়, কবি না হয়েও কবি হওয়া যায়, ভালেবাসার হৃদয় না থাকলেও প্রেমিক হওয়া যায়, শিল্প-সাহিত্যের প্রকৃত অনুরাগী না হয়েও শিল্প-সাহিত্যের সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক হওয়া যায়। টাকা থাকলে নিজে কিছু না করেও, নিজে কিছু না লিখেও পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করা যায়, কবি-উপন্যাসিক-কলামিস্ট হওয়া যায়। টাকা থাকলে পত্রিকার সাহিত্যপাতা অঘোষিতভাবে রিজার্ভ হয়ে যায়, পুরস্কার-সম্মাননা-ক্রেস্ট সহজলভ্য হয়ে ওঠে। অর্থের মূল্য এবং ক্রয়ক্ষমতা চিরদিনই ছিল। কিন্তু তারপরও আগে অর্থ সবকিছু কিনতে পারতো না। প্রেম-ভালোবাসা-বন্ধুত্ব-সাহিত্যখ্যাতি-এসব ছিল অর্থের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু এখন এসব ক্ষেত্রে অবক্ষয় ঘটেছে যে সবকিছুই ক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। সিনেমার গল্পকে ফুটিয়ে তোলার অপরিহার্য প্রযোজনে নয়, প্রযোজকের সীমাহীন বাণিজ্য বৃদ্ধিতে শুধু অর্থের বিনিময়ে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে নগ্ন বা প্রায়-নগ্ন হয়ে পর্দায় উপস্থিত হয়ে চলেছে উচ্চশিক্ষিত নায়িকার দল। পেটের দায়ে নয়, বহুকথিত সেলিব্রেটি হতে এবং মূলত অর্থের মোহে দেহ বিনিয়োগ করছে উচ্চশিক্ষিত ও অধিকারসচেতন নারী। আর বিবেক বিসর্জন দিয়ে পুরুষরা দর্শক-প্রযোজক হয়ে মেটাচ্ছে লালসা ও অর্থলিপ্সা। অর্থের লোভের কাছে তুচ্ছ যাবতীয় মূল্যবোধ। তো এখন টাকাই সব। এখন টাকা চায় প্রাণী, টাকা চায় ইঁট-কাঠ-পাথর; টাকা চায় প্রাণ, টাকা চায় প্রাণহীন মূর্তি। প্রেম টাকা চায়, বন্ধুত্ব টাকা চায়, এমনকি ধর্মও টাকা চায়। আল মাহমুদ যখন তাঁর ‘সোনালি কবিন’-এ বলেন,“মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিতসমাজ”, তখন অবক্ষয়ের অর্থনৈতিক চরিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভয়ংকর ব্যাপার এই যে এই সম্পদকেন্দ্রিক লোভ-লিপ্সার কাছে কোনো নৈতিকতা-মূল্যবোধ-বিবেক-মানবতা-সুনীতির কানাকড়ি মূল্য নেই। এজন্যই এটি অবক্ষয়। আর এর চেয়ে বড় অবক্ষয় আর কি হতে পারে!
মানবজাতিকে সর্বনাশা অবক্ষয় থেকে সরিয়ে সঠিক পথে আনয়নের জন্য যুগে যুগে ধর্ম-অবতারগণ এসেছেন। তারা বিভ্রান্ত জাতি ও সমাজকে সঠিক পথে আনার সংগ্রাম করেছেন। ধর্ম মানবসভ্যতার গোড়া পত্তন করেছে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্ধ এবং ধর্মান্ধ ব্যক্তি বর্তমান সময়ে ধর্মের নামে বিভেদ, বৈষম্য আর আন্তঃধর্মীয় বৈরীতার সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর সকল ধর্মই শান্তির কথা বলে, সকল মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, সকল পথের ও মতের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলে। এসব হচ্ছে উদার ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিন্তু কিছু সাম্রাজ্যবাদী ও লিপ্সাকামী মানুষ ধর্মের উদার মূল্যবোধসমূহকে পদদলিত করে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, রক্তপাত, জাতিনিধন আর যুদ্ধের ধ্বংসলীলা ডেকে আনছে। অহিংসার ধর্ম পরিণত হচ্ছে হিংস্রতার-রক্তপাতের ধর্মে। ধর্মের নামে চলছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষ কর্তৃক অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের ধ্বংস-সাধন, অন্যধর্মের মানুষকে হত্যা, অগ্রিম প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ অথবা উচ্ছেদকরণ বা নিশ্চিহ্নকরণ। নির্দোষ শিশু-নারী-বৃদ্ধদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। এসব চরম প্রকৃতির অপকর্মে কখনো পরোক্ষভাবে -কখনো প্রত্যক্ষভাবে- মদদ দিচ্ছে বহুকথিত গণতান্তিক ও আধুনিক রাষ্ট্র। যুদ্ধ ছাড়াই প্রকাশ্য অন্যায় সংঘটনে ধর্ম ও রাজনীতির এমন ভয়ংকর যোগসাজস সভ্য মানবসমাজে ইতোঃপূর্বে দেখা যায়নি। মধ্যযুগের বর্বররা এদের কাছে নস্যি। এরা কেউ পূর্ববাংলার কসাই, কেউ বসনিয়ার কসাই, কেউ গুজরাটের কসাই, কেউ গাজার কসাই– অভিধায় অভিহিত হচ্ছে । ধর্মের ধ্বজাধারী নেতা বা ধর্ম-পুরোহিত তার ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য জগদ্বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদছবি হচ্ছেন দি ফেস অব বুদ্ধিষ্ট টেরর এমন ধরনের ক্যাপশনসহ। এমনকি ধর্মের দোহাই দিয়ে একইধর্মের মানুষকে হত্যা করে চলেছে সেই ধর্মের পতাকাবাহী আরেকদল মানুষ। শিশু-গণহত্যায় তাদের উৎসাহের কমতি নেই। এর জন্য ধর্ম দায়ী নয়, দায়ী ধর্মের ধ্বজাধারী মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও অধঃপতন। মানুষ তার মূল্যবোধের কারণেই মানুষ। মানুষ তার মূল্যবোধ হারালে আর মানুষ থাকে না; সে হয়ে যায় মানুষরূপী ইতর পশু। কবিরা চিরদিন হানাহানির বিরুদ্ধে, রক্তপাতের বিরুদ্ধে, অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে। মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখে, মানুষের অমানুষে পরিণত হতে দেখে ব্যথিত হয়ে উঠেছেন কবি।
গরিলারা দলে দলে তড়িঘড়ি কামিজ পাৎলুন
প’রে মসজিদ গুঁড়ো করে আর আগুন ধরায়
দেবালয়ে; মানুষের স্বপ্নের বসতি পোড়ে, তাজা
রক্ত বয় পথে, ত্রাস-তাড়িত তরুণী মুক হয়
যূথবদ্ধ লালসার লকলকে নিঃশ্বাসে এবং
গরিলারা ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ে শহরে ও গ্রামে।
কান্নাও আসে না আর; প্রতিবাদ শরাহত পাখি,
যা কিছু গৌরবদীপ্ত ত্রস্ত সব বিবরে লুকায়।
মানুষকে দেখেই মানুষ প্রাণপণে পালাবার
পথ খোঁজে, বন্য পশুদের আজ বড় হাসি পায়।
(‘গরিলারা দলে দলে’, শামসুর রাহমান)
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়ংকর অবক্ষয় ঘটে চলেছে। এযাবৎ আবিস্কৃত শাসনব্যবস্থার মধ্যে গণতন্ত্রকে সর্বোত্তম ধরা হয়। কিন্তু সেই গণতন্ত্রের এখন ভয়ংকর অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়করা অন্যদেশের গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরে সেখানকার স্বেরশাসকদের মদদ দিচ্ছেন অথবা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে উসকানি ও মদদ দান করছেন। নিজদেশের জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে অন্যদেশের জনগণের ওপর অন্যায়ভাবে চালানো যুদ্ধ, গণহত্যা ও ভূমিদখল ইত্যাদি চালানো আগ্রাসী রাষ্ট্রকে সমর্থন করছেন , আর্থক ও সামরিক সহযোগিতা দিচ্ছেন। এটা মানবিকতার বিরুদ্ধ আচরণ। এটা রাজনৈতিক মূল্যবোধের চরম অধঃপতন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রগণ নিজেদের সভ্য, গণতান্ত্রিক ও উন্নত মূল্যবোধের ধারক বাহক বলে দাবি করে থাকে। অথচ পৃথিবীতে চালিয়ে আসছে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, অর্থনৈতিক লুটপাট ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। গণহত্যা, লুণ্ঠন, ভূমিদখল এসব তারার চালিয়ে আসছে গণতন্ত্রবিরুদ্ধ আচরণ এবং মানবতার চরম অবমাননা। কবির কলমে এই ভয়ংকর অবক্ষয় ও অধঃপতনে ছবি আঁকা হয়েছে এবং হচ্ছে।
ক.
তোমার বোমায় আজ ধ্বংস নগরী,
তোমার বোমায় আজ চূর্ণ সভ্যতা,
তোমার বোমায় আজ চূর্ণ সম্ভাবনা,
তোমার বোমায় আজ বিলুপ্ত স্বপ্ন।
———- —————
আমেরিকা তুমি হিসেব করো, নিজেকে ঘৃণা করো তুমি আমেরিকা।
[‘আমেরিকা’, তসলিমা নাসরিন]
খ.
আমেরিকা, তুমি তুঝতে পারছো না-,
নির্বান্ধবতার অন্ধ আবর্তের দিকে
কীভাবে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছো তুমি।
আমেরিকা, তুমি বুঝতে পারছো না-,
কীভাবে ক্রমশ তুমি পরিণত হচ্ছো
পাপ আর অন্যায়ের উৎসভূমিতে ।
(‘আমেরিকা আপডেটেড’, নির্মলেন্দু গুণ)
আবার কোথাও কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে নির্বাচিত ওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘু কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো হচ্ছে অত্যাচারের স্টীম রোলার। অথচ গণতন্ত্রের প্রধান মূল্যবোধ হচ্ছে Majority must be granted but minority should be respected. কিন্তু মানা হচ্ছে না এই মূল্যবোধ। সংখ্যালঘু দুর্বলদের ওপর পরিচালিত হচ্ছে সকল রকমের নিপীড়ন ও নির্যাতন। জনগণের স্বার্থ দেখার কথা বলে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসার পর জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন, বিদেশে অর্থপাচার, ধর্ষণ, গৃহদাহ, ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের নামে বিনাবিচারে হত্যা এসব করা হচ্ছে। মানবতার এই অপমৃত্যু এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধের এই ভয়ংকর অবক্ষয়ের চিত্র বিভিন্ন দেশের মানবতাবাদী কবিদের কবিতায় ফুটে উঠছে।
পাল্টে দিয়েছ আমার স্বদেশ
ধ্বংস হয়েছে ভরসা
গণহত্যায় গণধর্ষণে
গণলুণ্ঠনে সহসা
রাষ্ট্রের বুকের ওপর
ধর্ষণ চলতে থাকে
বেঁচে আছি এ কোন্ দেশে!
বেঁচে আছি সত্যি নাকি!
(‘আমি গুর্জরি মুসলিম মেয়ে’, মল্লিকা সেনগুপ্ত)
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায়- মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপক ও ভয়াবহ অবক্ষয় ঘটেছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন আন্তঃজাতি, আন্তঃধর্ম, আন্তঃঅঞ্চল, আন্তঃবর্ণ দ্বন্দ্ব প্রকটতর। একদেশ আরেক দেশকে দাবিয়ে রাখার মানসে, এক জাতি আরেক জাতিকে শাসন-শোষণ করার লক্ষ্যে, একধর্মের মানুষ কর্তৃক অন্যধর্মের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে এবং এক অঞ্চলের মানুষ কর্তৃক অন্য অঞ্চলের মানুষকে বশীভূত করার কুমতলবে ছলে-বলে-কৌশলে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর অনিবার্য ফল একের পর এক ভয়াবহ মারণাস্ত্রের আবিস্কার এবং নানা অছিলায় সবল রাষ্ট্র কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালানো, গণহত্যা এবং লুটপাট। একদিকে অনাহারে-অপুষ্টিতে-অচিকিৎসায় মারা যাচ্ছে কোটি কোটি শিশু-বৃদ্ধ-নারী, অন্যদিকে সমরাস্ত্র নির্মাণে ব্যয়িত হচ্ছে পৃথিবীর প্রভূত সম্পদ, মেধা ও সময়। আধুনিককালপূর্ব সময়ে যুদ্ধ হলেও তখন যুদ্ধের একটা নীতি ছিল। এখন সেটা নেই। আগে সমরাস্ত্র নির্মাণে এভাবে সম্পদ ব্যয়িত হতো না। এখন মানুষ মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তার সকল মেধা , সময় ও সম্পদ ব্যয় করছে। মানুষ এখন মানুষের কাছেই সবচেয়ে মূল্যহীন। মানুষই এখন মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। মানুষই মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আরও আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জীবনানন্দ দাশ মানুষের হিংস্রতা ও রণলিপ্সা দেখে বেদনার্ত কন্ঠে বলেছিলেন যে আধুনিক যুগের সভ্য মানুষ তার র্ববর কর্মকান্ড দিয়ে পৃথিবীকে জঙ্গলে পরিণত করেছে। তাঁর খেদোক্তি ছিল: “নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়- লিবিয়ার জঙ্গলের মতো/ তবু জন্তুগলো আনপূর্ব অতিবৈতনিক-বন্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।’’ (‘রাত্রি’ , জীবনানন্দ দাশ)। মানুষের মানিবক মূল্যবোধের এতটাই অবক্ষয় ঘটেছে যে জীবনানন্দ এসব শিক্ষিত ও বহুকথিত ‘সভ্য’ মানুষদের ‘জন্তু’ বলে অ্যাখায়িত করেছেন যারা পশুরও অধম অথচ শুধুমাত্র বাহ্যিক লোকলজ্জার কারণে কাপড় পরে থাকে। এরা ভেতরে ভেতরে পশুদের মতোই উলঙ্গ ও নির্লজ্জ। সে-অবস্থার এখন আরও অধঃপতন ঘটেছে। আজ বিশ্বমানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, বিশ্বশান্তি- এসকল বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রকাশ্যে ও সদম্ভে ভূলুণ্ঠিত ও পদদলিত হচ্ছে। এ হচ্ছে বিশ্বমানবতার সবচেয়ে বড় অবক্ষয়। কবিরা বিশ্বমানবতার পতাকাবাহী। পৃথিবীর এককোণে বসবাস করেও তারা লক্ষ রাখেন বিশ্বব্যাপী।
ক.
নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না।
(‘অশ্লীল সভ্যতা’, হেলাল হাফিজ)
খ.
কোথায় মানবতা সাম্য, বর্ষার মেঘগুলো ভারী হয়ে উঠছে আধুনিক দুঃখে;
আধুনিকতার অভিঘাতে পৃথিবী জর্জরিত, দিশেহারা-
পৃথিবী অস্ত্রের ভারে নুয়ে পড়ছে
পাখি মারার জন্য সামান্য গুলতিই যথেষ্ট ছিল;
মানুষ মারার জন্য এলএমজি, থ্রিনটথ্রি, রিভলভার,
পরমাণুবোমা ড্রোন রোবট।
(‘আধুনিক পৃথিবী অস্ত্র তৈরীর কারখানা’, মনির ইউসুফ)
অ্যারিস্টটল বলেছেন মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব এবং যে তা নয়, সে হয় পশু, নাহয় দেবতা। আর বর্তমান যুগে সকল মানুষই রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র। সত্যি কথা বলতে কি এখন কোনোকিছুই রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে না। আর সুষ্ঠু রাজনীতিরও নিজস্ব কিছু সোনালি মূল্যবোধ আছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান মূল্যবোধ হচ্ছে– সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা এবং সংখ্যালগিষ্ঠদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা। বাকস্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, জনগণের নির্বিঘ্ন ভোটাধিকার, জনগণের রায় মেনে নেয়ার মন, ন্যায্য পরাজয় স্বীকার করে নেয়ার মানসিকতা, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস—ইত্যাদিতে বিশ্বাস রাখা এবং এসব মেনে চলা হচ্ছে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক মূল্যবোধ। কিন্তু এসব রাজনৈতিক মূল্যবোধে এখন ধস নেমেছে। সাম্প্রদায়িকতা, মিথ্যাচার, ভন্ডামি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ভোট ডাকাতি, প্রতিপক্ষের চরিত্রহনন, প্রতিপক্ষকে ধ্বংসকরণ, ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা, গডফাদার-গিরি, নিজের দলের অপকর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং দলীয় দুস্কৃতিদের প্রশয় ও প্রটেকশন প্রদান, রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি অবক্ষয় রাজনীতির অঙ্গনকে কলুষিত করে তুলেছে। বলা হয় মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে আর সমাজের পচন শুরু হয় রাজনীতি থেকে। রাজনীতির প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে পড়ে বিধায় রাজনৈতিক অবক্ষয় অন্যান্য সকল সেক্টরে নানাবিধ অবক্ষয়ের জন্ম দিচ্ছে। খুনী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু, টেন্ডার ছিনতাইকারী, নারী নির্যাতনকারী, কালোটাকার মালিক, ঋণখেলাপী, ব্যাক লুটপাটকারী, শেয়ারবাজারের ডাকাত, বিদেশে টাকা পাচারকারী- প্রায় সকলেরই মূল আশ্রয়-প্রশয় রাজনৈতিক শক্তি। কোনো কোনো রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণকারীরা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু ভোটের জন্য কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর গণতন্ত্র। সে-গণতন্ত্রে মাইনোরিটির নিয়তি অপমান-নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ এবং অস্তিত্বসংকট। এশীয় কিছু কিছু দেশে রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশ নানারূপ ফৌজদারী অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্ন সময় জরিপ রিপোট এবং সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই নির্বাচন-প্রাক্কালে জনগণকে দেয়া জনসেবা-দেশসেবার প্রতিশ্রুতি বিসর্জন দিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি-ধনদৌলত বৃদ্ধিতে ব্যবহার করছেন রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পদ। জনগণকে রয়ে যাচ্ছেন প্রতারিত ও ভাগ্যবঞ্চিত। জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ছবি কবিদের কবিতায় প্রায়শ চোখে পড়ে।
ক.
তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি,
পুনরায় মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যা আগ্রাসী খুন
মানুষের ছড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষণœ মিথুন
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন
উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি..’
(‘অসভ্য দর্শন’, আবুল হাসান)
খ.
আমরা কখনো বিজয় দেখিনি, দেখেছি কেবল হানাহানি
রাজনীতি মানে: চাই মসনদ; দুধভাত নিয়ে টানাটানি।
চেয়েছি জীবন পেয়েছি মৃত্যু; রাজনীতি মানে মালপানি-
ব্যালটের দাবি বুলেটে মেটায়; এই আমাদের সম্মানি।
(‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের গান’, আবিদ আজাদ)
গ.
অতঃপর…ও জননী.একখানা সিল মেরে গণতন্ত্র লটারিতে
ভাগ্যটা যাচাই করি…
যদি লাইগ্যা যায়। লাগে না তো…
যে যায় লঙ্কায় তিনি রাবণই বটেন !
(‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’, রহমান হেনরী)
গ.
খুন করার পর থেকেই নিজেকে বেশ পুণ্যবান মনে হচ্ছে
খুনেও এত আনন্দ!
তা-ও দিনদুপুরে আস্ত একটা খুন
প্রকাশ্যে ফুলরঙের উজ্জ্বলতায়!
কাল পত্রিকায় ছাপা হবে
একজন আদর্শ খুনির ছবি ও খুনের ঘটনা
সাংবাদিকরা অবশ্য রসটস দিয়ে ভালোই লিখবেন
দু’একটা পোজ দিয়ে ছবি তোলা থাকলে ভালো হতো
কিন্তু শালা থানাটাকেই মনে হচ্ছে ধর্মশালা
পুলিশ আমাকে দেখেই বলল-এখানে খুনির জায়গা নেই
দয়া করে সংসদে যান।
(‘খুনি’, চন্দন চৌধুরী)
পৃথিবী থেকে পুঁজিবাদী শোষণ দর করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের অপর নাম ছিল প্রগতিশীলতা। তাছাড়া প্রথাবদ্ধতার অচলায়তন ভেঙ্গে বিজ্ঞানচেতনাভিত্তিক চেন্তাভাবনা ও জীবনযাপনের নামও প্রগতিশীলতা। এটি একটি প্রাগ্রসর মূল্যবোধ। জীবন ও পৃথিবীকে অলোকিত পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধের ভূমিকা বাতিওয়ালার বাতির মতো। আধুনিক সমাজে যেকোনো মানুষ নিজেকে প্রগতিশীল বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন। কিন্তু প্রগতিশীলতার মধ্যেও অথবা বলা যায় প্রগতিশীল নামধারী মানুষের মধ্যেও ব্যাপক পচন ধরে গেছে বহু আগেই। প্রকৃত ত্যাগের মানসিকতা ছাড়া কারো পক্ষে যথার্থ প্রগতিশীল হওয়া বা প্রগতিশীল থাকার অবকাশ নেই। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রলোভনে এবং আধুনিক ভোগবিলাসের মোহে একসময়ের প্রগতিশীল যোদ্ধারা হারিয়ে ফেলেছেন ত্যাগের মনোভাব, সেবার মানসিকতা। তারা সম্পদলিপ্সা, ক্ষমতালিপ্সা আর ভোগবিলাসের স্রােতে বেসে গেছেন। মুখে প্রগতির কথা বললেও তারা কাজেকর্মে ভোগবাদী ও লোভী। তাদের এই দুর্ভাগ্যজনক অধঃপতন পৃথিবীব্যাপী চরম-পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়নকে লাগামহীনভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠতে প্ররোচিত করেছে। সমাজে কোনো আইডল বা আদর্শের উদাহরণ না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম আদর্শহীন ফাঁপা মানুষ হয়ে বেড়ে উঠছে। সমাজে দুর্নীতি, লোভ, অমহৎ ভোগবিলাস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এ এক মহা অবক্ষয়। কবির শাণিত চোখে ধরা পড়েছে এই ছবি। তিনি অপরিসীম বেদনায় উচ্চারণ করেছেন তার ক্ষোভ ও ঘৃণার কথা।
এই দেশে আলুর দরে বিকিয়ে গেছে শুভবুদ্ধি।
রাজনীতি ল্যাজকাটা শেয়াল।
‘প্রগতি’ তথা ‘প্রগ্রেসিভ’ শব্দটাকে নিয়ে
কন্ডোমের মতো ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে।
(‘একজন লেখকের অহংকার’, আবুবকর সিদ্দিক)
আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষাসংক্রান্ত মূল্যবোধের অবক্ষয় ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক মদদে ছাত্র-রাজনীতির নামে চলে আসছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হলদখল, খুনাখুনি, ছিনতাই এবং সেক্সুয়াল অপরাধ। গুণগত উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ধ্বংসপ্রায়। প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফলাফলে জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ এবং দলীয় বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদান- এমনতর অভিযোগের শোনা যাচ্ছে হরহামেশাই। ছাত্রনেতা মানে সেসনহীন ছাত্রজীবন এবং অনুপার্জিত অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া। আগে কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে পুণ্যস্থান সমতুল্য ভাবা হতো। ছাত্রানং অধ্যয়নং তপঃ। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল সেই তপোবন। আগে এদেশের প্রতিটি মহৎ আন্দোলনে সামনে থেকে অংশগ্রহণ করেছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বন্যায়-শীতে-ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীরা। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেই ভাবমূতি অনুপস্থিত। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কে অধঃপতন ঘটেছে। সমাজের মানুষের কাছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভাবমূতিও অনুজ্জ্বল এবং অনেক ক্ষেত্রে কলুষিত ও কালিমালিপ্ত। শিক্ষার পরিবেশ ও মান শোচনীয়ভাবে নিচে নেমে গেছে। ফলে আমাদের কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বজরীপে নির্বাচিত ৫০০/১০০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও ঠাঁই পাচ্ছে না। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে দাবিকারী প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহ তার বা তাদের সেই দাবিকে হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখন আর এদের কোনো সুনাম নেই, স্বীকৃতি অবশিষ্ট নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই অবক্ষয়ের ছবি কবিতায়ও ঠাঁই করে নিয়েছে।
শিক্ষার প্রতিটি প্রাঙ্গণ কিশোর হত্যার মহাপাপে এখন রক্তাক্ত, পঙ্কিল।
প্রকৃত পাপীদের বিনাশ ত্বরান্বিত করতে তুমি কি বাংলাদেশের
প্রতিটি বিদ্যাপীঠকেই বিরাণ করে ফেলবে?
এমনিতেই গ্রামে গ্রামে ধসে পড়া স্কুলবাড়ির ভেতর থেকে
শেয়াল আর পেঁচার ডাকে প্রাইমারি স্কুলের আবু মাষ্টারের ঘুম নেই
তার ওপর তারই একমাত্র শহুরে পড়–য়া মেয়েটির গলার চেন ও হাতের বালা
জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা থেকে ছিনতাই হলো। বুকের ওপর ছুরি রেখে
খুলে দে হারামজাদী, চুপ।
আমরা তো চুপ করেই আছি, তবু হে পরওয়ারদিগার
জানতে সাধ জাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ডাকাতদের গ্রাম?
(‘কদর রাত্রির প্রার্থনা’, আল মাহমুদ)
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের মৌলিক পাথর্ক্য এই যে অন্যান্য প্রাণী শুধুই প্রাণী , কিন্তু মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী। একারণে মানুষের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘Human being is a rational animal.’ এই বিচারবোধ বা বিবেচনাবোধ অর্থাৎ র্যাশনালিটি হারিয়ে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে ন্যায়-অন্যায়ের ফারাক বোঝে এবং অন্যায়ের বিচার করে থাকে। প্রতিটি মানুষই বিচারক। প্রতিটি পরিবার, সংগঠন, অফিস এক একটি বিচারালয়। তথাপি প্রতিটি দেশে প্রতিটি সমাজে সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত বিচারালয় থাকে এবং আছে। আধুনিক সরকারব্যবস্থার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার তিনটি প্রধান স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের বিচার ও প্রতিকারের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারালয়। বিচারব্যবস্থার নিজস্ব মূল্যবোধ আছে। সেগুলো হচ্ছে-আইনের চোখে ধনী-গরীব, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সমান, বিচারকগণ নির্মোহভাবে নিরপেক্ষ, বিচারকগণ ভয় বা লোভের উর্ধ্বে, বিচার বিলম্বিত মানে বিচার অস্বীকৃত—ইত্যাদি। রাষ্ট্র অন্যায় করলে তার প্রতিকারেরও একমাত্র স্থান বিচারালয়। কিন্তু যদি সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে পড়ে! যদি বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-দলপ্রীতি-ক্ষমতাপ্রীতি-বর্ণবাদ-ধর্মীয় পক্ষপাত-রাষ্ট্রভীতি ঢুকে পড়ে! সেটা বিচারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এখন বিভিন্ন দেশে বিচারিক মূল্যবোধের কঠিন অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশেও কালোবর্ণের মানুষ শ্বেতবর্ণের বিচারকদের কাছে ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না। অহিংসার ধর্মের অনুসারী বিচারকগণ অন্য ধর্মের মানুষকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিচ্ছেন আর নিজধর্মের মানুষের সাম্প্রদায়িক গণখুন-ধর্ষণ-রাহাজানি-গৃহদাহ-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বেকসুর অব্যাহতি দান করে চলেছেন। আন্তর্জাতিক আদালত দুর্বল রাষ্ট্রকে শাস্তির আওতায় আনছে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল এর মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী-উনিবেশবাদী-লিপ্সাকামী যুদ্ধ-তৎপরতার প্রতি অন্ধ দৃষ্টি রেখে চলেছে। এসবই হচ্ছে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিচারব্যবস্থার অবক্ষয়। এসবের কোনোটাই কবির নজর এড়িয়ে যায় না। একসময় কাজী নজরুল ইসলাম বিচারের নামে অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুবিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন প্রকাশ্য আদালতে-যার মধ্যে উপনিবেশবাদী অত্যাচারী সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকের কাছে বিচারের নামে অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁতভাঙ্গা প্রতিবাদ ছিল। আজও গণসংগীতশিল্পীরা গেয়ে ওঠেন, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা!’ পরবর্তী যুগের কবিরাও নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেনি।
হায় আমাদের হাইকোর্ট, সুবিচারের সর্বোচ্চ প্রতীক ও ন্যায়দন্ড,
তোমার কী দশা হয়েছে! তোমার বহু কক্ষ বিশিষ্ট
বাহু ও বিতান আজ কোথায়?
তোমার স্থানচ্যুত গম্বুজটি এমনভাবে হেলে কাত হয়ে আছে,
দেখলে মনে হয়, কোনো মহামান্য প্রাজ্ঞ বিচারপতি
এক অসতর্ক মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ায়
তার কুঞ্চিত শ্বেতশুভ্র উইগ, মাথা থেকে মুখে এসে পড়েছে।
আমি হেলে পড়া সে মহান গম্বুজের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে
মনে মনে বললাম, ইওর লর্ডশীপ,
একনিষ্ঠ ন্যায়নিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে
আমি এর প্রতিকারার্থ সুবিচার প্রার্থনা করি।
(‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, আল মাহমুদ)
প্রতিটি রাষ্ট্রে-প্রতিটি সমাজে- আলোর প্রদীপধারী কিছু ব্যক্তি থাকেন। তারা সমাজকে-জাতিকে-রাষ্ট্রকে সঠিক পথ দেখান। রাষ্ট্র যখন অন্যায়ের সাথে আপোষ করে কিংবা নিজেই অন্যায়কারী হয়ে ওঠে, তখন তারা নানাভাবে প্রতিবাদ জানান। সমাজের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-অভিনেতা-দার্শনিক-সমাজবিজ্ঞানী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন এই শ্রেণির মানুষ। এরা সমাজের ভেতরের শক্তি। এই শক্তি হচ্ছে সাংস্কৃতিক শক্তি। একটি জাতিকে অসম সামরিক শক্তিবলে পরাজিত করা যায়, কিন্তু সে-জাতি যদি সাংস্কৃতিকভাবে ঐশ্বর্যশালী-শক্তিশালী হয়, তবে তাদের বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। মধ্যপ্রাচ্যে এবং ভারত উপমহাদেশে উপনিবেশবাদী বৃটেনের শেষ পর্যন্ত পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হওয়ার এটিই মূল কারণ। একই কারণে আরবরা বেশিদিন পারসিয়ানদের চেপে রাখতে অসমর্থ হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যদি পচন ধরে, যদি সমাজের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-অভিনেতা-দার্শনিক-সমাজবিজ্ঞানী-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় লোভ-ক্ষমতার কাছে বশীভূত হয়ে পড়েন, তবে সে-সমাজ অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিস রোগীর মতো ভেতর থেকে ক্ষয়ে যেতে থাকে। এই ক্ষয় হচ্ছে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। আল মাহমুদ যখন বলেন, “মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিতসমাজ’’, তখন আশাহত দৃষ্টির সামনে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের গভীর চিত্রটি ফুটে ওঠে। আবার আরেক ধরনের অবক্ষয় হচ্ছে অযোগ্যদের হাতে সাংস্কৃতিক-দার্শনিক নেতৃত্ব চলে যাওয়া। এমনটি হলে অকবিরা দখল করে বসে কবির আসন, মূর্খরা জেঁকে বসে পণ্ডিতের চেয়ারে, সাহিত্য-অজ্ঞরা হয়ে ওঠেন সাহিত্যবিচারক। একসময় এমন অবস্থা লক্ষ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তখন সেটা ঘটেছিল সীমিত পর্যায়ে। কিন্তু এখন সেই অবক্ষয় জবরদখল করে ফেলেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির সিংহভাগ অঙ্গন। ফলে জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ বর্তমানে আরও অনেক বেশি প্রকটভাবে এবং ব্যাপক মাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পথিবী অচল আজ তাহাদের সুপরামর্শ ছাড়া
যাদের গভীর আস্থা আছে অজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা নীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
(‘অদ্ভুত আঁধার এক’, জীবনানন্দ দাশ)
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের রূপটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিনেমায় নারীকে নতুন করে পণ্য করে তোলা হচ্ছে; কসমেটিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের সর্বগ্রাসী প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে সাহিত্য-সিনেমা-শিল্প-মিডিয়া সবকিছুকেই ব্যবহার করছে; সকল শ্রেণির মানুষকে শরীরসর্বস্ব ভোক্তা এবং বিমেষত নারীকে যৌন-পণ্যে পরিণত করছে। একাজে ভাড়া খাটছে বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পী, উপন্যাসিক, এমনকি সেলিব্রেটি নারীরগণও। মানুষের রুচি মেধার সৌন্দর্য থেকে, ব্যক্তিত্বের মাধুর্য থেকে সরে গিয়ে শুধুই যৌনতাসর্বস্ব শারীরিক সৌন্দর্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ শীর্ষক কবিতায় যে অবক্ষয়িত সমাজ-সংস্কৃতির আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, তা বাস্তবে রূপ লাভ করেছে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুল
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
(‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, হুমায়ুন আজাদ)
একটি সমাজের বা জাতির শেষপর্যন্ত মূলশক্তি তার জনগণ। জনগণই যোদ্ধা, জনগণই কর্মী, জনগণই পাহারাদার। রাষ্ট্রনায়কগণ, সমাজপতিগণ এবং সুশীল সমাজের সদস্যগণ যদি অধঃপাতে যান, তার প্রতিকার সম্ভব হয় গণজাগরণের ভেতর দিয়ে। সেখানে একসময় জনগণের ভেতর থেকেই উঠে আসে নেতৃত্ব। ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিক বিপ্লব, আফ্রিকার কালো মানুষের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই প্রভৃতি সেভাবেই সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু যদি সমাজের ভেতরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন ধরে, যদি ব্যক্তি নষ্ট হয়ে যায়, তখন সমাজ নিপতিত হয় গভীর-নিবিড় দীর্ঘ অন্ধকারে। সামাজিক মূল্যবোধের গণ-অবক্ষয় ঘটলে সে-সমাজে ব্যক্তি হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আর সমষ্টি হয়ে পড়ে ব্যক্তিত্বরহিত। সে-সমাজকে সুশৃঙ্খলায় ধরে রাখার মতো থাকে না কোনোকিছুই। সমাজ তার ভেতর থেকে শিথিল হয়ে পড়ে; সামাজিক বন্ধনগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। সামাজিক অসুস্থতা ও নৈরাজ্য দখল নেয় সবখানে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ অসম্ভব না হলেও তা হয় দীর্ঘদীর্ঘকাল সাপেক্ষ এবং অসাধ্য না হলেও হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। কারণ সেটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিবো কোথা!’- ধরনের চারিত্র্য পরিগ্রহ করে। আর সবাই নষ্ট হয়ে গেলে কে কাকে আরোগ্যের পথে নিয়ে যাবে? সবাই অন্ধ হয়ে গেলে কে কাকে পথ দেখাবে? কখনো কখনো কোনো কোনো সমাজে এমন সর্বব্যাপী গভীর-নিবিড় অবক্ষয় নেমে আসে। সমাজের এবং জীবনের নিবিড় শিল্পী হিসেবে সেটি কবিরাই দেখতে পান সবার আগে এবং সবচেয়ে সূক্ষ্ণভাবে। আমাদের দেশেও কখনো কখনো এমন অবস্থা দেখেতে পেয়েছেন বাংলার কবি।
মনে হয় আমি একা নই। আমরা সবাই নষ্ট ডিমের খোলস
ভেঙ্গে গেলে ভিতরে কেবল কালিমার ধারাস্রোত। লোলজিভ
শুয়োরের অমানব অবৈধ সংক্রাম।
আমাদের গলগণ্ডে মাংস নয় আমাদেরই অনাচারী দেশ
ফলিয়াছে।
এইসব অন্ধকারে আমি আজ -আমিও তো নষ্ট ডিম।
(‘নষ্ট ডিমের খোলসের শব্দ’, আবুল হাসান)
কোনো সমাজে ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্যশিল্প, বিচারালয় প্রভৃতি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যদি মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, তবে সে-সমাজে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে বাধ্য। পরিবারও সেই অবক্ষয়ের হাত থেকে রেহাই পায় না। তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতির মেরুদন্ড যুবসমাজ। ধর্মীয় হানাহানি, রাজনৈতিক সহিংসতা, সংকীর্ণ দলবাজি, শিক্ষাক্ষেত্রের নৈরাজ্য, বিচারব্যবস্থার অধঃপতন প্রভৃতি অবক্ষয় সমাজে সৃষ্টি করে পারস্পারিক অশ্রদ্ধা, অবিশ্বাস, অসহমর্মিতা এবং প্রেমশূন্যতা। মানুষ হয়ে পড়ে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক, অন্ধ দলবাজ, অন্ধ গোষ্ঠীবাদী । সমাজ ও জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাজত্ব করে অনৈক্য, বিভাজন ও নৈরাজ্য। ঐক্যমুখি মূল্যবোধের অনুপস্থিতিতে সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ববাজ অন্ধবিশ্বাস-অন্ধআনুগত্য যার অনিবার্য পরিণাম সংঘর্ষময় সমাজ। বর্তমান বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এমন একটি ছবি দেখতে পাই। আমাদের সমাজ এতটাই বিভক্ত ও সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে যে- এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো জাতীয় ইস্যুতেও এদেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে এখন আর একমত হতে পারে না। অর্থাৎ আমাদের ঐক্যবোধ ও একতার মন দুটোই নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছুতেই আমরা বিভাজিত ও বিভক্ত। অথচ নিকটাতীতে এদেশের মানুষ সহজেই একতাবদ্ধ হতে পারতো বলে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুটোতেই বিজয় অর্জিত হয়েছিল। আর এখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি অঙ্গনে বিরাজ করছে প্রতিকারহীন সংঘর্ষমুখি বিভাজন। মানুষ সত্যের পক্ষে নয়, সততার পক্ষে নয়, যুক্তির পক্ষে নয়, সময়ের দাবির পক্ষে নয়; মানুষ অন্ধ আনুগত্যে শুধু তার দলের পক্ষে, গোষ্ঠীর পক্ষে, সংকীর্ণ নগদ স্বার্থের পক্ষে। এখন নবীনদের কাছে প্রবীণরা নিজেদের কোনো আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন না; যুবসমাজ অনৈক্যে কলহমুখর; তো শিশুর চোখের সামনেও বড় কিছু থাকছে না। ফলে কোথাও সেই শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, মানসিক নিরাপত্তা নেই। এও একধরনের প্রতিমুহূর্তের নরকযন্ত্রণা।
এখানে প্রবীণমন ক্রীতদাস মত্ত ভীমরতির
এখানে যুবকচিত্ত অসুরের বিভক্ত কলোনী
এখানে শিশুর চোখে জন্মপটি উধাও আকাশ
নষ্ট লোনা হাওয়ায় ক্ষয়ে যায় বুনট জামদানি;
সিকস্তি শার্টের কলার রেঙে যায় উচ্ছ্বিষ্ট অধরে,
এখানে কুত্তার লেজে আধুনিকা খুঁজিছে মহিমা
এখানে হৃদয়ে নিত্য পদাঘাত তামাদি ফাউল
বিভ্রান্ত মননে জড় দিনযাপন নন্দিত নরকে।
(‘ক্ষয়ে যায় বুনট জামদানি’, আমিনুল ইসলাম)
পৃথিবীব্যাপী মূল্যবোধের গভীর ও ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে এবং ঘটছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বেনিয়া-স্বার্থে উৎপাদন ও বাজারজাত করে চলেছে নিত্যনতুন ভোগ্যপণ্য। একইসাথে মানুষকে ভোগবাদী প্রাণীতে পরিণত করার সব কৌশল ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ভোগে সুখ নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ–এই মহান প্রবাদবাক্যটিকে উল্টিয়ে দিচ্ছে তারা। নিজেদের স্বার্থে তারা পালন এবং নিয়ন্ত্রণ করছে মিডিয়া। অবাধ যৌনতাসহ সবরকমের অমহৎ ভোগবিলাসকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে মিডিয়ায়, সিনেমায়, নাটকে, উপন্যাসে, কবিতায়—সর্বক্ষেত্রে। পাল্টে দেয়া হচ্ছে শিল্প-সাহিত্যের উৎকর্ষের মাপকাঠি এবং নান্দনিকতার সংজ্ঞা। তারা তাদের বেনিয়া মতলব থেকেই সমরাস্ত্র উৎপাদন করছে এবং অস্ত্র বিক্রির বাজার সৃষ্টির জন্য নানাস্থানে সুকৌশলে যুদ্ধ বাধিয়ে দিচ্ছে। তাদের এই বেনিয়া-কার্যক্রমকে বিস্তৃত করে দিচ্ছে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বায়ন। ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই পুরাতন মূল্যবোধগুলো ধসে পড়ছে। কিন্তু তদস্থলে উত্তম কোনো নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছে না। এই অবস্থা সংক্রমিত হচ্ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও তার আওতার বাইরে নয়। তবে ইতিহাস বলে যে- কোনো খারাপ ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী হতে পারে না। সুতরাং এটা একটা ক্রান্তিকাল বলে ধরা নেয়া যায়। একদিন অবক্ষয় থেকে উত্তরণ ঘটবে। সেদিন হয়তো অনেক অনেক দূরে; হয়তোবা দূরে নয় অতোবেশি।
—-০০০—-
আমিনুল ইসলাম
কবি ও প্রাবন্ধিক
ঢাকা।
প্রকাশিত গ্রন্থ: ২৯টি।