তৈমুর খান
৯
এম এল এ খুব দয়ালু ছিলেন
অডালায় রেললাইনের ধারে ঝোপড়া পট্টি। চট, কাগজ, পলিথিন, কাপড় দিয়ে তৈরি ছোট ছোট খুপড়ি ঘর। যে খুপড়ি ঘরে আমরা উঠেছি সেটা দাদুল ভাইয়ের ঘর। একসময় ডাকসাইটে গোরু চোর হিসেবে খ্যাত ছিল এই দাদুল। ধরা পড়ে গিয়ে তার একটি ঠ্যাং কাটা যায়। সেই থেকে তার খেটে খাবার ক্ষমতা যেমন নেই, তেমনি চুরি করেও আর খাবার ক্ষমতা নেই। একমাত্র পথ ভিক্ষে করা। মুম্বাই এসে সে ভিক্ষে করে, আর তার বউ শেঠদের বাড়িতে কাম করে। সারাদিন কামকাজ করে সন্ধ্যায় বাড়ি আসে। আমাদের তিনজন তার বাড়িতেই অতিথি হয়েছি। লাইনের ধারে একটি গর্তে কিছু চুয়ানো পানি জমা হলে সেখান থেকে বালতিতে তুলে গোসল করে একটা লুঙ্গি পরে আপাতত কিছুটা বিশ্রাম পাওয়া গেল। দিনের বেলা এখানে পেচ্ছাপ-পায়খানা করার মতো কোনো আড়াল নেই, যা করতে হয় রেললাইনেই। সকলেই নাকি এরকমই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমি কোনোরকম পেচ্ছাপ করতে পারলেও পায়খানা করার ইচ্ছাকে সম্পূর্ণভাবে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিলাম। রাত্রের দিকে করব বলেই তা স্থগিত রইল।
দাদুল ভাই খুবই আন্তরিক। তার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়নি। এই প্রথম দেখাতেই সব কুশল জেনে তড়িঘড়ি খাবার-দাবারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার ঝুপড়িতে আমি একা। খালেক ও সিদ্দিক ভাই তাদের পরিচিত জনদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। একটু পরেই ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে আমার আসার খবর শুনে অন্যান্য ঝোপড়া-পট্টি থেকে কতকগুলি মেয়ে এসে উঁকি-ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। আমার নামধাম, বয়স, বাড়ির ঠিকানা, বাড়িতে কে কে আছে তা নিয়ে প্রশ্ন করছে। খালেক ভাই ঢুকেই সব জেনে ফেলল আর বলল, “তোরা এত কেন জানতে চাইছিস? তোদের কি বিয়ে-শাদীর মতলব আছে?”
ওদের যে সেরকমই ইচ্ছে তা না বললেও চলে। এরা বেশিরভাগই বাংলাদেশের। কথা শুনে তাই মনে হলো। ওদের মধ্যে একজন বলল, “সেরকমই একটি ছেলে দরকার তাই জিজ্ঞেস করছি!”
সিদ্দিক ভাই তাড়া দিয়ে ওদের বের করে দিয়ে বলল, “আগে যে কাজে এসেছি সেই কাজটাই করতে হবে। এসব কথা কেন?”
আমি আশ্বস্ত হলাম। ওরা চলে গেলে হাঁপছেড়ে বাঁচলাম। শরীর প্রায় অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। তাই চোখ বুজে আসছিল ঘুমের ভারে। পাশের ঝোপড়াটির পর্দার কম্পন দেখতে গিয়ে নারী-পুরুষের বীভৎস আদিম খেলার দৃশ্য প্রথম চোখে পড়ে যায়। সিদ্দিক ভাইয়ের কাছেই জানতে পারি, শুধু এই ঝোপড়া পট্টি কেন, সমস্ত মুম্বাই জুড়েই মানুষ এই আদিম খেলা খেলে চলেছে। দিনে-দুপুরে বৈধ-অবৈধ বলে এখানে কোনো কিছু নেই। যার যাকে ইচ্ছা সে তার সঙ্গে থাকতে পারে। স্বামী থাকুক বা না থাকুক। বয়স কম হোক বা বেশি। জাতি ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে এখানে ভোগ ও টাকার খেলা চলতে থাকে। সিদ্দিক ভাইয়ের এ কথার সত্যতা প্রমাণ পেয়েছি।
এই অডালায় একদিন এক রাতের বেশি আমি থাকতে পারিনি। সকালে উঠে লাইনে বসে সামনা-সামনি নারী-পুরুষের পায়খানা করা দেখে আঁতকে উঠেছি। এখানে এসে লজ্জাশরম বলে কিছুই থাকে না। চোখের পট্টি একেবারে খুলে দিতে হয়। স্যাঁতসেঁতে দুর্গন্ধময় স্থান। মানুষ কেন, পশুরাও থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। তারপরে আবার নারী-পুরুষের এই অবাধ বিচরণ, সামান্য টাকায় দেহ বিক্রি, ঘনঘন সঙ্গী বদল চলতেই থাকে। পরদিন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে মসজিদ বন্দরে গিয়ে পৌঁছাই। খালেক ও সিদ্দিক ভাই আমাকে নিয়ে কোথায় কাজে লাগানো যায় তা ভাবছিল। মসজিদ বন্দরের ওটাতে সব বাঙালি নারী-পুরুষরা সন্ধ্যার দিকে জমা হন। এখানেই পেয়ে গেলাম সোলেমান চাচাকে। সোলেমান চাচা মোট বহন করেন। আমি আপাতত মোট বহন করতে রাজি হয়ে যাই। কোনো ভারী মাল মাথায় নিয়ে মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। তার বদলে মজুরি মিলবে। এই মাল বহন করার জন্য আপাতত একখানা ঝুড়ি চাই। কিন্তু কী দিয়ে কিনব ঝুড়ি? সোলেমান চাচাকেই টাকা ধার চাইলাম। সোলেমান চাচা বললেন, “একখানা পুরনো ঝুড়ি আছে, আপাতত ওইটাতেই কাজ চালাও। একটা চটের বিড়ে মাথায় দিয়ে মোট বইবে।”
সেই থেকেই শুরু হয় মোট বওয়া জীবন। রাস্তাঘাট ভালো না চিনলেও মসজিদ বন্দরের কাছাকাছি থাকি। মালিক মাল কিনে মাথায় চাপিয়ে দিলে তার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাই। ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত গড়ে আয় হতে থাকে। সেই টাকা দিয়েই সন্ধেবেলায় হোটেলে তড়কা-রুটি খাই। রাত্রে এসে মসজিদ বন্দরে রাস্তায় একটা চট পেতে মাথায় ইট দিয়ে ঘুমাই।
রাস্তায় কি ঘুম আসে?
প্রথম প্রথম আসত না, তারপর আসতে থাকে। প্রথম প্রথম ভয় ভয় করত। রাত জেগে চারিদিক দেখতে থাকতাম। কত নারী-পুরুষ রাস্তাতেও আদিম খেলায় মেতে ওঠে। কত অচেনা নারী আমার কাছাকাছি এসেও দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন তো আমার হাত ধরে টেনে বসায় একজন। তার বাসায় যেতে বলে। অবশ্য সে জানায়, আমার মতো কম বয়সী ছেলেকে একা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তার মায়া হয়।
আমিও ভাবতে থাকি, পৃথিবীতে বেঁচে থাকা কত কষ্টের। ঘরবাড়ি ছেড়ে এই বিদেশবিভূঁইয়ে আমাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। কেন আমি এভাবে পড়ে থাকছি? এ প্রশ্ন অনেকেরই।
রোজ সন্ধ্যাবেলায় ওটাতে নারী-পুরুষের ঢল নামে। বিভিন্ন শেঠের বাড়িতে কাজ করে সবাই ফিরে আসে। তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে কিছু বাড়তি খাবারদাবার। যেগুলো ফেলে দেওয়ার কথা। সেসব খাবারদাবারগুলো ওরা আমাকে দেয়। বিশেষ করে আমার ডাক পড়ে তাদের চিঠিপত্র লেখার জন্য। অনেকেই গ্রামের বাড়িতে টাকাও পাঠায়। তাই তাদের এম.ও ফর্মটাও ফিলাপ করে দিতে হয়। কারও কারও চিঠি লিখে ঠিকানাও লিখে দিতে হয়। চিঠি লিখতে গিয়ে জানতে পারি বিভিন্ন হাল-হকিকত। কেউ স্বামীকে ছেড়ে মুম্বাইয়ে আবার নতুন স্বামী ধরেছে। কেউ বউকে ছেড়ে আবার নতুন বউ নিয়ে সংসার করছে। কেউ আবার চিঠিতেই পাঠাচ্ছে তাদের ডিভোর্সের জবানবন্দি। এইসব লিখতে গিয়েই প্রচুর মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। জানতে পেরেছি তাদের কাজকর্মও।
এক সুন্দরী মহিলা ত্রিশোর্ধ বয়সের একদিন সে বলতে লাগল,”হামি শরীল বিচি টাকা রুজগার করি তো তুদের কী! তুদের শরীল থাকে তো তোরাও বিচি টাকা রুজগার কর দেখি!”
আরেকদিন আরেকটি মেয়ে বলতে লাগল,”আমি আর তোমার ভাত খাব না। চিঠিতেই তোমাকে জানালাম। ইখানে আমি একটো ধরি লিয়াছি, পারলে তুমিও ধরি লিও।”
এখানে এসেই জানতে পারলাম অনেক রাতে কিছু যুবক এসে যুবতী নারীদের নিয়ে যায়। সারারাত কোথায় তারা থাকে তা কেউ জানে না। আবার ভোরবেলায় তাদের দিয়ে যায়। এতে নাকি তাদের মোটা আয় হয়। অনেক শেঠ আছেন তার বাড়ির কাজ করার পর শরীর দিয়েও তাকে খুশি করতে হয়, তাহলে মোটা টাকা বেতন পাওয়া যায়।
এই ওটাতে যেখানে এসে বসি তার পাশ দিয়েই উপরতলাগুলিতে যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে। আমাকে প্রায়ই দেখতে পায় এখানে যারা উপরে থাকেন। একদিন এক সাংবাদিকের মেয়ে কলেজ ছাত্রী আমার সঙ্গে আলাপ করে। কেন আমি এখানে আসি, আমি কী কাজ করি, কোথায় আমার বাড়ি সবই তার জানার কৌতূহল।
সব কথা শুনে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে এবং আমার তারিফও করে। একদিন জোর করেই তার সাংবাদিক পিতার কাছে নিয়ে যায় আমাকে। আমিও কি তবে তার সংবাদ হতে চলেছি?
না, তা নয়। এক মানবিক অনুভূতি তার হৃদয় ক্ষরণ ঘটায়। সাংবাদিক আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, মুম্বাই শহরে থেকে পড়াশোনা করতে। সব ব্যবস্থাও তিনি করে দেবেন। কিন্তু আমি রাজি হতে পারি না। আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট হয়নি। পড়তে হলে নিজের দেশেই পড়ব, এখানে আমার থাকার ইচ্ছা নেই তাকে তা জানিয়েও দিলাম। ভাঙা হিন্দি এবং ভাঙা ইংরেজিতে তাদের সঙ্গে কথোপকথন মোটেও সুখকর ছিল না। তবু সেই দিন সেই সাংবাদিক আমাকে চা ও পকোড়া খাইয়েছিলেন। তাঁর একটি ডেজিগনেশন লেখা ঠিকানা সম্বলিত কার্ডও দিয়েছিলেন। প্রয়োজন হলে তাঁকে আমি যেন সব জানাতে পারি।
এখানেই একদিন জানতে পারলাম রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ পাওয়া যাবে। আমাদের গাঁয়েরই একটি ছেলে এসে জানাল। তার সঙ্গেই সেই কাজে গিয়ে যোগ দিলাম। বি.টি স্টেশনের কাছাকাছি একটি বহুতল বিল্ডিং নির্মাণ হচ্ছিল। সেখানে বেশিরভাগ কর্মীই ছিল মারাঠি। আমিও কাজে গিয়ে যোগ দিলাম। সকাল ছ’টায় উঠে টাইম কলের পানি ভরে নিয়ে স্নান করে তাড়াতাড়ি রান্নার কাজে বসে যেতাম। ভাতের সঙ্গে আলু সিদ্ধ করে রোজই মাড়ভাত খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কাঁচা লঙ্কা কাঁচা পেঁয়াজ এবং আলুসিদ্ধ মেখে বেশিরভাগ মজুরেরাই অর্ধেকটা খেয়ে বাকি অর্ধেকটা দুপুরের জন্য রেখে দিত। দুইদিকে দুটো ইট দিয়ে কাঠের কুচি জ্বালিয়ে আমরা রান্না করতাম। কিন্তু মুশকিল হলো রাতদিন ডবল ডিউটি অর্থাৎ সকাল ন’টা থেকে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত। মাঝে মাত্র এক ঘন্টা সময় পাওয়া যেত খাবারের জন্য দুপুর একটায়। সন্ধ্যা সাতটায় পাওয়া যেত আধঘন্টা। রাত্রে শুকনো পাঁউরুটি পানিতে চিনি গুলে ভিজিয়ে খেতাম। সুতরাং রাত্রে বেশিক্ষণ ঘুমানোর বা বিশ্রামের সুযোগ ছিল না। তখন মজুরি ছিল চৌদ্দ টাকা। ডবল ডিউটিতে মাত্র আঠাশ টাকা আয় করতাম। সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল লরি লরি সিমেন্ট আসত। এক একটি সিমেন্টের বস্তা পঞ্চাশ কেজি ওজনের। সেগুলি মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সাত তলা পর্যন্ত তুলতে হতো। সিমেন্ট ছাড়া বালি, রড্, পাথরও মাথায় বহন করতাম। এমন ক্লান্তি আসত যে মাঝে মাঝে চোখে আঁধার লেগে ভির্মি খেয়ে পড়তাম। উপরের কড়ি-বর্গা দিয়ে যেতে যেতে একবার প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। হাত দিয়ে ধরে ঝুলে গিয়েছিলাম বলেই সে যাত্রা রক্ষা পাই।
খুব বেশিদিন এই কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হলেই শেঠজি খান সাহেবকে বলেছিলাম, আমি বাড়ি যাব।
খান সাহেব একজন এমএলএ। কিন্তু দুর্ভাগ্য ‘মুম্বাইকা আওরাতকা কই ভি ভরসা নেহি’ বলে তিনি আফসোস করেছিলেন। কারণটা অনেক পরে জানতে পারি। তার বউ অন্য আরেকজনের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। অর্থকড়ি গাড়িবাড়ির কোনোই অভাব নেই তাঁর। কিন্তু বউ কেন পালাল?
সেই ভাবনা থেকেই তিনি বলেছিলেন মুম্বাইয়ের মেয়েদের কোনো ভরসা নেই। তাদের প্রকৃতিই এমনি। এরা বহুজনের সঙ্গ চায়।
এমএল এ খুব দয়ালু ছিলেন। আমার বয়স কম বলে এবং লেখাপড়া করতে চাই শুনে, তিনি আমাকে বলেছিলেন, “কিতনা রুপিয়া জরুরত হ্যায় মুঝে বাতাও!”
আমি পাঁচশো টাকার কথা বলেছিলাম। তিনি পাঁচশোর বদলে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। টাকা পেয়ে মহাফুর্তিতে বাড়ি আসার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।