spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআরশি নিকেতন : ৮

ধারাবাহিক আত্মজীবনী : তৈমুর খান

আরশি নিকেতন : ৮

তৈমুর খান

কবিতা জন্মের বীজ

মোগলসরাই এক্সপ্রেস ট্রেনে অসম্ভব ভিড়। রাত বারোটায় ট্রেনে উঠে ভোর হতে চলল তবুও এতটুকু কোথাও বসার জায়গা নেই। একবার বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়াচ্ছি, তো একবার ট্রেনের গেটে। টিকিট চেকার এসে কয়েকবার নামিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। সিদ্দিক ও খালেক ভাই দুজনেই আমার জন্য বলছে, “ও হামারা আদমী হ্যায়, দেখিয়ে বাবু হাম অন্ধা ও লেংড়া দোনো আদমি যা রাহে হ্যায়!” টিকিট চেকার তখন ভালো করে দেখে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে থেকে রাত জেগে এই প্রথম কোথাও আমার দীর্ঘ সফর। পিপাসায় আমার মুখ শুকিয়ে গেছে সেইসঙ্গে খিদেও লেগেছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। খালেক ভাইয়ের কাছে ঘাড়ে একটা ভিক্ষে করা ঝুলি আছে অবশ্য। তাতে কিছু আছে কিনা পরীক্ষা করে জানতে পারলাম অল্প চাট্টি মুড়ি আর পানি খাওয়া একটি ঘটি। আগের কোনো স্টেশনে ট্রেন থামলে পানি নেওয়া যাবে। এমনি করে করেই আমাদের সময় কাটতে লাগল। একসময় সিটের তলায় গিয়ে ধনুকের মতো তির্যক হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যাত্রীদের পায়ের লাথি খেতে খেতে সারা শরীর ধুলোমলিন। চেহারাতে ও মালিন্যের ছাপ পড়ে গেল। প্রায় দুপুর পর্যন্ত এইভাবে কাটার পর ট্রেনের সিট ফাঁকা পেলাম।
পরের দিন রাত্রি এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম এলাহাবাদ স্টেশনে। আলো ঝলমলে বিরাট স্টেশন। বিস্মিত বিহ্বল হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। এখানে কিছু খেতেই হবে, না খেয়ে আর যেতে পারব না। সিদ্দিক ভাইকে সব কথা বলতে লাগলাম। খালেক ভাই বহু চেষ্টা করে কোথা থেকে এক ছড়ি সিঙ্গাপুরি কলা নিয়ে এল। হয়তো এটাই ছিল আমাদের শেষ খাবার এই ভেবেই মুম্বাই মেলের ট্রেনে উঠে পড়লাম।
মনের মধ্যে একটা কষ্ট জেগে উঠল। মায়ের মুখখানা মনে পড়ল। অভাবের দিনে কত কষ্টেশিষ্টে আমাদের দিনগুলো কাটছিল। গমের দলিয়া খেতে পারতাম না বলে মা আমার জন্য খুদেরই ভাত রান্না করে দিত। কতদিন না খেয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেও ঠিকমতো খাবার থাকত না। তবু মনের মধ্যে একটা আনন্দ জেগে উঠত নন্দ গাঙ্গুলী স্যারের ক্লাসে। যে বইগুলো কখনো হাতের নাগালে থাকত না, স্যারের মুখে মুখে শুনেই অনেকটা আয়ত্ত করতে পারতাম। ইংরেজি গ্রামারের অনুশীলনী খাতাখানায় স্যারের সই থাকত বলে খাতাখানাকে যত্ন করে রেখেছিলাম। ওই খাতাতেই অনেকগুলো কবিতাও লিখেছিলাম। সেই সব কবিতা আজ পর্যন্ত কাউকে দেখাইনি। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন সকাল হয়ে গেছে। ট্রেন ছুটে চলেছে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে। দূরে মাঠে মাঠে দু-চারজনকে কাজ করতে দেখছি। সারাদিন সারারাত গেলে তবেই মুম্বাই পৌঁছাব। নাগপুর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে, ভিড়ের মাঝে মানুষের লাথি ও গুঁতো খেয়ে আমরা চলেছি।
শরীর প্রায় আধখানা হয়ে গেছে। মনও খুব বিষণ্ণ। মনে হচ্ছিল না এলেই ভালো হতো। কিংবা অন্য কোথাও গেলেও এরকম কষ্ট পেতাম না। যাইহোক নাগপুর পর্যন্ত এসে কিছুটা স্বস্তি মিলল। ট্রেন ফাঁকা হলো। বসার জায়গাও পেলাম। আমরা তিনজন অসহায় মানুষ। কোনো ভদ্রলোক আমাদের দিকে চেয়েও দেখবে না। এতই ক্ষুধাজীর্ণ ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছি যে, সবাই মনুষ্যেতর জীব ভাববে এবং সেটাই স্বাভাবিক। তবু নাগপুরে একটি মারাঠি পরিবার ট্রেনে উঠেই প্রথম থেকেই আমাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। হিন্দিতে তাদের সঙ্গে যা কথাবার্তা হয় তার বাংলা করলে এরকম বোঝায়।
—আপনাদের এরকম অবস্থা কেন? কোথা থেকে আসছেন?
—আমরা বাংলার মানুষ। আমি কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত প্রায় পঙ্গু ব্যক্তি। আমার সঙ্গে যে আছে কেউ একজন অন্ধ। আর এই ছেলেটা লেখাপড়া করে। কিন্তু খুব অভাবের কারণে মুম্বাই যাচ্ছে কাজ করার জন্য।
—মুম্বাইয়ে আপনারা কী করেন?
—আমরা ভিক্ষে করি। আমাদের আর কোনো পথ নেই জীবিকার জন্য।
—ছেলেটা কতদূর লেখাপড়া করেছে?
—এবছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে।
—আর কি পড়ার ইচ্ছা নেই?
—পড়ার ইচ্ছা থাকলেও কী করে পড়বে? বাড়িতে অভাব। কাজ করে খেতে হয়।
—আমাদের সঙ্গে কি যেতে পারবে ছেলেটা? আমার এই দুটো মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। জমিজমা আছে সেখানে ভালো চাষবাস করি। বাড়িতে অভাব নেই। একটা ভালো ছেলে পেলে তাকে নিজের ছেলে মনে করেই রাখতে পারব।
তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভবিষ্যতে লেখাপড়া করার ইচ্ছা আছে কিনা এবং তাদের সঙ্গে যেতে আমার আপত্তি আছে কিনা।
আমি আশ্চর্য হলাম এই তাৎক্ষণিক পরিচয় একটি মুসলিম মারাঠি পরিবার আমাদের প্রতি এরকম সদয় হয়ে উঠবে। তার ১৫-১৬ বছরের বড় মেয়েটি জ্বলজ্বল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখদুটি বড় মায়া ভরা শান্ত ও স্নিগ্ধ। সেই চোখ থেকে কী একটা আহ্বান আসছে, আকুতি আসছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলাম না। পরক্ষণেই ভাবলাম, অচেনা মানুষের সাথে আমি যেতে পারব না। মারাঠি সংস্কৃতি, মারাঠি জীবনযাত্রায় আমি অভ্যস্ত নই। আগে যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই যাব। তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, “আপনাদের সঙ্গে যেতে পারবো না। আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার অনেক দায়িত্ব আছে। আগে যেখানে যাচ্ছি, সেখানেই যাই।”
অনেক কথার মাঝেই সেই মারাঠি ব্যক্তির স্ত্রী বাড়ি থেকে করে আনা ভুট্টার শুকনো রুটি আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। যে খিদের আগুনে দেহ-মন ঝলসে উঠেছিল, সেই রুটি পেয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম, লজ্জা পাওয়ার বা ভেবে দেখার সময় কোথায়? রুটি খাওয়া শেষ করে এক ঘটি জল খেয়ে তবে স্বস্তি মিলল।
যতক্ষণ এই মারাঠি দম্পতি আমাদের সঙ্গে ছিল, ততক্ষণ মনে হচ্ছিল আমাদের কোনো হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়কে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অন্য অনুভূতি বারবার ছায়া ফেলে যাচ্ছিল। মারাঠি কন্যাটির বড় বড় চোখে চেয়ে থাকার মধ্যে প্রথম হৃদয়ের স্পন্দন উপলব্ধি করছিলাম। এরকম তো কখনো হয়নি! ময়লা একখানা ফতোয়া পরা প্রায় সমবয়সী এক বাঙালি ছেলের প্রতি এই ঘরোয়া মারাঠি মেয়েটির যেন কোনো নীরব ভাষার সংলাপ চলছিল। মেয়েটি যেন বলছিল, “এসো না আমাদের সঙ্গে! একসঙ্গে কত আনন্দে থাকবে!পড়লে পড়বে, না পড়লে আমাদের জমিতে কত ফসল ফলে দেখবে। তোমার কোনো কষ্ট হবে না।”
আমিও তাকে মনে মনে উত্তর দিচ্ছিলাম, “মন তো যেতেই চাইছে, তোমাকে খুব ভালোও লেগেছে। তবুও বড় অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। তাই যেতে পারব না। তোমাকে হয়তো ভুলতে পারব না। তুমি ভালো থেকো।”
এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। একসময় তাদের গন্তব্যে নেমে গিয়েছিল পরিবারটি। জানালার ফাঁক দিয়ে বারবার চেয়েছিলাম তাদের দিকে। মেয়েটিও হাঁটতে হাঁটতে বারবার ঘুরে তাকাচ্ছিল। অনেক পরে জেনেছিলাম রবীন্দ্রনাথের জীবনে আনা তড়খড় নামে এক মারাঠি মেয়ে এসেছিলেন। যাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ কবিতাও লিখেছিলেন। ট্রেনের উপরে ক্ষণিক দেখা এই মারাঠি মেয়েটির জন্যও আমার কবিতা জন্মের বীজ রোপিত হয়ে গেল তা বলাই বাহুল্য।অনেকবার অনেক লেখার মধ্যেই এই মেয়েটির প্রসঙ্গ আপনা থেকেই এসে যায়। ক্ষণিকের কয়েক পলক দৃষ্টি বিনিময় অনন্ত সময় ধরে চলতে থাকে।
পরের দিন যথাসময়ে মুম্বাই বি.টি স্টেশনে
নেমে যাই। বিশাল জনসমাগমে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র অতি তুচ্ছ মনে হয়। যাতে হারিয়ে না যাই সেজন্য সর্বদা সিদ্দিক ভাইয়ের লাঠি ধরে থাকি। স্টেশনের বাইরে এসে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ি। রাস্তার ধকল আর সহ্যও হচ্ছিল না। সিদ্দিক ভাই এবং খালেক ভাই আমাকে রেখে অনেকক্ষণ তারা কোথায় চলে গেল কোথাও দেখতেও পাচ্ছি না। নিজের মনেই কত ভাবনার উদয় হচ্ছে। এই পৃথিবীতে এইভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়? এরকম জীবন কি আমি চেয়েছিলাম? একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকে। গ্রামের হিন্দু মোড়ল বাড়িতে কাজ করার সময় গামছার আঁচল পেতে মুড়ি নিতাম। গোয়াল ঘরে রাখা শুধু আমারই জন্য একটা কাপে চা নিতাম। কোনো কোনোদিন অন্য কিছু খাবার থাকলে তা নির্দিষ্ট একটি থালায় খেয়ে আবার পুকুর ঘাট থেকে মেজে আনতাম। বাড়ির মেয়েরা মজুরির টাকা বা চাল-গম দিলে তা আলগা করে দিত যাতে আমার ছোঁয়া না লাগে। এরকম একটি ঘৃণ্য জীবন অতিবাহিত করেছি। আজও অপাংক্তেয় হয়ে এখানে বসে আছি অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ নিয়ে। কী আমার লক্ষ্য, কোন রাস্তাটি আমার সঠিক তা কে-ই-বা বলে দেবে? মাথার উপর দিয়ে একটা কাক ডেকে চলে গেল। মুম্বাই শহরে আলো-অন্ধকারের লীলা কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রায় ঘন্টাখানেক পরেই ফিরে এল খালেক ও সিদ্দিক ভাই। একটা কাগজের ঠোঁঙায় কিছু খাবার ও পানি নিয়ে।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সাদ আব্দুল ওয়ালী on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on ৩টি কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
রাবেয়া আখুঞ্জী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা
সাদ আব্দুল ওয়ালী on লজ্জাবতী ও অন্যান্য কবিতা