spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকদু-স-কৃ-তি-কা-রী

লিখেছেন : তাজ ইসলাম

দু-স-কৃ-তি-কা-রী

দু-স্কৃ-তি-কা-রী

………

শব্দ ইতিহাস,বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটের আবর্তে পড়ে নিজের অর্থ হারিয়ে ফেলে কখনও কখনও। শৈশবের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। লোটা কোন খারাপ শব্দ না। আমাদের গ্রামের মাঠে একবার ফুটবল খেলা হইছিল। সম্ভবত কান্দাইল বনাম মদন। সে খেলায় মদন গ্রামের খেলোয়াররা নয় দশটি গোল খায়। মিনা চকিদার ছিল আধা পাগল টাইপের লোক।এত পরিমান গোল খাওয়ায় রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথে মিনা চকিদার মাঠের ভিতর প্রবেশ করে ‘ মদইন্নেরা লইছে লোডা’  বলে চিৎকার করতে থাকে। মুহূর্তে পুরো মাঠে এটি শ্লোগানে পরিনত হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেখেছি পরাজয়,হার,ব্যর্থ কাউকে সহজে বলতে শুনেছি ‘ লোডা লইছে’। 

এবার আসি মূল কথায়। ‘রাজাকার’ শব্দটির উৎপত্তিগত অবস্থানে  আভিধানিক অর্থ কিন্ত নেগেটিভ না। পজেটিভ একটি অর্থ। কিন্ত আমাদের দেশে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বর্তমান পরিবেশে শব্দ তার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে প্রয়োগ হয়। আমজনতাও এর অর্থ নেতিবাচক হিসেবেই গ্রহণ করে। 

এমন বহু শব্দ আছে। কথা দীর্ঘ করব না। সংক্ষিপ্ত কথা হল বর্তমানে এমন আরেকটি শব্দ অর্থ বিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অচিরেই তার  প্রকৃত অর্থের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করবে সে শব্দটি। চলমান আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে দুস্কৃতিকারী হিসেবে। আমার মনে হয় মানুষ এক সময় দুস্কৃতিকারী বলতে শব্দের আভিধানিক অর্থের বাইরে অন্যকিছু বুঝে নিবে। ক্ষমতাসীনদের মুখে দুস্কৃতিকারী শুনলে দুস্কৃতিকারীদের এখনই টিভি সেটের সামনে বসা লোকেরা লেঙড়া আম মনে করে। লেঙড়া আম নামে লেঙড়া হলেও মানে, গুণে, স্বাদে লেঙড়া না,বরং সচল। চলমান সময়ে দুস্কৃতিকারীও এমন দৃশ্যের বাহক হয়েই হাজির হয়। একই সাথে ম্লান হচ্ছে কিছু শব্দ,স্লোগান ও চেতনা বাহক শব্দ ও শব্দগুচ্ছ।

লালে লাল সোশ্যাল মিডিয়া

…………..

” নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া” দুনিয়া না হলেও লালে লাল সোশ্যাল মিডিয়া। সারাজীবন জানা বিষয়কে উল্টে দেওয়া হল। শোকের রঙ কালো বলেই জানে সবাই।সারা পৃথিবীই কালোকে শোকের রঙই মান্য করে। বাংলাদেশের তারুণ্য নিয়ম পাল্টে দিল।  চিন্তার রাডারে এর পিছনে বহু কারণ ভেসে ওঠে।

এক নম্বর কারণই প্রতিপক্ষকে থ্রেট। ক্ষোভের সাথে তাদের বিরোধিতা করা। আজ ছিল কোটা আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশ্যে সরকারী শোক পালনের দিন।জানা কথা তারা কালো রঙ ব্যবহার করবে। ধিক্কারের সাথে তারা পাল্টা লাল রঙ বেছে নিল। এইটাই অন্যতম।তারপর আমরা পর্যালোচনায় পাই, কোটা আন্দোলনে যারা মারা গেল তাদের নিয়ে সরকার শোক পালনের আয়োজন করেছে।প্রশ্ন তাহলে হত্যাকারী কারা? আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানে তাদের সাথীদের হত্যাকারী কারা?

যারা হত্যাকারী তারাই শোক পালনকারী।এইটা তাদের কাছে মশকরা মনে হল।তাই তারা কালো রঙের সামনে তুলে ধরল লাল রঙ।লাল রঙ আমার ভাইয়ের রক্তের রঙ। রক্তে তোমাদের হাত রঞ্জিত।লাল রঙ আমাদের দ্রোহের রঙ।লাল রঙ আমাদের বিপ্লবের প্রতীক।যে পথে আমার ভাইয়ের রক্ত ঝরেছে মুক্তির প্রয়োজনে সে পথে আমার রক্তও ঢেলে দেব। আমি ও আমার ভাই অভিন্ন।আমাদের সবার রক্ত এক, উদ্দেশ্য এক।রক্তের রঙও এক। আমাদের শোক আমাদের শক্তি। চলমান সময়ে এই শক্তির প্রেরণা শহীদের রক্ত।তাই আমাদের শোকের প্রতীক কালো না।রক্ত লাল রাজপথে আমাদের শোকের প্রতীক লাল। শুরুতে থ্রেটের কথা বলছিলাম না! হতে পারে এমন, তুমি বহু ফাউল করেছ।সর্বশেষ খুনরাঙা হাতে এসেছ আজ আমার ভাইয়ের শোক পালন করতে।তোমাকে আর মানা যায় না।এই তোমাকে লাল রঙে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলাম।ভাগো!  

সময়,পরিবেশ,পরিস্থিতি এভাবেই পাল্টে যায় বহু কিছু।কালো রঙের বদলে শোকের রঙ হয়ে যায় সহসায় লাল রঙ।বাংলাদেশের সোশাল মিডিয়া তাই আজ লালে লাল।লাল রঙ আজ সংহতির রঙও। আজ প্রকৃতিতে লালের উপস্থিতি না থাকলেও আন্দোলনকারীদের হৃদয় রক্তক্ষরণে লালে লাল।আমার মতো হাফ বুড়োরা দেখছি আর ভাবছি কী জানি কী হয়!

কষ্টে আছি আইজুদ্দিন

…………

মনে আছে আপনাদের? ঢাকার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা ‘ কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’। সময়টা স্মরণ করতে পারছি না।তবে তখন মোবাইলের রমরমা বা সহজলভ্যতা ছিল না। সারা ঢাকার ওয়ালে আইজুদ্দিনের কষ্টের কথা লেখা থাকত। দেওয়ালের সেই লেখা,সেই রঙ আজ আর নেই।কিন্তু ঢাকার মানুষ সুখে নাই। একথা হলফ করে বলা যায়। খোঁজ নিয়ে দেখেন সারা দেশের মানুষের কেউ সুখে নেই। 

ঢাকাই বাংলাদেশ,ঢাকা থেকেই বাংলাদেশ। ঢাকা ভাল তো বাংলাদেশ ভাল,ঢাকা খারাপ হলে বাংলাদেশ ভাল বলা যায় না।  ঢাকার প্রভাব সারাদেশেই পড়ে। রাজনৈতিক কারণে ঢাকার আবহাওয়া উত্তপ্ত। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। মোবাইলের যুগে,ফেসবুকের যুগে দেওয়াল লিখন উধাও হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ছাত্রদের আন্দোলনের কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আবার ফিরে এসেছে দেওয়াল লিখন– গ্রাফিত্তি।  এখন আর কেউ লেখে না–কষ্টে আছি আইজুদ্দিন। মূলত দেশের কেউই ভালো নেই। 

এই মুহুর্তে দেশের মানুষকে মোটাদাগে ভাগ করা যায় তিনভাগে।

১.

সরকার পক্ষ 

২.

আন্দোলন পক্ষ

 ৩.

নিরপেক্ষ 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে টানা চৌদ্দ বছর।  বিগত চৌদ্দ বছরে যত আন্দোলন হয়েছে মাঠে ময়দানে শেষ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছে সরকারী দল। ময়দানে পুলিশ,র‍্যাবের সাথে দলীয় নানা ক্যাডার বাহিনীর দাপটে বিরোধী দল মাঠে টিকতে পারেনি এ যাবত। হুন্ডা,হেলমেট,লাঠিবাহিনীর দখলে থাকত রাজপথ। আন্দোলনকারী কিংবা বিরোধীদল কোনঠাসা থাকত সবসময়। তাদেরকে শেল্টার দিত বৈধ পোষাকধারী বাহিনী। এবারের চিত্র ভিন্ন। রাজপথ ও ভার্সিটিগুলো থেকে বিতাড়িত ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সকল শাখা প্রশাখার লোক। পুলিশ,  র‍্যাব ও কোন লীগ কোথাও নেই। শেষ অস্ত্র হিসেবে আছে সেনাবাহিনী ও তাদের পরিচালিত কার্ফিউ। কাজেই প্রথম পক্ষ মুখে না বললেও জনতা বলতেই পারে ” কষ্টে আছে আইজুদ্দিন “

২.

আন্দোলন পক্ষ

তারা দাবী নিয়ে মাঠে নেমেছিল। 

তারপরের ইতিহাস চোখের সামনেই। সরকারী হিসাব ধরলেও নিহতের সংখ্যা আঁৎকে ওঠার মতো।সারাদেশে দমন পীড়ন,নিপিড়ন, নির্যাতন,হত্যার পর শুরু হয়েছে গ্রেফতার। নিহতের পরিমাণ জানা যাবে ভার্সিটি খুললে।কোন হলে কে নাই,কতজন নাই,কার পুত্র নাই,ভাই নাই,বন্ধু নাই, সব জানা গেলে, পরিসংখ্যান নিশ্চিত হলে বলা যাবে কত প্রাণ ঝরেছে এই আন্দোলনে।এত হত্যা,রক্ত, গ্রেফতার,নির্যাতনের পর আন্দোলনকারীরাই কী ভালো আছে? না ভালো নেই।তাদের দিকে তাকিয়েও বলা যায় কষ্টে আছে আইজুদ্দিন। 

৩.

নিরপেক্ষ 

বাংলাদেশের একেবারে নিরপেক্ষ লোকটিই কী নিরাপদ আছে? এই লেখাটা দীর্ঘ করা যায়।নানা বিশ্লেষণে দীর্ঘ হতে পারে। কিন্তু সংক্ষেপ করছি। খুব সংক্ষেপে সমাপ্ত রাখছি।চার,পাঁচ,ছয়,সাত বছরের একটা শিশু তার কী কোন পক্ষ আছে? তার থেকে নিরপেক্ষ, নির্দোষ,নিষ্পাপ পবিত্র আর কেউ থাকতে পারে? তার নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন পক্ষের দ্বিমত থাকার কথা না।এমন শিশুরা নিহত হয়েছে মায়ের কোলে,দাদীর হাতে,দোতলা বাসার বারান্দায়,বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে। বাসায় নিহত হয়েছে মা,দাদী। দোকানে,দোকানের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে দোকানদার,নিহত হয়েছে পথচারী। সবাই মরে যায়নি। বহু মরেছে।জীবিতরা দম বন্ধাবস্থায় আছে। তারপর চলছে কারফিউ।  কারফিউ মানেইতো ঘরবন্দি। সমগ্র স্বদেশ মুক্ত কারাগার।নিজের ঘর নিজের জেলখানা।  দেশে এখনও থমথমে অবস্থা। ইন্টারনেট বন্ধ ছিল।মানুষ ছিল সোশ্যাল জেলে। মুক্তি মিলেছে। বৃটিশের শহর জেলের মতো। এমন একটা শাস্তি নাকি ছিল।শাস্তি প্রাপ্ত লোক নির্ধারিত শহরের বাইরে যেতে পারতো না। ইন্টারনেট এখনও শ্লো।শ্লো মানে শ্লো। এর মাঝে প্রতিদিন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। সমন্বয়করা ডিভি হেফাজতে ওয়াজ ফরমাইছে।জনগণ দ্রুত বুঝে গেছে এই ওয়াজ হারুনায়ন হইছে।তারপর বের হইছে নানক-হারুন নওনু সমগ্র। লোকেরা হাসলেও চোখ রাজপথে। 

দেশ এখনও অস্থির। কেউ ভালো নেই।কেউ স্বস্তিতে নেই। সবাই বলতে পারে কষ্টে আছি আইজুদ্দিন। আইজুদ্দিন ঢাকার দেওয়াল থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।ফের ফিরে এসেছে আন্দোলনের পথ ধরে।ছাত্ররা পালন করেছে দেওয়াল লিখন ও গ্রাফিত্তি কর্মসূচী। সেই লিখন ও গ্রাফিত্তি চিত্র ভেসে বেরাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।অবাক বিষয় হল এই অংকনে অংশ গ্রহণ করেছে স্কুলের খুদে বাচ্চারাও।

এতসবের শেষে বলতে পারেন আজকের বাংলাদেশে কে ভালো আছে? কে নিরাপদ আছে? কে স্বস্তিতে আছে?  তিনদাগে বললাম।আপনি তৃনমূল থেকে গাছের শীর্ষ ডাল পর পর্যন্ত বলেন। মুদি দোকানদার,রিক্সওয়ালা,ব্যবসায়ী,চাকরিজীবী,কবি,সাংবাদিক,সাহিত্যিক কেউ ভালো নেই।নেই যে এ কথাটাও অনেকে বলছেন মেপে মেপে। এর চেয়ে বরং আইজুদ্দিই সুখের ছিল। মনের দুঃখ ওয়ালে হুট করে লিখে ফেলতেন ” কষ্টে আছি আইজুদ্দিন “।  এখন এইটা লেখতে গেলেও মিলওটারি কইব  ” কী লিখ,কেন লিখ? সরকার আছে মিলিটারির কামানের হেফাজতে আর বাংলাদেশ চলছে মিলিটারির ডান্ডার ডগায়।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ