spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধজিয়াউর রহমান ছিলেন অনিবার্য

লিখেছেন : ফজলুল হক সৈকত

জিয়াউর রহমান ছিলেন অনিবার্য

ফজলুল হক সৈকত

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে, স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক-সামাজিক অগ্রগতির সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (জন্ম: জানুয়ারি ১৯, ১৯৩৬; মৃত্যু: মে ৩০, ১৯৮১)-এর নাম যে সব কারণে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত, তা আজকের প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তিনি রাজনীতি করে নেতা হননি বলে একশ্রেণির লোকেদের নোংরা রাজনীতির শিকার এই অতুলনীয় নেতা। রাজনীতি যে কেবল মাঠ থেকে হয় না– এর যে বিচিত্র ব্যঞ্জনা রয়েছে, তা আধুনিক বিশ্বে সচেতন মানুষের কাছে একটি স্বচ্ছ ধারণা হিশেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মানুষ এখন দেশকে, রাজনীতিকে, সমাজ ও মানুষকে নানান বিবেচনায় রেখে বিচার-বিশ্লেষণ করছে। ফলে, জিয়াউর রহমানের মতো রাজনৈতিক দূরদর্শি ব্যক্তি নতুনভাবে জনগণের সামনে মূল্যায়িত হচ্ছেন। বাংলাদেশ উৎপাদনে, উন্নয়নে বর্তমানে যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, তার চিন্তক ও উদ্ভাবক যে জিউয়ার রহমান, তা যে-কোনো গবেষণায় ধরা পড়বে; ১৯ দফার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাষ্ট্রভাবনার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এ দেশের সকলস্তরে। 

আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার প্রেসিডেন্ট জিয়া উন্নয়নের রাজনীতির ভিত স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এই সাহসী নেতার দুর্ভাগ্য হলো– তিনি বারবার অবমূল্যায়ন এবং রোষানলের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে বাহ্যিকভাবে নেতৃত্ব দিলেও কৌশলগতভাবে যুদ্ধকালীন নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন মেজর জিয়া। তিনি তখন পাকিস্তান সরকারের চাকুরিজীবী। তাঁর পোশাক ও অস্ত্র ছিল পাকিস্তানের। কী রকম সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, তা সাধারণের কল্পনারও অসাধ্য ব্যাপার। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে আদৌ মুক্তিযুদ্ধ হতো কি-না, সন্দেহ রয়েছে। তার প্রমাণ মিলবে যদি আমরা দেখি, মুক্তিযুদ্ধকালে ১১টি সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্বে কারা ছিলেন। তারা কি শেখ মুজিবের অনুসারী ছিলেন? তারা কি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন? কে বা কারা সেইসব সেনা অফিসারদের সমন্বয় করেছিলেন? এবং ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের ১জনও কি আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন– না-কি সকলেই বাহিনীর সদস্য? এসব প্রশ্ন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। মিডিয়া এবং গবেষণাকেন্দ্রগুলোও এর গভীরে যেতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা এবং মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা তৈরি হলে আরো নতুন নতুন তথ্য উন্মোচিত হবে। আর তখন, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ বা বিনির্মাণে তাঁর অবদান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান হঠাৎ করে আবির্ভূত হননি– সেই সময়ে তিনি ছিলেন অনিবার্য। সময়ের প্রয়োজনে তিনি প্রাগ্রসর চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। 

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মুত্যু, রাজনৈতিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিশেবে জিয়ার আবির্ভাব এবং বিএনপির জন্ম– প্রভৃতি ঘটনার পরম্পরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের মূল সূত্র। এই ধারাটিকে বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে– কেন মুজিবের পরাজয় হলো? কী করেছিলেন মুজিব? – বাকশাল গঠন করে তিনি এমন এক রাষ্ট্র-ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন, বিশ্বে যা প্রায় ৩০ বছর আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধচলাকালে বিভ্রান্ত চিন্তা বলে প্রমাণিত হয়েছে। ইতালির প্রেসিডেন্ট মুসোলিনী ‘পার্টি ন্যাসিওনাল ফ্যাসিস্টে’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯২১ সালে– যার মূলনীতি ছিল জনগণ রাজনৈতিকভাবে একজন ব্যক্তির প্রতিই আস্থাশীল থাকবে। বিশ্বরাজনীতি তাঁর এই চিন্তাকে মেনে নেয়নি। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী বিশ্বনেতারা একমত হন এবং নির্মিত হয় জাতিসংঘ। ফলত, মুসোলিনী এবং তাঁর বন্ধু জার্মানির হিটলারের নির্মম পরাজয় ঘটে। শেখ মুজিব মুসোলিনীর সৃষ্ট সেই ভুল পথে পা বাড়ালেন– জনগণের নেতা থেকে স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হলেন। তাঁর পতনও অনিবার্য হয়ে উঠলো। আর মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমান মুজিবের পতনের পর সকল চিন্তার, সকল দলের রাজনৈতিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথ তৈরি করেছেন। ১৯৭৫ সালেও জিয়াউর রহমানের অপরিহার্যতার পথ তৈরি হয় সমাজ-রাজনৈতিক কারণে; মুজিবের ধ্বংসস্তুপে নির্মিত হয় জিয়াউর রহমানের অনিবার্য উত্থান। এটি কোনো নাটকীয় পরিবর্তন নয়, কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা সামরিক ক্যু নয়– ধারাবাহিক রাজনৈতিক পরিণতি।

অপরাধী যেমন তার অপকর্মের কোনো-না-কোনো চিহ্ন রেখে যায়, তেমনই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও এমন নজির রেখে গেছেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন বিশ্লেষণ নতুন প্রজন্মের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তার মধ্যে একটি নজির হলো– যে বৈদ্যনাথতলায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অস্থায়ী সরকার গঠন হয়েছে, কখনও শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা সে স্থানটি পরিদর্শনে যাননি। কেন যাননি? যদি বৈদ্যনাথতলা আলোচনায় আসে, তাহলে কি মুজিবের অবদান খাটো হয়ে যাবে? – সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিংবা তাজউদ্দীন আহমদ আলোচনার কেন্দ্রে এসে গেলে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে? তখন কি জিয়াউর রহমানসহ তাঁর সেনা-সহকর্মীদের অবদান প্রধান হয়ে উঠবে? তখন কি বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস লেখা হবে? তখন কি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে– কেন জিয়া অনিবার্য ছিলেন?

একজন সেনা কর্মকর্তা, একজন রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত ও কাঠামো তৈরি করেছেন, তার সামরিক বিশ্লেষণ আজও সম্পন্ন হয়নি। তাঁর সহযোদ্ধা বিভিন্ন বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকদের স্মৃতিচারণ থেকে তৈরি হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস। এমনকি তাঁদের পরিজনদের কাছ থেকেও জানা যেতে পারে অনাবিস্কৃত উপাদান। প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রিয়তমা স্ত্রী মিলি রহমানের কথাও আলোচনায় আসতে পারে। তিনি কেন এতকাল নিশ্চুপ? কিংবা কেন তাঁকে রাজনৈতিক নেতা কিংবা মিডিয়া আড়ালে রেখেছেন? অন্যান্য বীরশ্রেষ্ঠের পরিজনেরা? – তারা কেন স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবহেলিত? সে-আলোচনায়ও কি জিয়াউর রহমান বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন– এমন ভয় রয়েছে নিভৃতে? মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর নথিপত্রও তো সব প্রকাশ হয়নি বোধহয়। তাতেও সম্ভবত জিয়াউর রহমানের সামরিক রাজনীতির ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। কে জানে, সেসব কথা? ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সামরিক গবেষণায়ও (অনাগতকালে) বেরিয়ে আসতে পারে জিয়াউর রহমানের অনিবার্যতার কথামালা। 

যারা বলেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিএনপির জন্ম, তাদের স্মরণে রাখা দরকার– সামরিক ঘাঁটি থেকে একজন অফিসার সেদিন দায়িত্ব না নিলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ হতো না। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের এতো নেতা থাকতে কেন জিয়াউর রহমান কালুর ঘাট বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন? তিনি ঘোষণা না দিলে কি নিরস্ত্র বাঙালি পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে পারতো? তিনি ঘোষণা না দিলে কি এতোগুলো সেক্টরে সেনা অফিসারগণ নেতৃত্ব দিতেন? বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হতেন? ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে লিয়াজোঁ কে করেছিল– মুজিব না জিয়া? এসব বিচিত্র জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে সামরিক অফিসার জিয়ার রাজনৈতিক চিন্তা এবং রাষ্ট্রগঠনে তাঁর ভিন্নদৃষ্টির পরিচয় মেলে। 

একটি বিপন্ন জাতিকে আলোর পথের সন্ধান দিয়েছিলেন একজন মেজর জিয়া; একটি বিধ্বস্ত দেশে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সূচনা করেছিলেন একজন প্রেসিডেন্ট জিয়া। গ্রামকেন্দ্রিক উৎপাদন ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ভেতর দিয়ে, নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তার প্রকাশে, দেশে-বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টি করে তিনি বাংলাদেশের নুয়েপড়া রাজনীতিতে যে নতুনধারা নির্মাণ করেছিলেন, তা আজও জাতিকে আলোর পথ দেখায়। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

কাজী জহিরুল ইসলাম on কবিতার জন্য নির্বাসন
নয়ন আহমেদ on কবিতাগুচ্ছ