তৈমুর খান
১৩
ওরা কেউ বিচার পায়নি
অনার্স পার্ট টু পড়াকালীন বেশ কিছু ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই ঘটে যায়। কম বয়সের কারণে আবেগ তাড়িত হয়ে বহু কাজের মধ্যেই সামিল হই কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছাড়াই। সেই সময় আমার বয়সের থেকে কিছুটা বড় একটি মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও বিয়ের দিন বর আর উপস্থিত হয় না। ফলে সমাজের চোখে মেয়েটি লগ্নভ্রষ্টা। গায়ে হলুদ, আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো এবং আরও যেসব সামাজিক সংস্কার প্রচলিত আছে সেগুলো একে একে সবই সম্পন্ন হয়। বিয়ের আয়োজনেও খামতি ছিল না। বরযাত্রীদের জন্য মাংস-পোলাও রান্না করা হয়েছিল। কিন্তু বর আসেনি, বরের বাড়ির দিক থেকে কোনো খবরও পাঠানো হয়নি। সবাই রাস্তা চেয়ে অপেক্ষা করছিল আর এভাবেই সারাদিন কেটে যায়। চাষি ঘরের নিম্নবিত্ত একটি পরিবারের এই মেয়েটি কি বিদ্রোহিনী হতে পারে না? তাকে নিয়েই লিখেছিলাম গল্প। প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিকল্প’ পত্রিকায়। গল্পের সব ঘটনা সত্যি হলেও শেষটুকু এই ভাবেই শেষ করেছিলাম—
“—দেলেরা একটা হাত ধরে তাকে টান দিল। হঠাৎ আঁতকে উঠল। বলল, কে?
—উশশ্! আস্তে কথা বল। আমি দেলেরা।
—এত রাতে? ভয় মিশ্রিত স্বরে মুনু জানতে চাইল।
—আমার সঙ্গে আয়।…কঠোর নির্দেশ।
—কোথায়?
—আমার ঘরে।
—কেন?
—আমার সঙ্গে থাকবি।
—আপনার আব্বা কিছু বুলবে না তখন?
—আমি আর কাউকে ডরাই না।
হঠাৎ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে কয়েকটা কাক ডেকে উঠল—নূতন সূর্য। চারিদিকে হৈ-হট্টোগোল আলোচনা-সমালোচনার মাঝে দাঁড়িয়ে বাপ কাশিদ শুধু ভাবছে, এত বন্দোবস্ত সব বিফলে গেল…”
গল্পটির নাম ছিল ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’। দেলেরার যে স্বপ্ন ভেঙে গেছিল, সেই স্বপ্ন সে বাড়ির মাহিন্দারকে নিয়ে আবার নির্মাণ করল। হোক সে মাহিন্দার অন্য সম্প্রদায়ের। তার বাপ বিয়ের পণ মিটিয়ে দিতে পারেনি বলে বর বিয়ে করতে আসেনি। এরকম সমাজকে উচিত শিক্ষা দিল—এরকমই মনোভাব নিয়ে গল্পটি লিখেছিলাম। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে গেল। পত্রিকায় গল্পটির কথা চাউর হতেই চারিদিকে হই হই শব্দ। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে সালিশি সভার আবেদন জমা হল।
এদিকে দেলেরা ওরফে মিলুয়ারা আমাকে ফাঁসানোর একটি অন্য পন্থা অবলম্বন করল। পাশের গ্রামে টিউশন করে আমি রাত্রে বাড়ি ফিরি। সেদিনও রাত্রে ফিরছিলাম। গ্রামে ঢোকার মুখেই নির্জন সরু রাস্তায় টর্চের আলো ফেলতেই দেখি সামনে সে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন দেহে দাঁড়িয়ে আছে।যে সাপের ভয়ে আমি রাস্তা দেখি, এ সেই সাপ নয় ঠিকই, কিন্তু সাপের থেকেও আরও বেশি বিষধর মনে হল। চকচকে রুপোলি মাছের মতো শরীর, ঊরুসন্ধি, গভীর নিতম্ব, দুই চন্দ্রচূড় রহস্যময় স্তন, নিটোল ও উদ্দাম চুচুক এক ঝলক টর্চের আলোয় সেসব বিদ্যুৎ চমকের মতো উদ্ভাসিত হলো। দুই কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। শরীরে ঘাম ঝরতে শুরু করল। সে কঠোরভাবে নির্দেশ দিল, “টর্চ বন্ধ কর!”
তারপর দৌড়ে আমাকে ঝাপটে ধরতে চাইল দুই হাত বাড়িয়ে। বিপদ বুঝে আমি আর অগ্রসর হলাম না, আবার পিছন ফিরেই লাগালাম দৌড়।
বাড়ি এসে রাত্রে ভালো ঘুম হলো না। একরাশ চিন্তায় নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম, আমার গল্পটা লেখাই কি তাহলে ভুল হলো? কেন এরকম সত্য ঘটনা লিখতে গেলাম? তাহলে কি আমাকে আবার মার খেতে হবে পঞ্চায়েত প্রধানের হাতে? ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেল। বিশেষ একটা কাজে আমাকে কলেজে যেতেই হবে।
কলেজ থেকে ফেরার পথেই জানতে পারলাম আজ সন্ধ্যাতেই বসছে সালিশি সভা।দেখা পেলেই লোকজন এসে ধরে নিয়ে যাবে। হয়তো মার খেতে হবে, কিংবা জরিপানা। নতুবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার কৌশল। খুব সংকটজনক অবস্থায় সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারলাম না। সে রাত্রেই ট্রেন ধরে মুম্বাই রওনা হলাম। টিকিট নেই, পকেটে পয়সাও নেই। মোগলসরাই এক্সপ্রেস ট্রেন। জেনারেল বগি। তিন দিন না খেয়ে যেতে হবে আমাকে। হ্যাঁ, আগের যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে টিকিট চেকার এলেও আমি সিটের তলায়, বাথরুমে অথবা গেটে চলাফেরা করেই নিজেকে রক্ষা করতে লাগলাম। বারবার চোখে মুখে পানি দিয়ে, খালি পেটে পানি খেয়ে গুটিশুটি মেরে, অন্যের খাবার খাওয়া দেখে দেখে মুম্বাই পৌঁছে গেলাম। নিজের কাছে নিজেই যেন এক আশ্চর্য বস্তু। কিভাবে সম্ভব হয়েছিল তা আজও ভেবে পাই না।
তবে যতই সংকট অবস্থা হোক তিনদিন পর বি.টি স্টেশনে নেমেই পা-কাটা দাদুল ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা ছিল বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। দাদুল ভাই পরিচিত একজনকে ট্রেনে চাপাতে এসেছিল। আমাকে দেখেই সে চমকে উঠল। বলল, “একা একা হঠাৎ কী ব্যাপার?”
আমি উত্তর দেওয়ার আগে তার হাতটি ধরে এনে স্টেশনের বাইরে সবকিছু বলতে লাগলাম। তিন দিন না খাওয়ার কথা শুনে সে-ও অবাক হলো। বিনা টিকিটে এতদূর! পকেটে একটা কানাকড়িও নেই! যাহোক আল্লাহ রক্ষা করেছেন। তারপর বলল, “দাঁড়াও, আমি কিছু ধান্দা করে আসি!”
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকলাম। দাদুল ভাই ভিক্ষে করে সামান্য কিছু পয়সা নিয়ে এক ঠোঙা পকোড়া এবং এক বোতল পানি নিয়ে ফিরে এল। সেদিন এই খাবারটুকুই ছিল আমার কাছে অমৃতের মতো। সব খেয়েটেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বাড়িতে কী কাণ্ডই না হলো এই চিন্তাও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
দাদুল ভাইকে বললাম, “চলো তোমার সঙ্গে যাই। গোসল করতে হবে।”
সেবার দাদুল ভাইয়ের ঝোপড়াপট্টিতে এসে তার বউয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। আজ সরাসরি তার বউকে দেখলাম। পরিচয়ও হলো। মাটির নিচে খোঁড়া গর্ত থেকে পানি তুলে গোসল করলাম। দাদুল ভাইয়ের দেওয়া একটা শুকনো কাপড় পরে কিছুটা আরাম বোধ হলো। ভাবি টিনের থালায় ভাত বেড়ে দিলে। দু’জনে মিলেই ভাত খেলাম। ক্লান্তিতে চোখ বুজে এল। আর বসে থাকতে পারলাম না।
রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে মন বসাতে পারছি না। বাড়ি থেকে একটা খবরও পাইনি। তখন ফোন করার এত চল ছিল না। চিঠির উপরেই ভরসা করতে হতো। সেই উদ্বেগ নিয়েই আমাকে সারাদিন কাটাতে হয় কুলি-কামিনদের সঙ্গে। তারা সবাই মারাঠি। সব কথা ওদের বুঝতেও পারি না, তবু ধীরে ধীরে আয়ত্ত করতে থাকি। নিটোল শরীরের মারাঠি মেয়েরাও পুরুষের মতো কাপড় পরে। সিমেন্টের বস্তা তুলে দেয় মাথায়। ওদের উন্নত বক্ষ যুগলের ঠেস লাগে আমার মুখের ওপর। কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলে ওরাই তখন বলে, “থোড়া রুখিয়ে। ব্যাট যাইয়ে।”
একজন তো বলেই দিল একদিন, “চলিয়ে হামারা সাথ, হামারা মুলক-মে। হামারা সাথ জামিনমে কম করোগে।”
না, ওদের সঙ্গে আমি যেতে পারব না,তা ওদের বলতেও পারলাম না। শুধু নিরুত্তর থেকে কষ্ট করে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। প্রায় মাস খানিক পর বাড়ি থেকে একটা চিঠি পেলাম। তাতেই জানতে পারলাম, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান আমাকে না পেয়ে আমার পিতা-মাতাকে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে, উপরন্তু গলা ধাক্কাও দিয়েছে। মাটির বাড়িটি কেউ কেউ ভেঙে ফেলতে চেয়েছে। চালের খড় টেনে আগুন জ্বালাতে চেয়েছে। উঠোনে ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে। দরজার কপাটে লাথি মেরেছে। আমি যদি মুম্বাই থেকে ফিরি তাহলে আমার কপালে আরও অশেষ দুঃখ আছে।
সামনে পরীক্ষা! তাহলে পরীক্ষার কী হবে? আমাকে ফিরতেই হবে। ফিরেছিলামও দু’মাস পর। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে ততদিন নিযুক্ত ছিলাম। বেশ কিছু টাকা রোজগারও করতে পেরেছিলাম। বাড়ি এসে গল্প লেখার পত্রিকার সমস্ত সংখ্যাগুলিই বহু কষ্টে সংগ্রহ করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে দোস স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলাম। সে একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম বটে। পরে আর গল্প লিখতে সাহস পাইনি। উপন্যাস তো দূরস্থ। কিন্তু আমার যে পড়াশোনা হয়নি। কিছুদিন সময় পেলে তা হয়তো করতে পারতাম। কিন্তু একেবারেই সময় ছিল না। তবু পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আতঙ্কে আত্মগোপনে নিভৃতচারী হয়ে।
তখনও রেজাল্ট হয়নি। এমন সময় বীরভূম জেলার উত্তরে চাতরা রেলস্টেশনে একদিন এক ময়লা কাপড় পরিহিতা এক মারাঠি যুবতীকে কাঁদতে দেখলাম। তার চারিপাশে কয়েকজন নারী-পুরুষ ঘিরে বাংলায় তাকে নানা প্রশ্ন করছে, কিন্তু সে কিছুরই উত্তর দিতে পারছে না। শুধু ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে দেখছে সবার মুখের পানে। আমি প্রথম তাকে বললাম:
—Where is your home?
—My home is in the city of Mumbai. —What did you come here to do?
—I have been in the trap of love.
—Then?
—He has taken away my everything and left it in this station. Now I do not have a rupees.
—Will you go with me? I will help you.
তারপর আর কিছুই বলতে হয়নি। মারাঠি শিক্ষিতা মহিলা। একটি কোম্পানিতে ক্লার্কের চাকরিও করত। এ দেশীয় এক সুন্দর ফুটফুটে চেহারার রাজমিস্ত্রির সঙ্গে তার প্রেম জন্মে। রাজমিস্ত্রি নিজেকে অবিবাহিত এবং ধনী পরিবারের সন্তান বলে জানায়। মেয়েটির বাবা বেঁচে নেই, বিধবা মা ও এক ভাই রয়েছে। তা রোজগারের টাকা ও যাবতীয় স্বর্ণালঙ্কারগুলি সে সঙ্গে নিয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়েছে। তবে বরাবরের জন্য নয়। এখানে কিছুদিন থেকে আবার মুম্বাই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘরে এসে দেখে সেই যুবকের আরও দুটি বউ রয়েছে এবং তাদের গণ্ডা দুয়েক ছেলে-মেয়েও। তার সতীনরা যাবতীয় অলংকারপাতি এবং পরনের কাপড়ও কেড়ে নিয়ে তাকে একটি পুরনো ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। অসহায় নিঃস্ব মেয়েটি কিভাবে মুম্বাই ফিরে যাবে তাই সে ভাবছে। সেদিন আমিই তাকে নিয়ে এসে এক বিধবা পিসির কাছে বেশ কয়েকদিন রেখে দিয়েছিলাম। তখন আমরা গ্রামের ছেলেরা সকলে মিলে গ্রামে একটা ‘নবীন সংঘ’ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছি। ক্লাবের প্রধান উপদেষ্টা অজিতকুমার মণ্ডল বললেন, “পুরো গ্রাম ঘুরে চাঁদা তুলে মেয়েটিকে মুম্বাই পাঠাতে হবে। তোমরা আজ থেকেই চাঁদা তুলতে শুরু করো।” তার কথামতো আমরা সেই সময়ও বেশ কিছু টাকা চাঁদা তুলেছিলাম। রামপুরহাট থেকে মুম্বাই পর্যন্ত টিকিট কেটে মেয়েটিকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে তার হাতেও কিছু টাকা দিয়েছিলাম। তারপর সে মুম্বাই গিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটা করে চিঠি লিখত। আর প্রতিটি চিঠিতেই থাকত কৃতজ্ঞতা। বারবার সে যেতে বলেছিল তাদের চাঁদনী চকের বাড়িতে। কিন্তু কোনোদিনই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
ক্লাব করে সেই সময় আমাদের আরও কম ঝক্কি সামলাতে হয়নি। ক্লাবের ক্যাশিয়ার নিজেই এক কুমারী যুবতীর সঙ্গে দীর্ঘদিন সহবাস করে চলেছিল তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। যুবতীটি সমাজের ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপজাতির মেয়ে। কিন্তু কলকাতায় বেশ কিছুদিন কাটানোর পর শরীরী আবেদনে গ্রামের যুবকদের রক্তক্ষরণ ঘটাতে শুরু করেছিল। তার রূপলাবণ্যে মাতাল হয়ে উঠেছিল এই তরুণ ক্লাবের ক্যাশিয়ার। সহবাসের ফলে দুই তিনবার গর্ভপাতও সম্পন্ন করেছিল। তারপর তাকে মারার হুমকি দিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিল। সেই বিচারের ভার যখন ক্লাবে এসে পড়ে, তখন আমরা থানার বড় বাবুর সাহায্য চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম। থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথেই কয়েকজন গুণ্ডাবাহিনীর বোমা বিস্ফোরণে আমরা হতচিত হয়ে পড়ি। প্রাণভয়ে যে যেদিকে পারি ছুটে পালাই। এবারও আমরা গ্রাম ছেড়েছিলাম বেশ কিছুদিনের জন্য। তরুণীটি বিচার পায়নি। থানাও কূল-কিনারা করতে পারেনি। কারণ যার জন্য বিচার তারই অনুপস্থিতির কারণে মামলাটি হিম ঘরে চলে গেছিল। সেই থেকে ক্লাবও প্রায় উঠে যাবার মুখে। আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবে আমাদের অভিভাবকেরা বারবার এসব করতে নিষেধ করেছিল। সুতরাং সবকিছু সহ্য করেই আমরা পিছিয়ে এসেছিলাম। বহুদিন পর একদিন বাসের ভিতরে কোঁকড়া চুলের একটি সন্তান কোলে নিয়ে সেই তরুণীকে দেখতে পেয়েছিলাম।
—এতদিন পর তুই কোথা থেকে আসছিস?
—বেনারস থেকে।
—তোর কোলে এটা কে?
—আমার সন্তান।
—তোর কি বিয়ে হয়েছিল?
—না বিয়ে হয়নি, আমাকে বেশ্যাখানায় বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখান থেকে এক বাবু নিয়ে গেছে। এখন তার কাছেই থাকি।
—তুই কি সুখে নেই?তোর শরীর কেমন রোগা রোগা হয়ে গেছে! প্রথমে তোকে চিনতেই পারিনি!
—খুব ধকল সহ্য করতে হয়েছে। এখনও হয়। বেশ্যাখানায় বছর তিনেক ছিলাম। তারপর এখন এই বাবুর বাঁধা আছি। হয়তো এও একদিন বিক্রি করে দিতে পারে!
—এখন কোথায় যাবি?
—সন্তানটিকে রাখতে যাচ্ছি মল্লারপুরে, মাসির কাছে। কোনোদিন যদি ফিরে আসতে পারি!
—সেদিন তোকে সুবিচার দিতে পারিনি। আমাদেরও হুমকি দিয়েছিল মেরে ফেলার।
—সে তো জানি!আমাকে তো গ্রাম ঢুকতেই নিষেধ। মা-বাবা কেউ নেই। শুধু এক দিদি ছিল। সেও মারা গেছে। বাবার ভিটেটুকু ওরা দখল করে নিয়েছে। কোথা থেকে কী হয়ে গেল জীবনটা! আর কোমর সোজা করতে পারলাম না! কত স্বপ্ন ছিল সব ভেঙে গেল!
—সত্যি রে! তোর জন্য মনটাও খুব খারাপ করে। সেই গুণ্ডারাও বেঁচে নেই। অতিরিক্ত মদ খেতে খেতেই দুনিয়া ছেড়েছে। আর সেই ক্যাশিয়ার গ্রাম ছেড়ে কোথায় নিরুদ্দেশ! আমাদের ক্লাবও আর নেই।
আর কথা বলতে পারলাম না। চোখ দুটো ভিজে গেল। ওর দিকে একবার শেষবারের মতো তাকাবার চেষ্টা করলাম; না, পারলাম না। মাথা নিচু করে নেমে গেলাম রামপুরহাটে। ওকে আরও দুটো স্টপেজ পেরিয়ে যেতে হবে মল্লারপুর।