তৈমুর খান
১০
দৌড় শুরু হল
—————————————————–
মোট সাড়ে তিন হাজার টাকা মুম্বাই থেকে এনে ইলেভেন ক্লাসে ভর্তির তোড়জোড় শুরু করেছি। মাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছি; এর বেশি আমার আকাঙ্ক্ষাও ছিল না। ভর্তি হলে রামপুরহাট কলেজেই হবো এবং কলা বিভাগেই হবো। সব টাকা যে পড়ার পেছনে খরচ করব এমনটিও নয়; মায়ের হাতেও কিছু দিতে হবে। অবশ্য আসার সময় মুম্বাইয়ের চোরবাজার থেকে পুরনো কিছু জামা-কাপড়ও কিনে এনেছি; এগুলি পরেই কলেজে যাব। ভর্তি ফি, বইপত্র কেনা এসবেই যা খরচ হয় হোক। আমাদের বিদ্যালয়েই কয়েকজন ভালো রেজাল্টও করেছে; এমনকি পশ্চিমবঙ্গের দশজনের মধ্যেই রয়েছে। মুম্বাই থেকে আসার পথেই খবরটা চাউর হয়ে গেছে। ট্রেনের ধকল এবং ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া না হওয়ায় নিজেকে খুব অবসন্ন লাগছিল। তবু পরীক্ষার পাশের খবরটায় মন চাঙ্গা হয়ে উঠল। বহুদিন পর মনে হলো আজ আবার বাড়িতে ভাত খেতে পারব।
গ্রাম থেকে রামপুরহাট কলেজের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। একটা বাস থাকলেও সময় মতো চলে না। তাই কলেজে যাওয়ার জন্য সাইকেলই ভরসা। বহুদিনের একটি পুরনো সাইকেল কিনেছিলাম এক ধান ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। সেইটাকেই মেরামত করে আমার কলেজ যাওয়ার বাহন ঠিক হলো। কলা বিভাগে ভর্তি হলেও পড়াশোনা বিষয়টা হেলাফেলার নয় সেটা আমি প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে এসে সকলের সঙ্গে খোলামেলা মিশতে পারতাম না। সাদা পায়জামা ও একটি হাফহাতা জামা গায়ে এবং পায়ে সস্তা চপ্পল পরে আমরা কলেজে আসতাম। গ্রাম থেকে যারাই কলেজে এলাম তারা বেশিরভাগই গ্রাম্যতায় আচ্ছন্ন। কথাবার্তা, চালচলন, আদব-কায়দার মধ্যেই একটা সীমাবদ্ধতা ফুটে উঠত। প্রথমদিকে তেমন বন্ধুবান্ধব না জুটলেও পরে সবকিছুই সহজ হয়ে গেল। বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে অধ্যাপকদের শিক্ষাদানে যে অনেকটাই ফারাক তা বুঝতে পারতাম। আমরা গ্রাম থেকে আসা নিরীহ ও কথা কম বলা ছাত্ররা যখন চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতাম, তখন শহরের হাল ফ্যাশনের মেয়েরা আমাদের নানাভাবে মজা নেওয়ার চেষ্টা করত। কেউ চোখ টিপে ইশারায় কিছু বলতে চাইত, তো কেউ মুখ ভেংচে জিভ বের করে দেখাত। কেউ আবার জোর করে পাশে এসে বসত। যতই এসব করত, ততই আমাদের অস্বস্তি বাড়ত। কিন্তু কিছুই বলতে পারতাম না। অফ পিরিয়ডে কোনো ফাঁকা জায়গায় বসে কোনো কোনো বন্ধু গুন গুন করে রবীন্দ্রসংগীত অথবা নজরুলগীতি গাইত। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।আমিও নতুন কবিতা পড়তাম। ভর্তির কিছুদিনের মধ্যেই কলেজ ম্যাগাজিনে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে লেখা আহ্বান করা হয়। তখনই সুযোগ পেয়ে যাই প্রথম আমার লেখা দেওয়ার।
১৯৮৪ সালে কলেজ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপার অক্ষরে ‘বিদ্রোহী নজরুল’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটি আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। তখন কবিতা কেমন করে হয় তার সঠিক শিক্ষা পাইনি। কিন্তু সর্বদা একটা আবেগ মনকে তাড়িত করত কবিতা রচনার জন্য। এই কবিতাটিও প্রদীপ্ত আবেগ থেকেই উৎসারিত তা বলাই বাহুল্য। কবিতাটি শুরু হয়েছিল এভাবে—
“চির বিদ্রোহী বীর নজরুল
তুমি ধূলির ধরাতে অবিনশ্বর
তুমি চেতনার বুলবুল …. হে বীর নজরুল!”
প্রথম জীবনে নজরুলের প্রতি এতই আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম যে মাঝে মাঝে তাঁকে স্বপ্নেও দেখতাম। তাঁর কবিতার পংক্তিগুলি মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হতো।মল্লারপুরের পিসি আমাকে একবার পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন মিঠাই কিনে খাওয়ার জন্য। সেই পাঁচ টাকা দিয়ে আমি রামপুরহাট রেল স্টেশন থেকে লক্ষ্মণ বিশ্বাসের লেখা ‘বিদ্রোহী নজরুল’ বইটি কিনেছিলাম। তারপর রামপুরহাট থেকে গ্রামে পায়ে হেঁটে সারারাস্তা বইটা পড়তে পড়তে ফিরেছিলাম। পথে দু-একজন জিজ্ঞেসও করেছিলেন এভাবে বই পড়ার কারণ কী। উত্তরে তাদের জানিয়েছিলাম,”নজরুলের জীবনী ভালো করে জানার জন্যই পড়ছি। ধৈর্য ধরতে পারছি না।” সুতরাং নজরুলকে ছাড়া তখন আর কার কথা ভাবব? কবিতা খিদে মেটাতে পারে না, অন্নবস্ত্রের ভবিষ্যৎও আলোকিত করতে পারে না। সম্মান? না তখন সম্মানের কথাও মাথায় আসেনি। কবিতা লিখে সম্মান পাব এ কথা আজও ভাবতে পারি না। কবিতা তাহলে কেন লিখতে শুরু করলাম? তখন এবং এখনও এর একটিই জবাব—নিজের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, শূন্যতা, বিদ্রোহ, কষ্টের ভার কবিতার কাছেই নামিয়ে রাখতে পারি। একমাত্র কবিতাই আমাকে সহ্য করতে পারে। মানুষ নয়, স্রষ্টা নয়, এমনকি নিজের কাছে নিজেও নই। তাই কবিতার কাছেই সব কথা বলে যেতে চাই। আমার নির্ঘুম রাত্রির কথা। আমার ক্ষুধার্ত মুহূর্তের জ্বালার কথা। আমার আত্মহত্যার কথা। আমার জীবিত থাকার কথাও। কবিতার অসীম ধারণ ক্ষমতা আছে। কবিতার অসীম গোপন করার রহস্য আছে। এত ব্যর্থতা, এত হতাশা, এত ক্রন্দন কবিতা ছাড়া কে আড়াল করত? তাইতো অন্য কিছু করার কথা না ভেবে কবিতা লিখতে চলে এসেছি। কবিতা নিজে লিখি তাতে অন্যেরও কিছু ক্ষতি হয় না। আমার মন খারাপের মুহূর্তগুলিকে শব্দচেতনায় শুইয়ে রাখি। আমার আনন্দ যাপনের মুহূর্তগুলিকে শব্দচেতনায় জাগ্রত করি। কবিতা তাই লিখতেই হয়। না লিখে পারি না। যে জীবনকে সমাজ নির্বাসিত করেছে, যে জীবন পারিবারিকভাবেও কিছুই প্রাপ্তির আশা করে না—কবিতা না লিখে সেই জীবন নিয়ে আমি কী করতাম? মনের মধ্যে সেই কবিতাই আমাকে তাড়া দিয়েছিল মুম্বাই যাওয়ার। সেই কবিতাই আমাকে ফিরিয়ে এনেছে এবং কলেজে ভর্তি হতে বলেছে। সেই কবিতাই নজরুলের রূপ ধারণ করে আমার কাছে ‘বীর নজরুল’ হয়ে উঠেছে। এটাই আমার আদর্শ। এটাই তো আমার প্রেরণা।
পত্রিকাখানি কলেজ লাইব্রেরি থেকে নিয়ে এসে বুকের উপর শুইয়ে রেখেছি। অনুভব করেছি লেখার আনন্দ। এই আনন্দ অন্য কোনো আনন্দের মতো নয়। তাই যারা না লেখে তাদের কিছুতেই তা বোঝানো যাবে না। কেননা আনন্দকে অনুভব করতে হয়, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আর এই অনুভব একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কলেজের সহপাঠী বন্ধুরা সবাই জেনে গেল আমি কবিতা লিখি। কিছুদিন পরেই ১৯৮৪ সালের ৩১ শে অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী খুন হয়েছেন। সারাদেশ তোলপাড় হচ্ছে। সকাল থেকে সারাদিন রেডিওতে শুনছি সেসব। তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমস্ত দেশ জুড়েই শুরু হয়েছে হানাহানি। আমাদের বন্ধুবান্ধব মহলেও তাই নিয়ে আলোচনা চলছে। মাঠে-ঘাটে সর্বত্র শুনতে পাচ্ছি একটাই কথা এই মৃত্যুর বিচার হোক। তখন নিজেও কলম তুলে বেশ কিছু কবিতা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়েই লিখেছিলাম। সেসব কবিতাও ছিল আবেগের কবিতা। আমার নামে যে কবিতাটি ম্যাগাজিনে দিয়েছিলাম, সেটি শুরু হয়েছিল এইভাবে—
“আজ আমার বুকের পরে
কী শোকশূল বিঁধল আসি ওরে
দুটি চোখে অশ্রু ঝরে অব্যক্ত বেদনায়
দেশকে আঁধার করে চলে গেলে মাতা হায়!”
কবিতাটির নাম ছিল ‘শ্রীমতী ইন্দিরার মৃত্যু সংবাদে’। সেই সংখ্যা কলেজ ম্যাগাজিনটিতে বেশিরভাগ কবিতাই ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে লেখা। অন্যের নামে আমার অনেকগুলো কবিতাই প্রকাশিত হয়েছিল।
বারবার অন্যের নামে কবিতা লিখে দিতে দিতে ১৯৮৫ সালে এসে ধরা পড়ে গেলাম। তখন আমি বাংলা অনার্সের ছাত্র। জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পড়তে শুরু করেছি। আধুনিক বাংলা কবিতা আমাদের সিলেবাসেরই অন্তর্ভুক্ত। সেবার ‘যেতে চাই চলো’ নামে একটি কবিতা আমার নামে এবং অন্য বন্ধুদের নামে ভিন্ন ভিন্ন কবিতা জমা দিয়েছিলাম।
পত্রিকা উপদেষ্টা মণ্ডলিতে ছিলেন সুনীলবরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নোজফুল হক স্যার। কবিতাগুলো লেখার ভঙ্গি এবং ভাব প্রায় একই রকম। তাই কবিতাগুলি বাছতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন এগুলি একজনেরই লেখা। একদিন নোজফুল হক স্যার তাঁর বাড়িতে ডেকে বললেন—
“তুমিই তৈমুর?”
আমি মাথা নুইয়ে সম্মতি জানালাম। অনেকগুলো কবিতা বেছে নিয়ে বললেন—
“এসব লেখা কি তোমার নয়?”
আবারও আমি মাথা নুইয়ে সম্মতি জানালাম। তখন স্যার পুনরায় বলতে লাগলেন—
“এরকম কাজ আর কখনো করো না। তোমার লেখা কারো নামে দেবে না।”
আমি জানালাম, “অনেক কবিতা লেখা রয়েছে সেগুলো প্রকাশের সুযোগ হয় না, বলেই ভিন্ন ভিন্ন নামে দিয়েছি।”
তখন স্যার বললেন, “আমরা একটা পত্রিকা বের করব, তাতে তখন লেখার সুযোগ ঘটবে। আরও কিছুদিন অপেক্ষা কর।”
সেই থেকেই ফিজিক্স বিভাগের নোজফুল স্যারের বাড়ি যাতায়াত করতাম। তাঁর বাড়িতেই একদিন পরিচয় হয় ‘বিকল্প’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে। সেই পত্রিকায় প্রথম যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল তার নাম ‘বিরহ ঝরে ঝরে’। কবিতাটির প্রথম অংশটি এরকম—
“প্রেম নয় নারী নয়
বিরহের ঝিলিমিলি হাওয়ায়
ফোঁস ফোঁস আওয়াজ
সমস্ত দ্রাঘিমা জুড়ে বিরহ ঝরে ঝরে…”
সম্পাদক শর্ত দিয়েছিলেন দশ কপি পত্রিকা বিক্রি করে পত্রিকার মূল্য দিতে হবে। পত্রিকা প্রকাশিত হলে একদিন গিয়ে দশ কপি পত্রিকা তাঁর বাড়ি থেকে নিয়ে আসি । কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এক কপি পত্রিকাও বিক্রি করতে পারিনি। প্রতিটি কপির দাম ছিল পাঁচ টাকা। সুতরাং মোট পঞ্চাশ টাকার জন্য আমাকে মজুরও খাটতে হয়েছিল। তবু লেখাটাকে প্রকাশ করে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম তাতে মজুর খাটাও আমার কাছে খুব সহজ ব্যাপার ছিল। লেখা ছাপানোর জন্য সেই আমার প্রথম দৌড়।