কাজী জহিরুল ইসলাম
একটা চমৎকার ছবি এঁকেছেন কোনো এক শিল্পী, ক্যাপশনটা আরো চমৎকার। একটি বাসে আগুন লেগেছে, কিছু যাত্রী প্রাণ বাঁচাতে নেমে গেছেন, কিছু যাত্রী তখনও বাসে বসে আছেন। যারা জ্বলন্ত আগুনের ভেতর বসে আছেন, তারা বলছেন “বিকল্প কোথায়?” আর যারা নেমে এসেছেন, তারা বলছেন, “গাধার বাচ্চারা আগে বাস থেকে নাম”।
কী দারুণ করেই শিল্পী বলে দিলেন, শেখ হাসিনার বা এই সরকারের বিকল্প কে, বা কেউ আছে কি-না, সেইসব পরে ভাবা যাবে, আগে তো জ্বলন্ত গাড়ি থেকে নামুন।
অনেকেই বহুদিন ধরে এই জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন, হাসিনা নামলেই তারেক জিয়া বসে যাবেন এবং তার কাঁধে ভর দিয়ে জামাত এসে দেশকে তালেবান বানিয়ে ফেলবে। আমরা কতটা মূর্খ, পাশের দেশ ভারত থেকেও শিক্ষা নেই না। হিন্দু রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দেওয়া দল বিজেপি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এলো, একবার না, পরপর তিনবার, কই ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিজেপির আগে যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন, সেই কংগ্রেস, সেনাবাহিনীর, পুলিশ বাহিনীর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে হাসিনার মতো অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে যাননি তো? একটি দেশে যদি গণতন্ত্রের ধারাবাহিক চর্চা অব্যাহত থাকে তাহলে মন্দ সরকারকে জনগণই হটিয়ে দেবে। বিএনপি যদি এসেই যায় এবং তারা যদি হাসিনার মতো বা তার চেয়েও খারাপ কাজ করে তাহলে জনগণই আবার তাদের নামিয়ে দেবে।
এবার আসি, ঠিক এই মুহূর্তে সমাধানটা কোন পথে, সে আলোচনায়। আরো বহু মানুষ হত্যা করে কিংবা ছাত্রদের নয় দফা মেনে নিয়ে, অপরাধের দায় স্বীকার করে নাকে খত দিয়ে, সরকার হয়ত, সেই সম্ভাবনা যদিও এখন আর নেই বললেই চলে, তবুও বলছি, হয়ত, টিকে যেতেও পারে। কিন্তু তা হবে অতি অল্প সময়ের স্বস্তি।
এই যে বাংলাদেশের মানুষ ফুসে উঠেছে, পুরো দেশ এই সরকারের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এটা কী শুধু কোটা সংস্কারের দাবীর কারণে? একদম না, আমি আগেও বলেছি, কোটা সংস্কারের দাবীটা ছিল বারুদ ভর্তি ওয়াগনের মুখে লাগানো একটি চিকন সলতে। সেই সলতের মাথায় আগুনটা ধরিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেই। তিনি ভেবেছিলেন, বরাবরের মতোই এদেশের মানুষকে “রাজাকার” বলে গালমন্দ করে, চাটুকার সাংবাদিক পরিবেষ্টিত হয়ে হাস্যরসের নাটক করে, বিকৃত সুখ অনুভব করে, পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। সলতের আগুন ওয়াগনের বারুদে গিয়ে লেগেছে। যেখানে পুঞ্জিভূত হয়ে ছিল সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, গণতন্ত্র হত্যা, স্বজনপ্রীতি, এক দেশে দুই নীতি, আইন-আদালত পকেটস্থ করা এবং সর্বোপরি এদেশের সৎ, মেহনতী ও মেধাবী মানুষকে কথা কথায় সবচেয়ে ঘৃণ্য গালি ‘রাজাকার’ বলার ক্ষোভ।
ফিরে আসি সমাধানের জায়গায়। স্বল্পকালীন সমাধানের কথা তো বললাম, যেটির চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। পলককে দেখলাম হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছেন। কিন্তু এতে কাজ হবে না। এতো বড়ো অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবার যোগ্যতাই তো পলকের নেই। ওর জন্য আমার পরমর্শ হচ্ছে, ক্ষমা চেয়েছেন, স্বাগত জানাই, এখন পদত্যাগ করে আন্দোলনে যোগ দিন তাহলে হয়ত শাস্তিটা কম হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হচ্ছে জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। এই প্রক্রিয়াটি কঠিন হবে বলে অনেকে মনে করেন কারণ সংবিধান থেকে তত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। মনে রাখবেন, সংবিধান মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধানের জন্য নয়।
বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যখন কোনো স্বৈরাচারের পতন ঘটে তখন একটি নতুন সংবিধানের সূচনা হয়। হাসিনার পতনের পর একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই ছাত্ররাই ঠিক করবেন কেমন হবে জাতীয় সরকার। ৫২ বা ৬৫ জন যে সমন্বয়ক আছেন, তারা বসে ঠিক করবেন জাতীয় সরকারের রূপরেখা, আমরা তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেব। জাতীয় সরকার দ্রততম সময়ের মধ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করবে এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এটিই একমাত্র স্থায়ী সমাধান।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২ আগস্ট ২০২৪