তৈমুর খান
৬
ক্ষণিক আলোর উদ্ভাসন
১৯৮৩ সালের শ্রাবণ মাসে আমার পরের চার বছরের ছোট বোনটির বিয়ে হয়ে গেল মোরগ্রাম সংলগ্ন সালিশাণ্ডা গ্রামে। তখন থেকে মাঝে মাঝেই এই গ্রামেই আমার যাতায়াত। এই গ্রামে এসেই জানতে পারলাম আবদুর রাকিব(১৯৩৯-২০১৮) বোখারা হাজী জুবেদ আলী বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করেন। মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা পায়ে হেঁটে গেলেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যাবে। আত্মীয় কুটুম্বরা বলতে লাগলেন, তিনি খুব ভালো মানুষ। এলাকায় তাঁর খুব সুনাম। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর কাছেই তিনি খুব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাদের বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি তো সেই বাজারেও বহু কষ্টে পঞ্চাশ টাকা জমিয়ে ‘কাফেলা’ পত্রিকার গ্রাহক হয়েছিলাম। সেখানে প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই তাঁর লেখা পেতাম। আগ্রহ নিয়ে পড়তে পড়তে অনেকটাই তিনি পরিচিত ব্যক্তি তখন। কিন্তু একজন বড় মানুষের সামনে আমি কী করেই বা দাঁড়াব? আমার বৃহৎ দীনতা সর্বদা আমাকে সংকুচিত করে চলেছে। তাই আত্মগোপন করে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিন্তু কতদিন এভাবে রাখব নিজেকে? একবার সাহস নিয়েই কতকগুলি কবিতা লিখে খাতাসহ তাঁর কাছে পাঠালাম ওই বিদ্যালয়েরই এক ছাত্রের হাত দিয়ে।আমি দূরে থেকেই লজ্জানত অবস্থায় নিরীক্ষণ করতে থাকি। খাতাটি কয়েকদিন তিনি নিজের কাছে রেখে পরম যত্নে প্রতিটি কবিতা খুঁটে খুঁটে পড়েছিলেন। প্রতিটি কবিতার নিচে নিচে মন্তব্য লিখে জানিয়েছিলেন কোনটি উপযুক্ত এবং কোনটি আরও ভালো করা যেত কিভাবে। কোন শব্দের বদলে কোন শব্দটি লিখলে ভালো হতো, কোন চিত্রকল্পটির বদলে কোনটি লিখলে আরও ব্যঞ্জনাপূর্ণ হতো। একটা চিত্রকল্পে লিখেছিলাম—
“রাধিকার অশ্রু ঝরে বৃন্দাবন জুড়ে”
এই লাইনটির বদলে তিনি লিখে দিয়েছিলেন—
“সখিনার অশ্রু ঝরে মরু-কারবালায়”
তিনি বলেছিলেন, “রাধিকাকে নিয়ে অনেক সাহিত্য লেখা হয়েছে, কিন্তু সখিনাকে সেভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। বরং এইসব উপেক্ষিত ইসলামিক মিথকে বেশি করে ব্যবহার করা দরকার।” খুব সত্যি কথা, সেদিন আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি কখনো কবিতা লিখেননি, কিন্তু তাঁর মতো এত ভালো কবিতা বোঝার লোক খুব কমই দেখেছি। অভাব দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমার কবিতায় এক যন্ত্রণা ও শূন্যতার আবেগ সর্বদা সক্রিয় হয়ে উঠত। এই কবিতাগুলিতেও তাই এসেছিল অন্ধকারময় জীবনের ছবি। হতাশাগ্রস্ত দীর্ঘশ্বাসক্লান্ত এক ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার নানা কথা। তিনি তাই খাতার শেষে লিখেছিলেন, “হতাশ হলে চলবে না। মনে সাহস সঞ্চার করতে হবে। ভরসা করতে হবে একজনের উপরেই যিনি এই সারা জাহানের মালিক। নিশ্চয়ই একদিন সফল হতে পারবে।”
এই আশীর্বাদ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলাম। সেই দিন থেকেই তিনি আমার পথপ্রদর্শক। বীরভূম জেলায় সেই সময়ে নামকরা কবি ছিলেন কবিরুল ইসলাম(জন্ম ২৪ আগস্ট ১৯৩২)। তাঁর ‘কুশল সংলাপ’ আমাদের কাছেও প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনোদিনই তাঁর কাছে যেতে পারিনি। আবদুর রাকিব সহজ মনের দরদী একজন ভালবাসার মানুষ। তাই বহু চিঠিপত্রেই তাঁকে মনের কথা বলতে পারতাম। পরামর্শ চাইতে পারতাম। কিন্তু কবিরুল ইসলাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুনেছিলাম ইংরেজির অধ্যাপক। থাকেন সিউড়িতে। কবিতা লেখেন নামকরা পত্রপত্রিকায়। সেখানে আমাদের মতো অচেনা গ্রামীণ কিশোরকে তিনি চিনবেনই বা কেমন করে! যদিও অনেক পরে ১৯৯৮ সাল নাগাদ তিনিই আমাকে প্রথম দীর্ঘ চিঠি লেখেন। আমার কবিতা বিষয়ে তাঁর মূল্যায়ন চিঠিতেই প্রথম পাই। এবং এ কথাও তিনি স্বীকার করেন অনেক আগেই নাকি আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করা দরকার ছিল। সেই সময় থেকে মৃত্যুর আগে (২০১২, ১৯ জুলাই) অবধি নিয়মিত চিঠিপত্র লিখতেন। শুধু চিঠিপত্রই নয়, বারবার কাছেও ডাকতেন। তখন তাঁকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন পর্বতের মতো মনে হতো। কবিতাপ্রাণ মানুষটি সেভাবে সম্মানিত হননি। তাই এক সর্বব্যাপী অভিমান তাঁর মধ্যে জেগে উঠত। কবিতা লেখা যে তাঁর শখ ছিল না, জীবন রসায়নের এক অভিজ্ঞতা লব্ধ তীব্র আত্মক্ষরণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর—
“মানুষের পৃথিবীতে কবিও সন্ন্যাসী”
অথবা
“কবিতা রচনা যেন ঈশ্বরেরই স্তব”
পড়তে পড়তে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছি।
রাকিব কিন্তু অন্য মানুষ। গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি এক মাহাত্ম্যকে আবিষ্কার করেছেন, যে মাহাত্ম্যকে আমরা দেখতে পেতাম না—তা স্পষ্ট করে তুলেছেন। সামাজিক এক মূল্যবোধ এবং মানবিক প্রাচুর্যের অনবদ্য জাগরণ তাঁর সাহিত্য। অতিথিবৎসল মানুষটির বাড়ি যতবার গেছি, ততবার তিনি স্নেহে-মমতায় আপন করে নিয়েছেন। কখনো বিরক্তি বোধ করেননি। তাঁর প্রতিটি চিঠিপত্রই এক একটি মূল্যবান সাহিত্য। প্রকৃতি, জীবন এবং সময় সবকিছুকে ধারণ করেই তাতে ভবিষ্যতের কর্ম পন্থা নির্ধারণও স্পষ্ট হয়ে উঠত। একদিকে কর্তব্যপরায়ণতা, অন্যদিকে সৎ পরামর্শদাতা ছলনাহীন মানুষটিকে তাই অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে কখনো কার্পণ্য করতাম না। তাঁর ‘চারণ কবি গুমানি দেওয়ান’ বইটি আমার কাছে পাঠ করা আজ পর্যন্ত একটি শ্রেষ্ঠ বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। সেই বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোকপাতও করেছি। শুধু সাহিত্যের বিচারই নয়, ব্যক্তি জীবনেও তিনি আদর্শ মানুষ বলেই সর্বদা জেনে এসেছি। নাম-যশ-খ্যাতির জন্য তিনি কখনো অস্থির হতেন না। তাই নিজ জন্মভূমি এদরাকপুর গ্রামেই থেকে গেছিলেন।
আবদুর রাকিব, কবিরুল ইসলাম এবং বীরভূমের আরেক অনালোকিত কবি মাস্টার বনঅলি ওর্ফে আলি আহাদ ফুরকান (১৯৪২-২০১২) প্রায় সমসাময়িক তিন বন্ধুই ছিলেন। আলি আহাদ ফুরকান জমিদারের সন্তান হলেও সেভাবে আভিজাত্য বজায় রাখতে পারেননি। একটি সন্তান মারা যাওয়ার পর থেকেই শোকসন্তপ্ত হয়ে সাহিত্যচর্চা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যা লিখেছিলেন তা বিভিন্ন চিঠিপত্রেই সীমাবদ্ধ। একটা কাব্যও প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাঁর কবিতার মধ্যে একটা রোমান্টিক মনের বিছিন্নতা ধরা পড়ত। সেই সময়ের পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু গল্প-কবিতাও প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যিক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘মাস্টার বনঅলি’। তিনি প্রায় প্রতিদিনই একটি করে পোস্ট কার্ড আমাকে লিখতেন। পোস্টকার্ডের এক পিঠে থাকত কবিতা, অন্যপিঠে তাঁর আঁকা একটা ছবি। সাহিত্য জগতের নানা খবর তিনি দিতেন। সাহিত্যের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হলে, একটা বিড়ি বার করে দিয়ে নিজেও ধরাতেন। আর একটা কথা বারবার বলতেন, “নামেই দিঘি, কিন্তু ঘটি পর্যন্ত ডোবে না।” অর্থাৎ তিনি নামেই জমিদার, কিন্তু জমিদারের অবশিষ্টটুকুও নেই। জীবনের নানা টানাপোড়েনে এই মানুষটির কাছে বহু পরামর্শ পেয়েছি। কালস্রোতে হয়তো তাঁকে কেউ মনে রাখবে না, কিন্তু তাঁর যে হৃদয়ের স্পন্দন ছিল, আবেগের দীপ্ত বর্ণমালা ছিল, উপলব্ধির কাঁপন ছিল তা চিঠিগুলিতে বোঝা যায়। তাঁর কবিতার তিনটি লাইন এরকম—
“ঐ তো তোমার চোখ কলমের ঠোঁটে,
ঐ তো সে গভীরতা কালিময় দেহে—
বেঁচে ছিল একদিন মৃত কেউ এখানে;”
তিনি যেন এই সত্যই উচ্চারণ করে গেছেন নিজের সম্পর্কে। তাই কলমের ঠোঁটে তাঁকে যেমন দেখতে পাই, তেমনি কালিময় পংক্তিতে তাঁর দৈহিক গভীরতাও অনুভব করি। মরেও তিনি বেঁচে ছিলেন,কিংবা বেঁচেও মরেছিলেন এখানে।
তখনও তেমন কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশ না হলেও ঘরোয়া ছোটখাটো সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতে আমার যাতায়াত ছিল। প্রতিবছর বীরভূম জেলার ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন রাজগ্রাম মহামায়া উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ে বেশি নাম্বার পাওয়া মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করত। সেইসঙ্গে এই অনুষ্ঠানে সাহিত্য পাঠও হতো। এই বিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক কুদ্দুস আলি ‘চরৈবেতি’ নামে একটি পত্রিকা ও প্রকাশ করতেন।এই অনুষ্ঠানে কবিরুল ইসলাম ছাড়া বীরভূমের প্রায় সকল কবিকেই পেতাম। মধ্যমণি হিসেবে থাকতেন আবদুর রাকিব। এরকমই একটি অনুষ্ঠানে রাজগ্রামের এক কিশোর কবি ইমদাদুল হোসেন(১৯৭৪-১৯৯৮)-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মাধ্যমিক পাশ করেই তাঁর হাতে কবিতার যে নতুন ধারা উঠে আসতে থাকে তাতে অবাক না হয়ে পারি না। দরিদ্র পরিবারে মানুষ এক বিড়িবাঁধা শ্রমিক ঘরের সন্তান সে। কিন্তু সেই যুগেও ইংরেজি বাংলা, ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নাম্বার নিয়ে বিদ্যালয়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। অত্যন্ত মেধাবী এই তরুণ কম বয়সেই পড়ে ফেলেছে ওমর খৈয়াম, আমির খসরু, মির্জা গালিব প্রমুখ বহু কবির কবিতা। পরিচয় হওয়ার পর থেকে নিয়মিত সে আমাকে চিঠি লিখতে থাকে। তাঁর এক বুক দুঃখের কথা, জীবন সংগ্রামের কথা প্রতিটি চিঠির মধ্যে ফুটে ওঠে। কবিতায় রোমান্টিক ও বাস্তব জগতের অপূর্ব মেলবন্ধন দেখতে পাই। কখনো কখনো ইতিহাসও জীবন্ত হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পারস্য-ইসফাহানের বালিকার ঘুঙুর। বয়ঃসন্ধির যুবতীর স্বপ্নময় ইশারা। আবার ইতিহাসের ধূসর ধ্বংসাবশেষ। মীরকাসিমের বাংলার ছবি। বিহ্বল নৌকার ভেসে চলা। স্তন পান করা আটপৌরে শিশুর ঘুমন্ত মুখ। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন বেগুন বিক্রেতার ঝুড়ি। ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল’ নামে। কবিতাটি সাহিত্য মহলে যথেষ্টই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। আমাদের সমাজ সভ্যতার রূপ যেন ইক্ষুক্ষেত। ইক্ষু খেতে খেতে সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। টেবিল বাজিয়ে গান করছে। কেউ ব্ল্যাকবোর্ডে জবা গাছ আঁকছে। রুই মাছ আঁকছে। সিঁদুর পরা ছাত্রীরাও আছে। ‘হাওয়া হাওয়া’ গান করা ছাত্ররাও আছে। বাংলা সাহিত্যের পাঠক এরকম কবিতা পূর্বে কখনো পড়েছে কিনা জানি না। কিন্তু সেই ইমদাদুলই রেলের চাকায় কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করে মাত্র ২৪ বছরের জীবনে। একবার রামপুরহাট থেকে পায়ে হেঁটে আমার গ্রামের বাড়ি পানিসাইলে ইমদাদুল আসে। নানা অভাবের মধ্যেও সেদিন তাঁকে চাট্টি ভাত খাওয়াতে পেরেছিলাম। সারারাত জেগে দুজনে অনেক গল্প হয়েছিল। মানুষের মধ্যে এত দুঃখ কেন? কেন মানুষ এত দরিদ্র হয়? কেন মানুষ ভালো হতে পারে না? এসব প্রশ্নেরই বারবার সে উত্তর অনুসন্ধান করেছিল। কিন্তু কোনো কূলকিনারাই পাওয়া যায়নি। এক অন্ধকারের বিশাল গহ্বরে দুজনেই যেন তলিয়ে গেছিলাম।
পড়লাম । খুব ভালো লাগল । লিখুন ।