তৈমুর খান
১২
দরজা বন্ধ, দরজা খোলা
পত্রিকার নাম ঠিক হলো ‘বালার্ক’ সকাল বেলার সূর্য। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ আঁকলেন নজির আহমেদ। সূর্য উঠছে। নীল আকাশ। কয়েকটা উড়ন্ত পাখি। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির আভা ছড়িয়ে পড়ছে। পত্রিকার সম্পাদক হলেন নোজফুল হক স্যার। সহ-সম্পাদকীয় বিভাগে আরও কয়েকজনের সঙ্গে রইলাম আমিও। ‘বালার্ক’ মাত্র দুটি সংখ্যা বেরিয়েছিল। সেখানে স্বনামে একটি ও ‘কমললতা’ ছদ্মনামে দুটি করে মোট ছয়টি কবিতা লিখেছিলাম। পত্রিকার দুটি সংখ্যাই খুব সুন্দর হয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হওয়ারও কথা নয়। অনেক দূরদূরান্তে গিয়েও আমরা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু নোজফুল স্যারের একটি পারিবারিক বিপর্যয় ঘটেছিল। স্যার ছিলেন ফিজিক্স এর অধ্যাপক। বিদেশ থেকে ডক্টরের ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। প্রাণ খুলে সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে ভালবাসতেন। সেই সব মানুষদের মধ্যেই কিছু কুচক্রী মানুষ স্যারের বহুল ক্ষতি করে দিয়েছিলেন যা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন না। তাই সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সাহিত্য সম্পর্কিত কোনো ব্যক্তিকেই তাঁর ঘরে আর আশ্রয় দেননি। চিরদিনের মতো তাঁর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এতখানি তিনি আঘাত পেয়েছিলেন যে স্বাভাবিক জীবনেও ফিরতে পারেননি। দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আমার জীবনে স্যারের অবদান কোনোদিনই ভুলতে পারব না। গ্রাম থেকে কাদামাটি মেখে, মাঝে মাঝে জলে ভিজেও তাঁর বাড়ি এলে তিনি শুকনো কাপড় দিতেন গা মোছার জন্য। খাওয়া-দাওয়া করেছি কিনা তার খোঁজখবরও নিতেন। সারাদিন কলেজ করে বাড়ি ফিরে গেলে তিনি একবেলা খেয়েও যেতে বলতেন। এরকম মরমি সহানুভূতিশীল অভিভাবক তুল্য মানুষটিকে হারিয়ে আমি বেশ কিছুদিন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
যে মূল্যবোধ, যে মানবিক চেতনা, যে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নোজফুল হক স্যার দান করেছিলেন তা আমার জীবনে ছিল সবচেয়ে বড় শিক্ষা। মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থেকে সেই সময়ই ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকা প্রকাশ করতেন আবুল কালাম। বীরভূমের রাজগ্রাম থেকে ‘চরৈবেতি’ প্রকাশ করতেন কুদ্দুস আলি এবং কলকাতা দুর্গানগর থেকে ‘দৌড়’ পত্রিকা বের করতেন মধুমঙ্গল বিশ্বাস। রামপুরহাট থেকে প্রকাশিত হতো আমার প্রথম কবিতা লেখা পত্রিকা ‘বিকল্প’। এই পত্রিকাগুলির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কখনো কখনো উপস্থিত হতে শুরু করেছি। সাইকেল চালিয়ে ভ্রাম্যমান পূর্বাভাস পত্রিকার অনুষ্ঠানে মুর্শিদাবাদে কান্দি, কুলি, নগর, নবগ্রাম পর্যন্ত ছুটেছি। কোনো কোনোদিন বাড়ি আসতে পারিনি। উঠোনে ত্রিপল টাঙিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত সাহিত্য অনুষ্ঠান চলেছে। তখন উঠোনেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুঘনি-মুড়ি, মাছ-ভাতও জুটেছে। অনেক পরে এমন সাহিত্য অনুষ্ঠান হয়েছে বোলপুরের শ্রীনিকেতনে ‘কবিতায়ন’ পত্রিকার সম্পাদক চারুচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে। কালামদার অনুষ্ঠানে গান গাইতেন মানোয়ার হোসেন। তিনি কবিতাও লিখতেন। আরও সব বেশিরভাগ মানুষ থাকত অতিসাধারণ যারা হাটুরে, কৃষক, মজুর, ছাত্র-ছাত্রী, এমনকি গৃহবধূরাও। সাহিত্যে এত মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা বা আগ্রহী করে তোলা দেখে আমি তাজ্জব হতাম। ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকা ত্রৈমাসিক হিসেবে বের হতো। আবুল কালাম হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বেশিরভাগই প্রতিবাদী কবিতা লিখতেন। ভালো ছবিও আঁকতে পারতেন। বাড়ি ফিরতে না পারলে তাঁর কোঠাপাড়া টিনের চাল দেওয়া মাটির বাড়িতে থাকতাম। ভাবি দু’খানা বালিশ দিতেন। বালিশের সাদা ওয়াড়ের উপর লাল সুতোর অক্ষরে লেখা থাকত:
“নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল
ফুল নেব না, অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।।”
কালামদার সঙ্গে গল্পে গল্পে কেটে যেত সারারাত। শুনতাম তাঁর অতীত জীবনের কথা। ভাগলপুরে এবং বিশ্বভারতীতে পড়াকালীন নানা অভিজ্ঞতা। আমরা কবিতা কেন লিখব, কবিতা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়েও বারবার আলোকপাত করতেন। তবে সমাজের অনাচার, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনা ও পীড়নের প্রতিবাদে কলমই একমাত্র হাতিয়ার বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সাহিত্য সৃষ্টি থেকে সাহিত্য সংগঠক হিসেবে তাঁর প্রতিভা ছিল অনেক বেশি। ছাত্রজীবনে তাই মুগ্ধ না হয়ে পারতাম না। তাঁর ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রথম কবিতাটি ছিল ‘রাস’।প্রথম অংশটি এরকম:
“ছুটতে ছুটতে মানুষের ভিড়ে মিশে গেছি
আমার লজ্জা নিবারণের বসন ছিল না
চুল আর বাহুমূলে ঢেকে আছি মুখ
নির্মাঙ্গে খোলা ইজ্জত হা হা করছিল বাতাসে।
পূর্ণিমার ভিতর চোখ খুলে দেখি
সারি সারি ন্যাংটো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে”
কবিতাটিতে সভ্যতার নগ্নরূপ যা ধর্মীয় মিথের আড়ালে উল্লেখ ছিল। প্রথম কবিতা হলেও কালামদা খুব সুনাম করেছিলেন।
চারুচন্দ্র রায়ের অনুষ্ঠানেও সারারাত জেগে থাকতাম। আশানন্দন চট্টরাজ মাঝে মাঝে গান গাইতেন। বাউলরা যেমন মাঝে মাঝে নেচে নেচে গান করেন ঠিক তেমনি। কবিতা পাঠেরও আসর হতো জমজমাট। ঘনঘন চা পান এর ব্যবস্থাও থাকত। আশানন্দনের গান এখনও যেন কানে বাজছে:
“দেশ-বিদেশের মানুষ ওগো যাও বীরঘুম ঘুরে”
অথবা,
“ওরে যেইখানেতে যাবি ওরে
নামতে হবে সেইখানে
ঠিক করে নে ধরবি গাড়ি কোন্ ইস্টেশানে”
এই অনুষ্ঠানে শুধু আশানন্দনই নন, নানা সময় থাকতেন বিশ্বভারতীর বহু অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। এই অনুষ্ঠানেও কবিতা পড়ার সুযোগ পেতাম। চারুদা প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই কবিতা প্রকাশ করতেন। একবার একটা কবিতা এরকম লিখেছিলাম—
“নারী দেখে দেখে, নারী দেখে দেখে
নিজের বউকেও আর নিজের মনে হয় না।”
কবিতাটির খুব প্রশংসা করেছিলেন চারুদা। কবিতার টানে এভাবে রাত জেগে থাকাতেও আনন্দ পেতাম খুব।
‘চরৈবেতি’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রত্যেক মাসেই একটা সাহিত্য সভা হতো। যদিও ত্রৈমাসিক বের হতো, তবু সাহিত্য সভাগুলিতে কবিতা-গল্প পাঠ ও আলোচনার মাধ্যমে সাহিত্য চর্চাকে অব্যাহত রাখাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। রামপুরহাট থেকে ট্রেন ধরে রাজগ্রামে নেমেই স্টেশনের কাছাকাছি এই আড্ডা বসত। সকালে ট্রেনে গেলে আমরা বিকেলে ফিরতে পারতাম। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেই অনুষ্ঠানে থাকতেন। কোনো কোনোদিন আবদুর রাকিবও। গল্প বা কবিতা পাঠের পর সেসব নিয়ে আলোকপাত করতেন সভাপতি। ফলে বেশ সমৃদ্ধ হতে পারতাম। আমার কবিতা জীবনের অনেকখানি মুগ্ধতা এই অনুষ্ঠানে পাওয়া। প্রতিবারই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার সময় ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে সম্পাদক কুদ্দুস আলি এক খিলি মিষ্টি পান কিনে দিতেন। তা মুখে পুরে ভারি স্বাদ পেতাম।
আমার সাহিত্য জীবনের মোড় ঘুরে গেছিল ‘দৌড়’ পত্রিকার সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। কলেজ পড়া অচেনা কিশোরের কবিতা তিনি ডাকযোগে পেয়েও খুব যত্নে ছাপিয়ে ছিলেন। তারপর পত্রিকা পাঠিয়ে, চিঠি লিখে উৎসাহ যুগিয়ে ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণেই প্রথম কলকাতায় পা রাখি দুর্গানগরের ভাড়া বাড়িতে। সেখানে দু-তিন দিন থাকলেও কোনো অসুবিধা হতো না। তীর্থঙ্কর মৈত্র, চিত্তরঞ্জন হীরা, সঞ্জয় গূহ ঠাকুর, সনৎ কুণ্ডু, বিভাস রায়চৌধুরী, প্রশান্ত সরকার, কমলেশ পাল প্রমুখ বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গেই পরিচয় ঘটে। ‘দৌড়’ পত্রিকায় লেখার মান অনুযায়ী প্রকাশ করা হতো। সম্পাদকীয় দপ্তরে প্রতিটি লেখা জমা হলে সেগুলি পাঠ করে বিশিষ্টজনদের মতামত নেওয়ার রীতি ছিল। ভালো লাগলে তবেই সেগুলো ছাপা হতো। পত্রিকা সম্মানের সঙ্গে ডাকযোগে পাঠানো হতো। প্রথম যে কবিতাটি মধুমঙ্গল বিশ্বাসকে পাঠিয়েছিলাম তার নাম ছিল ‘পৃথিবী দেখুক’। কিছুটা অংশ এরকম:
“কেমন করে মানুষের ইচ্ছেগুলি মরে যায়
মাটিতে লেপ্টে যায় বুভুক্ষ স্পর্শ
অপক্ব প্রাণের কাতরতা ঝরে
শিথিল আবেগে পরাহত সাধ
দ্যাখো পৃথিবী কেমন করে মুছে যায়”
সেই সময়ের হতাশা ও যন্ত্রণার কবিতা। একটা ভবিষ্যৎহীন জীবনের অন্ধকারময় ছবি। এই মধুমঙ্গল বিশ্বাস প্রায় জোর করেই আমাকে গদ্য লেখা শেখালেন। জোর করেই পুস্তক সমালোচনা করালেন। ‘দৌড়’ পত্রিকায় বরাবরেরই লেখক হয়ে উঠলাম। প্রথম যেদিন মধুদার ডাকে কলকাতায় গিয়ে উঠলাম, সেদিন তিনি দুর্গানগরের একটি রুমের ভাড়া বাড়িতে রয়েছেন। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী দীপিকা বালা বিশ্বাসের সঙ্গে। একটা মাত্র চৌকি সেখানে। মনে আছে সেদিন বৌদি ও আমার মাঝখানে মধুমঙ্গল বিশ্বাস ঘুমালেন। কতটা আন্তরিকতা থাকলে এবং আপন করে ভাবতে পারলে এ কাজ করতে পারেন তা জেনেছিলাম। তারপর ঘরের সংখ্যা বাড়লে বছরে বেশ কয়েকবারই যেতাম। একবার নিয়ে গেলাম বন্ধুবর এমবি ইসলামকে। এমবি ইসলাম তখন রামপুরহাট কলেজ সংলগ্নপাড়ায় মোটর পার্টস এর দোকান করেছিল। কলেজে গিয়ে তার দোকানেই একবার বসতাম। তার কবিতা লেখার খুব শখ ছিল। কিন্তু কবিতা ঠিক হতো না। তখন তার বকলমে আমিই লিখে দিতাম। ছাপানোও হতো বেশ কিছু পত্রিকায়। বেশ কিছুটা সুনামও হয়েছিল। কবিতা লিখে দেওয়ার বদলে সিঙাড়া, মিষ্টি, তেলেভাজা এবং চা জুটত। বাড়িতে খাবার না থাকলেও কবিতা লিখে দিয়ে খাবারের ভরসা ছিল। এমনকি বেশ কয়েকবার কোথাও যাওয়ার জন্য কিছু টাকাকড়িও চেয়ে নিতাম। সেই সব কবিতাগুলো মধুমঙ্গল বিশ্বাসের প্রকাশনা থেকেই ‘এ কেমন সময় এলো’ নামে প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু পত্রিকায় তার রিভিউও বের হয়েছিল। অবস্থার পরিবর্তন হলে সাহিত্য থেকে এমবি ইসলাম বিদায় নেয়। ১৯৯৪ সালে এই মধুমঙ্গল বিশ্বাসই ‘দৌড়’ প্রকাশনার সূচনা করেন। প্রথম বছর যাদের বই প্রকাশ হয় তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। দশটা কবিতা লিখিয়ে নিয়ে ‘কোথায় পা রাখি’ কাব্যটি প্রকাশ করেন। নিজ উদ্যোগে নিজস্ব খরচে এই কাব্য প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে আমার অভিষেক ঘটান। আমি প্রেরণা পাই, সাহস পাই, পাই অফুরান ভালবাসাও। একটি চিঠিতে মধুমঙ্গল বিশ্বাস জানান, “সাহিত্যে তোমার শক্তি আছে, মনন আছে, বোধ আছে। কী কবিতা কী গদ্য লেখায় তুমি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারো।সহজাত ও সাবলীল এই ক্ষমতা সবার থাকে না। তাই তুমি সাহিত্যচর্চা থেকে কখনো বিরত হ’য়ো না।”
শুধু সাহিত্যচর্চাই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও বহু সময় নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এমএ পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে যখন হোস্টেল খরচ জোগাতে পারিনি, তখন কিছু কিছু অর্থও পাঠিয়েছেন। আপনজনের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আজও তিনি রয়ে গেছেন। ১৯৯৯ সালে ‘বৃষ্টিতরু’ এবং ২০১১ তে ‘প্রত্নচরিত’ নামে আরও দুটি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে ‘প্রত্নচরিত’ কাব্যটিই ‘দৌড়’ সাহিত্য সম্মাননায় সম্মানিত হয়। ২০২৩ এ এসে ‘দৌড়’ পত্রিকা আমাকে নিয়েই একটি বিশেষ সংখ্যা করে। আমার জীবনে দৌড়’ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে এবং এখনো করছে। আমার জন্য সর্বদা দরজা খুলেই রেখেছে।