spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যআরশি নিকেতন : ১৪

ধারাবাহিক আত্মজীবনী : তৈমুর খান

আরশি নিকেতন : ১৪

তৈমুর খান

১৪

আমি এখনো বেঁচে আছি

কতই বা আর লিখেছি তখন! দু-একটা ছোটখাটো পত্রিকায় কয়েকটি কবিতা বের হয়েছে। ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’ গল্পটি লিখে বাড়ির সবাইকে অপমানিত হতে হয়েছে। সারা তল্লাট রটেও গেছে। এদিকে আবদুল বাসার খান একটি উপন্যাস লিখেছে ‘রাতের যাত্রী’ নামে। গ্রামের মোড়ল একের পর এক গরিব মেয়েদের শরীর ভোগ করে চলেছে। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি। নিত্যনতুন মেয়ে তার চাই-ই চাই। এই মেয়েখোর লোকটিই উপন্যাসের নায়ক। খুব বাস্তব চিত্র বইটির মধ্যে ফুটে উঠেছে। সেই বইটির ভূমিকা লিখেছি আমি এবং প্রকাশকও আমি। সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি মারাই মোড়লের উদ্দেশ্য। তার জন্যও একটা সালিশি সভা ঠিক করে দেয় সমস্ত উপন্যাসের কপি সংগ্রহ করে গুনে গুনে আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করতে হবে, তবেই রেহাই মিলবে। সেই কাজটিও তৎপরতার সঙ্গে করা হলো। এসব করতে গিয়েই সংবাদটি অনেকদূর ছড়িয়ে গেল। কী এমন গল্প! কী এমন উপন্যাস! সকলেরই কৌতূহল সেসব একবার পড়ে দেখবে। এই যখন অবস্থা, হতাশা, অপমান, ক্লান্তির ঘোর বিপন্নতা যখন কণ্ঠরোধ করতে আসছে, তখনই জয়কৃষ্ণপুরের শিক্ষক মহাশয় নজির আহমেদ রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে নিয়ে একটি জন্মদিন পালনের আয়োজন করেন। সেইখানে কবিতা, গান, আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে অনুষ্ঠান করা হয়। আমাকে সেই অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা জানানো হয় একটি চাইনিজ দামি কলম, একটি ডায়েরি, এক প্যাকেট মিষ্টি এবং একগুচ্ছ ফুল দিয়ে। সেইটি ছিল আমার সাহিত্য জীবনে প্রথম পাওয়া সম্মান। এত চোখ-রাঙানির মধ্যেও কিছুটা ভালোবাসার প্রশ্রয়। সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরেই আরও একটি যে উপহার পেয়েছিলাম সেটিও ছিল জীবনে প্রথম। প্রথম প্রেমের চুম্বন। এই স্বাদ গভীর গভীর। পরবর্তীকালে একটি কবিতায় লিখেছিলাম:
“ও চুম্বন ,
বিশ্বাসের নদী পেরিয়ে
জাগরণের রাত্রি পেরিয়ে
চলে যাচ্ছি দূরে
শিহরনের ফুল ফুটছে
আমার শরীরে

পাপড়িঠোঁটে কী বিস্ময় আলো
স্বপ্নের ভ্রমর এসে
আমার হৃদয়ে গান রেখে গেল
সমস্ত সময় ধরে প্রেমের প্রবাহ
তোমারই স্পর্শে বেজে ওঠে

            সে এক ভাষাহীন অনুভূতি 
                           সে এক ভাষাহীন দাহ!”

কবিতাটির নামও ছিল ‘প্রথম চুম্বন’। মরুভূমির মতো একটি হৃদয়ে এত ঝড় আছে, এত কম্পন আছে, এত স্রোত আছে তা কোনোদিন অনুভব করিনি। কিন্তু সেই দিনের পর থেকেই উপলব্ধি হয়েছিল। সাহিত্য আর প্রেম যে খুবই কাছাকাছি একটি সম্পর্কিত বিষয় তা বলাই বাহুল্য। জীবনকে স্বপ্নের কাছে নিয়ে যায় এই প্রেম। তেমনি সাহিত্য তথা শিল্প-সৃজনের শক্তি যোগায় এই প্রেম। সুতরাং প্রেমই বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। সেই বছরই এসইউসিআই নামে একটি রাজনৈতিক দল বীরভূম জেলা ভিত্তিক কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। স্বরচিত মৌলিক কবিতা লিখে জমা দিতে হবে। একটি সাপ্তাহিক কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারিত হয়। কথামতো ওদের ঠিকানায় একটি কবিতা লিখে জমাও দিই। এক মাসের মধ্যেই চিঠি আসে। বীরভূম জেলায় আমার কবিতাটি দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। এই দ্বিতীয় স্থান লাভ করাটাও আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি ছিল। কেননা একটি অনুষ্ঠানের সভামঞ্চে আমাকে ডেকে একটা সার্টিফিকেট ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ বইটি দেওয়া হয়। সেদিন কী কবিতা লিখেছিলাম তা আজ আর মনে নেই। তবে এক তরুণের পক্ষে তা ছিল যথেষ্ট উৎসাহ ব্যঞ্জক।
‘দেশ’ পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখতে লিখতেও একটা পরিচিতি প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীকালে সেই সব চিঠি পড়ে অনেকে আমাকেও চিঠি লিখতেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন হোস্টেল থেকে ঊর্মি বসুর চিঠি। চিঠির সঙ্গে তার বহু তথ্য এবং বহু অংকন ছবিতে মুগ্ধ না হয়ে পারতাম না। অনেক পরে তার চাকুরি জীবনের শুরুতে কর্মস্থল দুর্গাপুরে তার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎও হয়েছিল। তার সংগ্রামময় জীবনকথা এবং প্রথম দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদে নেমে আসা নিঃসঙ্গতা আমাকে স্পর্শ করেছিল।
ঊর্মির মতোই মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে চিঠি লিখত পিংকু মণ্ডলও। শুধু সাহিত্যের টানেই উপেক্ষা করতে শিখেছিল জীবনের নানা অন্তরায়। কোথাও কোনো কবিতা পাঠ করলে সেই কবিতার রেফারেন্স তুলেই আমাকে তার ভালো-মন্দের কথা জানাত। সেরকমই লিখতে লিখতে একসময় তার অন্তর্জীবনের পীড়ন ও দাহ, আগুন ও বিদ্রোহ সে প্রকাশ করত। সমাজের প্রতি তার অসন্তোষ ফুটে উঠত। কেননা পণ জোগাড় করে তার বাবা তার বিয়ে দিতে পারছিলেন না। বারবার বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেছে তার। সেই ক্ষোভ ও হতাশায় সে বিদ্রোহিনী হয়ে হাত ধরতে চেয়েছিল আমারও। সাহিত্যের মধ্য দিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল।
চাকুরিবিহীন জীবনে যখন নির্মম নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাস সহ্য করে চলেছিলাম, তখন সাহিত্যই ছিল একমাত্র অবলম্বন। জীবনের ফাঁকফোকরগুলি কবিতার শব্দ আর শব্দের ব্যঞ্জনায় ভরাট হচ্ছিল। হতাশার কবিতা লিখতে লিখতে উত্তরণের দিকেই অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিলাম। বারবার ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছিলাম, তবুও ভুলের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছিলাম। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছিল অন্তরাত্মা। কোনো সম্পর্ক, কোনো প্রেমই পরিপূর্ণ পরিণতির দিকে তাই অগ্রসর হতে পারছিল না। আন্দামান থেকে ‘বাকপ্রতিমা’ পত্রিকাটি প্রতি মাসেই প্রকাশিত হতো। খামে ভরে গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা পাঠালে তা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ হতে থাকত। সেই সব কবিতা পড়েই জনৈক এক পাঠিকা গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। চিঠি লিখে যখন সব কথা বলে আর শেষ হচ্ছে না, তখন সে একটা ফোন নাম্বার দেয়। কিন্তু ফোন করব কিভাবে? বরং ওকেই পাশের বাড়ির এক বৌদির ফোন নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বলি। সন্ধেবেলা, দুপুরবেলা অথবা বিকেলবেলায় যখনই সে সময় পেতো প্রায় ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন করত। প্রতিদিনের লেখার খবর, কী করছি বা কী করলাম কী ভবিষ্যৎ সবকিছুতেই আলাপ আলোচনা চলত। এক পর্যায়ে প্রেমের চূড়ান্ত সীমানায় সে পৌঁছে গেল।
—চলে এসো আন্দামানে, এখানেই আমরা ঘর করব।
—কী করে তা সম্ভব? বড্ড এলোমেলো জীবন!
—সব গুছিয়ে নিতে পারব। তোমার যোগ্যতা আছে, চাকরিও পেয়ে যাবে।
—চাকরি পেলে তো ভালোই, সেই আশাতেই দিন গুনছি।
—তাহলে আমিই চলে যাচ্ছি!
—তা কী করে হয়! এত তাড়াতাড়ি?
—তোমাকে ছাড়তে পারছি না, একদিকে তোমার সাহিত্য আমার ভীষণ প্রিয়, অন্যদিকে তোমার এই উদার মনোভাব জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে চিরন্তন মানবতাবাদ আমাকে চরমভাবে আকর্ষণ করেছে।
—আমার এই জীবন যে কত কষ্টের বোঝাতে পারব না। বলতেও পারব না কোথায় আমার যন্ত্রণা।
—তাহলে আগামীকাল আবার কথা বলব।
কত কথা যে বলতে চায়, তার কথারই শেষ হয় না। কিন্তু তারপরে বারবার ফোন করলেও আমি আর কথা বলতে পারি না। চরম এক সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছি। প্রথম প্রেম শাসিত হয়েছে। সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। কিশোরীটিকে বিচ্ছিন্ন ও আড়াল করা হয়েছে। সমাজ নিন্দিত এরকম নিষিদ্ধ প্রেম কখনোই সম্ভব নয় তা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বোঝানো হয়েছে। একটিবার কথা বলতে চেয়েও তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। একটিবার দেখতে চেয়েও তার সঙ্গে দেখার সুযোগ হয়নি। এই বিচ্ছেদ, বিরহ আমাকে যতটা বিষণ্ণ করেছে, ঠিক ততটাই আত্মনির্বাসনে পাঠিয়েছে। সেই সময়ই পরিচয় হয়েছে শেখ একরামুল হক দাদার সঙ্গে। তিনি ‘ভাই’ সম্মোধন করেই গুজরাটের সুরাট থেকে আমাকে চিঠি লেখেন। একটা সুতাকলে চাকরি নিয়ে তাঁর প্রবাসী জীবন। পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন সবাই থাকেন মেদিনীপুরে। তিনি সাহিত্য ভালবাসেন, ভালোবাসেন কবিতা। মেধাবী কোনো তরুণের সৃষ্টিকর্মকে উৎসাহ প্রদান করেন। তাই প্রতিটি চিঠিতেই অঢেল আন্তরিকতা ও মহান স্রষ্টার কাছে আমাকে রক্ষা করার আবেদন জানান। সেই সময়ই মানুষটি আমার কতটা উপকার করেছিলেন জানি না, কিন্তু স্বয়ং আল্লাহর ইচ্ছাতেই তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত রেখেছিলেন। চাক্ষুষ দেখা হয়নি ঠিকই, কিন্তু চিঠির ভাষাতেই বুঝতে পারতাম, তিনি আমার কাছেই আছেন, তিনি আমার হৃদয়ের স্পন্দন শুনছেন, তিনি আমার কান্না মুছিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
ধীরে ধীরে সবাই মুছে গেছিল। আন্দামান থেকে ফোন করে মেয়েটি আমার দূর সম্পর্কের বৌদিকে আহত ফণিনীর মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভিশাপের বাণী শুনিয়েছিল।
পিংকু একদিন আমার খোঁজে কলকাতার দৌড় দপ্তরে এসেছিল কত কিছু বলতে। ঊর্মি মনের দুঃখে সব অর্থ দিয়ে একটি অনাথ আশ্রমে মানব সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিল। আর প্রথম প্রেম নিঃশব্দেই বহুদূর সরে গেছিল। কয়েকজন ছাত্রী আমার কাছে এসে বলেছিল:
“—ওরা বিয়ে করতে চাইলেই আপনি করবেন? আপনি জাত-ধর্ম দেখবেন না? তাছাড়া আপনার আছেই বা কী! বামন হয়ে চাঁদে হাত!”
প্রেম যে জাত-ধর্ম মানে না, হৃদয় বলে যদি কিছু থাকে তবে তা হৃদয়েরই টান। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। কাউকে বোঝাতে যাইনি। নিজেই বুঝেছিলাম, প্রেম কখনো সুখের হতে পারে না, প্রেম কখনো মিলনেরও নয়—প্রেম চিরদিনই দুঃখের, প্রেম চিরদিনই বিরহ-বিচ্ছেদের। শেষ চিঠিতে শেখ একরামুল হক লিখেছিলেন—
“হে আল্লাহ, আমার ভাইকে রক্ষা করুন, তার মনের কষ্ট দূর করে দিন, তার জীবনকে সুন্দর স্বাভাবিক করে তুলুন। আমরা তাকে একজন প্রতিভাধর পরিপূর্ণ কবি হিসেবেই ভবিষ্যতে দেখতে চাই। আমিন।”
আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন কিনা জানি না। কিন্তু আশ্চর্য! আমি এখনো বেঁচে আছি।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on কবিতার স্ফুলিঙ্গ, স্ফুলিঙ্গের কবিতা