তৈমুর খান
১১
হৃদয়ের কারবারি
প্রথম প্রেমের অনুভূতি কেমন হয়? প্রথম ভাললাগা কতটা উথাল-পাথাল করে? প্রথম স্বপ্ন জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে কতখানি শক্তি যোগায়? এসব জেনেছিলাম বাংলা অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে এসে। যদিও তখন রংচটা একটি স্যুট আর টেরিকটের একটি সাদা শার্টই আমার সম্বল। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে কলেজ ম্যাগাজিনে, ‘বিকল্প’ নামের একটি লিটিল ম্যাগাজিনেও। বন্ধু বাগাল মুখার্জি ইংরেজি অনার্স পড়তে পড়তেই আমার কবিতারও মননশীল পাঠক হয়ে উঠেছে। কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদও করেছে। পরিচয় হয়েছে আরও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গেও। টিউশনি পড়ার অর্থ নেই একথা শুনে নোজফুল স্যার সুনীলবরণ ব্যানার্জিকে বিনা পয়সায় পড়াতে বলেছেন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। আমার সীমাহীন লজ্জা এবং সকল অভিজাত ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে বিনা পয়সায় পড়তে যাওয়া খুবই বেমানান মনে হয়েছে। সময় পেলে নোজফুল হক স্যারের বাড়িতেই পুরনো ‘দেশ’-এর সংখ্যাগুলো বের করে পড়ি। সেখানেই শামসুর রাহমান, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ প্রমুখ কবিদের পেয়ে যাই। কবিতা এক নতুনের দিকে মোড় নিতে থাকে। কলেজ লাইব্রেরি থেকে একে একে তুলে আনি সমরেশ বসুর উপন্যাস, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প, বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’। সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার নতুন সংখ্যাগুলি কিছু কিছু পয়সা বাঁচিয়ে প্রতি সপ্তাহেই কেনার চেষ্টা করি। আর ভালো লেগে যাওয়া কবিতাগুলি নিয়ে চিঠিপত্রও লিখতে থাকি। একদিকে কবিতার নেশা অন্যদিকে প্রেমের হাতছানি—মাঝখানে আর কোনো রাস্তা আমি দেখতে পাই না। রোজ কলেজ যাবার জন্য চার-আনা আট-আনা পয়সাই আমার কাছে যথেষ্ট। তবু তো নিজেও কিছু রোজগার করি। একটা টিউশনি পড়াই। সেখান থেকেও প্রতি মাসে কিছু আয় হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পড়াকালীন যে কষ্ট হয়েছিল, অনার্সের সময় সেই কষ্ট আর নেই। খুব মনে পড়ে উচ্চমাধ্যমিকে পরীক্ষা দিতে আসতাম তখন বেশিরভাগ দিনই কিছুই খাবার পেতাম না। পাড়ায় ঘুরে আমার ছোট বোনটি কখনো কখনো ভাতের মাড় চেয়ে আনত। কখনো শুধু শাক সেদ্ধ। পায়ের চপ্পল ছিঁড়ে গেলেও নতুন ফিতে লাগাতে পারতাম না। কোনো পুরনো চপ্পল থেকে ফিতে সংগ্রহ করে লাগাতাম। তার ফলে দুই পায়ে দু’রকম ফিতে হয়ে যেত। অনেকটা পথ না খেয়ে সাইকেলে যেতে হতো। মাথা ঘুরে একবার পড়েও গেছিলাম এক শিক্ষককে ধাক্কা মেরে। তিনি ছিলেন রামপুরহাট হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। সস্নেহে আমাকেই হাত ধরে তুলে বলেছিলেন, “তোমাকে লাগেনি তো বাবা! কত দূর থেকে আসছো! যাও, সাবধানে যাও!” এরকম মানুষ আর জীবনে দেখিনি। অন্য কেউ হলে আমাকে দু-চড় মেরেও সন্তুষ্ট হতেন না,পুলিশকেও দিতেন। অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতি মাসে বেতন দেওয়ার জন্য দাদার দেওয়া জমিটুকু আমাকে বিক্রি করতে হয়েছিল। তবুও সে টাকায় বেশি দিন চলেনি। মাঝে মাঝে কলেজ কামাই করে মজুরের কাজও করতে হতো। তখন বেশিরভাগ সময়ই ঠিকাকাজ করতাম।পাঁচজন মজুর মিলে ধানের বীজ তোলা এবং এক বিঘা জমিতে ধান রোপণ করার কাজ দেখে অঞ্চল প্রধান অমর ঘোষ বলেছিলেন, “এত কাজ করতে পারিস! আমি তো তোদের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেলাম!” সুতরাং লেখাপড়া করলেও আমার যে কাজের চাহিদা ছিল একথা বলাই বাহুল্য।
ছোটবেলায় দাদার সঙ্গে নবান্ন খেতে যেতাম আয়াস গ্রামের অতুলচন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি। বই কিনতে পারি না বলে বাবা তাঁকে একটা বইয়ের দাম চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ কিনে দিলেই হবে। বইটির দাম ছিল পঁচিশ টাকা। সে বাজারে পঁচিশ টাকার মূল্য অনেক। কিন্তু তিনি সেই বইয়ের দাম আমাকে দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামেরই প্রশান্তচন্দ্র মণ্ডলও দিয়েছিলেন একটি বইয়ের দাম। তাঁর দেওয়া দশ টাকায় আমি কিনেছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পাদিত ও সংগৃহীত ‘বৈষ্ণব পদাবলী’। বাংলা অনার্সের ক্লাসে এই বই দুটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আমার আজীবন কাজে লাগে এই বই দুটি।
টিউশনি পড়া সম্ভব হয়নি কিন্তু পড়ানো চলতে থাকে। এর ফাঁকে কখন ভাললাগার জন্ম হয় নিজেও জানি না। যে মেয়েটি প্রথম আমাকে নিয়ে একটি কবিতায় প্রেম নিবেদন করেছিল সে ছিল আমারই সহপাঠী। অনেক দূরের গ্রাম থেকে তাকে ট্রেন অথবা বাসে চেপে আসতে হতো। তার গায়ের রং এতই কালো ছিল যে তাকে কালো রংয়ের দুর্গা বলেই মনে হতো। বড় একা একা থাকত সে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি বিনিময় হলেও কথা বলতে পারতাম না। একদিন দুজনেই বাস স্ট্যান্ডে এসে আর বাস পেলাম না। সেদিনই কথা বলেছিলাম ওর সঙ্গে। একটি দোকানে বসে দুটি মিষ্টি খেতে খেতে কথা হয়েছিল। চেয়েছিলাম তাকে বাংলা নোটসগুলিও। সে সম্মতি জানিয়েছিল। বলেছিল, বহুদিন থেকে একটা কথা সে বলতে চায়।
—কী কথা?
—আরেকদিন বলব।
—আজ নয় কেন?
—থাক, কী মনে করবে!
—কিছু মনে করব না। সব বলতে পারো। আমি গ্রামের ছেলে, শহরের কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশতে পারি না। তাই কথাও বলতে পারি না। আমাদের অবস্থাও ভালো নয়।
—আমিও গ্রামের মেয়ে। কলেজে দেখতে পাই বড়লোকের বখাটে ছেলে-মেয়েরা কত প্রেম করে বেড়ায়। তুমি একা একা থাকো বলেই তো এতো ভালো লাগে!
—সবই বুঝতে পারছি। তোমার এই চালচলন গ্রামের মতোই সরল ও সাদাসিধে। আমিও পছন্দ করি।
শান্ত নিরীহ মেয়েটির মুখরাঙা করেই আমার সামনে মাথা নিচু করেছিল। মাঝে মাঝেই দৃষ্টি বিনিময় হলে একটু হেসে উঠত। চমৎকার লাগত তার হাসি। রং কালো বলে শ্বেতশুভ্র দন্তগুলি আকন্দের ফুলের পাপড়ির মতো মনে হতো। একদিন তার অলংকারের খাতাখানা আমাকে দিয়ে বলেছিল, “সেদিন যা বলতে পারিনি লিখে দিয়েছি এর ভেতরে। এখানে কিন্তু পড়তে পাবে না। বাড়ি গিয়ে খুলবে।”
সেই খাতাতেই শেষের দুইপাতা জুড়ে দীর্ঘ চিঠি লিখে তার মনের কথা জানিয়েছিল। লিখেছিল একটা কবিতা সেটাই নাকি তার প্রথম কবিতা। সেদিন তার না বলা কথা শোনার জন্য পীড়াপীড়ি করাতে সে ভেবেছিল আমি রাগ করেছি। এই কবিতার প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। আমি যেন তাকে দোষ না দিই এ কথা বারবার বোঝাতে চেয়েছিল। কবিতার চারটি লাইন এমন ছিল—
“মনের ভেতর শুধুই তুমি,দেখি তোমার মুখ
তোমায় আমি ভুলব নাকো যতই আসুক দুখ।
প্রথম যেদিন দেখেছিলাম,সেদিনই মনের মাঝে
জায়গা তুমি করে নিয়েছ,তা বলতে পারিনি লাজে।”
কবিতায় লেখা আমার জীবনের একটি মাত্রই প্রাপ্তি ছিল এই চিঠি। যে চিঠিতে শুধুই আত্মসমর্পণ, শুধুই আত্মনিবেদন। রাধার অন্তরের ব্যথা তখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তার দীর্ঘ চিঠির জবাব আমি দিতে পারিনি। আমি প্রেমকে সম্মতি জানাতে পারিনি, কিন্তু শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম। বহু টানাপোড়েনের পর আমি এম.এ পড়তে চলে যাই। সে অনার্স টিকিয়ে রাখতে পারেনি বলে পড়াশুনাতেও ইতি টেনে দেয়। ওর বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হলে আমাকে শেষ চিঠি লিখে অন্তত একবার দেখা করার আকুতি জানায়। কিন্তু আমি দেখা করতেও পারিনি। নিজের অসহায়তায় হোস্টেলে থেকে খরচই জোগাতে পারছিলাম না। তাই মানসিকভাবেও ছিলাম বিধ্বস্ত। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের কাছে সাহায্য চেয়ে তীর্থের কাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
এম.এ পড়া শেষ হলে বাড়ি ফিরে এসে শুরু করতে হলো আবার টিউশনি। পূর্বে যাকে পড়াতাম সে তখন অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। প্রায় দুই থেকে আড়াই বছর পর ডাক পড়ল তার বাড়িতে পড়াতে যাওয়ার। আর প্রথম দিনেই একরাশ অভিমান ঝরে পড়ল। কেন এতদিন তাকে একটা চিঠিও লিখিনি? কী করে তাকে ভুলে থাকলাম? প্রতিদিন সে আমার জন্য কান্নাকাটি করেছে শুধু আমার জন্যই তার কষ্ট!……এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি থ হয়ে গেছি। কিশোরী মেয়েটির এই অন্ধ ভালবাসা এতদিন আমি টের পাইনি? আমার মতো নিঃস্ব, ভিন্ন সম্প্রদায়ের একজন টিউশন মাস্টারকে মেয়েটি কি সত্যি সত্যি ভালবাসে?বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে যেন হৃদয় খুঁজতে থাকে। বলতে থাকে, “হৃদয় চাই! হৃদয় চাই! হৃদয় দাও, আর কিছু চাই নে আমি!”