spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাম্প্রতিকপেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা


কাজী জহিরুল ইসলাম

৬ বছরের শিশুরা, ৭ বছরের শিশুরা, ৮ বছরের শিশুরা পানির বোতল হাতে রাস্তায় নেমে এসেছে। আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার কাছে গিয়ে বলছে, “ভাইয়া পানি লাগবে, আপু পানি লাগবে? মুগ্ধ ভাইয়া পানি পাঠিয়েছে।” এই দৃশ্য দেখার পর কোন পাষণ্ড না কেঁদে পারে? আমি যতবার দেখেছি ততবার কেঁদেছি। যতবার এই দৃশ্যটির কথা ভেবেছি ততবার কেঁদেছি। একটি ৫/৬ বছরের শিশু তার সমস্ত রাগ, ঘৃণা নিয়ে পুলিশের পেটে ঘুষি মারছে, অভিভাবক তাকে সামলাতে পারছে না। কেন তার এতো ক্রোধ? সে যদি নাগাল পেত তাহলে হয়ত পুলিশের মুখেই তার ছোট্ট হাতের মুষ্ঠিটি বসিয়ে দিত।

একটি বেশ নাদুশ-নুদুশ ৯/১০ বছরের শিশু রাস্তায়, বলছে, “আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না৷ আমি মরতে এসেছি।” সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সে বলছে, “আমার ভাইদের ওরা মেরে ফেলেছে, আমার বেঁচে থেকে কী লাভ?” বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক তরুণী বলছে, “এই দেশে বেঁচে থেকে কী লাভ, তাই মরতে এসেছি।” সংলাপগুলো হয়ত হুবহু এইরকম নাও হতে পারে, স্মৃতি থেকে লিখছি, তবে মূল কথাটা এইরকমই।

শিশু-কিশোরদের মধ্যে পুঞ্জিভূত এই ক্ষোভ কি একদিনে, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণেই তৈরি হয়েছে? না, দিনের পর দিন, নির্যাতিত, নিগৃহীত হতে হতে এই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের চাটুকারিতা না করলে, ওদের ফুট-ফরমায়েশ না খাটলে অস্তিত্বই ঠিক থাকে না, এইরকম অভিযোগ করে আসছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা বহুদিন ধরে। একটি স্বাধীন দেশের ছাত্রসমাজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, নিজের মনের কথাটি কোনো এক জুজুর ভয়ে বলতে পারে না। কেউ কেউ সাহস করে বলতে গেলেই তাকে শুনতে হয় ‘রাজাকার’-এর মত এক ঘৃণ্য গালি। এই ঘৃণ্য গালিটি শোনার ভয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকে শিক্ষার্থীরা। শুধু কী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই অবস্থা, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানেই এই চিত্র। যারা আওয়ামী লীগের ধামাধরা তারা দাপটের সঙ্গে চলেন, বুক ফুলিয়ে সরকারী সম্পদ লুটপাট করেন, আর যারা সৎ, সাধারণ চাকুরে তারা মাথা নিচু করে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো স্বাধীন দেশে বসবাস করেন। কোনো সাংবাদিক সত্য কথা লিখতে পারেন না, কখনো কখনো ইনিয়ে বিনিয়ে কোনো মন্ত্রী এমপির দুর্নীতির কথা লিখলে বা বললেও তাকে শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর একগাদা স্তুতি করে তারপর বলতে হয়। এই স্তুতিবাক্যগুলো হচ্ছে সাংবাদিকের নিরাপত্তা শিল্ড। অথচ সকল দুর্নীতির মূল উৎসাহদাতা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি নির্বিঘ্নে দুর্নীতি করতে দিয়েছেন আজিজ-বেনজির সহ বহু মানুষকে।

আজ যে গণঅভ্যুত্থান তৈরি হয়েছে এ-এক মহাসমুদ্র, এখনো কিছু চাটুকার দালাল, “দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেল” “জামাত এসে গেল” ইত্যাদি ন্যারেটিভ দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন। এটি পুরনো খেলা। কিন্তু এই খেলা এতোই তুচ্ছ হয়ে পড়েছে যে এখন এই লোকগুলো বিশাল সমুদ্রের বুকে কয়েক ফোঁটা নর্দমার জল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কয়েক ফোঁটা নর্দমার জল সমুদ্রের শুদ্ধতার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। কিছু সাধারণ মানুষ এতে বিচলিত হয়ে পড়ছেন, তাদের জন্য বলি, আপনারা এক বিশাল জনসমুদ্রের স্রোতের মধ্যে আছেন, দু’চার ফোঁটা নর্দমার জল এই মহাসমুদ্রের ক্ষতি করা তো দূরের কথা, কিছুক্ষণ পরে ওদের আর দেখাই যাবে না। এইসব নিয়ে বিচলিত হবেন না, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যান। আমাদের লক্ষ্য শুধু সরকার পতন নয়, শেখ হাসিনাসহ তার সকল দোসরকে বিচারের আওতায় আনা। বিচার করতে হবে তাদের যারা জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, সীমাহীন লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, যারা গণতন্ত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত।

আমরা সমাজে বসবাস করি, নানান মত ও পথের লোক আমাদের বন্ধু, আত্মীয়। আজকের এই অভ্যুত্থানকে সমর্থন করতে গিয়ে হয়ত সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার কিছু বন্ধুকে ব্লক বা আনফ্রেন্ড করতে হয়েছে। এতে আপনি মোটেও বিচলিত হবেন না। একটি দীর্ঘ কাফেলার যাত্রী আপনি, যে কাফেলার লক্ষ্য বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই দীর্ঘ এবং বন্ধুর যাত্রাপথে আপনার পা থেকে জুতো, স্যান্ডের খসে পড়তে পারে, জামা থেকে বোতাম ছিঁড়ে পড়তে পারে। আপনার কাজ খসে পড়া জুতো, বোতাম খুঁজতে গিয়ে পিছিয়ে পড়া না। সামনে এগিয়ে যান, লক্ষ্যে পৌঁছে গেলে নতুন জুতো, স্যান্ডেল সংগ্রহ করতে পারবেন, জামার বোতাম লাগাতে পারবেন। শুধু বোতামই লাগাতে পারবেন না, নতুন জামাও পেয়ে যাবেন। আজ যাদেরকে হারাচ্ছেন তারা হচ্ছে আপনার পুরনো জুতোর মত। তাদের জন্য মায়া করে লাভ নেই। তারা কেবল আপনাকে পেছনেই টানবে।

রাজপথে এক তরুণী খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলছিলেন, “পেছনে ফেরার উপায় নেই, পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা।” আমরা একটি মহান ভোরের দিকে হেঁটে যাচ্ছি।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩৫ জুলাই ২০২৪।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ